Main Logo
আপডেট : ২৪ জুলাই, ২০২০ ০৯:৪০

ঘরে ঘরে বানের স্রোত বাঁধে ঠাঁই

অনলাইন ডেস্ক
ঘরে ঘরে বানের স্রোত বাঁধে ঠাঁই

স্রোতের তোড় : পদ্মার পানি বাড়ছেই। স্রোতের তোড়ে বিলীন হওয়ার পথে মাদারীপুরের শিবচরের বন্দরখোলার নুরুদ্দিন মাদবরকান্দি এসইএসডিপি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের ভবনটি। গতকাল তোলা। ছবি : কালের কণ্

কৃষক বাচ্চু শেখের ঘরের মধ্যেই যেন বইছে পদ্মার স্রোত! বানের পানিতে বিপর্যস্ত বাচ্চু শেখ উপায়ান্তর না দেখে সপ্তাহখানেক আগে সোজা গিয়ে ওঠেন ফরিদপুর সদর উপজেলার ডিক্রিরচর ইউনিয়নের ধলার মোড় এলাকার বেড়িবাঁধের উঁচু সড়কে। সেখানেই এখন তাঁর বসতি। পলিথিন আর বাঁশ দিয়ে তৈরি করা অস্থায়ী বসতি যে কখন বাতাসে উড়িয়ে নেয় সেই দুশ্চিন্তায় তাঁর চোখে ঘুম ধরা দেয় না। এমনিতেই চারদিকে বন্যার পানি দেখতে দেখতে তাঁর দুই চোখ ক্ষণে ক্ষণে থাকে অশ্রুভেজা। বলতে গিয়েও কথা বের হয় না বাচ্চু শেখের। চাপাস্বরে বললেন, ‘পানির ধারে মাচান বাঁধছি। এরপর উপরেত্যা সমানে ঝরতিছে বৃষ্টির পানি। চাইরদিকে পানি, কাজকাম পাইতেছি না। পরিবারের বাল-বাচ্চা নিয়্যা নিদারুণ কষ্টে দিন কাটাইতে হইতেছে। চাইল আর শুকন্যা খাবারে কয়দিন চলবে? এহন আমরা আর সাহায্য চাই ন্যা, আমাগেরে কাম দেন।’ জীবন-জীবিকার সমীকরণ মেলাতে না পেরে এভাবেই হা-পিত্যেশ করছিলেন সাদামাটা মানুষটি। শুধু ফরিদপুরের কৃষক বাচ্চু শেখই নন, জীবন-জীবিকা নিয়ে কপালে এমনই চিন্তার ভাঁজ পড়েছে কমপক্ষে ২৫ জেলার বন্যাদুর্গত অসহায় মানুষের। কাজ নেই। সরকারি-বেসরকারিভাবেও তেমন ত্রাণও জুটছে না। ফলে দুর্বিষহ দিন কাটছে লাখ লাখ পানিবন্দি মানুষের।

এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র থেকেও বন্যার পানি কমার সুখবর মিলছে না। উল্টো আট জেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হওয়ার শঙ্কার কথা বলছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সংস্থাটি তাদের নিয়মিত হালনাগাদ তথ্যে জানিয়েছে, আজ শুক্রবার কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নাটোর, বগুড়া, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও নওগাঁর বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হতে পারে। এ ছাড়া আগামী ২৪ ঘণ্টায় ধরলার পানি সমতল থেকে আরো বাড়তে পারে। ঢাকার আশপাশের নদ-নদীর পানি আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সমতল থেকে আরো বাড়বে। ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদীর পানিও বাড়ছে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় সেই ধারা অব্যাহত থাকবে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য বলছে, এবারের বন্যা অন্যবারের চেয়ে বেশি দীর্ঘমেয়াদি থাকতে পারে। জুলাই কাটিয়ে আগস্টেও বন্যার পানি দেখা যেতে পারে।

অন্যদিকে আবহাওয়া অফিস থেকে কিছুটা ভালো খবর পাওয়া গেছে। সরকারি সংস্থাটি জানিয়েছে, কয়েক দিন ধরে যে বৃষ্টির অঝোর ধারা বইছে, আজ শুক্রবার ভারি বৃষ্টির আশঙ্কা কম। সারা দেশেই বৃষ্টি হবে, তবে গত কয়েক দিনের চেয়ে কম। আবহাওয়াবিদ হাফিজুর রহমান বলেন, ময়মনসিংহ, সিলেট, চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগে তুলনামূলক বেশি বৃষ্টি হতে পারে। অন্য বিভাগে বৃষ্টির প্রবণতা কম হবে।

