আপডেট : ১৫ জানুয়ারী, ২০২৪ ০৯:২৫
ধারাবাহিক উপন্যাস-চতুর্থ পর্ব
গহীনে নীল
বেলায়েত হোসেন
বেলায়েত হোসেন
এখনো তুফানীর কলেজে ভর্তির টাকা যোগার করতে পারেনি হারাধন। এদিকে ভর্তির সময় প্রায় শেষ। কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে যতসামান্য টাকা পরিশোধে ভর্তি ফরম পূরণপূর্বক কলেজের প্রিন্সিপালের নিকট থেকে কয়েকদিনের সময় চেয়ে নিয়ে আসে হারাধন। শারীরিক অসুস্থতার কারণে নিয়মিত তার কাজে যেতে পারে না। কোথা থেকে টাকা যোগার করবে তাও বুঝতে পারে না। আগের মতো মাছও পায় না, যে কারণে উপার্জন নাই বল্লেই চলে। সবকিছু মিলিয়ে হারাধনের মন খুব খারাপ। খুবই হতাশার মধ্যে দিন কাটে তার। তুফানীকে কিছু বলতেও পারে না। কারণ তুফানী জানতে পারলে নিশ্চিত বলবে-আমি আর লেখাপড়া করবো না। তখন হয়তো হারাধনের সমস্ত স্বপ্ন ভেস্তে যাবে। হারাধন নীরব মনে প্রতিজ্ঞা করে যে করেই হউক তুফানীর কলেজের টাকা যোগার করতে হবেই। নিজ প্রতিশ্রুতির কাছে হেরে যেতে রাজি নয় হারাধন। তাই অসুস্থ শরীর নিয়ে এখন থেকে মাছ ধরার কাজে প্রচুর শ্রম দেয় হারাধন। হলে কী হবে,বিধিবাম। পরিশ্রম অনুযায়ী আগের মতো মাছ ধরা দেয় না তার জালে। উপার্জিত অর্থে প্রতিদিনের দুমুঠো ডাল-ভাতের যোগান দেওয়াই খুব কঠিন। এর মধ্যে কলেজের পাওনা কীভাবে শোধ করবে ভেবে পায় না। চারকূল যখন আশাহত! তখন নিরুপায় হারাধন ভাগ্যবরণের ডালি মাথায় এলাকার মাতব্বর নিরঞ্জন বাবুর শরণাপন্ন হয়।
-আরে হারাধন যে, হঠাৎ কী মনে করে নিরঞ্জন বাবুর দুয়ারে! নিরঞ্জন বাবু এমন ভাবেই জিজ্ঞেস করে হারাধনকে। হারাধন প্রথমে ভয়ে থতমত খেয়ে নমস্কার জানিয়ে বলে
- অয়্যো বদ্দা, ক্যানে হৈয়ুম বুঝিত ন'পারির।
-আরে বলো বলো, কোনো সমস্যা নেই। ততক্ষণে হারাধন মনের ভয় চেপে রেখে আমতা আমতা করে বলে
- হৈলামদে মাইয়াপুয়া ইবা গম গরিয়ারে এস এস সি পাশ গইজ্জে।
-হ্যাঁ ভালোইতো করছে তো কী হয়েছে?
-ইতারে হলেজত ভত্তি গরন পরিবো। ও বাজী ভত্তি গইত্তে বউত ট্যায়া লাই।
-তো আমি কী করবো।
- অ্যাঁত্তে এট্যা ট্যায়া নাই। আগের ডইল্যা হামাই রোজগার নাই। চিন্তা গরি কূল ন'পাইর, ক্যান গরিয়ারে ক্যান গইজ্জুম। কিছু ট্যায় লই হলেজত গেলাম বড় স্যারের হাছে। স্যার অ্যাঁরে ফরম ফিলাপ গরি দিয়ে। হইছেদ্যে বাকী ট্যায়াএগিন সাতদিনের ভিতর পরিশোধ গরিবাল্লাই। অ্যাঁই এতো ট্যায়া হরতুন পাইয়ুম বুঝত ন'পারির। এতাল্লাইবুলি অনর হাছে আইস্যি। বদ্দা অ্যাঁরে এককান উছিলা গরি দন। নইলে অ্যাঁরার তুফানীর হলেজত যওন বন্ধ অই যাইবো। তুফানীর লেহাপড়া বন্ধ অই গেলে অ্যাঁর দেহা খোয়াব বেয়াগ্গিন বরবাদ অই যাইবো। মেরবানি গরি অ্যাঁরে এককান উছিলা গরি দন না বদ্দা!
