Main Logo
আপডেট : ১৮ জানুয়ারী, ২০২৪ ১১:০৭

ধারাবাহিক উপন‍্যাস (সপ্তম পর্ব)

গহীনে নীল

বেলায়েত হোসেন

গহীনে নীল
বেলায়েত হোসেন
তুফানী ততক্ষণে শোকে পাথর। মাঝে মাঝে বিলাপ করে কাঁদে আর ডাকে-কাকাবাবু ও কাকাবাবু,কথা কও চুপ কইরা আছো ক্যান? তুমি চুপ কইরা থাকলে আমি কই যাবো। আমি এখন কী করবো কাকাবাবু। আমাকে এখন কে দেখবে। কাকাবাবু ও কাকাবাবু কথা কও। আমারে একলা রাইখ্যা চইলা গেলা ক্যান। আমারে তোমার সঙ্গে নিয়া গেলা না ক্যান। তুফানীর বিলাপ শুনে পাড়াপড়শিরা দৌড়ে এসে দেখে হারাধনের নিথর দেহটা মাটিতে পড়ে আছে। শোক সইতে না পেরে তুফানী বারবার মূর্ছা যাচ্ছে।
উপস্থিতজনের মধ্যে কেউ কেউ তুফানীর চোখে-মুখে জল ছিটিয়ে তাকে সুস্থ করার চেষ্টা করে এবং শোকে বিহ্বল তুফানীকে সবাই সান্ত্বনা দিতে থাকে। 
হারাধনের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে মাতব্বর নিরঞ্জন বাবু ছুটে আসে তুফানীদের বাড়িতে। হারাধনের মৃতদেহটা দেখে মাতব্বর ভেতরে ভেতরে খুব খুশি। তৃপ্তির ঢেঁকুর চেপে সান্ত্বনার ভান করে তুফানীকে বলে-তুফানী তুই কোনো চিন্তা করিস না। তোর কাকাবাবুর চুক্তি অনুযায়ী আজ থেকে এই বাড়িভিটা আমার। বাড়িটা আমার হলেও তুই এই বাড়িতেই থাকবি। তোর কোনো সমস্যা হবে না। আমি তোর দেখভাল করবো। মাতব্বরের মুখে এসব শুনে প্রতিবেশীরা বলতে লাগলো-তাইলে তো ভালোই হয় কর্তাবাবু। আপনি অনেক দয়ালু। মেয়েটাকে আপনি একটু দেইখ্যেন।
মাতব্বর একচিলতে মুচকি হাসি দিয়ে বলে- আরে, তোমরা কী যে বলো, এলাকার মাতব্বর হিসাবে আমার একটা দায়িত্ব আছে না! তোমরা কোনো চিন্তা করো না। আমি সময় মতো সব ব্যবস্থা করবো। মাতব্বরের কথার মারপ্যাঁচ আর কেউ না বুঝলেও তুফানীর বুঝতে বাকি থাকেনি। কিন্তু তুফানীর কিচ্ছুটি করার নেই।
-এলাকাবাসী তোমরা শোনো, সময় অনেক হয়ে গেছে। চলো সবাই মিলে হারাধনের শেষকৃত্যের ব্যবস্থা করি। সবাই তখন মাতব্বরের কথায় হারাধনের শেষকৃত্যের কাজে হাত লাগায়।
নিয়মানুসারে অশৌচ পালন করা প্রয়োজন। কিন্তু কে করবে অশৌচ পালন? তুফানী ছাড়া হারাধনের সংসারে আপন বলতে আর তো কেউ নেই। তুফানী যদিও হারাধনের সংসারে পালিত মেয়ে। তবু কর্তব্যের তাগিদে তুফানী তেরো দিনের অশৌচ পালনে রত হয়। 
প্রতিবেশীরা তুফানীর বাহ্যিক খোঁজখবর নেয় বটে ভেতরের খবর কেউ রাখে না। তার ভেতরে সারাক্ষণ কষ্টের আগুন দাউদাউ করে জ্বলে। 
একদিকে কাকাবাবুর মৃত্যুর শোক অন্যদিকে মাতব্বরের কুনজর। এই অবস্থায় কী করবে সে বুঝে উঠতে পারে না। কীভাবে মাতব্বরের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করবে এসব চিন্তায় তার চারিদিক অন্ধকার হয়ে আসে। ঘুম নাওয়া- খাওয়া কোনোকিছু নেই তার। তাকে সারাক্ষণ একটি ভয় তাড়িয়ে বেড়ায়,কখন জানি মাতব্বরের পাতা জালে আটকে পড়ে সে। 