এদিকে চাঁদপুরে পদ্মার তীব্র স্রোতে রাজরাজেশ্বর ইউনিয়নের তিনতলা আশ্রয়কেন্দ্রটি হেলে পড়েছে। এটি নদীতে বিলীন হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। গতকাল ভোর থেকে স্রোতের মাত্রা বাড়তে শুরু করলে সকাল ৮টায় ভবনটি পেছনের দিকে কাত হয়ে হেলে পড়ে। এর আগে কয়েক দিন ধরে রাজরাজেশ্বর ইউনিয়নের মজিদকান্দি এলাকায় সদ্য নির্মিত এই ভবনের চারপাশ পদ্মা গ্রাস করে নেয়। গত এক সপ্তাহে নদীভাঙনে এই এলাকার ছয় শতাধিক বসতবাড়ি, ফসলি জমি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ ও বাজার নদীতে বিলীন হয়ে যায়। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান হযরত আলী বেপারী জানান, তাঁর ইউনিয়নের পাঁচটি চরের প্রায় ২৫ হাজার মানুষ দুর্ভোগে রয়েছে।

জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে ঝিনাই নদের ওপর নির্মিত সেতুর আরো দুটি পিলারসহ ২০ মিটার দৈর্ঘ্যের অপর একটি গার্ডার গতকাল সকালে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এ নিয়ে চারটি পিলারসহ ২০ মিটার দৈর্ঘ্যের তিনটি গার্ডার বিলীন হলো। এতে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে সরিষাবাড়ী-মাদারগঞ্জের ২০ গ্রামের লক্ষাধিক মানুষ দুর্ভোগে পড়েছে।

তৃতীয় দফা বন্যায় দিশাহারা সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরের মানুষ। গত কয়েক দিনের অব্যাহত বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে জগন্নাথপুরের মানুষ নতুন করে বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। গতকাল পর্যন্ত নতুন করে শতাধিক মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছে।

এদিকে কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা, দুধকুমারসহ ১৬টি নদ-নদীর পানি আবারও বাড়তে শুরু করেছে। ফলে জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। পানিবন্দি জীবন-যাপন করছে অন্তত সাড়ে তিন লাখ মানুষ। ধরলার প্রবল ভাঙনে সদর উপজেলায় একটি পরিত্যক্ত বাঁধ ভেঙে ৪০টি পরিবারের ঘরবাড়ি বিলীন হয়েছে। অন্যদিকে তিস্তার পানির প্রবল স্রোতে ভাঙন দেখা দিয়েছে রাজারহাটের বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের রতিরাম এলাকার ক্রসবারেও। পাঁচ দিন ধরে জিও ব্যাগ ও বালুর বস্তা ফেলে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।

উজানে পানি বাড়তে থাকায় সিরাজগঞ্জের কাছে যমুনা নদীর পানি আবারও বাড়ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় সিরাজগঞ্জে যমুনার পানি ৭ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপত্সীমার ৬৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ফলে সিরাজগঞ্জে বন্যার সার্বিক পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। এদিকে যমুনার পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কাজিপুরের শুভগাছা, সদর উপজেলার সিমলা এলাকা, শাহজাদপুর ও চৌহালী উপজেলা এবং এনায়েতপুর থানার নদীতীরবর্তী অংশের কয়েকটি এলাকায় ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। দ্বিতীয় দফা বন্যায় সিরাজগঞ্জ সদর, কাজিপুর, বেলকুচি, চৌহালী, শাহজাদপুর ও উল্লাপাড়ার ৫১টি ইউনিয়নে পানি ঢুকেছে। এর মধ্যে ৩৫টি ইউনিয়নে ক্ষতি হয়েছে বেশি। এসব এলাকার আড়াই লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। আড়াই শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ ব্রিজ, রাস্তাঘাট ও বিস্তীর্ণ ফসলি জমি তলিয়ে আছে।

এদিকে শেরপুরে বন্যার পানিতে কলার ভেলায় চড়ে বান্ধবীদের সঙ্গে বেড়ানোর সময় পানিতে ডুবে এক স্কুলছাত্রীর মৃত্যু হয়েছে।

সূত্র : কালের কণ্ঠ

উপরে