অকারণে পুলিশকে গালি দিচ্ছিলাম
মনিরুল ইসলাম
অনেকদিন আগের কথা। আরবের লোকেরা তখন আর গাছের কোটরে বাস করতো না, কিন্তু আমি কলেজ হোষ্টেলে বাস করিতাম। এইচএসসি পরীক্ষায় রেওয়াজ অনুযায়ী আমাদের সরকারী তিতুমীর কলেজে সিট পড়ে। মফস্বলের ছেলে, আমাদের কাছে হোষ্টেল ছিল অনেকটা এতিমখানার মতই, সবই নিজ দায়িত্বে। হোষ্টেলে মাসিক ৩০০ টাকা জমা দিয়ে দুইবেলা খাওযার সুবন্দোবস্ত থাকলেও হোস্টেলে সকালের নাস্তা তৈরি হতো না। ফলে সারা বছরই শম্ভুদার উপর নির্ভর করতে হতো। পরীক্ষার সময়ও শম্ভুদা নীলক্ষেত রেষ্টুরেন্ট থেকে নাস্তা এনে খাওয়াতো। নাস্তা শেষ করে দলে দলে কলেজের সামনে পার্কিং থেকে ৮/১০ জন এক একটি টেম্পু রিজার্ভ করে পরীক্ষা কেন্দ্রের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হতাম। সারা রাস্তায়ই হৈ চৈ করতাম। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর গেইটে এসে দেখতাম টেম্পু দাঁড়িয়ে আছে। ফেরার পথে অকারন চিৎকার চেঁচামেচি বেড়ে যেত। পরীক্ষার ক্লান্তি আর হোষ্টেলেই ফিরলেই ডাইনিং রুমে গরম ভাত আর অমৃতের মত সুস্বাদু এক টুকরা মাছ কিংবা মাংসের ঝোল আর ডালে তো কোন রেশনিং নাই। পঞ্চম কিংবা ষষ্ঠ পরীক্ষা শেষে চার পাঁচটি টেম্পুতে হৈ চৈ করতে করতে ফিরছিলাম। অন্যান্য দিনের মতই অকারনে মহাখালি রেলগেইটের পুলিশের কয়েকজন সদস্যকে ঠোলা ঠোলা বলে গালি দিচ্ছিলাম। পুলিশের সদস্যরা উত্তেজিত না হয়ে হাসছিল। আমাদের এক বন্ধু এতে উত্তেজিত হয়ে হাতের নাগালে থাকা এক পুলিশ সদস্যকে ঘুসি মারে। এবার পুলিশ ও উত্তেজিত হয়, আমরা পালিয়ে আসতে পারলেও পুলিশ ঐ টেম্পুর ছাত্রদের আটক করে। তখনতো আর মোবাইল ছিল না, আমরা কলেজে ফিরে কর্তৃপক্ষকে জানালে তাঁদের মধ্যস্থতায় বন্ধুরা ছাড়া পায়। আমার সন্দেহ কিছু উত্তম মাধ্যম দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু ঐ বন্ধুরা অস্বীকার করায় সেটি রহস্যময়ই থেকে গেছে। ফাইনাল পরীক্ষার আগেও হরতাল অবরোধে (তখন প্রায়ই ৪৮/৭২ ঘন্টা হরতাল হতো) রাস্তায় এসে অকারনেই পুলিশকে আধলা ইট মারতাম আর গালিগালাজ তো ফ্রি। ঠোলাই ছিল বোধহয় ঐসময়কার সবচেয়ে ভদ্রোচিত গালি। পরীক্ষা শেষে অফুরন্ত সময়, হোস্টেলে থাকার সুযোগ নাই। রেজাল্ট বেরোতে দেরী হবে, ঢাকায় থাকার জায়গা নাই, অগত্যা বাড়িতে। খাই, দাই আর মনের সুখে ঘুরে বেড়াই। একদিন শুনলাম পুলিশের সিআই আসবে, প্রবল উত্তেজনা। অবশেষে সিআই সাহেব আসলো, চেয়ারম্যান চাচার বিরুদ্ধে সরকারী গম আত্মসাতের গুরুতর অভিযোগ। আমাদের পুরোনো বাড়িতে তখন সরকারী গম গুদামজাত করা হতো। কাজেই সেই বাড়িতে স্টক চেকিং হ’লো সবার সামনেই। ষ্টক সঠিক, অভিযোগ বিদ্বেষপ্রসূত। বাড়ির উঠানে সিআই (ওসি-ইন্সপেক্টর) সাহেবকে ঘিরে