Main Logo
আপডেট : ১৭ জানুয়ারী, ২০২৪ ১১:১৩

ধারাবাহিক উপন‍্যাস (ষষ্ঠ পর্ব)

গহীনে নীল

বেলায়েত হোসেন

 গহীনে নীল
বেলায়েত হোসেন
তুফানীর চাপের মুখে হারাধন বাধ্য হয়ে বলতে শুরু করে-মন দিয়ারে অ্যাঁর হথা হোন। যে দিনত তুই এই জগতত আইচ্ছিলি, হেইদিনত তোর আইবার কালত বউত বড় ঝড় অইয়ের। ঝড়ের লগে লগে ১০/১৫ ফুড উঁচা অইয়ারে বানের জোয়ার আইস্যিল। সেই জোয়ারে তোর বাপেরে ভাসি লই গিয়েগৈ। তোরে আর তোর মায়েরে এককান কাড'র চৌকিত হোয়াই রাক্কিলো। জোয়ারের পানির স্রোতে ভাসি লই যাইবার টাইমে কাড'র চৌকিডা এককান ঝোপের উয়ারে বাজি গিয়ে। ঝড়বৃষ্টি থামার লগে লগে জোয়ারের পানিও হমি গিয়ে। ঝড়ের গতিতে ঘর বাড়ি গাছ-গাছালি ভাঙি তছনছ অই গিয়ে। জোয়ারের পানির স্রোতে মানুষ গরু-ছাগল ভাসি গিয়েগৈ। যারা বাঁচ্চি গিয়ে হেগিনের লগে অ্যাঁই একজন।
অ্যাঁই গরীব মানুষ দিনত আনি দিনত হাই। অ্যাঁর ঘরত হ'নো কিছু হাওয়নের ন' আছিলো। পানি থামিবার লগে লগে অ্যাঁই মাছ ধরিবার লাই যাইয়ের। যাইবার কালত পথের ধারত দেহিরদে ঝোপের উয়ারে এককান কাড'র চৌবি দেহা যার। চৌবির উয়ারতুন বাচ্চা মানুষের  হাঁন্দার আওয়াজ আইস্যে। হাঁন্দার আওয়াজ গম গরিয়ারে স্পষ্ট ন' অইয়্যে। অ্যাঁই ঠিক গরিয়ারে বুঝিত ন'পারির। হাঁন্দার আওয়াজ হুনিয়ারে অ্যাঁই ভয় পাই গিয়েগৈ। মানুষেরে ডাকি আইন্নি ইবাত দেহিদ্যে, ফটফুইট্টা এককান বাচ্চা আত পা লাড়াই হাঁন্দের। বাচ্চা ইবার লগে এইক্কা মহিলা ইবা তোর মা আছিলো। হ'নো নড়াচড়া নাই ইবা মারা গিয়ে। তোরে দেহি অ্যাঁর খুব মায়া লাইগ্গে। অ্যাঁই তোরে ঘরে আনিয়েরে আদর মায়া গরি পাইল্লি। তুই তুফানের মইধ্য হইচজ্জে ইয়ার লাই বুলি অ্যাঁই তোর নাম রাইক্কিদ্যে তুফানী। অ্যাঁর আপন বলতে হ'নো আত্মীয় স্বজন ন' আছিলো। ওইদিন অ্যাঁই তোরে পাইয়েনে বউত খুশি অইয়্যে।তোর চেহারা দেহি অ্যাঁর মন ভরি গিয়েগৈ। তোরে লইয়েরে বউত বড় স্বপ্ন দিক্কিলাম। তুই বড় মানুষ হইবি। মাইনষে তোরে বউত সুনাম গরিব। অ্যাঁই হুনি হুনি পরানডা ঠাণ্ডা গৈজ্জুম। অ্যাঁই তোরে ইস্কুলে ভর্তি গরাই হড়ালেহা গরাইয়্যে। ইস্কুল পাস দিয়েরে তুই যহন কলেজত আইয়্যে, তহন অ্যাঁর ধারে হ'নো ট্যায়া ন' আছিলো। হ'নো হাজহামে যাইত ন'পারির। শরীরের অবস্থা গম ন' আছিলো। তোরে কলেজত ভর্তি গরন লাইবো। কলেজর ট্যায়া যোগার গরিত ন' পারির। হ'নো উপায় ন' পাইয়্যেরে মাতব্বর নিরঞ্জন বাবুর