আপডেট : ৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪ ১২:০০
ধারাবাহিক উপন্যাস (ত্রয়োবিংশ পর্ব)
গহীনে নীল
বেলায়েত হোসেন
আঁধারের পর্দা সরিয়ে ভোরের সূর্যটা উঁকি দেয় আকাশের কোলে । সুমনের জল্পনায় সারারাত ঘুম হয়নি শ্রাবণীর । অসহনীয় যন্ত্রণায় ছটফট করে রাত পেরোয় তার। জানালার কার্ণিশে ঝুলে থাকা অপরাজিতার গতর ছুঁয়ে যখন খানিকটা আলো এসে প্রবেশ করে শ্রাবণীর ঘরে, তখন বেদনা বিমূঢ় হৃদয়ে বিছানা ছেড়ে গিয়ে ভাবনার ফিরিস্তি নিয়ে দাঁড়ায় জানালার পাশে। ঘুমভাঙা পাখিরা তখনো কিচিরমিচির সুরে গেয়ে চলেছে আপন মনে। তবে শ্রাবণীর মন জুড়ে এ কোন্ বিষাদের সুর? ভাবনার অতল গহ্বরে সাঁতরে যখন ক্লান্ত শ্রাবণী,তখন নবোদিত সূর্যের অরুণ আলোকচ্ছটা কুয়াশা ভেদ করে উজ্জ্বলতা বাড়াতে ব্যস্ত। শ্রাবণী কী আদৌও পারবে তার মন থেকে সুমনের ধোঁয়াশা কাটাতে? পারবে কী সুমনের কথা ভুলে গিয়ে স্বাভাবিক হতে? এই নিয়ে চলে মন আর বিবেকের তুমুল যুদ্ধ। যুদ্ধের মীমাংসা না হলেও তাকে যে পারতেই হবে। কারণ, সুমনের উপর তো এখন আর তার কোনো অধিকার নেই! সুমনকে তো বহুবছর আগেই শ্রাবণীর আকাশ থেকে কেড়ে নিয়েছে বেরসিক প্রলয়ঙ্কারী এক নির্মম ঝড়। সুমন এখন তুফানীর আকাশে উচ্ছ্বল আলোর স্বপ্নের ভেলা। যে ভেলায় চড়ে তুফানী দিনরাত স্বপ্নের ফেরি করে বেড়ায়। সেখানে আর জমাট বাঁধা কালো মেঘের ঘনঘটায় নতুন কোনো ঝড়ের আবির্ভাব ঘটাতে চায় না শ্রাবণী। বিবেকের যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে এ পথ থেকে সরে দাঁড়ানোর মনস্থির করে সে। তুফানী শ্রাবণীর Best Friend. তুফানী যদি গুণাক্ষরেও জানতে পারে সুমন শ্রাবণীর ছোটোবেলার সম্পর্কের কথা, তাহলে তুফানী যথেষ্ট কষ্ট পাবে। শ্রাবণী অনেক ভেবেচিন্তে মন থেকে আড়াল করতে চেষ্টা করে সুমনের কথা। কিন্তু বেহায়া মন বারবার ঘুরে ফিরে বেড়ায় সেখানেই। স্মৃতির পাতা খুললেই কপোল বেয়ে নোনা জলের ফোঁটাগুলো টপটপ করে পড়তে থাকে জানালার গ্রীলের ফাঁক দিয়ে ঘরে ঢুকা অপরাজিতার কচি ডগায়। তখন বিচ্ছেদের ভারে শ্রাবণীর মনের বাগে ফুটন্ত কুসুমের আশাহত পাপড়িগুলো কাঁপনি দিয়ে ওঠে। সেই সাথে বুকের বাতায়ন খুলে দীর্ঘ একটা চাঁপাশ্বাস অজান্তেই বেরিয়ে এসে মিশে যায় বাইরের খোলা বাতাসে।
একই রূপকে রূপায়িত দুটি ধারা। ছন্দে-তালে মিলেমিশে চলছিলো একসাথে। আচমকা এক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে অঙ্গাঙ্গীভাবে বহমান ধারা দুটি হারিয়ে ফেলে গতিপথ। বিপর্যয়ের ঘূর্ণিপাকে সুমন হারায় শ্রাবণীকে,শ্রাবণী হারায় সুমনকে। সূত্রের সিঁড়ি বেয়ে সুমনের সন্ধান পেলেও সে এখন ভিন্ন গ্রহের অধিবাসী। সুমনের স্মৃতি থেকে মুছে গেছে শ্রাবণীর নাম। তাই অযাচিত ভাবনার দুয়ারে কড়া নেড়ে ত্রিকোণী সংঘর্ষের রূপক হতে চায় না সে। যদিও পদ্মা মেঘনার জলরাশি এক জায়গায় এসে মিলনের ছোঁয়া খুঁজছে। তবু দুটি ধারা দু'রূপেই প্রবাহিত হচ্ছে। আজ অব্দি দুটি ধারার মিলন স্থলে মেঘনার স্বচ্ছ আর পদ্মার ঘোলাটে জলের মিশ্রণ হতে পারেনি। পারেনি একে অপরের মাঝে মিশে একাকার হতে। তাই শ্রাবণীর যতো কষ্টই হোক নিয়তিকে বরণ করেই এ পথ থেকে সরে আসা ছাড়া তার গত্যন্তর নেই। তুফানী ও সুমনের বন্ধুত্বের বাঁধন খুবই সুদৃঢ় এবং হৃদয় ঘনিষ্ট। বলা চলে একে অপরের প্রাণ। তাদের এই অন্তর ঘনিষ্ট পথে স্বার্থের মশাল নিয়ে নিজেকে উন্মোচন করা বড়োই বেমানান এবং হীনমন্যতার সামিল। তাই সুমনের চিন্তাবোধ, মাথা থেকে সরিয়ে সুমন তুফানীর মিলন আকাশে স্বার্থের মশালের বদলে ধৈর্যের পতাকা উড়িয়ে সাক্ষী হতে চায় শ্রাবণী। নয়তো বিবেকের কাঠগড়ায় আজীবন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে মাথা ঠুকে মরতে হবে।
চলবে...