এলাকার গন্যমান্যরা গল্প গুজবে মত্ত। সিআই সাব গল্প করছেন যে প্রতিরাতেই নৌকা ভরে ভরে আত্মসাৎকৃত সরকারী গম সিন্ধির ঘাটে মহাজনের গুদামে যায়। আমার কাছে বিষয়টি গোলমেলে লাগে, আমি বলি যে, যদি জানেনই তা’হলে ধরেন না কেন। প্রশ্নটা সহজ কিন্তু উত্তরটা যা আসে তাতে উপস্থিত সকলে বিচলিত হয়। আমার বাপ-মা তুলে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে ওঠে সিআই সাহেব। কলেজে পরীক্ষা শেষ, এলাকার সকলে খুবই ভদ্র ছেলে বলে জানে। উপস্থিত সবাই ব্যথিত হয়, কিন্তু সিআই সাহেব বলে কথা। তবে আমি প্রতিবাদ করি, সাথে আমার আরেক সহপাঠি আত্মীয়। আমিতো প্রায় গ্রেপ্তারই হয়ে যাই, কিন্তু সকলের বিশেষ অনুরোধে সিআই সাহেব দয়া পরবশ হয়ে আমাকে ছেড়ে দেয়। এখনও সেই দৃশ্য আমার চোখের সামনে ভাসে, বিনা কারনে এতটা অপমান আমার জীবনে কেউ করে নি।
পুলিশে চাকুরীর বিষয়ে বরাবরই আমার মায়ের মত ছিল না। মায়ের কথা ছিল, পুলিশের চাকুরীতে মানুষ খারাপ হয়ে যায়। যাহোক, চাকুরীতে যোগদানের পরে যখন ট্রেনিং এ যাই তখন ও মায়ের কথা ছিল যেন গালিগালাজ না শিখি। ট্রেনিংয়ের ছুটিতে যখন বাড়িতে গেছি, তখন অনেকেই প্রশ্ন করত কি কি গালি শিখায়। পুলিশের ট্রেনিং সিলেবাসে যে ‘আদর্শ গালি শিক্ষা’ নাই, এটা অনেকেই বিশ্বাস করত না। যেকোন চাকুরীতে যোগদানের আগে বোধহয়, ব্যতিক্রম ছাড়া সকলেরই এক ধরনের ‘idealistic attitude’ থাকে। আমারও তা ছিল, কিন্তু প্রশিক্ষণকালে নিয়মকানুনের সঙ্গে আগেকার ধ্যান-ধারনার একটা সংঘর্ষের মধ্য দিয়েই একজন মানুষ ধীরে ধীরে পুলিশে পরিণত হয়। প্রশিক্ষণলদ্ধ জ্ঞান নিয়ে যখন মাঠে কাজ করতে যায় তখন দেখা যায় যে, বইয়ে পড়া আইন-কানুন আর অনগ্রাউন্ড বাস্তবতা আলাদা। আমার ক্ষেত্রেও তেমনটাই ঘটেছে, দেখতে দেখতে চব্বিশ শেষ করে পঁচিশ পূর্ণ করতে যাচ্ছি। গালি শেখা কিংবা গালি দেওয়া কোনটাই আমার হয়ে ওঠেনি, সকলের সাথে মার্জিত ব্যবহারেরই চেষ্টা করেছি। বিভিন্ন ইউনিটে চাকুরীকালীন আমার সহকর্মীদেরও সেভাবে চালানোর চেষ্টা করেছি, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সন্তুষ্ট হতে পারি নি। পুলিশের আচরণে পরিবর্তন আনাটাই ছিল সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং, যেটা সন্তোষজনক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। মানুষকে হয়রানি, অকারন দূর্ব্যবহার, সামান্য কারনে তুই তোকারি কিংবা গালিগালাজ বন্ধ করাটা যথেষ্টই কষ্টকর ছিল। ১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দে Robert Peel যে বলে গিয়েছিলেন, “The police are the public and the public are the police..” এতো বছরেও আমরা তা হতে পারিনি। আমরাই দাবি করি যে ‘পুলিশ জনতার বন্ধু’, কিন্তু বন্ধুত্ব