মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস
পাঁচ চিকিৎসক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানসহ গ্রেপ্তার ৯
মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় এবার পাঁচ চিকিৎসক, এক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানসহ ৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি। গ্রেফতারকৃতরা হলেন সাজ্জাদ হোসেন, ডাঃ ফয়সাল আহমেদ রাসেল, রায়হানুল ইসলাম সোহান, বকুল রায় শ্রাবণ, আবদুল হাফিজ ওরফে হাপ্পু, ডাঃ মোঃ সোহানুর রহমান সোহান ও ডা: তৌফিকুল হাসান রকি। এই ৭ জন ছাড়াও পৃথক একটি অভিযানে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ডাঃ ফয়সাল আলম বাদশা এবং ডাঃ ইবরার আলমকে। তাদের কাছ থেকে ৯টি মোবাইল ফোন,২টি ল্যাপটপ, বিভিন্ন ব্যাংকের চেক ও চেকবই, ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড উদ্ধার করা হয়েছে।
সিআইডি জানায়, মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের মামলার অব্যহত অভিযানের অংশ হিসেবে গত ১১ ডিসেম্বর থেকে গতকাল ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত দিনাজপুর, নীলফামারী, ঢাকা জেলায় অভিযান চালিয়ে মেডিকেল কলেজে প্রশ্ন ফাঁস চক্রের গুরুত্বপূর্ণ হোতা দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার ৩ নম্বর সিংড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাজ্জাদ হোসেন, নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার বিটস কোচিংয়ের পরিচালক আবদুল হাফিজ @ হাপ্পু এবং ৫ চিকিৎসকসহ ৯ জনকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে সিআইডি। গ্রেফতারকৃতদের সবাই মেডিকেল প্রশ্নফাঁসের সাথে জড়িত থাকার বিষয়ে বিজ্ঞ আদালতে ১৬৪ ধারায় দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী প্রদান করেছে। গ্রেফতারকৃত আসামীদের কাছে থেকে চক্রের অন্যান্য সদস্য ও অসাধু উপায়ে বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়া অসংখ্যা শিক্ষার্থীর নাম পাওয়া গেছে।
এর আগে এ চক্রের মাস্টারমাইন্ড জসীম উদ্দিন ভূইয়া মুন্নুর কাছে থেকে উদ্ধার হওয়া গোপন ডায়েরী থেকে সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা চক্রের সদস্যদের সন্ধান পায় সিআইডি। এ সংক্রান্তে সিআইডির প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া মহোদয় একটি সংবাদ সম্মেলন করেন এবং প্রশ্নফাঁসের সাথে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনার বিষয়ে দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ঢাকা, দিনাজপুর এবং নীলফামারির বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করে মেডিকেল প্রশ্ন ফাঁস চক্রের অন্যতম মূল হোতা সাজ্জাদ হোসেনসহ আরও ৯ (নয়) জনকে গ্রেফতার করেছে সিআইডি।
গ্রেফতারকৃত সাজ্জাদ হোসেন দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার ৩ নং সিংড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। ২০১০ সাল থেকে তিনি প্রশ্নফাঁস চক্রের সঙ্গে জড়িত। চক্রটির মাস্টার মাইন্ড জসীমের গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী। সাজ্জাদ ২০১৭ সালের মেডিকেল প্রশ্নফাঁসের অন্য আরেকটি মামলারও এজাহারনামীয় আসামী। সাজ্জাদ উত্তরবঙ্গের অসংখ্য শিক্ষার্থীকে অনৈতিক উপায়ে মেডিকেলে ভর্তি করিয়ে কোটি টাকার উপরে আয় করেছেন। পূর্বে গ্রেপ্তারকৃত একাধিক আসামী ১৬৪ এ সাজ্জাদের নাম বলেছে এবং জসীমের গোপন ডায়রীতেও তার নাম ও ফোন নাম্বার পাওয়া গেছে।
