Main Logo
আপডেট : ২৭ জানুয়ারী, ২০২৪ ০৯:৫৭

ধারাবাহিক উপন‍্যাস (ষোড়শ পর্ব)

গহীনে নীল

বেলায়েত হোসেন

গহীনে নীল
বেলায়েত হোসেন
হঠাৎ সুমনের চারদিকের আকাশটা যেনো স্তব্ধ হয়ে আসে। আস্তে আস্তে হাত পায়ের শক্তি হারিয়ে ফেলে সুমন। গলা শুকিয়ে একফোঁটা জলের তেষ্টায় শ্বাসনালিতে তখন শুষ্ক ঝড়ের মাতম বইতে থাকে। বুকের বামপাশের দমের যন্ত্রটা বেপরোয়া হয়ে ওঠানামা করতে শুরু করে। পূর্ব দিগন্তের সূর্যটা তাপের মাত্রা বাড়িয়ে জানান দিয়ে যায় ঘড়ির কাঁটায় দশটা বেজে গেছে। তুফানীর দোকানে টানানো দেয়াল ঘড়িটা তখন সময় সংকেতের ক্রিং ক্রিং বেরসিক শব্দে বেজে ওঠে। বেজে ওঠা শব্দে সুমনের স্তব্ধতার রেশ কেটে যায়। বুকের উপর থেকে তুফানীর মাথাটা আলতো করে চোখে চোখ রাখতেই তুফানী লজ্জায় লাল হয়ে যায়। তুফানীর লাল গোলাপি ঠোঁট দুটি নিমিষেই কেঁপে ওঠে। ঠোঁটের উপরিভাগে জমতে শুরু করে বিন্দু বিন্দু ঘামের কণা। মনে হয় একেকটা ঘামের কণা রূপালী আভার মুক্তোদানা। সারিবাঁধা প্রতিটা ঘামের স্বচ্ছ কণার গভীরে ভেসে ওঠে সুমনের মুখচ্ছবি। তৃষ্ণার্ত আঁখিদ্বয় পলক হারায় তুফানীর শান্ত নিপুন চাহনির নীলাভে। পলকহীন চাহনির ভাষা জানতে চায় তুফানী। : কী দেখছেন এমন করে! সুমন সংকোচ এড়িয়ে নির্দ্ধিধায় বলে: দেখছি স্রষ্টার কারুচিত্র। তুফানী লজ্জায় আবারও মাথা গুঁজে সুমনের বুকে। বুকের ভেতরে তখন ধুকপুক শব্দ। তুফানীকে বুকের আরো কাছে জড়িয়ে নেয় সুমন। মগ্নতার কোলে আত্মসমর্পণ করে তুফানী। যেখানে ধ্বনিত হচ্ছে বারবার তার নিজ নামের উচ্চারণ। বেলা বাড়ার সাথে সাথে বীচের পাড়ে ক্রমশই লোকের সমাগম বাড়তে থাকে। 
এদিকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় মাটিতে পড়ে থাকা লোকটিকে দেখে অনেকেই কৌতূহলী হয়ে তার চারপাশে এসে ভীড় জমায়। লোকসমাগমের শব্দে আর রোদের খড়তাপে একটু একটু করে চেতন ফিরতে শুরু করে তার দেহে। এ অবস্থায় কেউ একজন চোখেমুখে জল ছিটাতে শুরু করে। আস্তে আস্তে সে চোখ মেলে তাকায়। কিছুক্ষণের মধ্যে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে লোকটি। জড়ো হওয়া লোকের ভীড় থেকে আগ্রহভরা কণ্ঠে অনেকেই জানতে চায় হঠাৎ করে সংগা হারালেন কেন! আগে পরেও এমন হয়েছিলো? লোকটি কোনো কথা বলে না। এদিক-সেদিক তাকিয়ে সুমন আর তুফানীকে আবারও সামনে দেখতে পেয়ে সে ভয়ে ঘাবড়ে যায় এবং মাথা নত অবস্থায় চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। মনে মনে ভাবে, যদি এই মুহুর্তে উপস্থিত জনতা তার কর্মযজ্ঞের কথা গুনাক্ষরেও জানতে পারে তাহলে আর রক্ষা নেই। ঘটে যাওয়া অন্যায়ের দায়ে এখান থেকে সে প্রাণ নিয়ে ফিরে যেতে পারবে না। ক্ষণিকের নীরবতা ভেঙে মুহুর্তের মাঝে লোকটির উদ্যেশ্যে সুমনের ঝাঁঝালো কণ্ঠে ধ্বনিত হয়, ফের যদি তোকে বীচের আশেপাশে দেখছি বা তুফানীর পিছু লেগেছিস, তাহলে তোকে প্রাণে মেরে সাগর জলে ভাসিয়ে দেবো। লোকটি কোনো কথা না বাড়িয়ে তড়িঘড়ি করে এলাকা ত্যাগ করে।
 
