আপডেট : ২৩ জানুয়ারী, ২০২৪ ১০:৪৫
ধারাবাহিক উপন্যাস ( দ্বাদশ পর্ব)
গহীনে নীল
বেলায়েত হোসেন
বাইরে কাকডাকা দুপুরের বিরামহীন রোদের তীব্র তাপ। চারদিকে পিপাসার অনলে কাতর পাখপাখালির দল। সমবয়সী চামেলিকে বন্ধুর আসনে পেয়ে কষ্টের দাবদাহে চৌচির হয়ে যাওয়া তুফানীর হৃদয় আজ সুখরসে প্লাবিত। দীর্ঘ সময়ের একাকিত্বের পথ পেরিয়ে সোহাগি বিরহী চামেলির হৃদয়ও তুফানীর স্পর্শে মুখরিত। আলাপচারিতায় জানাজানি হয় দুজন দুজনকে। চামেলি তার পরিচয়ে জানায়, সে ময়মনসিংহ জেলার গাড়ো পাহাড় পাদদেশের অধিবাসী। অভাব অনটনের কারণে বেশকয়েক বছর আগে তার বাবা মা এখানে চলে আসে। একই এলাকার অনেক লোক বাস করে এখানে। সেই সুবাদেই পার্শ্ববর্তী বস্তিতে তাদের জায়গা হয়। দিনব্যাপী দু'জন দু'জনের সুখদুঃখের নিবিড় আলাপনে দিন কাটে তাদের।
ততক্ষণে পশ্চিম আকাশে হেলে পড়া সূর্যটা লাল আবির ছড়ায়। এক চিলতে রঙিন রোদরশ্মি কোনো এক ফাঁক খুঁজে ঘরে প্রবেশ করে দু'জনকে সন্ধ্যা আগমনীর বার্তা বিলায়।
গগন আলোড়িত করে সারাদিনের ব্যস্ত পাখিরা নীড়ে ফিরতে ব্যাকুল। কিন্তু কুঁজোবুড়ির এখনো ঘরে ফেরা হয়নি। আস্তে আস্তে সন্ধ্যা পেরিয়ে আঁধার নেমে আসে। আড্ডার আসর ছেড়ে চামেলি তখন নিজ বস্তিতে ফিরে যায়। এ অবস্থায় তুফানী আবারও ঘরে একা। চারদিকে কেমন যেনো সুনসান নীরবতা। আঁধার কালো সন্ধ্যার গতর বেয়ে দূর থেকে মাঝেমধ্যে ভেসে আসে দু একটি ঝিঁঝি পোকার ঝিঁঝি শব্দ। ঘরকোণে কুনো ব্যাঙটি তখন কুড়কুড় শব্দে রাতের নির্জনতাকে স্বাগত জানায়। ভয়ে ভয়ে এসে তুফানী কুপির সলতেয় আগুন জ্বালিয়ে কুঁজোবুড়ির আগমন অপেক্ষায় প্রহর গুনে। এরই মাঝে হঠাৎ মাঠের ওপাশ থেকে একটি ক্লান্ত ক্লিষ্ট কণ্ঠের আওয়াজ তুফানীর কর্ণকুহরে জায়গা করে নেয়। ধ্বনিত হয় তুফানী কইরে বইন? ও তুফানী, তুফানী? তুফানী ঠাম্মার কণ্ঠ বুঝে উত্তরে জানায়-ঠাম্মা তুমি আসছো? হ' রে বইন আইছি।
সকালবেলা কুঁজোবুড়ি বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার সময় যা রান্না হয়েছিল,তাই দিয়ে সকালের নাস্তা সেরেছিল। ঘরে রান্না করার আর কিছু ছিলো না বলে সারদিন উনুনে আগুন জ্বলেনি। তবে উনুনে আগুন না জ্বললেও ক্ষুধার আগুনে পুড়েছে তুফানীর উদর। দিনভর এ পাড়া ও পাড়া ঘুরে যা-কিছু যোগাড় করে এনেছে কুঁজোবুড়ি তা নিয়ে দ্রুত রান্না চড়ায় তুফানী। বয়সের ভারে ন্যুব্জ এই দেহটি নিয়ে কাঠফাটা রোদ মাথায় দুমুঠো অন্ন জোগাড়ে পাড়ায় পাড়ায় দৌড়ঝাঁপ এ যেনো নিঃশ্বাস নেওয়ারও সময় ছিলো না তার। রান্না শেষে খেয়ে দেয়ে বিছানায় যেতেই সারাদিনের পরিশ্রমী দেহটি বিছানা পেয়ে এক মহা প্রশান্তিময় ঘুমের জগতে হারিয়ে যায় কুঁজোবুড়ি। নাক ডাকার প্রতিটা নিঃশ্বাস জানান দিয়ে যায় ব্যস্তদিনের পরিশ্রমের কথা।
ক্রমশই রাতের গভীরতা বাড়ছে। তুফানীর চোখ জুড়ে ঘুমের ছিটেফোটাও নেই। শুধুই এ পাশ ও পাশ করছে। নিস্তব্ধ রাতের গভীরতার পাড় ছুঁয়ে চোখের পাতায় ভর করে মাতব্বর নিরঞ্জন বাবুর সাথে ঘটে যাওয়া সেদিনকার নারকীয় ঘটনার বিভৎসতার দৃশ্য। মুহুর্তের জন্যও মন থেকে সেসব ভুলতে পারে না তুফানী।
ভাবতেই যেনো গা শিউরে ওঠে তার। কাকাবাবুর কথা মনে হলে চোখজোড়া জলে টইটুম্বুর হয়ে যায়। এদিকে আশ্রিত ঠাম্মার কষ্টের জীবন তুফানীকে আরো ভাবিয়ে তুলে। রাত বাড়ার সাথে সাথে ভাবনার আঙুলগুলো অবিরাম গলা টিপে চলছে তুফানীর।
আশপাশের প্রতিবেশীসহ সবাই গভীর ঘুমে বিভোর। একমাত্র তুফানী ছাড়া কেউ জেগে নেই। বাইরে শিশিরে ভেজা পাতা চুঁইয়ে নিঃসৃত ফোঁটার টপটপ শব্দ। ঘরের উপরে হেলে থাকা বটগাছের ডালে হুতোম প্যাঁচাটির পালক ভিজে জবুথবু। হঠাৎ গা ঝাড়া দিয়ে হুতোম হুতোম করে বেরসিক শব্দে নড়েচড়ে বসে। চোখের পাতায় ভীড় জমানো বিভৎস স্মৃতিগুলো নিয়ে আর ভাবতে চায় না তুফানী। এগুলো এখনই ঝেড়ে ফেলতে চায় সে। এভাবে আর পালিয়ে বেড়ানো নয়। সাহসিকতার সঙ্গে মোকাবেলা করবে সকল কিছু। কিছুতেই আর পিছু হটবে না। অন্যের উপর নির্ভর হয়ে বেঁচে থাকতে চায় না তুফানী। অবশ্যই নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে তার। রাতের গভীরতা যতোই বাড়ছে ততই যেনো তুফানীর মনের প্রত্যয়ের দৃঢ়তা বেড়ে চলছে। এখন থেকে ঠাম্মাকে আর কাজে যেতে দেওয়া যাবে না। জীবন নামক যুদ্ধের মাঠে আলবৎ লড়ে যাবে সে। চামেলির সাথে কথা হয়েছে তুফনীর। সে ঝিনুক থেকে মুক্তা কুড়ায়ে বিক্রিত অর্থে তাদের সংসার চালায়। তাকেও চামেলির সাথে যেতে বলেছে। বিষয়টি মন্দ নয়। অন্তত পরনির্ভরশীলতার অভিশাপ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে। এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমের জোয়ারে তরীটা ভেসে যায় তুফানী তা টের পায় না।
চলবে...