আপডেট : ১ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪ ১০:৩১
ধারাবাহিক উপন্যাস (একবিংশ পর্ব)
গহীনে নীল
বেলায়েত হোসেন
সবাইকে হারিয়ে তুফানী একেবারেই শোকে পাথর। কাঁদতে কাঁদতে এখন আর তার চোখে জলও আসে না। নানামুখী ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়া তুফানীর জীবনটা এক অনিশ্চিতের দুয়ারে গিয়ে পৌঁছায়। কী করবে কী করবে না, তা ভেবে পায় না। উপমায় আছে- অতি চাপের কারণে যদি কারো পিঠ দেয়ালে ঠেকে যায়, তাহলে তার সামনে যাওয়া ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকে না। তুফানীর বেলাও তাই । এখন আর তার হারাবার কিছু নেই। কোনো পিছুটান নেই, শুধুই এগিয়ে যাওয়ার পালা। জগতে যতোদিন বেঁচে থাকবে ততোদিন বাঁচার মতো বাঁচতে চায় তুফানী। আসুক ঝড়, কোনো ঝড়কে আর সে ভয় পায় না। জন্মই যার ঝড়ের মাঝে তার আবার ঝড়ের ভয় কিসের? তাই নির্ভীকতার তরী ভাসায় মনের উত্তাল গাঙে।
কুঁজোবুড়ি পরপারে যাওয়ার পরপরই এলাকার লোকবলের সহায়তায় মাতব্বর নিরঞ্জন বাবুর নিকটে কাকাবাবুর রেখে যাওয়া বন্ধকী বাড়িভিটা ছাড়িয়ে আনে। সে এখন এই বাড়িটাতেই বাকি জীবন কাটাতে চায়। বস্তিতে আর ফিরে যেতে চায় না তুফানী। তাই সময়ক্ষেপণ না করে কাকাবাবুর ভাঙা ঘরটি মেরামত করে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। এলাকাবাসীও খুশি মনে তুফানীকে সময় দেয় এবং খেয়াল রাখে।
এখানে এসে একদিন তার বান্ধবী শ্রাবণীর সাথে দেখা করে। শ্রাবণীর মাধ্যমে সে উন্মুক্তে ভর্তি হয়। একদিকে তার চলমান ব্যবসা অন্যদিকে পড়াশোনা। মাঝেমধ্যে শ্রাবণী এসে আড্ডায় মাতে। সব মিলিয়ে দারুণ ব্যস্ততায় দিন কাটে তুফানীর।
এমন অবস্থায় হঠাৎ একদিন এক ডাক পিয়ন তুফানীর দোকানে এসে হাজির। দিদি আপনার নামে বিদেশি একটি খাম এসেছে। তুফানী আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করে: কী বললেন? ডাক পিয়ন আবারও বলে: বিদেশ থেকে আপনার নামে একটা চিঠি এসেছে। তুফানী রিসিভ কপিতে স্বাক্ষর করে চিঠির খামটি হাতে নেয়। দেখে খামের বাম পাশে সুমনের নাম লেখা ডান পাশে তুফানীর দোকানের ঠিকানা। কী লেখা আছে ভেতরে? সুমন বিদেশে কেন? তবে কী সুমন আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছে! নাকি তার কোনো বিপদাপদ হয়েছে? তুফানীর মনে এসব নানামুখী প্রশ্নের উদ্ভব ঘটতে থাকে। কী লেখা আছে তাতে? ক্ষণিক ভেবে খামটি খুলে দেখে লেখা আছে: -প্রিয় তুফানী, আমি জানি তুমি ভালো নেই। কিন্তু সেদিন আমার কিছু করার ছিলো না। আমি কোম্পানির কাজ শেষ করে হোটেলে ফেরার সাথে সাথে অফিসের একটি টেলিগ্রাম পাই। রাতের মধ্যেই ঢাকায় ফিরতে হবে।
বার্তাটা পেয়েই আমি তোমার দোকানে গিয়েছিলাম। দুঃখের বিষয় তুমি তখন দোকান বন্ধ করে চলে গিয়েছো। কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে একটি চিরকুট লিখে রেখে গিয়েছিলাম। আশা করি নিশ্চয়ই পেয়েছো। ঢাকায় ফেরার বিস্তারিত বিষয় আমার জানা ছিলো না। এসে দেখি কোম্পানির মার্কেটিং কাজে দেশের বাইরে যাওয়ার জন্য বিমানের টিকিটও কেটে রেখেছে। চাকরিটা বাঁচানোর দায়ে অমত করতে পারিনি। ইচ্ছার বাইরে আসতে বাধ্য হয়েছি। আমাকে ভুল বুঝো না লক্ষীটি! আমার হৃদয়ে তোমার জন্য যে আসন পেতেছি সেটি শুধুই তোমার। এই আসনে বসার আর কারো অধিকার নেই। দোকানের পাশাপাশি পড়াশোনা টা চালিয়ে যেয়ো নিয়মিত। ইতি তোমারই সুমন। তুফানী চিঠির ভাষায় মুগ্ধ হয়ে চিঠির খামটি বুকে জড়িয়ে একবুক প্রশান্তির নিঃশ্বাস নেয়।
এতোদিন ধরে সুমনের প্রতি তুফানীর মনে যে ভুল ধারণা তৈরি হয়েছিল, চিঠির মর্মার্থে সেই ভুল ভেঙে ভেতর জুড়ে তার আনন্দের বন্যা বইতে থাকে। একটু আগেও যে বুকে অশান্তির ঝড় বইতেছিল, সে বুকেই এখন ঝড় কাটিয়ে শান্তির পায়রা নাচছে। অসংখ্য স্বপ্নেরা তখন রঙিন পালক মেলে উড়ে এসে চোখের পাতায় ভর করতে শুরু করে। তুফানীর মনের আকাশে জমাট বাঁধা মেঘগুলো সরে গিয়ে পরিস্কার হয়। হৃদয় মাঠে প্রশান্তির আলো ঝলকায়। পুলকিত মনের একচিলতে মুচকি হাসি গোলাপমাখা ঠোঁট দু’টির সীমানা ছোঁয়।
তুফানীর ঝলমলে হাসি মুখের ভাব দেখে দোকানের জনৈক কর্মচারী জিজ্ঞেস
করে : আজকে আফনের কী অইছে। ম্যালাদিন পর আফনেরে আইজকা খুশি খুশি লাগতাছে। কোনো খুশির খবর আছে বুঝি? তুফানীর ঠোঁটে আবারও মুচকি হাসি। মাথার ইশারায় তুফানী জানায় কিছুতো বটেই। : সুমন স্যার কই! ম্যালাদিন ধইরা সুমন স্যারেরে দেহি না। তুফানী এবার জানায় : তিনি দেশের বাইরে।
- কোনদিন গেছেন?
- এইতো কয়দিন হলো।
- সুমন স্যার ম্যালা ভালা মানুষ আছিলো। কর্মচারীর মুখে সুমনের সুনাম শুনে তুফানীর মন ভরে যায়। আধবেলা দোকান শেষে সকাল সকাল বন্ধ করে বাড়ির পথে হাঁটে তুফানী। পথিমধ্যে বান্ধবী শ্রাবনীর সাথে দেখা হয়। শ্রাবণী জোর করে তুফানীকে তাদের বাড়িতে নিয়ে যায় এবং সেখানেই সেদিন থেকে যায় তুফানী।
চলবে...