তো একপাক্ষিক নয়, মানুষ পুলিশকে বন্ধু ভাবতে পারেনি। ফলে, চাকুরীতে যোগদানের আগে পুলিশ সম্পর্কে যে perception ছিল তা বলা যায়, অনেকটাই অপূর্ণ ছিল। সন্দেহ নাই যে ২৪/২৫ বছর আগে পুলিশের যে অবস্থা ছিল তার অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে। সরকারী উদ্যোগ, পুলিশ নেতৃত্বের বিরামহীন প্রচেষ্টা, মানুষের সচেতনতাবোধ, মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়ার প্রেসার ইত্যাদি কারনে পুলিশের সকল দায় মওকুফের দিন অনেক আগেই শেষ হলেও প্রকৃত অর্থে পুলিশ জনগনের বন্ধু হয়ে উঠতে পারেনি। চলতি বছরের শুরুর দিকে পুলিশ সপ্তাহের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল, “মুজিব বর্ষের অঙ্গীকার, পুলিশ হবে জনতার।” এই শ্লোগান শুনে অনেকে
টিপ্পনী কেটেছে, পুলিশ কি তা’হলে এতদিন জনতার পুলিশ ছিল না, আর যদি এত বছরে তা না হয়ে থাকে তবে মাত্র এক বছরে কিভাবে জনতার পুলিশ হবে। আমি তো বলি, না, প্রকৃতপক্ষেই পুলিশ জনতার পুলিশ ছিল না। তবে আমার মনে ও সন্দেহ ছিল, মাত্র এক বছরে পুলিশের পরিবর্তন কিভাবে সম্ভব! শতাব্দীর চলমান অভ্যাসগুলো রাতারাতি বদলে ফেলে জনতার পুলিশে পরিণত করার কাজটি অসম্ভব নাহ’লেও নিতান্তই কঠিন।
করোনার এই নিদানকালে দেখতে পাই, পুলিশ কনস্টেবল একা পরিত্যক্ত লাশ ভ্যানে তুলে নিজে ভ্যান চালিয়ে থানায় নিয়ে যাচ্ছে, দেখি, সংজ্ঞাহীন বৃদ্ধার সাহায্যে পথচারী কেউ না এগুলেও পিপিই পরিহিত পুলিশ সদস্য বৃদ্ধার মাথায় পানি ঢালছেন। করোনা সন্দেহে মৃত দেহের সৎকারে কেউ এগিয়ে আসছে না, পুলিশ সদস্যরা কবর খুঁড়ে জানাযা শেষে দাফন করছে। বাড়িওয়ালা কিংবা অন্য ভাড়াটিয়া চিকিৎসাকর্মী কিংবা অন্যকোন ফ্রন্ট লাইনারকে বাড়ি ছাড়ার চাপ দিচ্ছে, সেখানেও পুলিশ। ঘরে খাবার নাই, চক্ষুলজ্জ্বার খাতিরে ত্রান নিতে পারছে না, গোপনে ত্রান পৌঁছে দিচ্ছে পুলিশ। মূলতঃ হাসপাতালের দরজা থেকে কবরস্থান পর্যন্ত-সবখানেই পুলিশ, প্রভু কিংবা শাসক হিসাবে নয়, বন্ধুবেশেই পুলিশ। শতাব্দীর চেনা পুলিশ হঠাৎ করেই লাপাত্তা, কোথা থেকে যেন একদল নতুন পুলিশ। অনেকের কাছেই আবার চেনা চেহারা কিন্তু অচেনা আচরণ, যেন এক অবিশ্বাস্য পরিবর্তন। চাকুরীতে যোগদানকালে মনে মনে পুলিশের যে মূর্তি কল্পনা করেছিলাম, আজ চব্বিশ বছর পরে সেই পুলিশ দেখলাম। এই পুলিশে আমি সন্তুষ্ট, এই পুলিশের একজন হিসাবে আমি এখন গর্ববোধ করি।
