আপডেট : ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪ ১৯:৩৬
ধারাবাহিক উপন্যাস ( চতুত্রিংশ পর্ব)
গহীনে নীল
বেলায়েত হোসেন
নীরব নিস্তব্ধ বাড়িতে তুফানী সম্পূর্ণ একা। ভ্রমণ থেকে ফেরার লগ্নে শ্রাবণীর প্রতি তার অভিমানের পাল্লাটা একটু বেশিই ভারী ছিলো। তবু সে ভেবেছিলো শ্রাবণী তাকে থাকার আপত্তি জানালে এই রাতটি অন্তত তাদের ওখানেই কাটিয়ে আসবে। কিন্তু শ্রাবণীর পক্ষ থেকে তেমন কোনো আগ্রহ না দেখতে পেয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও দোকানের ঝামেলা দেখিয়ে চলে আসতে বাধ্য হয় তুফানী। শ্রাবণীদের ওখান থেকে বাড়ি ফেরার পর তুফানীর মনের অবস্থা এতোটাই খারাপ হয়, যা বলার মতো নয়। শ্রাবণীর শেষ মুহুর্তের ব্যবহারটা তুফানীকে খুব অশান্ত করে তোলে। তুফানী কিছুতেই স্থির হতে পারে না। ভুলতে পারে না শ্রাবণীর পরিবর্তনশীল ব্যবহারের কথা। ভাবনার সাগরে নিমজ্জিত তুফানী ভাবনার আরও গভীরে তলিয়ে যায়। চারিদিকের সুনসান নীরবতার বেরসিক আঙুলগুলো যেনো তার গলা টিপে ধরছে। রাতের নীরবতা আর একাকিত্ব দুয়ে মিলে তুফানীকে ফাঁপিয়ে তুলছে। এমন কেউ নেই যে, ভেতরের জমাট বাঁধা কথাগুলো কাউকে বলে মনের দুঃখ একটু হাল্কা করবে।
বেশ কিছুদিন যাবৎ তুফানী একটা অভ্যাস ভালোই রপ্ত করেছে। সেটি হলো, তুফানীর কোনো সময় কোনো কারণে মন খারাপ থাকলে সুমনের দেওয়া চিঠি ও চিরকুটটা বের করে পড়ে। তাতে তার মনের সকল মলিনতা কেটে যায়। কারণ চিঠির ভাষায় রয়েছে আশানির্ভর ভিত্তি এবং স্বপ্ন। এ দুটোতে ভর করে তুফানীর মন পাখিটা উড়ে বেড়ায় উৎফুল্লতার বাগানে । আশান্বিত মনে সান্ত্বনার ঢোক গিলে তৃপ্তি অনুভব করে তুফানী। আজ তার অনেক বেশিই মন খারাপ। তাই সেই অভ্যাসের সারা দিতে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের কার্ণিশে ঝুলন্ত তার ভ্যানেটি ব্যাগটি হাতে নেয়। এর ভেতরে আরও একটা পকেট পার্স রাখা থাকে। সেই পার্সটার ভেতরে যত্নসহকারে রাখা হয় তার ভালোবাসার মানুষটির কাছ থেকে পাওয়া চিঠি ও চিরকুট। কিন্তু ব্যাগটা খুলে দেখে তার ভেতরে রাখা পার্স ও চিঠি চিরকুট কোনোটাই নাই। ব্যাগের ভেতরের অন্যান্য সকল কাগজগুলো একটা একটা করে দেখছে সে। কিন্তু কোনো হদিস মিলেনি। সেগুলো না পেয়ে ভারাক্রান্ত মনে বিছানায় লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে শুরু করে। কান্নারত চোখের নীরব জলে বালিশ ভিজে একাকার হতে থাকে। এ যেনো বিষণ্ণতার মাঝেই আরেক বিষণ্ণতার ঢেউ ওঠে মনের গাঙে। তুফানী শুয়ে শুয়ে ভাবে, পার্সটি তো সবসময় ব্যাগের ভেতরেই থাকতো। তাহলে আজ পাচ্ছি না কেন? কোথায় রেখেছি নাকি হারিয়ে ফেলেছি! কিছুই মনে পড়ছে না তার।
