Main Logo
আপডেট : ২৮ মে, ২০২০ ১৯:২২

উপন্যাস

নিশি কথা

ওমর ফারুক

নিশি কথা

০১

পূবে সূর্য উঠলেও বরাবরের মতো দেখা যায়নি আজও। আশপাশের বিল্ডিংয়ের ফাক গলে নাহিদ আহমেদের বাসার বেলকনি ছুতে পারে না রোদ। অথচ এই রোদটা খুব প্রিয় নাহিদ আহমেদের। দো’তলা বাড়িটা যখন তিনি বানিয়েছিলেন তখন চারপাশ বলতে গেলে খালিই ছিল। সে সময় শুধু বেলকনীতে নয় ঘরের ভেতর পর্যন্ত রোদ খেলা করতো। গত ১০ বছরে তার বাড়ির চারদিকে ছ’তলা ১০ তলা ভবন উঠেছে। এর পর থেকেই তার বাড়ির বেলকনী থেকে রোদ পালিয়েছে। এ নিয়ে প্রথম প্রথম খারাপ লাগলেও এখন মানিয়ে গেছে নাহিদ আহমেদের।
আজ সকাল থেকেই চির চেনা বাড়িটা তার কাছে অচেনা লাগছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। সকাল ছাড়িয়ে দুপুরের দিকে যাচ্ছে সময়। সূর্য বাড়িয়েছে তার প্রখরতা।
কিন্তু নাহিদ আহমেদের কাছে যেন সূর্যটা ডুবে যাচেছ অথবা পূর্ণ গ্রাস হচ্ছে। এমনতো তার কোনদিন হয় না। বিষয়টি ভাবতে গিয়ে হোচট খান তিনি। আবারও খবরের কাগজটা হাতে নেন। তিন নম্বর পাতায় চোখ বুলান। নিচের দিকেই একটি বক্স আইটেমের মধ্যে তার মেয়ে নিশির ছবি। ছবির ঠিক নিচে লেখা ‘একে ধরিয়ে দিন।’ 
প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেননি নাহিদ আহমেদ। কম করে হলেও ১০ মিনিটের মতো তিনি তাকিয়ে ছিলেন ছবিটির দিকে। ৫০ বারের বেশি পড়েছেন নিচের লেখাটি। এরপরও বিশ্বাস হয় না তার। তার মেয়ের ছবি পত্রিকায় থাকবে কেন? কেনই বা ধরিয়ে দেয়ার বিজ্ঞাপন থাকবে? তা হলে কি তার মেয়ে ক্রাইমের সঙ্গে জড়িয়েছে? তার মেয়ে ক্রাইমের সঙ্গে জড়াতে পারে এওকি তাকে বিশ্বাস করতে হবে?
অবশেষে শান্তি খুঁজে পান নাহিদ আহমেদ। ভাল করে চোখ বুলিয়ে মনে মনে সিদ্ধান্ত নেন এ ছবিটি তার মেয়ের নয়। হয়তো দেখতে একই রকম হওয়ায় ছবিটি তার মেয়ের মনে হচেছ। গতকাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফেরার পর থেকেইতো নিশি বাড়িতে। তার সামনেই ঘোরাফেরা করেছে। রাতে দু’জন বেলকনীতে বসে চা খেয়েছে। নাহিদ আহমেদকে একটা গানও শুনিয়েছে নিশি। গান বলতে বাথ রুম সিঙ্গার যাকে বলে। কিন্তু এই গলাই নাহিদ আহমেদের ভাল লাগে। মেয়েও তার আবদার রক্ষা করে। গান শেষে  রাত ১২ টার দিকে মা মেয়ে ঘুমাতে গিয়েছে। সকালে উঠেই পত্রিকায় কেন দেখা যাবে ‘একে ধরিয়ে দিন’ বিজ্ঞাপন। তার বদ্ধমূল ধারনা হয় ছবির মেয়েটা দেখতে নিশির মতো। তবে নিশি নয়।
এরই মধ্যে দু’বার নিশির ঘরে উকি দিয়ে এসেছেন নাহিদ আহমেদ। দেখেছেন নিশি কোল বালিশ জড়িয়ে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। শান্তির ঘুম। এমন ঘুম নাহিদ আহমেদ অনেক দিন ঘুমাননি। যে কারনে মেয়েকে ডাকতে গিয়েও ডাকেননি। এ ছাড়া ঘুম থেকে ডেকে তুললে নিশির মেজাজ খারাপ হয় সে বিষয়টাও মনে পড়ে তার। 
পরের বার নাহিদ আহমেদ পত্রিকার পাতাটা নিয়েই নিশির ঘরে গিয়েছিলেন।  পত্রিকার ছবি ও মেয়ের মুখের দিকে বারবার তাকাচ্ছিলেন। কখনো মনে হচিছল এটা নিশির ছবিই। আবার মনে হচ্ছিল না। নিশির ঘরের জানালার পর্দা পড়া থাকায় মুখটা পুরোপুরি দেখাও যাচিছল না। নাহিদ আহমেদ লাইট জ্বালানোর সাহস পেলেন না। তিনি জানেন লাইট জ্বালানোর সঙ্গে সঙ্গেই নিশি জেগে যাবে। আর সারাটা দিন চিৎকার চেচামেছি করবে। সংসারের অশান্তি চান না তিনি। এর আগে একবার মেয়েকে ডেকে তুলে এই বিপত্তিতে পরেছিলেন।