অশৌচ পালন শেষে প্রতিবেশীদের সহযোগিতায় হারাধনের শ্রাদ্ধের কাজ সমাপ্ত করে তুফানী। এরই মাঝে কিছুদিন যেতে না যেতেই মাতব্বর নিরঞ্জন বাবু নানান ছলে এটা ওটা নিয়ে হাজির হয় তুফানীর কাছে। তুফানী অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে বিভিন্ন কায়দা কৌশলে মাতব্বরকে এড়িয়ে চলতে থাকে। কিন্তু এ ভাবে আর কতদিন চলতে পারবে তুফানী তা জানে না।
ভোরবেলা পাড়াপড়শির ঘুম না ভাঙতেই মাতবর নিরঞ্জন বাবু এসে হাজির তুফানীর বাড়িতে। অবিরত কড়া নেড়ে যাচ্ছে ঘরের দরজায়। তুফানী ঘরের ভেতর থেকে জানতে চায়-আপনি কে।
 বাইরে থেকে আওয়াজ আসে -আমি নিরঞ্জন।
-আজ্ঞে কর্তাবাবু আপনি এতো সকালে ক্যান আসছেন? -তুফানী দরজা খোল।
- না কর্তাবাবু, দরজা খুলবো না। প্রতিবেশী সবাই ঘুম থেকে আগে উঠুক তার পর আইসেন। কিন্তু নির্লজ্জ মাতব্বর দরজা খোলার জন্য তুফানীকে বারবার তাগাদা দিচ্ছে। তুফানী ততক্ষণে বুঝে ফেলেছে এখন আর কোনো উপায় নাই। দরজা খুলতেই হবে। দরজা খুললেইতো বিপদের সম্মুখীন হতে হবে। তখন কী করবে তাই নিয়ে ভাবছে। ভয়ে তার গা কাঁপছে। প্রচণ্ড শীতের মাঝেও ঘেমে একাকার। মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় নিজেকে রক্ষা করার প্রয়োজনে দরকার হলে মাতব্বরকে ধারালো কিছু দিয়ে আঘাত করবে। এই ভেবে একটি চাকু জামার নীচে লুকিয়ে তারপর দরজা খোলে। মাতব্বর ঘরে ঢুকেই তুফানীকে এটা-সেটা বলতে থাকে। তাকে ভয়ভীতি দেখায়। বিভিন্ন রকম অঙ্গভঙ্গিতে অশোভন আচরণ শুরু করে বলে - তুফানী তুই যদি আমার কথা শুনিস তাহলে এই বাড়ি ছেড়ে তোকে কোথাও যেতে হবে না। তুই এখানেই থাকবি আমি তোর সব দেখাশোনা করবো। এই বলে মাতব্বর তুফানীর দিকে এগিয়ে যায়। তুফানী কোনো কথা না বলে বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। মাতব্বর তার পথরোধ করে সামনে এসে দাঁড়ায়। তুফানী বলে-কর্তাবাবু আপনি এই এলাকার মাতব্বর। আপনার কাছ থেকে এলাকার মানুষ এই ধরনের আচরণ আশা করে না। রাস্তা ছাড়েন কর্তাবাবু। সামনে পা বাড়ায় তুফানী। নির্লজ্জ মাতব্বর তুফানীকে ঝাপটে ধরে। সাথে সাথে যেনো তুফানীর গায়ের রক্ত বিদ্যুতের মতো চমকাতে শুরু করে। আর সহ্য করতে না পেরে ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে কৌশলে সাথে থাকা ধারোলো চাকুটা বের করেই মাতব্বরকে এলোপাতাড়ি আঘাত করে দৌড়ে পালিয়ে যায়।
 
চলবে...
 
 
 
 
 
উপরে