আপডেট : ৩১ জানুয়ারী, ২০২৪ ০৯:২০
ধারাবাহিক উপন্যাস ( বিংশ পর্ব)
গহীনে নীল
বেলায়েত হোসেন
সুমন-তুফানীর দিনকাল ভালোই কাটছে। প্রতিদিনের কাজের অবসরে দু'জন মিলে সৈকতে হাত ধরাধরি করে নিরিবিলি হেঁটে বেড়ায়। মাঝেমধ্যে একসাথে কফির আড্ডায় সময় কাটায়। তখন সুখ দুঃখের জানাবুঝায় হৃদয়ঙ্গমের খুব কাছাকাছি এসে সমান্তরালে স্থির হয় উড়ুউড়ু দুটি মন। একে অপরের অপূরক ভাবে, দু'জনই। তাই আরো কাছে আসতে স্বপ্ন দেখে ঘর বাঁধবার।
প্রতিদিনের ন্যায় সুমন সেদিনও অফিসের কাজ শেষ করে হোটেলে ফেরত আসে। কক্ষে ঢুকার মুহুর্তে হোটেল ম্যানেজার রিসিপশন থেকে একটি টেলিগ্রাম বার্তা সুমনের হাতে তুলে দেয়। বার্তাটি এসেছে সুমনের কোম্পানি থেকে। তাকে অবশ্যই রাতের মধ্যে ঢাকায় ফিরতে হবে। বার্তাটি হাতে পেয়ে সুমন ছুটে যায় তুফানীর দোকানে। তুফানী ততক্ষণে দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরে গেছে।
তখনকার সময়টাতে মোবাইলের প্রচলন নাই বললেই চলে। সংবাদ আদান-প্রদান টেলিগ্রাম বা চিঠিপত্র ছাড়া তেমন কোনো ভালো ব্যবস্থা ছিলো না। সুমন তৎক্ষণাৎ একটি চিরকুট লিখে তুফানীর দোকানের সাটারের ফাঁক দিয়ে ভেতরে ফেলে রেখে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। সুমনের খুবই মন খারাপ। যাচ্ছে আর ভাবছে, এবার নির্ঘাত তুফানী আমাকে প্রচণ্ড ভুল বুঝবে। কিন্তু আমার যে আর কিছু করার ছিলো না! রাতের আঁধার কেটে আকাশটা আস্তে আস্তে ফর্সা হতে চলছে। সুমনকে বহন করা গাড়িটা তখন ঢাকার ভেতরে প্রবেশ করছে। কর্মব্যস্ত মানুষগুলোর দৌড়ঝাঁপে ঢাকার অলিগলি ক্রমাগত সরব হচ্ছে। সুমন বাস থেকে নেমে সরাসরি কোম্পানির অফিসে গিয়ে হাজির।
এদিকে তুফানী প্রতিদিনের রুটিনমাফিক দোকানের পথে পা বাড়ায়। হাঁটে আর ভাবে আজকে একবেলা দোকানের কাজ শেষ করে সুমনকে নিয়ে দূরে কোনো নির্জন এলাকায় বেড়াতে যাবে। ফেরার পথে সন্ধ্যাকালীন শো তে সিনেমা দেখে রাতের ডিনার সেরে বাড়ি ফিরবে।
মনে মনে এসব স্বপ্নের ফর্দ সাজিয়ে উৎফুল্ল মনে গিয়ে দোকানের সাটার খোলে। ভেতরে প্রবেশ করতেই মাটিতে পড়ে থাকা একখণ্ড ভাঁজ করা কাগজের টুকরা তুফানীর নজর কাড়ে। কৌতূহলবশে কাগজের টুকরোটা হাতে নেয়। ভাঁজ খুলে তাতে দৃষ্টিপাত করতেই তার চোখদুটি জলে ছলছল করে ওঠে। বুকের ভেতরে শুরু হয় বাঁধভাঙা ঢেউ। একেকটা ঢেউয়ের আঘাতে যেনো তুফানীর হৃদয়ের পাড় ভেঙে তচনচ হতে থাকে। তুফানী তখন একেবারেই পাথরের ন্যয় নির্বাক নিস্তব্ধ হয়ে যায়। এ অবস্থা দেখে দোকানের কর্মচারীগণ জিজ্ঞেস করে: কী হয়েছে আপা কোনো সমস্যা? তুফানী প্রত্যুত্তরে শুধু জানায়: কিছু না।
সুমন অফিসে হাজির হয়ে দেখে তার নামে বিমানের টিকিট কাটা হয়ে গেছে। মার্কেটিং কাজে কোম্পানির টিমের সাথে বেশকিছু দিনের জন্য দেশের বাইরে সফরে যেতে হবে। এ কথা শুনে সুমনের যেনো আকাশ ভেঙে মাথায় পড়ে। তখন কী করবে সে কিছুই বুঝে ওঠতে পারে না। চাকরি রক্ষা করতে হলে অবশ্যই তাকে অফিসিয়াল অর্ডার ক্যারি করতে হবে। তা না হলে চাকরির মায়া ত্যাগ করতে হবে। কোন্ পথ বেছে নেবে সে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতে থাকে সুমন। আবার এটাও ভাবে, সফর শেষ হলে ফিরে এসে তুফানীর সাথে দেখাতো অবশ্যই হবে। তখন তাকে সবকিছু খুলে বলবো। তবে এই মুহূর্তে চাকরিটা ছাড়া যাবে না।কারণ চাররি যোগাড় করা অনেক কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এসব ভেবে চাকরিটা ঠিক রাখার পক্ষে সীমাবদ্ধ থেকে অসম্ভব মন খারাপের মধ্য দিয়ে দেশের আকাশসীমা ত্যাগ করে সুমন।
এদিকে তুফানী সুমনকে নিয়ে মনে মনে যে স্বপ্নের আকাশ এঁকেছিল, সেই আকাশ জুড়ে আজ তুমুল ঝড়ের আয়োজন। চারদিক ছেয়ে গেছে ঘন-কালো মেঘে। কথার ঝুড়িটাও যেনো হারিয়ে গেছে তার। মুখে কোনো কথা নেই হাসি নেই, সারাদিন চুপচাপ সময় পাড় করে। দোকানের কাজেও তেমন মনোযোগ নেই। তুফানীর এ অবস্থা দেখে কুঁজোবুড়িও শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। চিকিৎসায় তার কোনো উন্নতি ঘটে না। অবশেষে দিন কয়েকের মধ্যে কুঁজোবুড়ি ওপারের ডাকে সারা দিয়ে চিরদিনের জন্য পাড়ি জমায় পরপারে। তার শেষ ভরসা ছিলো ঠাম্মারুপি কুঁজোবুড়ি। অবশেষে তাকেও হারিয়ে তুফানী একেবারে স্বজন হারা নিঃস্ব।
চলবে...