বেলকনীর চেয়ারটাকেও আজ নাহিদ আহমেদের অচেনা মনে হচ্ছে। চেয়ারটাও যেন তাকে দেখে উপহাস করছে। দেখেই সরে যেতে চাইছে। কিন্তু যখন মনে মনে স্থির হলেন ছবিটা তার মেয়ের নয়-নিশ্চিত অন্য কারো তখন সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে আসতে থাকলো।
নাহিদ আহমেদ চেয়ারে বসে পত্রিকার অন্য পাতাগুলোতে চোখ বুলাতে লাগলেন। খেলার পাতায় বাংলাদেশের মাশরাফি বিন মর্তুজা ও  মোহাম্মদ আশরাফুলের আইপিলে যোগ দেয়া ও কত ডলারে বিক্রি হলো সে বিষয়টি পড়ায় মনোযোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু এরপরও তার সেই তিন নম্বর পাতায় যেতে ইচ্ছে করে। এই সংবাদে তার মন টানে না। সত্যিই কি মেয়েটার ছবি নিশির কিনা আরও একবার নিশ্চিত হতে চান। পরক্ষনই সিদ্ধান্ত  নেন তিনি তিন নম্বর পাতাটা  আর খুলবেনই না। 
মিনিট দশেক পরই তার মোবাইল ফোন বেজে উঠে। মনিটরে ভেসে উঠে বন্ধু তারিকের নাম। খুশি হন নাহিদ আহমেদ। তারিক অনেক দিন পর ফোন করেছে। কত বছর এক সঙ্গে তারা পড়াশোনা করেছে। চাকরিও করেছে এক সঙ্গেই। অবসরে যাওয়াটাও এক সঙ্গে। তাদের দু’জনের পরিবারেই মাত্র একটি করে সন্তান। দু’জনের স্ত্রীই ব্যাংকে চাকরি করেন। দু’জনই চায়ের চেয়ে কফি খেতে বেশি পছন্দ করেন। দু’জনের বাড়িও দো’তলা। একই নামের পত্রিকা পড়েন দু’জনই। পত্রিকা বদল করলে একসঙ্গেই বদলান। দু’জনের অদ্ভুদ মিল। শুধু দু-একটা অমিল আছে। এর একটা নাহিদের মেয়ে আর তারিকের ছেলে।
তারিকের কণ্ঠে করুনার সুর-‘দোস্ত ঠিক আছিস তুই?  প্রশ্ন শুনে আৎকে উঠেন নাহিদ আহমেদ।
‘কেন কি হয়েছে আমার’ গলা কেপে উঠে নাহিদের।
‘ না না, তোর কিছু হয়নি। পত্রিকা পড়েছিস আজ?’
‘হাঁ পড়েছি, কেন কি হয়েছে?’
‘না মানে ইয়ে’-আমতা আমতা করতে থাকেন তারিক। 
‘কি হয়েছে আমতা আমতা করছিস কেন?’
‘না মানে, আজকের পত্রিকায় বিশেষ কোন ঘটনা চোখে পড়েছে তোর?’
‘খুলে বলতো তুই কি হয়েছে?’
এ প্রশ্ন শুনে তারিক নিশ্চিত মেয়ের সংবাদ পড়া হয়নি নাহিদের। কিন্তু এমন একটা সংবাদ তিনি কি করে দেবেন-ইতস্তত করছিলেন। এ ছাড়া নাহিদের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে। কি থেকে কি হয়ে যায়। যদি কিছু হয়ে যায় তা হলে নিজেকে অপরাধী মনে হবে। তারিক বুদ্ধি খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন। হঠাৎ তিনি বললেন-
‘নাহিদ তুই পত্রিকার তিন নম্বর পাতার নিচের দিকে তাকিয়ে দেখ একটি বিজ্ঞাপন আছে। সেই বিজ্ঞাপনটি দেখার পর আমি তোর সঙ্গে কথা বলছি’
‘ওহ এই কথা। আমি দেখেছি। ছবিটা আমার মেয়ের মতো মনে হয়তো? আরে না সে আমার নিশি না। দেখতে তার মতো।’
‘তাই’ স্বস্থির নিশ্বাস ছাড়লেন তারিক। 
তবে তিনি চমকে গেছেন। তিনি তা হলে ভুল দেখলেন। এমন ভুলতো তার কখনো হয় না। তা হলে তার চোখের পাওয়ার আরও কমে গেছে। হয়তো তাই হবে। ভাবলেন, নাহিদ যেহেতু বলেছে তাহলে তার মেয়ের ছবিই নয় এটি। আবারও তিনি চশমার কাচ পরিস্কার করে পত্রিকার পাতায় চোখ বুলালেন। কিন্তু তার কাছে নিশিই মনে হচ্ছে। কিন্তু নাহিদের কেন মনে হচ্ছে না তাই নিয়ে আবার চিন্তায় পড়ে গেলেন তারিক। 
এবার মোবাইল ফোন নয় বেজে উঠেছে ল্যান্ড ফোন।  নাহিদ আহমেদ ফোন ধরতে দেরি করলেন না। 
ফোনটি করেছে নিশির বান্ধবী নিলি। সেই ফোনেও নিশির খোঁজ নেয়। নাহিদ আহমেদের কাছ থেকে জানতে চায় নিশির কোন সমস্যা হয়েছে কি না। পর পর আরও ক’টি ফোন রিসিভ করেন নাহিদ আহমেদ। সবারই পশ্ন প্রায় একই ধরনের। 
নাহিদ আহমেদ তার বিশ্বাস থেকে সড়ে আসেন। তিনিও নিশ্চিত এ ছবি নিশিরই। তা না হলে সবাই কেন ফোন করে জানতে চাইবে? সবাইতো আর ভুল করতে পারে না। নিশি কখন ঘুম থেকে উঠবে সে কারনে এ রুম ও রুম পায়চারি শুরু করেন নাহিদ আহমেদ। 