জনতার পুলিশ হতে গিয়ে চ্যালেঞ্জ ও কম নিতে হয় নি, ইতোমধ্যে করোনাতে জীবন উৎসর্গ করেছেন আট পুলিশ সদস্য। জীবন-মৃত্যুর মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে আছে একাধিক সহকর্মী, আক্রান্তের সংখ্যা ও আড়াই হাজার ছাড়িয়ে গেছে, প্রতিদিন যোগ হচ্ছে অন্ততঃ তিন ডিজিটের সংখ্যা। জানি, আমাদেরকে আরও মূল্য দিতে হবে, তবুও আপনাদের নিরাপত্তার খাতিরেই আমরা বাইরে থাকবো, প্রয়োজনে আরও মূল্য দিয়েই আপনাদের বন্ধুত্ব অর্জন করবো। চ্যালেঞ্জ আরো আছে, ঐ যে ছেলেবেলায় পড়েছি, “স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন।” করোনা কাল একদিন শেষ হবে, পুলিশের দায়িত্বের ধরণ পাল্টাবে, পুলিশও কি পাল্টে যাবে, ফিরে যাবে পুরোনো চেহারায়? করোনা কালে যে নতুন পুলিশের জন্ম হয়েছে, জনতার পুলিশে পরিণত হয়েছে তা ভবিষ্যতে ধরে রাখাটাই পুলিশ নেতৃত্বের সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। আমি বিশ্বাস করতে চাই, আমি বিশ্বাস করি, জনতার পুলিশ জনতার দিকেই থাকবে, জনগনের সাথে বন্ধুত্বটা আরো পাকাপোক্ত হবে।
পুলিশ তো আজ জনতার কাছে এসে গেছে, জনতা কি এখন পুলিশকে সহযোগিতা করবেন না? আপনারা কি চান না, করোনাতে আর কোন পুলিশ সদস্যের মৃত্যু না হোক, আর কোন স্ত্রী স্বামী বা সন্তান পিতা কিংবা মা সন্তানকে না হারাক? আপনারা কি চান না, পুলিশ আক্রান্তের সংখ্যা শূন্যতে নেমে আসুক? যদি তাই চান, তাহলে পুলিশের কাজ কমিয়ে দিন, অতি প্রয়োজন ছাড়া ঘরেই থাকুন, যে যেখানে আছেন সেখানেই ঈদ করুন। করোনায় বেঁচে থাকলে জীবনে অনেক ঈদ করতে পারবেন, শপিং করতে পারবেন। জানি, আপনারা কষ্ট করেছেন, আর কটা দিন কষ্ট করেন, নতুন সকাল আসবেই। একদিন ঘুম থেকে জেগে শুনবেন, কোন একটা করোনা ভ্যাকসিনের পরীক্ষায় সফলতা এসেছে, করোনার ওষুধ বেরিয়ে গেছে। পৃথিবীর নানা প্রান্তে পরীক্ষা চলছে, সাফল্য সময়ের ব্যাপার মাত্র, করোনা নখ দন্তহীন হয়ে যাবে। কিন্তু, যতদিন তা নয়, ততোদিন-
১. ঘরে থাকা মানেই করোনামুক্ত থাকা, করোনাকে এড়িয়ে যাওয়া;
২. প্রয়োজনে বাইরে গেলে মাস্ক পরুন, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন;
৩. বাইরে গেলেই আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়বেই, সেক্ষেত্রে করোনা মোকাবিলার শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি গ্রহন করুন;
৪. করোনা ভয়ানক সংক্রামক হলেও মরনঘাতী নয়, কাজেই আক্রান্ত হলেও মনোবল না হারিয়ে করোনাকে পরাজিত করুন;
৫. হাঁশি, কাশির শিষ্টাচার মেনে চলুন, আশেপাশের লোককে বাঁচান;
৬. WHO ও স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের পরামর্শ মেনে চলুন;
৭. আপনার সুস্থতা আপনার কাছেই, তাই স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলুন, নিজে বাঁচুন, পরিবার ও প্রতিবেশীকে বাঁচান।
আমি বিশ্বাস করি, সুদিন আর বেশী দূরে নয়, করোনার বিরুদ্ধে মানুষের জয় হবেই।
কেননা,
“বুকের গভীরে আছে প্রত্যয়, আমরা করবো জয় নিশ্চয়!!!
লেখক : ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার