Main Logo
আপডেট : ১ মার্চ, ২০২৪ ১১:০৮

ইতালি যাওয়া হলো না মোবরকের : পুরো পরিবার কড়ে নিল বেইলী রোডের আগুন

নিজস্ব প্রতিবেদক
ইতালি যাওয়া হলো না মোবরকের : পুরো পরিবার কড়ে নিল বেইলী রোডের আগুন

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শাহবাজপুরের ছেলে সৈয়দ মোবারক বহু বছর ইতালী থাকেন। কিছুদিন আগে ছুটিতে দেশে এসেছিলেন। ফেরার সময় হয়েছে তার।  আর ফেরার আগে স্ত্রী–তিন সন্তানকে নিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে বেইলি রোডের কাচ্চি ভাই রেস্তোরায় খেতে গিয়েছিলেন। আর সেখানকার ভয়াবহ অগুনে  প্রাণ গেল সবার। আগুনে কেড়ে নিল পুরো একটি পরিবার। 

বেইলি রোডের যে ৭ তলা ভবনে আগুন লেগেছিল সেটির  দ্বিতীয় তলায় ‘কাচ্চি ভাই’ রেস্তোরা। তৃতীয় তলায় একটি পোশাকের দোকান ছাড়া ওপরের তলাগুলোতেও রয়েছে খাবারের দোকান। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর থেকে খাবারের দোকানগুলোতে ক্রেতাদের ভিড় হয়। অনেকেই পরিবার নিয়ে সেখানে খেতে যান।
সৈয়দ মোবারকও  গিয়েছিলেন পরিবার নিয়ে।  এ মাসেই  তাঁর ইতালি ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। নিহত ব্যক্তিরা হলেন মোবারকের স্ত্রী স্বপ্না আক্তার, মেয়ে সৈয়দা তুজ জোহরা (১৯), আমিনা আক্তার (১৩) ও ছেলে আবদুল্লাহ (৮)।
স্বপ্না আক্তারের খালাতো বোন আয়েশা আক্তার গণমাধ্যমেক জানান, তাঁদের পরিবারে আর কেউ বেঁচে নেই। পাঁচজনের সবাই মারা গেলেন। মোবারক কিছুদিন পরে চলে যেতেন। তাই সবাই মিলে খেতে বের হয়েছিলেন। এক মেয়ের এসএসসি পরীক্ষা চলছিল। সবারই ভিসা প্রসেসিং হচ্ছিল ইতালি যাওয়ার জন্য। তিনি আরো জানান. ঢাকা মেডিকেলের মর্গে চারজন এবং বার্ন হাসপাতালে একজনের মরদেহ রয়েছে। সবাইকে তাঁদের গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শাহবাজপুরে দাফন করা হবে। ঢাকার মধুবাগে তাঁদের নিজস্ব ফ্ল্যাট রয়েছে। 
রাজধানীর বেইলি রোডের ভয়াবহ আগুন থেকে ৭৫ জনকে জীবিত উদ্ধারের তথ্য জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। তবে এ ঘটনায় মারা গেছেন ৪৫ জন। যার মধ্যে অনেক নারী ও শিশু রয়েছে। এ ঘটনা তদন্ত করতে ফায়ার সার্ভিস তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।  পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয়েছে  ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যানট  কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী। সদস্য সচিব ঢাকা বিভাগের উপ-পরিচালক  মোঃ ছালেহ উদ্দিন। সংশ্লিষ্ট জোনের ডিএডি, সিনিয়র স্টেশন অফিসার এবং ওয়ারহাউজ ইন্সপেক্টর রয়েছেন সদস্য হিসেবে।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১০ টায় বেইলি রোডের কাচ্চি ডাইং নামের রোস্তোরায় আগুনের ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের ১৩ টি ইউনিটর দুই ঘন্টায় আগুন নিয়ন্ত্রনে নিতে সক্ষম হয়। এই সময়ের মধ্য আটকে পড়াদের মধ্যে থেকে ১৫ জন নারীসহ ৭৫ জনকে জীবিত উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। উদ্ধারের সময়ই তিন জনের লাশ পায় ফায়ার সার্ভিস। এর পর খোজে অচেতন ও মারা যাওয়া ব্যাক্তিদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল  কলেজ হাসপাতালে পাঠায়। আর স্বজনদের খােজে মানুষ ঢাকা মেডিকেল কলেজে যেতে থাকেন।
