যেভাবে ধরা পড়লেন ইকবাল
ইকবাল কুমিল্লার পুজাম-পে কোরআন শরীফ রেখে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সংঘষের ঘটনা ঘটান। এতে ৭ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। ৩৫ টি প্রতিমা ভাঙচুর হয়েছে। রংপুরে আগুন দেয়া হয়েছে হিন্দুদের বাড়িতে। আর সেই ইকবাল মনের সুখে কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। আর তাকে পুলিশ খুঁজে না পেলেও সমুদ্র সৈকতে ঘুরতে যাওয়া তিন বন্ধুর চোখে পড়ে যান। আর কলেজ ছাত্র তিন বন্ধুর সন্দেহ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গোয়েন্দাগিরি শুরু করেন। তাদের গোয়েন্দা গিরিতেই ধরা পড়ে ইকবাল।
তাঁরা তিনজনই নোয়াখালীর চৌমুহনী এস এ কলেজের ছাত্র। সম্প্রতি অনার্স পরীক্ষা দিয়েছেন। পরীক্ষা শেষ করে বেরিয়ে পড়েন ‘ঘোরাঘুরিতে’। শুরুতে তিনজন মিলে যান কক্সবাজারে। বেড়ানোর মধ্যে এমন একটা অ্যাডভেঞ্চারে জড়াবেন তা ভাবনাতেই ছিল না তাঁদের। সিনেমা, নাটকের মতো এই তিন তরুণ বাস্তবে মুখোমুখি হলেন তেমনই এক ঘটনার।
গত বুধবার কক্সবাজারের কলাতলী সমুদ্র সৈকতে ঘুরতে গিয়েছিলেন তিন বন্ধু। সেখানেই ঘটে ঘটনা। কিছুটা উদভ্রান্ত, আচার-আচরণও অন্য রকম এক ব্যক্তির দিকে চোখ যায় তাদের। চেনা চেনাও লাগছিল। তবে খুব বেশিক্ষণ পাত্তা দেননি তারা। সমুদ্রে নেমে পড়েন তিনজন। ওই ব্যক্তির কথা ভুলেও যান। কিন্তু পরদিন বৃহস্পতিবার আবারও ওই ব্যক্তির সামনে পড়েন। এবার সুগন্ধা সমুদ্র সৈকতে। লোকটির অদ্ভুত আচরণ, ঘোরাঘুরি অনেকের মতো তিন বন্ধুর কাছেও ধরা পড়ে। একপর্যায়ে তিনজনের একজন সাজেদুর রহমানের (অনিক) কাছে লোকটিকে চেনা চেনা মনে হয়। রহস্যভেদের চেষ্টা পেয়ে বসে তাঁদের।
সংবাদমাধ্যমে এর ছবি দেখেছেন বলে মনে হচ্ছিল তাঁর। এরপর মোবাইলে গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়া ছবির সঙ্গে ওই ব্যক্তির ছবি মেলাতে শুরু করেন তারা। সাজেদুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, আমাদের কাছে মনে হচ্ছিল কুমিল্লার পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন শরিফ রেখে আসা ব্যক্তিটিই (ইকবাল হোসেন) এই ব্যক্তি। কিন্তু পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারছিলাম না। এরপর নোয়াখালীর সহকারি পুলিশ সুপারের (এএসপি) নম্বরে ফোন করি। তিনি ফোন ধরলে পুরো বিষয়টি তাঁকে জানাই। তিনি আমাদের ফোন নম্বর রাখেন। যোগাযোগ করবেন বলে জানান।
পুলিশ সূত্র জানায়, পরে নোয়াখালীর এসপি পুরো বিষয়টি কুমিল্লার পুলিশ সুপারকে জানান। তিনি কুমিল্লার এসপিকে বলেন, কয়েকজন ছেলে বিষয়টি তাঁকে জানিয়েছেন। তবে ছেলেরা নিশ্চিত নন ইনিই ইকবাল কিনা। তবে ছেলেরা বলেছেন, গণমাধ্যমে আসা ছবির সঙ্গে এই ব্যক্তির চেহারায় মিল আছে।
কুমিল্লা জেলার পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, "নোয়াখালী জেলার পুলিশ সুপার আমাকে জানান সমুদ্র সৈকত থেকে তাঁকে ফোন করে বলা হয়েছে ইকবালের মতো একজনকে দেখা যাচ্ছে। যাঁরা ফোন করেছিলেন তাঁদের আমরা পুলিশ ঘটনাস্থলে না পৌঁছানো পর্যন্ত নজরদারিতে রাখতে বলি।" পরে কক্সবাজার জেলার পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ইকবালকে আটক করে।
ফারুক আহমেদ বলছিলেন, সমুদ্র সৈকতে যে ছেলেরা খবরটি দিয়েছিল তাদের সঙ্গে তিনি বারবার কথা বলেছেন। ইকবালকে নজরদারিতে রাখতে বলেছেন। এরপর ছেলেরা ইকবালের সঙ্গে কথা বলেছেন। ফারুক আহমেদ বলেন, ‘আমি ওদের (তিন বন্ধু) কাছে জানতে চেয়েছিলাম ইকবাল কি চায়, কি করতে চায়। ওরা জানালো খেতে চায়। তখন ওদের বলেছি, খাওয়ান, যা চায় তাই দেন, পুলিশ না পৌঁছানো পর্যন্ত আটকে রাখেন। সম্ভব হলে ইকবালে ছবি ও ভিডিও পাঠাতে বলি।’ ওরা ছবি ও ভিডিও পাঠালে সেই ছবি ও ভিডিও ইকবালের পরিবারের সদস্যদের দেখানো হয়। তাঁরা নিশ্চিত করেন ছবির ব্যক্তিই ইকবাল হোসেন। ইকবাল কোনো মোবাইল ব্যবহার করেন না। তাঁকে শনাক্ত করতে পুরোপুরি 'ম্যানুয়াল' সূত্রের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। ছবিই ছিল ভরসা। ফারুক আহমেদ বলেন, ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া ছবি পুলিশ ইকবালের পরিবারের সদস্যদের দেখায়। তারপর ই তাঁরা মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যান এই সেই ইকবাল, যাঁকে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে তাঁরা হন্যে হয়ে খুঁজছেন।
সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায় কুমিল্লার নানুয়ার দীঘির পাড়ে পূজামণ্ডপে এক ব্যক্তি কোরআন শরিফ রেখে, প্রতিমার হনুমানের গদা হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসছেন। সেটি দুর্গাপূজার মহাঅষ্টমীর (১৩ অক্টোবর) দিন। কে রেখেছেন তা ফুটেজ দেখে চিহ্নিত করে পুলিশ। কিন্তু ধরা পড়ছিলেন না ইকবাল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও বলেছেন, সন্দেহভাজন ব্যক্তি মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন না। ফলে ধরতে সময় লাগছে।
পুলিশ বলছে, পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন রাখার ঘটনার একদিন পরই এর সঙ্গে কে জড়িত তা জানতে পেরেছিল পুলিশ। এরপর শুরু হয় খোঁজ। কিন্তু পাওয়া যাচ্ছিল না ইকবালকে। অভিযানে সম্পৃক্ত পুলিশ জানায়, কক্সবাজার থেকে গ্রেপ্তারের আগ পর্যন্ত ছোট ছোট দলে পুলিশ ৩৫ থেকে ৪০ টি অভিযান করেছে। কিন্তু ইকবালকে ধরা যায়নি।