হাছত যাই। তোর কলেজর স্যার অ্যাঁরে বারবার তাগিদ দিয়ের। কলেজর বাকি ট্যায়া এগিন পরিশোধ গরিবার লাই। ট্যায়া এগিন ন' দিলে তোর ভর্তি বাতিল অই যাইবো গই। তুই হ' মা অ্যাঁরতুন আর কী উপায় আছিলো? অ্যাঁই নিরঞ্জন বাবুর হাছে সবকিছু খুলি কইয়্যেরে কিছু ট্যায়া ধার চাই। নিরঞ্জন বাবু অ্যাঁরে এ্যানে এ্যানে ট্যায়া দিতে রাজি ন' অইয়্যে। নিরঞ্জন বাবু অ্যাঁরে কইয়্যের হারাধন ট্যায়া নিবার লাই এককান ইষ্ট্যাম্প নিয়া আয়। ইষ্ট্যাম্পে টিপ দস্তখত গরি ট্যায়া নিই যা। সময় গরিয়ারে শোধ গরি দিস। জ্বী বদ্দা, অ্যাই সময় মতো ট্যায়া বেগিন শোধ গরি দিয়ুম। অ্যাঁই লেহাহড়া ন' জানি মা। খালি ইষ্ট্যাম্পে টিপ দস্তখত নিই মাতব্বর অ্যাঁরে ট্যায়া দিয়ের। অ্যাঁই ট্যায়া এগিন নিয়েরে তোর কলেজর পাওনা শোধ গরি।
কাকা বাবুর মুখে এসব কথা শুনে তুফানী কাঁদে আর চোখের জল মুছতে মুছতে বলে
- তুমি আমারে আগে কওনাই ক্যান কাকাবাবু! ক্যান লুকাইছো, কও ক্যান লুকাইছো। এখন আমরা কী করবো কই যাবো কাকাবাবু? মাতব্বর নিরঞ্জন বাবু মানুষ ভালো না। তার নজর খারাপ। সেইদিন সে আসছিলো,আমারে বাজে কথা শুনাইছে। কুনজরে চাইয়্যা আছিলো। এখন তার থেইক্কা কীভাবে বাঁচুম কাকাবাবু। মাতব্বর নিরঞ্জন বাবুর কুনজরের কথা জানতে পেরে হারাধনের রক্তচাপ বেড়ে যায়। হারাধনের ভেতরে প্রতিশোধের আগুন জ্বলতে শুরু করে। চেষ্টা করে বিছানা ছেড়ে ওঠে দাঁড়াতে। মাতবর নিরঞ্জন বাবুর সাথে আজ একটা রফাদফা করতেই হবে । যেই বিছানা থেকে ওঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করে হারাধন ঠিক তখনি অত্যধিক উত্তেজিত হওয়ার কারণে হার্টবিট বেড়ে গিয়ে দাঁড়ানো অবস্থা থেকে আস্তে আস্তে ঢলে পড়ে তুফানীর কোলের উপর। তুফানী তখনো বুঝে উঠতে পারে না তার কাকা বাবুর কী হতে চলেছে। কোলের উপর মাথা রেখে জলে ছলছল করা হারাধনের স্বপ্নমাখা নয়ন দুটি তুফানীর চোখেমুখে একবার তাকিয়ে তৃপ্তি ভরে দেখে নেয়। বড় করে একটা নিঃশ্বাস নেওয়ার মাধ্যমে হারাধনের প্রাণপাখিটা পাড়ি জমায় আকাশের ওপারে।
নিমিষেই যেনো স্তব্ধ হয়ে যায় হারাধনের পৃথিবী। কোনো উত্তেজনা নাই দেহে। হার্টবিট থেমে গেছে একেবারে ব্যাটারীবিহীন ঘড়ির কাঁটার মতো নীরব নিথর। হারাধনের এই অবস্থা দেখে তুফানী মাটিতে মাথা ঠুকে ঠুকে কাকাবাবু কাকাবাবু করে ডুকরে কাঁদতে শুরু করে। তার কান্নার আওয়াজে তখন আকাশ বাতাস ভারী হয়ে আসে।
উপরে