পাসপোর্ট তৈরীতে নজিরবিহীন জালিয়াতি বেনজীরের
পুলিশের সাবেক আইজি বেনজীর আহমেদ শুধু আর্থিক দুর্নীতিই করেননি। তিনি জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে করেছে পাসপোর্ট ‘পাসপোর্ট ও। যে পাসপোর্ট নিয়ে মিথ্যা পরিচয়ে বিশ্বভ্রমণ করেছেন। সাবেক এই আইজিপি পাসপোর্টে আড়াল করেছেন পুলিশ পরিচয়। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত তিনি সরকারি চাকরিজীবী পরিচয়ে নীল রঙের অফিশিয়াল পাসপোর্ট করেননি। সুযোগ থাকার পরও নেননি ‘লাল পাসপোর্ট’। বেসরকারি চাকরিজীবী পরিচয়ে সাধারণ পাসপোর্ট তৈরির ক্ষেত্রেও আশ্রয় নিয়েছেন নজিরবিহীন জালিয়াতির। সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের আলোচিত দুই ভাই হারিস আহমেদ ও তোফায়েল আহমেদ জোসেফ যে প্রক্রিয়ায় পাসপোর্ট করেছিলেন, সেই একই কায়দায় পাসপোর্ট নেন বেনজীর। নবায়নের সময় ধরা পড়লে আটকে দেয় পাসপোর্ট অধিদপ্তর। চিঠি দেওয়া হয় র্যাব সদর দপ্তরে। কিন্তু অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে ম্যানেজ করেন সব। পাসপোর্ট অফিসে না গিয়ে নেন বিশেষ সুবিধা।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের মতে, সরকারি কর্মকর্তারা পূর্বানুমোদন ছাড়া বিদেশে যেতে পারেন না। এটা এড়ানোর জন্য সরকারি চাকরির তথ্য গোপন করে পাসপোর্ট নেওয়াটা একটা কারণ।
অন্য কারণ হচ্ছে-বেসরকারি চাকরিজীবী হিসাবে তিনি যতটা সহজে বিদেশে ভ্রমণ, বিনিয়োগ ও স্থায়ী বসবাসের সুযোগ পাবেন, সরকারি চাকরিজীবী পরিচয়ে অফিশিয়াল পাসপোর্ট করলে সেই সুযোগ পাবেন না। কাজেই ভয়াবহ ধরনের অপরাধের পরিকল্পনা যে তার শুরু থেকেই ছিল, এটা তারই পরিচায়ক বলে ইফতেখারুজ্জামান মনে করেন।
দুদক কর্মকর্তারা বেনজির ও তার পরিবারের সদস্যদের প্রায় ৫০ বিঘা জমির তথ্য পেয়েছেন এবং ঢাকার উত্তরা ও ভাটারা এলাকায় যথাক্রমে দুটি সাততলা ভবন শনাক্ত করেছেন। ২০১৬ সালে জমির দাম বিঘা প্রতি ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা হলে বেনজীর আহমেদ ওই এলাকায় জমি কেনা শুরু করেন।
কিন্তু দলিলপত্রে তিনি জমির দাম কম দেখিয়েছেন বলে দুদকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এদিকে ভাটারার ভবনটি সম্প্রতি বিক্রি করা হয়েছে বলে দুদক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
শুধু তাই নয় গ্রাম থেকে শহর, সাগরের বুকে প্রবাল দ্বীপ ও সংরক্ষিত বনের পর এবার পাহাড়েও সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের বিপুল পরিমাণ জমির খোঁজ মিলেছে। পার্বত্য আইন অমান্য করে বান্দরবানে নিজের ও স্ত্রী-কন্যার নামে শত একরের বেশি জমি কিনেছেন তিনি। আর এই জমিতে গড়ে তুলেছেন খামারবাড়ি ও বাগান। পাহাড়ে বেনজীরের এসব সম্পত্তি দেখাশোনা করেন বান্দরবান জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মং ওয়াইচিং মারমা এবং বান্দরবান সদর থানার ডিবির সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তফিজুর রহমান। স্থানীয়দের অভিযোগ, এ দুজনই ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে বেনজীরকে এসব জায়গা দখল করে দিয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, লিজের জমি ক্রয় ও বিক্রয় নিষিদ্ধ থাকলেও বান্দরবান পৌরসভার মধ্যমপাড়া এলাকার আবুল কাশেমের ছেলে শাহ জাহানের কাছ থেকে সদর উপজেলার