উপস্থিত জনতার ভীড় ছেড়ে তুফানী ও সুমন গিয়ে দোকানে বসে। এ সময়ের আলাপচারিতায় লোকটির সাথে ঘটিত বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেয় সুমন। এর মধ্যে ক্রমাগতভাবে দোকানে খরিদ্দারের চাপ বাড়তে থাকলে তুফানী ব্যস্ত হয়ে পড়ে বেচা-কেনার কাজে। সুমনেরও অফিস টাইম পার হতে থাকলে দ্রুত হোটেলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে সে তার কাজে চলে যায়।
ঢাকার একটি অভিজাত কোম্পানিতে চাকরি করে সুমন। কোম্পানির কাজে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয় তাকে। সেই সুবাদে ইতোপূর্বে একবার কক্সবাজারে এসেছিল সুমন। কাজের শেষদিনের অবসরে সৈকত বীচে ঘুরতে এসে গোধুলির এক লগ্নে কাকতালীয়ভাবে দেখা হয়েছিল তুফানীর সাথে। প্রথম দেখাতেই দু'জন দু'জনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলো । আগ্রহের সাথে একে অপরের পরিচয় জানতে চায়। কথোপকথনে তুফানীর পরিচয় জেনে নিলেও সুমন তার নাম পরিচয় গোপন রাখে। সেই অনুযোগে তুফানীর মনে গভীর অভিমানের সঞ্চার ঘটে। সেই মুহুর্তে আর কোনো কথা না বলে সোজা তার বস্তির পথে পা বাড়ায় তুফানী। সন্ধ্যা লগনের গণ্ডি পেরিয়ে তখন সুমনের চারপাশে ধীরে ধীরে নেমে আসে নিকষকালো অন্ধকার। স্তব্ধ আঁধারে মুহুর্তেই মিলিয়ে যায় তুফানীর হেঁটে যাওয়া পথের সীমানা। নীরব নিষ্পলক চেয়ে থাকা ছাড়া সুমনের আর কোনো পথ ছিলো না। তুফানীর কাছে সেদিন পরিচয় গোপন রেখে যে অপরাধ করেছিলো সুমন, সেই অপরাধের বিষাক্ত ছোবলে ভেতরে ভেতরে দংশিত হতো সারাক্ষণ। 
কোম্পানির কাজে এবারও কিছুদিনের জন্য কক্সবাজারে এসেছে সুমন। কিন্তু বিধির কী নিপুণ খেলা। এসেই এভাবে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার মাঝে তুফানীকে ফিরে পাবে তা ছিলো কল্পনার অতীত। 
এ জেলার অংশবিশেষ গভীর সমুদ্রের একটি দ্বীপে তার জন্ম। তবে সেখানে এখন আর সুমনের আপন বলতে কেউই বেঁচে নেই, এমন কী তার পুরো গ্রামের চিহ্নটা পর্যন্ত নেই। স্মরণকালের এক প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে তার সব হারিয়েছে। জলোচ্ছ্বাসের লীলাময়ী তাণ্ডবে জীবন মরণ সন্ধিক্ষণে সমুদ্রের প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার গভীরে অবস্থিত একটি দ্বীপ থেকে সেদিনের জলোচ্ছ্বাসের ঢেউয়ে ভেসে এসে বীচের বালুচরে আটকা পড়েছিলো । বালির মধ্যে অর্ধ ডুবন্ত অবস্থায় তাকে পাওয়া যায়। অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া সুমনকে উদ্ধারকারী দলের সহয়তায় বীচের বালুচর থেকে তুলে এনে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তোলা হয়। জ্ঞান ফেরার পর তার কাছ থেকে জানতে পারা যায়, প্রথমে প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড় শুরু হলে সাথে হানা দেয় জলোচ্ছ্বাস। ঘূর্ণিঝড়ে তচনচ হওয়া বাড়িঘর,সঙ্গে গবাদিপশু মানুষসহ সবকিছু জোয়ারের স্রোতে ভাসছিলো। চারদিকে শুধু বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার আর চিৎকার। ঐ মুহুর্তে জোয়ারের স্রোতে কখন যে সুমন ভাসছে তা তার বোধগম্য নয়। শুধু এতটুকুই মনে করতে পারে সে পাহাড় সমান ঢেউয়ের মাঝে ভাসছে আর ডুবছে । লবণাক্ত পানির অসহনীয় জ্বলোনিতে চোখমুখ খুলতে পারছিলো না। এ অবস্থায় হাতের নাগালে শক্ত একটা কিছু অনুমান হচ্ছিলো তখন সেটাকেই চেপে ধরে । 
 
চলবে...
উপরে