নাহিদ আহমেদ ভাবনায় আসে কোন পাপের কারনেই হয়তো আজ এই পরিণতি। তার মেয়ে বিপথগামী হয়েছে। ছবি উঠেছে পত্রিকায়। কিন্তু কি পাপ তিনি করেছেন বুঝে উঠতে পারেন না। জীবনে কারো কাছ থেকে দু’টাকা ঘুষ নিয়েছেন তাওতো মনে করতে পারছেন না। কারো উপকার করতে না পারলেও অপকার করেছেন তাও মনে পড়ে না। সরকারি বড় কর্মকর্তা হয়েও বাড়ি বানিয়েছেন গ্রামের বাড়ি থেকে জমি বিক্রি করা টাকায়। অথচ তিনি শুনেছেন তার অফিসের পিয়নেরও নাকি ঢাকায় ৬ তলা ৮ তলা বাড়ি আছে। তবে কোন পাপে আজ তার মেয়ে বিপথ গামী? বাবা-মা’র পাপ নাকি সন্তানদের ছুয়ে যায়-এমন বিশ্বাস তার। পাপ-পূণ্যের হিসাব মিলাতে গিয়ে ঘামতে থাকেন তিনি।
 
০২
নাহিদ আহমেদের স্ত্রী জবা আহমেদ ব্যাংকের বড় চাকুরে। প্রতিদিন সকাল ৮টায় বাসা থেকে বের হন ব্যাংকের উদ্দেশ্যে। আজও তার অন্যথা করেননি। বাড়িতে সকাল ৮ টার দিকে পত্রিকা এলেও তিনি পত্রিকার হেডলাইন গুলো ছাড়া আর কিছু পড়ার সুযোগ পান না। ভেতরের পাতাগুলো কাজের ফাকে অফিসেই পড়ে থাকেন। আজও তৈরি হতে হতে পত্রিকার প্রথম পাতার খবরের শিরোনামগুলো দেখে নাহিদ আহমেদের কছে দিয়ে বেরিয়ে যান।
অফিসে ঢোকার পর সবাই যেন কি একটা বিষয় নিয়ে বলাবলি করছিলেন। জবা আহমেদ ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই চুপ করে গেলেন সবাই। বিষয়টা ভাল ঠেকেনি তার কাছে। কিন্তু কি নিয়ে তারা আলোচনা করছিলেন সে বিষয়টি জানার আগ্রহ বোধ করেননি জবা। কারো কোন বিষয়ে নাক গলাতে তিনি একদমই পছন্দ করেন না। এসব নিয়ে ভাবতেও ভাল লাগে না তার। তিনি জানেন, বেশিরভাগ মানুষই ফিসফাস করে কথা বলতে পছন্দ করে। অফিসে কোন একটা ঝামেলা হলে তা নিয়ে সমালোচনার শেষ থাকে না। এক জনের কাছ থেকে আরেকজন শোনার জন্য অতি আগ্রহে চেষ্টা করে। কেউ কেউ কাজ ফেলে রেখে ক্যান্টিনে গিয়ে চায়ের কাপে ঝড় তুলে। সেখানেও আবার কয়েকটি ভাগে ভাগ হয়। সেখানে বুঝা যায় কোন সহকর্মীর সঙ্গে কার খুব মিল, বিশ্বাস। বিশ্বাসী লোক না হলে গসিপিং করে মজাও নেই। যদি কোন কথা বলতে গিয়ে ভেটো আসে তা হলে গসিপিংয়ের মজাটাও থাকে না। এসব বিষয় ব্যাংকে যোগদানের পর থেকেই দেখছেন তিনি। ২৫ বছরে এসব তার গা সওয়া হয়ে গেছে। তবে ফিসফিসানি, গসিপিং একদম অপছন্দ জবার। তবে কাউকে তিনি তার অপছন্দের কথা বলেননি। তাতে কী! সহকর্মীরাতো আর মুর্খ নন। এ কারনেই তারা কোন গসিপিংয়ে জবার সঙ্গে শরিক হন না। আজও অফিসের কোন ঘটনা নিয়ে হয়তো তারা গসিপিং করছিল। জবা  তার টেবিলে বসেই ফাইল নাড়াচাড়া শুরু করেন। 
জবার পাশের টেবিলেই বসেন সিনিয়র অফিসার  হায়াৎ আলী। তিনি একবার তার মেয়ের কথাটা উঠাতে গিয়েও নিজেকে সামলে নেন। তবে হায়ৎ আলী জানেন, জবা আর কারো সঙ্গে বিষয়টা শেয়ার না করতে চাইলেও তার সঙ্গে করবে। আধাঘন্টার বেশি হয়ে গেল কিন্তু জবা কোন কথাই বলছে না। তা হলে নিশ্চয়ই তার মনটা আজ ক্ষুব্দ। যদি তার মেয়েকে নিয়ে এমন একটি বিষয় ছাপা হতো তা হলে তার কেমন লাগতো। মনে মনে আন্দাজ করার চেষ্টা করছেন হায়াৎ আলী। অন্য টেবিল থেকেও কোন কোন অফিসার বার বার তাকাচ্ছিলেন জবার দিকে। বিষয়টি জবার চোখে পড়ে। একবার মনে হয় কপালের টিপটা বোধ হয় ঠিক জায়গায় বসানো হয়নি। সেটাই সবাই দেখছেন বারবার। এতো ব্যস্ততার মধ্যে যখন বাসা থেকে বেরিয়ে আসতে হয় তখনতো টিপটা ঠিক জায়গায় বসতে নাও পারে। তাতে এতো দেখার  কি আছে? এক পর্যায়ে তিনি নিশ্চিত হওয়ার জন্য ফ্রেস রুমে যান। আয়নায় দেখতে পান না সব ঠিক আছে। বরং অন্যদিনের চেয়ে আজই তাকে বেশি সুন্দরী লাগছে। তা হলে কি তার সহকর্মীরা তার সৌন্দর্য্য দেখছে। এই বুড়– বয়সে সৌন্দর্য্য দেখারই বা কি আছে- ভেবে কোন কুল কিনারা করতে পারেন না জবা।
আয়নায় চোখ ফেলে খানিক হেসে ফেলেন জবা। ২৫ বছরে দু’বার কপালের টিপটা ফ্রেস রুমের আয়নায় গিয়ে দেখলেন তিনি। প্রথম বারের কথা তার মনে পড়ে যায়। সে দিনটির কথা মনে হতেই আরো কিছুক্ষন নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করলো তার। জবার স্পষ্ট মনে আছে সেদিনটির কথা। ব্যাংকের ক্যাশ কাউন্টারে বসে টাকা দিচ্ছিলেন লোকজনকে। হঠাৎ এক যুবক টাকা নিতে গিয়ে তার দিকে অপলক তাকিয়ে ছিলো। যা বিরুক্তির উদ্রেক করার কথা কিন্তু সেদিন মোটেও বিরক্ত হননি জবা। বরং তিনিও এক ফাকে যুবককে নয়নভরে দেখে নিয়েছিলেন। এর পর টাকা নিয়ে যুবক চলে যায়। ব্যাংকের প্রধান গেট পেরুনোর আগেও একবার পেছন ফিরে তাকিয়েছিল সেই যুবক। সেদিন জবার মনে পড়েছিল কি এমন সৌন্দর্য তার মধ্যে দেখতে পেল ওই যুবক। এই কারনে জবা কিছুক্ষন পরই ফ্রেস রুমে গিয়ে আয়নায় নিজের চেহারাটা দেখে ছিলেন। সেদিন তার কপালের টিপটা ঠিক আজকের মতো ছিল। আজকের মতোই সুন্দরী লাগছিল তাকে।
যুবক চলে যাওয়ার দু’দিন পর আরেক যুবক এসে সরাসরি ব্যাংকের ম্যানেজারের কাছে গিয়েছিল। বন্ধুর জন্য জবাকে পছন্দ হয়েছে এমন কথা অকপটে বলে ফেলতেও দ্বিধা করেনি সে। স্পষ্টভাসি যুবককে বেশ পছন্দ হয়েছিল ব্যাংক ম্যানেজারের। যুবক ম্যানেজারকে জানিয়েছিল ব্যাংকের সুন্দরী মেয়েটিকে তার বন্ধুর পছন্দ হয়েছে। তার বন্ধুটি বড় পদে সরকারি চাকরি করে। পাত্র হিসেবেও খারাপ না। ব্যাংক ম্যানেজার খুশি হয়েই ঘটকালি করেছিলেন সেদিন। আর বড় কর্মকর্তা নাহিদ আহমেদের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন জবাকে। পরবর্তীতে জবা জানতে পেরেছিলেন, নাহিদ আহমেদ তাকে দেখেই পছন্দ করে ফেলেছিলেন।  কিভাবে কি করা যায় তা নিয়ে পরামর্শ করেছিলেন বন্ধু তারিকের সঙ্গে। তারিকই ম্যানেজারের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে গিয়েছিলেন। বিয়ের পর থেকে তারিকও জবার বন্ধু বনে যায়। তবে তারিক তাকে ভাবী বলেই সম্বোধন করে। হঠাৎ জবার সম্বিত ফিরে। মনে পড়ে টেবিলে অনেক কাজ পড়ে আছে। দ্রুত তিনি ফ্রেস রুম থেকে নিজ টেবিলে গিয়ে বসেন।  
আরও একবার জুনিয়ার অফিসার মনির হাসান তার দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলেন খাতার দিকে। বিষয়টি চোখে পড়ে জবার। তার তাকানোটা সুবিধের মনে হয়নি জবার কাছে। মনির অন্যদিন তাকে দেখেই দাড়িয়ে সালাম দেয়। আজ টেবিল থেকে নড়লই না। তা ভেবেও খটকা লাগে জবার। অথচ মনিরের সঙ্গে  নিশির বিয়ের কথা বার্তা চলছে।
যখন থেকে কথা বার্তা শুরু হয়েছে তখন থেকেই তাকে শ্বাশুরির মতোই সম্মান করে মনির। আজ এমন কি হলো যেন সব পাল্টে যাচ্ছে। তা হলে কি গতকাল কোন কাজে জবা ভুল করে গেছে। তাতে ব্যাংকের সুনাম নষ্ট হওয়াসহ ক্ষতিও হয়েছে। কিন্তু এমনতো হওয়ার কথা নয়। ক্যাশ মিলানোর পর তিনি বেরিয়েছেন। ম্যানেজার সাহেব তাকে ডেকে বরং কাজের প্রশংসাই করলেন। বললেন, বয়স হলেও কাজে কোন ধরনের অলসতা তিনি জবার মধ্যে দেখতে পান না। এমন যদি সব অফিসারই হতো তা হলে জন বল আরো কম দিয়েও ব্যাংক চালানো যেতো। 