এদিকে শ্রাবণীর মা মনে মনে স্থির করে, তুফানীর
সাথে সুমন সম্পর্কে কথা বলবে। এ পথে না আগানোর জন্য বারণ করবে তাকে। কারণ, একজন সনাতন ধর্মের মেয়ে হয়ে একজন মুসলিম ছেলের সাথে প্রণয়ের সম্পর্ক সমাজ কোনোদিন প্রশ্রয় দেবে না। ফলে স্বপ্নের ঘোরে পড়ে যে পথে এগুচ্ছে তুফানী তাতে তার ভবিষ্যৎ জীবন অনিশ্চিতের সীমানায় অস্তিত্ব হারাতে পারে। তাই যে করেই হোক, আগবাড়িয়ে হলেও, অভিভাবকের দায়িত্ববোধ থেকে তুফানীর ভুল পথে হেঁটে যাওয়ার মধ্যসীমায় দাঁড়িয়ে সঠিক পথের চিত্র আঁকবে শ্রাবণীর মা। তুফানীকে বুঝাবে এ পথ থেকে সরে আসতে। হিতোপদেশ না মানলে বিপরীতমুখী অবস্থান নিতে কৃপণতার পরিচয় দিবে না সে।
কিন্তু শ্রাবণীর চিন্তাধারা ভিন্ন পথে মোড় নেয়।
সুমন সম্পর্কে তুফানীর মুখের বর্ণনায় শ্রাবণী যখন সুমনকে চিনে ফেলে এবং তারই কৈশোরকালের স্বপ্নের মানুষ সুমনের সাথে তুফানীর প্রণয় গড়ে উঠার কথা জানতে পারে তখন অজান্তেই ঢেকে যায় শ্রাবণীর মনের আকাশ হিংসার কালো মেঘে। গুমোট বাঁধা মেঘের অন্তরালে ভ্যাঁপসা হতে থাকে শ্রাবণী ও তুফানীর বন্ধুত্বের জগৎ। এক পর্যায়ে দুটি মনের অভিমান যখন আকাশচুম্বী তখন ভুল করে ফেলে যাওয়া তুফানীর পকেটপার্স থেকে আবিষ্কৃত চিঠি ও চিরকুটের মর্ম বাতাসে জমাট বাঁধা মেঘগুলো আস্তে আস্তে সরে যেতে থাকে। পরিষ্কার হতে থাকে শ্রাবণীর মনের আকাশ। বিবেকের এজলাসে প্রমাণিত হয় তুফানীর প্রতি শ্রাবণীর অভিমান ছিলো সম্পূর্ণ ভুল। ভাবনার ঘড়িটা তখন জানান দিয়ে যায় ফেলে আসা অতীত কখনো ফিরে আসে না চলমান কাঁটায়। তাই আর অতীতকে নিয়ে ভাবতে চায় না শ্রাবণী। শ্রাবণীর মনের অবস্থান বদলায়। ভাবে, সময়ের কাঁটায় অতীত টানলে বর্তমান হারাবে ধ্বংসের চোরাবালিতে।
সুমন আর তুফানীর মধ্যে যে প্রণয়ের বন্ধন সৃষ্টি হয়েছে তাতে তো তুফানীর কোনো দোষ নেই! তুফানী তো জানতো না সুমনের সাথে তার ছোটবেলার স্মৃতি জড়িত! তার আকাশ থেকে সেই কবেই তো সুমন নামক উড্ডীন স্বপ্নটা হারিয়ে গেছে। তবে কেনো হারানো আকাশে পুরোনো স্মৃতির ঝাণ্ডা উড়িয়ে তুফানী ও তার মধ্যকার বন্ধুত্বের টানাপোড়েন ঘটাবে! বিবেকের প্রশ্নে নাস্তানাবুদ শ্রাবণী, যুক্তি সমর্থিত কোনো উত্তর খুঁজে পায় না। অবশেষে নিরুত্তর শ্রাবণী বিবেকের কাছে আত্মসমর্পণ করে।
চলবে...