Main Logo
আপডেট : ২৪ জানুয়ারী, ২০২৪ ০৯:৫৯

ধারাবাহিক উপন‍্যাস (ত্রয়োদশ পর্ব)

গহীনে নীল

বেলায়েত হোসেন

গহীনে নীল
বেলায়েত হোসেন
প্রভাত পেরিয়ে সবুজের বুকে আলোর বিকিরণ। চারদিকে ঝলমলে নির্মল আকাশ। মাঠে মাঠে গুল্মের ডগায় বিন্দু বিন্দু শিশিরের কণা ,যেনো সোনালী প্রভায় প্রাণ খুলে হাসছে। মুহুর্তের অপরূপে তুফানীর হৃদয় বাগে উঁকি দেয় স্বপ্নের কুঁড়ি। একটু পরেই চামেলি চলে আসবে তুফানীকে নিতে। আজ তার জীবনযুদ্ধে প্রথম যাত্রা। তাই ফুরফুরে মেজাজে ঝটপট তৈরি হয়ে নেয় সে। এদিকে ঠাম্মাকে ডেকে বলে: আজ থেকে তুমি আর কাজে যাইবা না। এখন থেকে সব দায়িত্ব আমার। 
তুফানীর এমন দুঃসাহসিক প্রত্যয় দেখে কুঁজোবুড়ির ভেতরের শুকিয়ে যাওয়া নদীতে যেনো আজ আশার জল বইতে শুরু করে। নয়ন পাড়ে নোঙর ফেলে স্বপ্ন তরী। 
তুফানীর চোখেমুখের দৃঢ়তায় কুঁজোবুড়ি খুবই আশাবাদী। মাথায় আশীর্বাদের হাত রেখে অনর্গল উপদেশ দিয়ে যায় তুফানীকে। মেয়ে মানুষের জন্য বাস্তবতা বড়োই কঠিন। মাথার উপর সব সময় শকুনের নজর। পথেঘাটে নানানরকম বিপত্তি। হিংস্র হায়নার থাবা। সকল ধরনের প্রতিকূল অবস্থা থেকে নিজেকে নিরাপদ রাখার মানসিক মনোবল অটুট রেখে সমুখে এগিয়ে যেতে হবে। এসব কথোপকথনের মধ্যেই চলে আসে চামেলি। তুফানীসহ দুজনে ঠাম্মার চরণধুলি মাথায় নিয়ে কাজে বেরিয়ে যায়।
শুরু হয় তুফানীর জীবনযুদ্ধের পথচলা। এই যুদ্ধে তাকে অবশ্যই জয়ী হতে হবে। পেছনে ফিরে তাকানোর সুযোগ নেই। ফেলে আসা দিনগুলোর দরিদ্রতার নির্মম কষাঘাত। আর সেই সুযোগে মাতবর নিরঞ্জন বাবুর কূটকৌশলী কায়দায় কাকাবাবুর একমাত্র বাড়িভিটে বেদখল। এসব বিমর্ষ স্মৃতি যখন চোখের কোণে ভেসে ওঠে, তখন প্রতিশোধের আগুনে তুফানীর ভেতরটা জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যায়। 
যে করেই হোক মাতবর নিরঞ্জন বাবুর হাত থেকে কাকাবাবুর বাড়িভিটে ফিরিয়ে আনতে হবে। লম্পট মাতব্বরের নির্লজ্জ বেহায়াপনার সমুচিত জবাব দিতে হবে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে এসব ভাবনা প্রেরণার মশাল হাতে তুফানীর হৃদয়ে চেতনার উদ্ভব ঘটায়। বাড়িয়ে দেয় কর্মস্পৃহা। হৃদয়ের বাগে বাগে জাগ্রত হয় অসংখ্য আশার কলি। জীবনে বয়ে যাওয়া ঝড়ে,তচনচ হওয়া স্বপ্নের পাপড়িগুলো আবারও গা ঝাড়া দিয়ে দাঁড়াতে শেখায়। কঠোর পরিশ্রমের মধ্যদিয়ে পার হয় প্রথমদিনের উপার্জেয় অধ্যায়। অর্জিত অংকে দিনশেষের খাতায় মিলিয়ে যায় ক্লান্তির হিসাব। হৃদয় রাঙে গোধুলির রঙে। দিনশেষে পরিশ্রান্ত দেহে সাঁঝবেলার নীড় খোঁজা পাখিদের পথ ধরে ঘরে ফিরে তুফানী।
এভাবেই চলতে থাকে তুফানীর প্রতিদিনের জীবনযুদ্ধ। যুদ্ধের এই নদীপথে অজানায় ভাসমান নোঙরবিহীন তরীটা অবশেষে কোথায় গিয়ে ভিড়বে ঠিকানা জানা নেই তার। বাস্তবতা যে বড়োই কঠিন। দেহে তার সবেমাত্র যৌবনের ফুল ফোটেছে। পুরুষশাসিত সমাজে অতীতেও যেমন মেয়েদের পথচলা অমসৃণ ছিলো- আজও ঠিক তাই। পথে পথে বিপত্তির যেনো শেষ নেই। এ পথে পা বাড়াতে গিয়ে নানাভাবে হোচট খাচ্ছে সে। চলতি পথে একদল শকুন সর্বদা তাড়িয়ে বেড়ায় তার আলোকোজ্জ্বল যৈবতী দেহটাকে ঠুকরে খাওয়ার জন্য। তুফানী অনেক চতুর এবং বুদ্ধিমতী মেয়ে। তার বুদ্ধির জোর খাটিয়ে নানাভাবে মাথার উপর উড়ন্ত শকুনদের থাবা থেকে নিজেকে রক্ষা করে পথচলে সে। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? একদিকে যেমন হিংস্র শকুনের থাবা,অন্যদিকে যৌবনের উত্তাপ। দুইয়ে মিলে সর্বদা তার মাথার ভেতরটা কুড়ে কুড়ে খায়। ভাবনার কবলে পড়ে দিনকে দিন সে কাজেকামে আনমনা হতে থাকে। যে কারণে এখন আর আগের মতো ঠিকঠাক কাজে মন বসে না তার। ভাবে, এই মুহুর্তে একটি শক্ত হাতের খুব প্রয়োজন। যে হাত সর্বদা আগলে রাখবে তাকে। যে হাতের পেশীতে ভর করে সকল বিপত্তির পাহাড় ডিঙাবে সে। যে হাতের বাহুতে আবদ্ধ হয়ে স্বপ্নের ঠিকানা খুঁজে নিবে। ভাবনার বোঝাটা কেবলই ভারী হয় তার। এই অবস্থায় একদা পরন্ত বিকেলে সৈকত সীমানায় ভাবনার ঝোলা কাঁধে আনমনে হাঁটছিল তুফানী। দিনভর আলো বিকিরণে ব্যস্ত সূর্যটা দিনশেষে রঙ বদলিয়ে নরম লালিমায় যখন পশ্চিম আকাশে তখনই, হঠাৎ পেছন থেকে কেউ একজন বলে ওঠে : এই যে শুনছেন? তুফানী ডান-বামে তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে পেছনে তাকায়। নজরে আসে সুঠামদেহের অধিকারী সুদর্শন হাস্যোজ্জ্বল একটি মুখ। তুফানী একটু ইতস্ততবোধ করে জিজ্ঞেস করে: আমাকে বলছেন? 
: হ্যাঁ, এখানে আপনাকে ছাড়া অন্য কাউকেতো দেখছি না?
 
চলবে...
উপরে