কাজে মনোযোগ দেন জবা আহমেদ। অনেক ফাইল তার সামনে। গতকাল সব কাজ শেষ করে যেতে পারেননি। তিনি একের পর এক ফাইলে চোখ ফেলতে শরূ করলেন। 
ঠিক ওই সময় তার মোবাইলে ফোন আসে। টেবিলের এক পাশে রাখা ব্যাগের ভেতর মোবইলটা বেজে উঠে। বিরক্ত হন জবা। প্রতিদিন তিনি রিংগার সুইচ অফ করে কাজ শুরু করেন। আজ কেন যে করলেন না এ জন্য নিজের উপরই রাগ হচ্ছিল তার। শব্দটা শুধু তাকে নয় অন্যদেরও কানে লাগে। 
পাশের টেবিল থেকে হায়াৎ আলী বললেন-
‘আপা আপনার ফোন বাজছে’। হায়াৎ আলীর কথায় ব্যাগ থেকে মোবাইল ফোন বের করেন। তার ইচ্ছে ছিল যেই ফোন করুক না ধরে সুইচ স্টপ করে দেবেন। কিন্তু মনিটরে দেখতে পান তারিকের নাম ভাসছে। এই ফোনটা তাকে ধরতেই হবে। কেন না তারিকের ফোন তিনি ধরেননি এমন ঘটনা মনে করতে পারছেন না। অনিচ্ছা সত্বেও ফোনটি ধরলেন তিনি।
‘হ্যালো- স্লামালেকুম’- তার গলা স্বাভাবিক। চমকে যায় তারিক। মেয়ের এতো বড় সমস্যা হচ্ছে আর তার বাবা-মা নাকি স্বাভাবিক আচরন করছে! অথচ তারিক নিজেই জ্বলে পোড়ে মরছে। 
‘ভাবী, ভাল আছেন।’
‘ভাল আছি ভাই’
‘আপনি কি অফিসে?’
প্রশ্ন শুনে রসিকতা করতে ইচ্ছে করলো জবা আহমেদের
‘অফিসে নয়তো কোথায়। আপনার বন্ধু কি আমাকে নিয়ে মঙ্গল গ্রহে ঘুরতে যাবেন নাকি। তারিক ভাই জরুরী কোন কাজে ফোন করেছেন?’
কি বলবে তারিক ভেবে পাচ্ছেন না। তিনি নিশির বিষয়টা তার সঙ্গে তুলবেন সে সাহস হলো না। তারিকও স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলেন-
‘না ভাবী আপনার কথা মনে পড়লো তাই ফোন করা। ভেবে ছিলাম আপনি বাসায় আছেন। নাহিদের সঙ্গে একটু কথা বলা দরকার। তার ফোনটা বন্ধ পেয়ে আপনাকে ফোন করলাম’
‘বলেন কি তার ফোনতো কখনো বন্ধ থাকে না। আমি দেখছি।’
‘না না ভাবী আপনার এই ব্যস্ত সময়ে তাকে ফোন করার দরকার নেই। আমার মনে হয় নেটওয়ার্কে প্রবলেম। যা হয়েছে না এই ফোন কোম্পানীগুলোর। ফোন খোলা থাকলেও অনেক সময় বলে ক্যাননট বি রিজড এট দিস মোমেন্ট, অথবা আপনার নাম্বারটি সঠিক নয় ইত্যাদি’
‘ঠিকই বলেছেন।’
‘আমি আবার নাহিদকে ট্রাই করছি। আপনি কাজ করুন।’
‘জ্বি ঠিক আছে। স্লামালেকুম’ 
ফোন কাটেন জবা আহমেদ। তার মনে সন্দেহ দানা বেধে উঠেছে। তারিকতো জেনে শুনেই তাকে ফোন করেছে। কিছু একটা বলতে চেয়েছিল। কিন্তু বললো না কেন। কোন সমস্যা হয়েছে নাকি তার পরিবারে? কোন সমস্যা হলেইতে এই লোকটি এগিয়ে আসেন। তাদের পরিবারের সমস্যাকে নিজের সমস্যা মনে করেন। সুসময়ে তার যোগাযোগ কম থাকলেও দু:সময়ে ঝাপিয়ে পড়েন। এমন লোক পৃথিবীতে ক’জন আছে হয়তো হিসাব করে বের করা যাবে। 
অফিসে ঢোকার সময় লোকজনের ফিসফিসানি চোখে পড়েছে তার। হায়াৎ আলী, মনিরের তাকানোটাও সুবিধের মনে হয়নি। তাদের আচরন মনে হয়নি আর দশটা দিনের মতো। নিজে নিজে হিসাব মিলানোর চেষ্টা করছেন জবা আহমেদ। কিন্তু কি ঝামেলা হয়েছে সেটা তিনি বুঝে উঠতে পারছেন না।  
তিনি কিছু হয়েছে কি না তা জানার জন্য নাহিদকে ফোন করেন। কিন্তু তার ফোন ব্যস্ত। জবা আহমেদ ফোনটি বন্ধ করে বিড়বিড় করতে করতে ব্যাগের ভেতর রেখে ফাইলের দিকে নজর দেন।  

০৩
পত্রিকা অফিসের পিএবিএক্সের কর্মী জলিল একটু রগচটা টাইপের লোক। প্রথম দুই তিন ঘন্টা ভালই সামলায়। কিন্তু এর পর থেকেই মেজাজ গরম হতে থাকে। ফোনের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। যন্ত্রনায় অতীষ্ট হয়ে উঠে সে। তখন মানুষের সঙ্গে খারাপ ব্যবহারও করতেও ছাড়ে না। তার বস ফোন করতে পারে সে বিষয়টিও তার মাথায় থাকে না। এ কারনে তিনবার চাকরি যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। কিন্তু সিনসিয়ারিটির কথা বিবেচনায় এনে তাকে ক্ষমা করে দেয়া হয়। 
আজও তার মেজাজ গরম। ধরিয়ে দিন বিজ্ঞাপনের ছবির মেয়েটির নাম কি, কেন তাকে ধরিয়ে দিতে হবে, এই মেয়ের অপরাধ কি, ইত্যাদি প্রশ্ন করে পাঠকরা অতীষ্ট করে তুলছে। জলিল মনে মনে ভাবছিল যদি কোন ক্রাইম রিপোর্টার অফিসে চলে আসতো তা হলে অনেকটা সামাল দেয়া যেতো। কারন বিষয়টা ক্রাইম রিলেটেড।
আর ক্রাইম রিলেটেড না হলেও এ ধরনের ফোন জলিল ক্রাইম ডিপার্টমেন্টেই পাঠায়। এ জন্য তাকে জারিও খেতে হয়। এর পরও নিজে না সামলে ক্রাইম রিপোর্টারের উপরই ছেড়ে দেয়ার পক্ষপাতি সে। তাদের অফিসে ক্রাইম রিপোর্টাররা বিকাল ৪ টার আগে আসে না। এখন বাজে দুপুর ১২ টা। আরও চার ঘণ্টা পর আসবে তারা। এতোক্ষন সে কিভাবে সামলবে এ চিন্তায় পড়ে যায়। 
জলিল নিজেও পত্রিকায় ছবিটার দিকে তাকিয়ে দেখে ফোন রিসিভের ফাকে ফাকে। সে বুঝতে পারছে এটা একটা বিজ্ঞাপন। কোন এক প্রতিষ্ঠান দিয়েছে। সে সংবাদ পত্রে প্রায় এক যুগ কাটিয়ে দিচেছ এমন বিজ্ঞাপন দেখেনি। কেউ কাউকে ধরিয়ে দেয়ার বিজ্ঞাপন দিলে সেখানে বিব্ধাপন দাতা প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির নাম ছাপা হয়। কোন কোন বিজ্ঞাপনে পুরস্কারের ঘোষনাও থাকে। কিন্তু এতে কিছুই নেই। শুধু পত্রিকা অফিসের বিজ্ঞাপনের একটি নাম্বার লেখা রয়েছে। কিছুক্ষন মেয়েটির দিকে চোখ রেখে সে দ্রুত পত্রিকা ভাজ করে ফেলে। ভয় পেয়ে যায়। মনে পড়ে তার পঞ্চম শ্রেনী পড়–য়া কন্যার কথা। 
গত বছর পত্রিকার প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী অনুষ্ঠানে একটি পাচতারা হোটেলের বল রুমে তারও যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। ওই দিন পুরনো এক বান্ধবীর সঙ্গে দেখা হয়ে যায় জলিলের। একে অপরকে চিনতে পারছিল না। এ করনে দু’জন দু’জনার দিকে অনেক্ষন তাকিয়েও ছিল। বেশ কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকার পর একজন আরেকজনকে চিনতে পারে। বন্ধবী আগ বাড়িয়ে এসে বলে ‘হায় তুমি জলিল না? জলিল বলেছিল তুমি জুলি না? এর পর দু’জন হ্যান্ডশেকও করে। 
হ্যান্ডশেক শেষ করে জলিল তার মেয়েকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য পাশে তাকায়। দেখে তার মেয়ে নেই। মহা চিন্তায় পড়ে যায় সে। জলিল ও জুলি অনুষ্ঠান স্থলে অনেক্ষন ধরে মেয়েকে খুজে। কিন্তু পায়নি। অবশেষে অনুষ্ঠান উপভোগ না করেই ক্লান্ত অবসাদ মনে বাসায় ফিরে জলিল। বাসায় গিয়ে মেয়ে হারানোর কথা বলার আগেই তার স্ত্রী তাকে দেখে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে। বলে, সে মেয়ে মানুষের সঙ্গে হাসি তামশা করে। আজ মেয়ের কাছে ধরা পড়েছে। কথাটা শুনে জলিলের মনে কিছুটা স্বস্থি ফিরে। তা হলে তার মেয়ে হারিয়ে যায়নি। সে বাসায় চলে এসেছে। 
স্ত্রী বলে যেতে থাকে, তার মেয়ে যদি ওই অনুষ্ঠানে না যেতো তা হলে বিষয়টা জানতেই পারতো না। সেদিন অনেক্ষন ধরে তার স্ত্রীকে বুঝিয়েছিল বিষয়টি। কিন্তু তার স্ত্রী দু’দিন পর্যন্ত তার সঙ্গে কথা বলেনি। এর পর থেকেই জলিল কোন নারীকে তাকিয়ে পর্যন্ত দেখে না। আর যতোটা পারে নিজের মেয়েকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। মেয়েও তাই। কখনো কখনো সামনে পড়ে গেলে লজ্জায় মুখ ঢাকে জলিল।
একদিন অনেক্ষ ধরে জলিল ভাবছিল একটি হ্যান্ডশেক কত গরমই না ছড়িয়ে দিল তার পরিবারে। সুখী পরিবারে হয়তো এভাবে ভুল বুঝাবুঝিতে অবিশ্বাসের সৃষ্টি হয়। ভেঙ্গেও যায়।
সেদিন জলিল তার স্ত্রীকে বলছিল জুলি আর সে একই কলেজে পড়েছে। ইন্টামিডিয়েট পাশ করে জুলি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। তার আর পড়া হয়ে উঠেনি। জুলি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে এখন বড় চাকরি করছে। ফার্স্ট ক্লাস অফিসার। এতোদিন পর তার সঙ্গে অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছে। একে অপরে কি করছে জানতে চাইছিল। জলিল সামান্য একটা টেলিফোন অপারেটর এ কথা শুনেও তাকে জুলি তুচ্ছ করেনি। বরং তার ভিজিটিং কার্ড দিয়ে বলেছিল তার সঙ্গে দেখা করার জন্য। সুযোগ পেলে তাকে একটা ভাল কাজ জুটিয়ে দেবে। 
ভাল কাজের কথা শুনলে সব সময়ই খুশী হয় তার স্ত্রী। কিন্তু এদিন আর তার চোখ নেচে উঠেনি। তা দেখে জলিল খুব একটা অবাক হয়নি। সে বুঝতে পারে হ্যান্ডশেক বান্ধবী তাকে চাকরি দিক এটা তার পছন্দ নয়। বরং তার স্ত্রী বলেছিল-
-আদার বেপারী জাহাজের খবর নেওয়ার দরকার নাই। যেখানে আছ সেখানেই কাজ করো। তখন রসিকতা করে জলিল স্ত্রীকে বলেছিল- দেখ আদার বেপারীদেরই কিন্তু  জাহাজের খবরা খবর রাখার কথা। তুমি কি জানো এখন দেশে বেশিরভাগ আদা জাহাজে করে বিদেশ থেকে আসে। তা হলে জাহাজের খবর কে রাখবে এই টেলিফোন অপারেটর নাকি আদার বেপারী। জলিলের কথা শুনে মুড অফ স্ত্রী হেসে ফেলেছিল। 
পরে জানায়, বান্ধবীর সঙ্গে হ্যান্ডশেকের বিষয়টি তার মেয়ে সহজভাবে নিতে পারেনি। তাই সে কাদতে কাদতে বাড়ি ফিরে তার মায়ের কাছে অভিযোগ করে বাবার চরিত্র নিয়ে। এখনো কোন সুন্দরী নারীকে দেখলেই জলিলের সেই কথাটি মনে পড়ে যায়।
আজও নিশির ছবিটি দেখে ওই ঘটনা মনে পড়তেই দ্রুত পত্রিকাটি ভাজ করে রেখে দেয় জলিল। তার মনে হচ্ছিল মেয়েটির ছবি দেখার সময় তার কন্যা পেছন থেকে দেখে তার মায়ের কাছে দৌড়ে যাচেছ। 

০৪
নিশি বড়ই ঘুম কাতরে মেয়ে। ঘুম থেকে জেগে মোবাইলটা হাতে নেয়। দেখে ১৬৪ টি মিসড কল হয়ে আছে। চমকে যায় সে। ভুল দেখলো কি না সে জন্য দু’বার চোখ কচলায়। না সে ভুল দেখছে না। যা দেখছে সত্যি। চিন্তায় পড়ে যায় সে। কোনদিনতো এমন হয় না। কি হয়েছে দেশে?  নিশ্চয়ই বড় ধরনের কোন ঘটনা ঘটেছে। 
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্র“য়ারি পিলখানায় যখন বিডিআররা বিদ্রোহ করেছিল সেদিনও সে সকালের দিকে খুব ঘুমিয়েছিল। উঠে দেখতে পায় তার মোবাইলে ২৫ টি মিসড কল হয়ে আছে। কল খুলে দেখতে পায় তার ঘনিষ্ট বন্ধুরাই ফোন করেছিল তাকে। তবে রিংগার টোন বন্ধ করে রাখায় সে কারো ফোনই ধরতে পারেনি। আজ কি হলো এ নিয়ে চিন্তায় পড়ে যায় সে। একবার ভাবে প্রায়ই পত্রিকায় সংবাদ ছাপা হয় দেশে ভয়াবহ ভূমিকম্প হবে। তা হলে কি ভূমিকম্প হয়েছে। সে ঘরের চারদিকে তাকায়। এতো বড় ভূমিকম্প হলে তাদের বাড়িতেও কিছু একটা হতো। সবইতো ঠিকঠাক আছে। তা হলে কি হয়েছে? দেশের প্রধানমন্ত্রীর কোন সমস্যা হলো। কিছুই ঠাহর করতে উঠতে পারে না নিশি। এরই মাঝে নিশি মনে মনে বিরক্তও হলো। বিডিআর বিদ্রোহ হলে এমনকি যে, তাকে খবর জানানোর জন্য ২৫ জন বন্ধু ফোন করে বসে ছিল। সেতো একজন সাধারন নাগরিক। তা হলে তাকে এতো খবর জানানোর কি আছে। তার কিইবা করার ক্ষমতা আছে? হিসাব মিলাতে না পেরে বিছানা ছেড়ে উঠে। ভাবে একজনকে অন্তত কল ব্যাক করে জানা দরকার কেন ফোন করেছিল। কিন্তু কাকে সে ফোন করবে বুঝে উঠতে পারছে না। কারন যাদের ফোন মিসড কল হয়ে আছে তার মধ্যে বেশিরভাগ সেইভ করা নাম রয়েছে ফালতু-১ , ফালতু-২ এমন ৪০ টির বেশি ফালতু নাম্বার। 
