আপডেট : ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪ ১০:০৬
ধারাবাহিক উপন্যাস (পঞ্চবিংশ পর্ব)
গহীনে নীল
বেলায়েত হোসেন
সাগরের বুক চিরে ছুটে চলে তাদেরকে বহন করা দ্রুততরী নামক বাহনটি। বাহনের গতিতে জলের বুকে সৃষ্ট ঢেউগুলো যখন দুইদিকে ভাগ হয়ে তীরের খুঁজে মরিয়া তখন শ্রাবণীর মনের সৈকতে ভেসে বেড়ায় স্বপ্ন ভাঙার বিষণ্ণতার ঢেউ। ঢেউয়ের প্রতিটা আঘাত যেনো পলকে পলকে ভেঙে চলে সুমনকে নিয়ে দেখা স্বপ্নের পাড়।
দ্রুততার সাথে বাহনটি এগিয়ে যাচ্ছে গন্তব্যের দিকে। তুফানী এবং শ্রাবণী দু'জনই খুব চুপচাপ বসে ভাবছে আর চারপাশের দৃশ্য অবলোকনে মনোনিবেশ করে চলেছে। দু'জনের মনেই রকম ফেরের প্রশ্নের উদ্ভব ঘটছে। উদ্ভাবিত প্রশ্নের তীরগুলো দু'রঙে বিভক্ত হয়ে একই লক্ষ্যে বিধ্বস্ত। নিয়তির কী অদ্ভুত খেলা! যে খেলায় কারোর স্বপ্ন ভেঙে হয় নীলাক্ত! আবার কারোর স্বপ্ন নানা রঙে রঞ্জিত । চলতি পথের গভীর সমুদ্রে দেখা মিলে টানটান বুকে আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গুটি কয়েক পাহাড়। যার চারপাশের নানামুখী বায়ুমণ্ডলের চাপে সৃষ্ট ঢেউয়ের এলোমেলো সারিগুলো দিকহারা হয়ে অজান্তে এসে পাহাড় পাদমূলে নির্ভরতার পাড় ছোঁয় একের পর এক। দৃশ্যের অবতারণায় তুফানীর দৃষ্টি ফিরে তার ফেলে আসা জীবন প্রবাহে। তুফানীর প্রবাহিত জীবনেও যখন নানামুখী আবহের বৈরীতায় সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত এলোমেলো তখন দিশাহারা তুফানীর অনিশ্চিত জীবনে বিস্ময় স্বপ্ন হয়ে ধরা দেয় সুমন। তুফানী খুঁজে পায় নির্ভরতার এক আশাতীত প্রতীক । প্রতীকের প্রতিবিম্বে বিমোহিত হয়ে তুফানী অবিরাম জ্বালিয়ে চলে স্বপ্নের প্রদীপ।
খানিক পরেই গন্তব্যের পাড় ছোঁয় তাদের বহন করা বাহনটি। এটি গভীর সমুদ্রের একটি দ্বীপ। দ্বীপের চারপাশ জুড়ে এখন গড়ে উঠেছে বেড়ীবাঁধ। বাহনটি পাড় ছুঁতেই শ্রাবণী ও তার মা মিলে পাড়ে দাঁড়িয়ে ঢেউয়ের পিঠ অনুমান করে করে তুফানীকে আঙুল ইশারায় দেখাতে শুরু করে তাদের সাবেক বসবাসের এলাকা। -ঐ যে দেখা যায় বড় ঢেউগুলো উটের পিঠের মতো গড়িয়ে গড়িয়ে এদিকে আসছে! ওখানেই ছিলো আমাদের সব। থাকার ঘর ছিলো, তার একটু দূরেই ছিলো শ্রাবণীর স্কুল,খেলার মাঠ পাশে ছিলো মন্দির, আর একটু এগোলেই ছিলো ঈদগাহ মাঠ, সাথে ছিলো মসজিদ সবকিছু। বেশ কয়েকটা গ্রাম নিয়ে পুরো এলাকাটা খুব জমজমাট ছিলো। গ্রামগুলোতে হিন্দু-মুসলিম সবাই মিলেমিশে একসাথে বসবাস করতো। কারোর প্রতি কারোর বিদ্বেষ ছিলো না। সবই এখন অতীত হয়ে রাক্ষুসে সাগরের পেটে বিলুপ্ত। কোনো কিছুর আর চিহ্নটি পর্যন্ত নাই। চাপা কণ্ঠে কথাগুলো বলতে বলতে মা মেয়ের বুক থেকে একটা ভারী নিঃশ্বাস বেরিয়ে মিলিয়ে যায় খোলা আকাশে-বাতাসে। মুহুর্তের জন্য কিছুটা হাল্কা হয় দু'জন। আস্তে আস্তে মাথার উপরের সূর্যটা সারাদিন আলো বিলিয়ে ক্লান্ত শরীরে নিয়মের কোলে ধীরে ধীরে ঢলে পড়ছে। ফেরার পথ অনেক। তাই আর বিলম্ব না করে প্রত্যাবর্তনের পথে পা বাড়ায় সবাই। ফিরে আসার পথে তুফানী শ্রাবণীর মায়ের কাছে জানতে চায় : আন্টি এই দ্বীপের নাম কী? তুফানীকে দ্বীপের নাম বলতেই তার মনের মাঝে হঠাৎ মোচড় দিয়ে ওঠে। তুফানী মুহুর্তেই যেনো কেমন ভাবনায় পড়ে যায়। তার কাছে নামটি পরিচিত বলে মনে হয়। সুমন তো এই দ্বীপের কথাই বলেছিলো মনে হচ্ছে। তাই যদি হয়ে থাকে তাহলে সুমনের বাড়িও তো এখানেই ছিলো। তাহলে সুমন কী শ্রাবণীকে চিনতো! তবে কী সুমন আর শ্রাবণীর মধ্যে কোনো জানাশোনা ছিলো! সন্দেহটা আরো ঘনীভূত হতে থাকে তুফানীর মনে। তাই যদি না হবে তাহলে সুমনের কথা বিস্তারিত শোনার পর শ্রাবণী আমার সাথে এমন করলো কেন? আর আজকে আমাকে এখানে ঘুরতে নিয়ে আসার কারণ কি? এসবের হিসাব মিলাতে গিয়ে হিমসিম খাচ্ছে তুফানী। প্রশ্নগুলো বারবার তুফানীর মনের গভীরে অবিরাম ঢেঁকুর তুলে চলেছে ।
চলবে...