গ্রেফতারকৃত আবদুল হাফিজ @ হাপ্পু নীলফামারির সৈয়দপুর উপজেলার বিটস নামের একটি কোচিং সেন্টারের পরিচালক। এছাড়াও তিনি একটি বেসরকারি হাসপাতালের মালিক। পূর্বে গ্রেপ্তারকৃত আসামী ডাঃ জিল্লুর হাসান রনির মাধ্যমে প্রশ্ন পেয়ে দীর্ঘদিন ধরে তিনি তার কোচিংয়ের শিক্ষার্থীদের অনৈতিক উপায়ে মেডিকেলে ভর্তি করিয়েছেন। ইতোমধ্যে তাদের বেশ কিছু শিক্ষার্থীকে সনাক্ত করেছে সিআইডি।
গ্রেফতারকৃত ডাঃ সোহানুর রহমান সোহান বিট'স কোচিং সেন্টারের পরিচালক আবদুল হাফিজ @ হাপ্পুর কাছ থেকে ২০১৩ সালে প্রশ্ন পেয়ে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল ভর্তি হন। পরবর্তীতে বিসিএস স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হিসেবে পার্বতীপুরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যোগ দেন।
গ্রেফতারকৃত ডাঃ ফয়সাল আহমেদ রাসেল চেয়ারম্যান সাজ্জাদ হোসেনের মাধ্যমে ২০১০ সালে মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন পেয়ে জাতীয় মেধায় ১১তম স্থান লাভ করেন এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। এরপর যক্ষা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পে দিনাজপুর সিভিল সার্জন কার্যালয়ে সার্ভেইলান্স মেডিকেল অফিসার হিসেবে যোগ দেন। ডাঃ ফয়সাল পরবর্তীতে প্রশ্নফাঁস ব্যবসার সঙ্গেও জড়িয়ে পড়েন।
গ্রেপ্তারকৃত ডাঃ তৌফিকুল ইসলাম রকি পূর্বে প্রেপ্তারকৃত আসামী ডা: জিল্লুর হাসান রনির গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী ছিলেন। তারা দুজনই রংপুর মেডিকেল থেকে পাশ করেছেন। সেই সুবাদে প্রশ্নফাঁসের ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। রকি বিট'স কোচিংয়েও ক্লাস নিতেন। রকি, হাপ্পু এবং রনি মিলে অনৈতিক উপায়ে বেশ কিছু শিক্ষার্থীকে দেশের বিভিন্ন মেডিকেলে ভর্তি করিয়েছেন। ডাঃ রনি তার ১৬৪ এ ডাঃ রকির কথা বলে গেছেন।
রংপুর মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করা গ্রেপ্তারকৃত আসামী ডাঃ ইবরার আলমও ডাঃ জিল্লুর হাসান রনির সহযোগী ছিলেন। তার কথাও ডাঃ রনি ১৬৪ এ বলে গেছেন। ইবরার ২০১৩ এবং ২০১৫ সালের ভর্তি পরীক্ষার আগের রাতে ডাঃ রনির মাধ্যমে প্রশ্ন পেয়ে বেশ কিছু শিক্ষার্থীকে অর্থের বিনিময়ে তা সরবরাহ করেছিলেন। এদের অনেকেই বিভিন্ন মেডিকেলে চান্স পেয়েছে।
গ্রেপ্তারকৃত আসামী রায়হানুল ইসলাম সোহান এবং বকুল রায় শ্রাবণ দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার বাসিন্দা। দুজনই একই স্কুলে পড়ার সুবাদে ঘনিষ্ট ছিলেন। রায়হানুল ২০১৫ সালে তার এক মামার মাধ্যমে মেডিকেলের ফাঁসকৃত প্রশ্ন পায় এবং বকুলকে তা সরবরাহ করে। বকুল তার ৪ ভর্তিচ্ছু ছোট ভাইয়ের কাছে সেই প্রশ্ন বিক্রি করে। ৪ জনই দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়েছে।
গ্রেপ্তারকৃত ডাঃ সাইফুল আলম বাদশা ২০১০ সালে সাজ্জাদ হোসেনের মাধ্যমে প্রশ্ন পেয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। এরপর প্রশ্নফাঁস ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। ২০১৩ এবং ২০১৫ সালে তিনি একাধিক শিক্ষার্থীকে প্রশ্নফাঁসের মাধ্যমে মেডিকেল ভর্তি করিয়েছেন।
গ্রেফতারকৃতদেরকে মিরপুর মডেল থানার মামলা নং-৪৩, তারিখঃ ২০/০৭/২০২৩ খ্রি, ধারাঃ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ এর ২২(২)/৩৩ (২) তৎসহ পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইন ১৯৮০ এর ৪/১৩ এর আওতায় বিজ্ঞ আদালতে পাঠানো হয়েছে।