আপডেট : ৬ মার্চ, ২০২৪ ০৯:৩৩
ধারাবাহিক উপন্যাস (অষ্টত্রিংশ পর্ব)
গহীনে নীল
বেলায়েত হোসেন
কারণ শব্দটা উচ্চারণ করেই থেমে যায় শ্রাবণী। তুফানী শ্রাবণীকে অবাক কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ে বলে, বল তো কী কারণ? শ্রাবণীকে কিছুক্ষণের জন্য চুপ থাকতে দেখে তুফানী তার চোখের দিকে তাকায়। চেয়ে দেখে তার চোখ দুটি জলে ছলছল করছে। তুফানী ভাবে, হঠাৎই শ্রাবণীর চোখে জল কেন! এ জলের রহস্য কী? তুফানী মনে মনে একেক করে রহস্যের পৃষ্ঠা ওল্টাতে থাকে। শ্রাবণী এবং তার মায়ের বলা কথার মাঝে ক্রমাগত সূত্র খুঁজে বেড়ায় তুফানী। সেদিন শ্রাবণীর মায়ের রহস্যে ভরা কৌশলী কথার উপদেশ, আর আজকে তারই মেয়ের মুখে দুঃসাহসিক উচ্চারণ তুফানীর যে কোনো সমস্যায় শ্রাবণী জীবন দিয়ে হলেও সমাধান করার প্রতিজ্ঞা সবকিছু মিলিয়ে তুফানীর মথাটা কেমন যেনো গুলিয়ে যেতে থাকে। দু'জনের কেউই খুলে বলেনি কারণের আসল রহস্যটা কি। তাই জানার যথেষ্ট ইচ্ছা থাকা সত্যেও তুফানী এই বিষয়ে আর গভীরে প্রবেশ করতে চায় না আপাতত। মুহুর্তের মোকাবেলায় ভেতরের সকল জল্পনা-কল্পনা থেকে নিজেকে সংবরণ করে নেয় তুফানী। শ্রাবণীর এ অবস্থা দেখে তুফানী স্বাভাবিক প্রশ্নে বলে-তোর চোখে জল কেনো রে? শ্রাবণী বলে, কই না তো? তুফানী বলে, তুই কী আমার কাছে কিছু গোপন করছিস! শ্রাবণী জানায়-মনে হচ্ছিলো চোখে কিছু পড়ছিলো তাই এমন। তুফানী বলে কই দেখি দেখি? চোখ মেলতো দেখি! তুফানী জোর করে শ্রাবণীর চোখের পাতা উল্টে দেখে কিছুই নেই। বলে, কিছুই তো পেলাম না। শ্রাবণী তড়িঘড়ি করে কথাটা পাশকাটাতে গিয়ে বলে, যাকগে, হয়তো বেরিয়ে পড়ছে। নাছোড়বান্দা তুফানী শ্রাবণীকে বলে এবার কারণটা কী বল! তুফানীর চাপে পড়ে তাকে সান্ত্বনা দিতে ভেতরের কষ্টের কারণটা ছাপিয়ে যায় শ্রাবণী। বলে, আমি তোকে খুব ভালোবাসি রে তুফানী! তোর মাঝে আমার হৃদয়ের বাস । শ্রাবণীর রহস্যময়ী কথার মারপ্যাঁচে তুফানী যখন ভাবনার অতলে ডুবতে থাকে তখন চিঠি হাতে এক ডাকপিয়ন এসে হাজির হয় তুফানীর দোকানে। ডাকপিয়ন বলে, ম্যাম বিদেশ থেকে আপনার নামে চিঠি আসছে। চিঠিখানা তুফানী হাতে নেওয়ার আগেই কৌতূহল বশে শ্রাবণী নিয়ে নেয়। দেখে,প্রেরক সুমন, প্রাপক তুফানী। তা দেখে শ্রাবণীর ভেতরটা অজান্তেই কিঞ্চিৎ ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে। তুফানী বুঝে ফেলবে কারণে কষ্ট হলেও নিজেকে সামলিয়ে নেয় শ্রাবণী। চিঠির খামটা এগিয়ে দিয়ে তুফানীকে বলে খুলে দেখতো কী লেখা আছে তাতে? তুফানী শ্রাবণীকে বলে পরে দেখে নিব। শ্রাবণী রসিকতা করে বলে, এতো ঢং করিসনে তো! এখন দেখলে কী তোর সুমনের গায়ে ছুঁতি লেগে যাবে? তুফানী শ্রাবণীর কথা শুনে খামটি এগিয়ে দেয় শ্রাবণীর হাতে। বলে তুইই দেখ এবং পড়। শ্রাবণী বলে তোর চিঠি আমি পড়বো কেন? তুফানী উত্তরে বলে, বাহ্ রে আমার মুখে শুনতে পারবি আর পড়তে পারবি না?
শ্রাবণী তুফানীর হাত থেকে চিঠির খামটি নিয়ে মাথা নীচু করে খুব মনোযোগসহকারে পড়তে থাকে। এদিকে শ্রাবণীর মুখে পঠিত চিঠির শব্দ গুঞ্জনে তুফানীর হৃদয় বীণায় সুরের ঢেউ জাগে। শ্রাবণী পড়তে গিয়ে মাঝেমধ্যেই থেমে যায়। কারণ,যতোই পড়ে ততই শ্রাবণীর চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। ভেতরে তার একধরনের তোলপাড় সৃষ্টি হতে থাকে। কারণ, তারই স্বপ্ন শাখের অঙ্কুরিত কুঁড়িটা কালের ফেরে আজ অন্যের শাখায় পাপড়ি মেলে রঙ ছড়ায়। ভাবতেই হাত পা নিঃশক্তি হয়ে আসে শ্রাবণীর।
কিন্তু তুফানীকে তা বুঝতে দেয় না। শ্রাবণী পড়তে গিয়ে থেমে যাওয়ার কারণ জানতে চায় তুফানী। তাকে তাড়া দিয়ে বলে, কি রে থামিস ক্যান পড়! শ্রাবণী ভাবে, তুফানী যদি আসল রহস্যটা বুঝে ফেলে কেনো থামছি, তাহলে নতুন আরেক ঝামেলার সৃষ্টি হবে। আগের প্রশ্নটা যেভাবেই হোক পাশ কাটিয়েছি। কিন্তু এখন আর পাশকাটানোর পথ থাকবে না। তাই ছলের আশ্রয় নিয়ে বলে, সুমনের টানা হাতের লেখা তো? তাই বুঝতে একটু কষ্ট হচ্ছে।
চিঠি পড়ে বুঝতে পারে সুমন কিছুদিনের মধ্যে দেশে ফিরছে। লেখা আছে দেশে ফিরেই হৃদয়ে লালিত স্বপ্নের মালাটা পড়ে নিবে এবার। শেষাংশের এই লাইনটা শ্রাবণীর মনে সুঁইয়ের মতো বিঁধতে থাকে। চিঠির ভাষার নীরব অনলে পুড়ে ছারখার হতে থাকে শ্রাবণীর মন। আর এদিকে আনন্দে দিশেহারা তুফানীর ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসির রেশ উড়ে।
শ্রাবণী নিপুণ চতুরতায় ধৈর্যের ঢোক গিলে এই ভেবে যে, তুফানীর সুখ জুড়ে সুমন। আর সুমন ভালো থাকা মানে শ্রাবণীর আপন ভালোবাসা অমর হয়ে জিইয়ে থাকা সুমন ও তুফানীর মাঝে।
চলবে...