বৃহস্পতিবার রাত আড়াইটার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে চিৎকার করছিলেন পীযুষ পোদ্দার নামের একজন।  বেইলি রোডের একটি রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়ে আগুনে পুড়ে মারা গেছেন তাঁর বোন পপি, ভাগনে সান রায় (১০) ও ভাগনি সম্পূর্ণা রায় (১২)।  তিনি জানান, সম্পূর্ণা ও সানকে নিয়ে তাদের মা পপি রায়  বৃহস্পিতবার (২৯ ফেব্রুয়ারি)  সন্ধ্যায়  বেইলি রোডের কাচ্চি ভাই রেস্তোরাঁয় খেতে যান। সম্পূর্ণা পড়ত সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজে ষষ্ঠ শ্রেণিতে। আর সান রায় পড়ত উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের চতুর্থ শ্রেণিতে। মা–বাবার সঙ্গে মালিবাগে থাকত তারা।   রেস্তোরাঁয় আগুন লাগার খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে তিনি সেখানে চলে যান। গিয়ে দেখেন দাউ দাউ করে রেস্তোরাঁ জ্বলছে। কিন্তু কোথাও পপি, সম্পূর্ণা ও সানের খোঁজ পাননি। এরপর মধ্যরাতে ছুটে এসেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে। সম্পূর্ণা ও সানের মরদেহ খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু পপির কোনো খোঁজ পাচ্ছেন না।
বৃহস্পতিবার রাত একটার পর একে একে বেইলি রোড থেকে লাশের সারি আসতে থাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে। খবর পেয়ে হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে ছুটে আসেন নিহত ব্যক্তিদের স্বজনেরা।
একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করতেন মেহেরা কবির (দোলা)। তাঁর বোন মায়েশা কবির পড়তেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। দুই বোন মিলে মতিঝিলে থাকতেন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার দিকে মতিঝিল থেকে তাঁরা বেইলি রোডের কাচ্চি ভাই রেস্তোরাঁয় খেতে আসেন। আগুনে পুড়ে এই দুই বোনও মারা গেছেন। তাঁদের স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে হাসপাতালের বাতাস।

আগুনে পুরো পরিবার শেষ : দুই সন্তান আয়ান (৮) ও আয়াতকে (৬) নিয়ে বেইলি রোড এলাকায় বসবাস করতেন নাজিয়া আক্তার (৩১)। তাঁর স্বামী মো. আশিক পেশায় ব্যবসায়ী। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ব্যবসার কাজে বনানীতে যান। নাজিয়া দুই সন্তানকে নিয়ে ভবনের তৃতীয় তলার একটি রেস্তোরাঁয় খেতে যান। আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে তিনি স্বামীকে ফোন দিয়ে বলেন তাঁরা বিপদে আছেন।

নাজিয়ার আত্মীয় রিফাত হোসেন জানান, তিনি ঘটনার সময় ওই ভবনের সামনে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলেন। হঠাৎ ভবনটির নিচতলায় বিস্ফোরণের বিকট শব্দ শুনতে পান। মুহূর্তের মধ্যে আগুন ওপরের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। পরে তৃতীয় সিঁড়ি থেকে আয়ানের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। আগুনে মারা গেছেন নাজিয়া এবং আয়াতও। ঢাকা মেডিকেলের মর্গে তাঁদের মরদেহ রাখা হয়েছে।

 

উপরে