সুয়ালক মৌজায় ৬১৪ নম্বর দাগের ৩ নম্বর সিটে ২৫ একর জমি স্ত্রী জীশান মির্জা, বড় মেয়ে ফারহিন রিস্তা বিনতে বেনজীর এবং ছোট মেয়ে তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীর ও নিজের নামে লিখে নিয়েছেন বেনজীর আহমেদ। ওই জমিতে গড়ে তোলা হয়েছে গবাদি-পশুর খামার, মৎস্য প্রজেক্ট, ফলদ বৃক্ষ ও সেগুনবাগান এবং বিলাসবহুল একটি খামারবাড়ি। এ ছাড়া বান্দরবানের লামা উপজেলার সরই ডলুছড়ি মৌজার টংগ ঝিরিতে অর্ধশত একর এবং জেলা সদরের সুয়ালক ১ নম্বর ওয়ার্ডের হরিণঝিরি এলাকায় আরও ৪০ একর জায়গা কিনেছেন বেনজীর।
সরেজমিন সুয়ালকে দেখা যায়, জেলা সদরের সুয়ালকের মাঝের পাড়ার চা অফিস থেকে পৌনে ১ কিলোমিটার দূরে ২৫ একর জমিতে গড়ে তোলা হয়েছে বেনজীরের ওই খামারবাড়ি। সেই খামারে এখন বিদেশি জাতের ৩৭টি গবাদিপশু আছে। আরও আছে বিভিন্ন ফল ও ফুলের বাগান, শীতাতপনিয়ন্ত্রিত দোতলা পাকা দালান। কিছুদিন আগেও এই খামারের ত্রিসীমানায় যাওয়া যেত না। বেনজীর র্যাবপ্রধান থাকা অবস্থায় সেখানে ডিবির সাবেক ওসি মোস্তফিজুর রহমানসহ বেশ কয়েকবার তিনি ঘুরে যান বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।
সুয়ালকের খামারবাড়িটি দেখাশোনা করেন লেদু মিয়া নামের এক ব্যক্তি। তিনি জানান, বেনজীর আহমেদের এই খামারে ১ মাস ধরে গরুগুলো দেখাশোনা করছেন তিনি। এই কাজের জন্য বেনজীরের পক্ষে তাঁকে বেতন দেন জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি ওয়াইচিং মারমা।
অন্যদিকে লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের ডলুছরি টংগো ঝিরি বাগানের কেয়ারটেকার মো. ইব্রাহিম আজকের পত্রিকাকে বলেন, বেনজীর আহমেদের ৫৫ একর জায়গা দেখাশোনা করছেন তিনি। তাঁকে আগে মং ওয়াইচিং মাসিক বেতন পরিশোধ করলেও ৫ মাস ধরে কোনো বেতন পরিশোধ করছেন না।
বান্দরবানে বেনজীরের সম্পত্তি দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা মং ওয়াইচিং জানান, সুয়ালকের মাঝের পাড়ায় নিজের জায়গার পাশে বেনজীর আহমেদের ২৫ একর জায়গা থাকার কারণে সেগুলো তাঁকে দেখাশোনার দায়িত্ব দেন বেনজীর। তবে লামার জায়গাজমি-সংক্রান্ত কোনো তথ্য তাঁর কাছে নেই বলে জানান জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের এই নেতা।
১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চুক্তি অনুসারে, পার্বত্য জেলার স্থায়ী বাসিন্দা না হলে বাইরের কেউ পার্বত্য চট্টগ্রামে গিয়ে জমি কিনতে পারবেন না। বেনজীর আহমেদ জন্মসূত্রে গোপালগঞ্জের স্থায়ী বাসিন্দা হয়েও কীভাবে সেখানে জমি কিনলেন, সে প্রশ্ন উঠেছে এখন।
এই বিষয়ে বান্দরবান বোমাং রাজার সহকারী অংঝাই খ্যায়াং আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘জমি ক্রয় করতে বোমাং রাজার স্থায়ী বাসিন্দার সনদ, এনআইডি, পৌরসভার নাগরিক সনদ ও মা-বাবার নামে মৌজার জমি থাকলে তাঁরা জমি ক্রয় করতে পারবেন। এই ক্ষেত্রে বেনজীর কীভাবে জমি ক্রয় করেছেন, তা আমার জানা নেই।’
সুয়ালকের ইউপি চেয়ারম্যান উ ক্য নু মারমা বলেন, ‘সুয়ালক মৌজার মাঝের পাড়ায় বেনজীর আহমেদের জায়গা আছে, তা আমি জানি। মাঝে মাঝে একজন এসপি ও সাবেক ওসি এখানে আসেন। সম্প্রতি বাগানটির গাছ বিক্রির জন্য জোত পারমিট করা হয়েছে।’
বান্দরবান জেলা প্রশাসক শাহ্ মোজাহিদ উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, বান্দরবানে বেনজীর আহমেদের জায়গাজমির তথ্য বা জবরদখল-সংক্রান্ত কোনো বিষয় জানা নেই। এই বিষয়ে তদন্ত সাপেক্ষে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
দেশ ছাড়ার আগে ভাটারার সাততলা বাড়ি বিক্রি করেন বেনজীর দুর্নীতির অভিযোগ মাথায় নিয়ে দেশ ছেড়েছেন সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ। তবে দেশ ছাড়ার আগে তিনি নিজের নামে থাকা ঢাকার একটি সাততলা বাড়ি বিক্রি ও ব্যাংক থেকে প্রায় ১৫ কোটি টাকা উত্তোলনের খবর পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা আজকের পত্রিকাকে এসব তথ্য জানিয়েছেন।
দুদকের তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রটি জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বেনজীর আহমেদের ব্যাংকিং লেনদেনের পুরো তথ্য পাওয়া যায়নি। সেটা পাওয়া গেলে তিনি ব্যাংক থেকে কী পরিমাণ অর্থ উত্তোলন করেছেন, সেগুলো কোথায় রেখেছেন, অবৈধ পন্থায় বিদেশে পাচার করেছেন কি না এবং তাঁকে অর্থ পাচারে কারা সহযোগিতা করেছে, তা খতিয়ে দেখবে দুদক।
এদিকে রাজধানীর ভাটারা এলাকায় বেনজীরের নামে থাকা একটি সাততলা বাড়ি বিক্রি করেছেন বলে প্রমাণ পেয়েছে দুদক। তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রটি জানায়, দুদকের অনুসন্ধান শুরু হওয়ার পরই বাড়ি বিক্রি করে দেন বেনজীর আহমেদ।
গত ২৮ মে বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নোটিশ দেয় দুদক। নোটিশে ৬ জুন (বৃহস্পতিবার) সকাল ১০টায় তাঁকে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদক প্রধান কার্যালয়ে উপস্থিত হতে বলা হয়েছে। ৯ জুন তাঁর স্ত্রী ও দুই মেয়েকেও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করা হয়। কীভাবে তিনি এই বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়েছেন, সেই বিষয়ে তাঁকে সশরীরে উপস্থিত হয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে নোটিশে।
এ অবস্থায় তিনি দুদকের তলবে হাজির না হলে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর জজ আদালতে দুদকের প্রসিকিউটর মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর বলেন, উনাকে (বেনজীর) যে চিঠি দেওয়া হয়েছে, সেখানে তাঁর উপস্থিতির বিষয়ে বলা থাকলে বক্তব্য দিতে উনাকেই আসতে হবে। আবার আইনজীবী বা প্রতিনিধির মাধ্যমে যদি বক্তব্যের বিষয়ে বলা হয়ে থাকে, তাহলে সেভাবেই বক্তব্য দিতে পারেন। আমার মনে হয়, উনার সশরীরেই উপস্থিত হয়ে উনার বিরুদ্ধে যেসমস্ত অভিযোগ, সেগুলো সঠিক নাকি মিথ্যা, জানানো উচিত।’
বেনজির আহমেদের ব্যাংক হিসাব জব্দের আগে ওই অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তোলা হয়েছে এবং এক্ষেত্রে ব্যাংক কর্মকর্তাদের গাফিলতি খুঁজে পেয়েছেন দুদক কর্মকর্তারা। দুদক জানায়, বেনজিরসহ অন্যদের অবৈধ সম্পদের সন্ধান পেলে কমিশন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। তার সম্পদের সুবিধাভোগীদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এরমধ্যে বেনজির বর্তমানে কোথায় আছেন সেই বিভ্রান্তির মধ্যে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ইঙ্গিত দিয়েছেন যে তিনি এখন বিদেশে থাকতে পারেন। তিনি দুর্নীতির দায়ে দোষী সাব্যস্ত হলে তাকে দেশে ফিরতে হবে, সরকার এ বিষয়ে আপস করবে না বলেও তিনি জানান।