হারাধনের আকুতি শুনে মাতব্বর নিরঞ্জন বাবু বলে-শোনরে হারাধন। আসলে তোকে এখন দেওয়ার মতো আমার হাতে টাকা নেই। হাতে যা আছে তা দিয়ে সামনে বড় একটা কাজ করতে হবে। তাই তোকে এখন কোনো টাকাকড়ি দিতে পারবো না। আর তোকে এখন টাকা দিলে তুই সময়মত শোধ করতে পারবে না।
-কর্তাবাবু যেনে হারেন ইক্কিনি দয়া গরেন। অ্যাঁই অনের ট্যায়া বেগ্গিন সময়মত শোধ গরি দিয়ুম। অ্যাঁরে নিরাশ ন'গৈরজ্জু বদ্দা। অ্যাঁই বউত বড় আশা লইয়েরে অনের হাছে আইস্যি। এককান বিহিত গরি দন। অ্যাঁরতুন এককান ঘরের ভিড়া ছাড়া হ'নো সম্পদ নাই। দরকার অইলি বাড়িভিড়াডা বন্ধকি লইয়ারে থোয়া ট্যায়া দন। অ্যাঁই সময় গরিয়ারে শোধ গরি ছাড়ায়া নিয়ুম। -আচ্ছা ঠিক আছে, বলাতো যায় না! এক কাজ কর্ একটা ষ্ট্যাম্প কিনে নিয়ে আয়। ষ্ট্যাম্পে টিপ দস্তখত দিয়ে টাকা নিয়ে যা। হারাধন রাজি হয়ে দৌড়ে গিয়ে একটা ষ্ট্যাম্প কিনে আনে। সে লেখাপড়া জানে না। মাতব্বর নিরঞ্জন বাবুর কথামতো খালি ষ্ট্যাম্পে টিপ দস্তখত দিয়ে টাকা নিয়ে তুফানীর কলেজের পাওনা পরিশোধ করে।
তুফানী নিয়মিত পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। এদিকে হারাধনের মনের অবস্থা খুব খারাপ। কারণ রুজিরোজগারও নাই আবার একমাত্র বাড়ি ভিটাও মাতব্বরের কাছে বন্ধক দেওয়া। মাতব্বর নিরঞ্জন বাবু মানুষ হিসাবে খুব একটা ভালো না। কখন কোন্ প্যাঁচে ফেলে বাড়িটা দখলে নিয়ে যায় সেই চিন্তায় হারাধনের চোখে ঘুম নেই। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া নেই। কোনো কাজে তার মনোযোগ নেই। এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়ায়। আস্তে আস্তে সে শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। হারাধনের এ অবস্থা দেখে তুফানীর মনে সন্দেহ দানা বাঁধে। মনে মনে ভাবে কাকা বাবুর কী হয়েছে। কেমন জানি চুপচাপ থাকে। একদিন তুফানী কাকাবাবুকে জিজ্ঞেস করে-কাকা বাবু তোমার কী হয়েছে? এইভাবে চুপচাপ থাকো ক্যান। হারাধন তুফানীর কথাটা এড়িয়ে অন্য প্রসংগে চলে যায়। তুফানীকে জিজ্ঞেস করে-অ মা তোর হড়ালেহা ক্যান চলের। ভালো গরি হড়ালেহা হর। নইলে যে অ্যাঁর স্বপ্ন বেয়াগ্গিন ভাসি যাইবো। তুরতুন বউত বড় মানুষ হন লাইবো। তোরে দেহি মানুষ যেনে হয়, ঐ যে হারাধনের মেয়েইগা যায়।
চলবে...