নিশি যা পছন্দ করে না এসব বিষয়ই তার জীবনে বেশি ঘটে। মোবাইল ফোনে জরুরী কথা ছাড়া বাড়তি কথা একদম অপছন্দ তার। আর যদি কেউ ফলতু প্যাচাল পাড়তে চায় তা হলে তার মেজার বিগড়ে যায়। এ পর্যন্ত সে তিনবার তিনটা সীম বদলেছে। এর পরও কোত্থেকে যে লোকজন তার নাম্বার পেয়ে যায়? আর রাত বিরাতে বিরক্ত করে। পরে বিরক্ত করা ফোন নম্বরগুলোকে সে ফালতু নাম দিয়ে সেইভ করে রেখেছে। ফালতু নম্বর থেকে ফোন আসার সঙ্গে সঙ্গে সে রিসিভ করে কোন কথা না বলে খাটের উপর, টেবিলের উপর বা অন্য কোথাও রেখে দেয়।
প্রথম প্রথম অনেক অনুরোধ করেছে সে ফোনকারীকে ফোন না করার জন্য। কিন্তু কে কার কথা শুনে। সবাই তাকে পটাতে চায়। কিন্তু জরুরী থাকার কারনে সে ফোনটা বন্ধও করে রাখতে পারে না। এরই মধ্যে তার এক বন্ধু তাকে রিসিভ করার বুদ্ধিটা দেয়। এর পর কাজ হয়েছে। একজনতো রোজ ১০ বার ফোন করতো। এখন সে একবারও ফোন করে না। ফালতুদের বিরক্তি থেকে বেচে বেশ শান্তিতেই ছিল নিশি। হঠাৎ আজ এক সঙ্গে সব ফালতুরা তাকে ফোন করলো কেন বুঝে উঠতে পারছে না। গোলক ধাধায় পড়ে গেছে নিশি। 

০৫
বিজ্ঞাপনের বিষয়টি থানা পর্যন্তও গড়িয়ে গেছে। থানার ওসি পত্রিকা হাতে পাওয়ার পরই তার চোখ যায় ওই বিজ্ঞাপনটির দিকে। তিনি ঘটনা বুঝে উঠতে পারেন না। বিজ্ঞাপনটার মানে বুঝার চেষ্টা করেন বার কয়েক। বিজ্ঞাপনের চারপাশে প্রতিষ্ঠানের নাম খুজেন। কারা তাকে ধরিয়ে দিতে বলছে তাও বুঝতে পারছেন না। 
ডিউটি অফিসারের রুমেও তখন বিজ্ঞাপনটি নিয়ে আলোচনা চলছিল। কায়েস নামের এক সাব-ইন্সপেক্টর ডিউটি অফিসারকে জানালেন তিনি এই মেয়েটিকে চিনেন। কথা শুনে ডিউটি অফিসার বিস্মিত। পর মূহূর্তেই তার বিস্ময় কাটে। সাব-ইন্সপেক্টর জানান, এই মেযেটির বড়ি এই থানা এলাকায়ই। প্রায় প্রতিদিনই থানার সামনে দিয়ে রিক্সায় যেতে দেখেন। তার কথা শুনে দরজার সামনে দায়িত্বপালনকারী এক কনস্টেবলও ভেতরে আসেন। ডিউটি অফিসারের কাছ থেকে পত্রিকাটা নেয়ার জন্য কাচুমাচুৃ করতে থাকেন। বিষয়টি সহজেই বুঝতে পারেন ডিউটি অফিসার। তিনি কনস্টেবলকে বলেন-
কি হাকিম মিয়া পত্রিকাটা দেখতে চাচ্ছেন? বুড়– কনস্টেবল আগ্রহ নিয়ে বলেন-
‘স্যার যদি একটু দেন’। 
ডিউটি অফিসারের কাছ থেকে পত্রিকাটা নিয়ে বুড়– কনস্টেবলও নিশ্চিত করে এ মেয়েটিকে তিনি অনেকবার থানার সামনে দিয়ে যেতে দেখেছেন। সাব-ইন্সপেক্টর ভাবলেন বিষযটা ওসি সাহেবের কানে দেওয়া দরকার। এই সুযোগে একটু তেলও মারা যাবে। নতুন ওসি এসেই তার উপর ক্ষেপে রয়েছেন। যোগদানের দু’দিন পরই তাকে রুমে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে তাই গালাগালি করেছেন। বলেছেন কায়েসের বিরুদ্ধে তিনি চাদাবাজির অভিযোগ পেয়েছেন। ডিউটিও ঠিকমতো করে না বলে জানতে পেরেছেন। 
কায়েস পত্রিকাটা হাতে করে নিয়ে দ্রুত ওসির রুমে যেতে গিয়ে দরজার সামনে দাড়িয়ে যায়। ৮০ কিলোমিটার বেগে যাওয়া কোন গাড়ির হঠাৎ ব্রেক কষার মতো। কিছুক্ষন চিন্তা করেন-এই মেয়েটার কথা ওসি সাহেবের সামনে বললে হিতে আবার বিপরীত হবে নাতো। তিনি আবার বলে বসবেন নাতো যে, শুধু চাদাবাজি, ফাকিবাজিই করেন না, কোন রাস্তা দিয়ে কোন সুন্দরী মেয়ে মানুষ যায় তার খররও রাখেন। কিন্তু এ কথা তো তিনি নাও বলতে পারেন। হতে পারেতো উল্টোটাও। ওসি সাহেব ভাবতে পারেন কায়েসের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ থাকলেও আসলে সে থানা এলাকার খোজ খবর ভালই রাখে। 
শেষ চিন্তাটাই তার মনে ধরে। সে পত্রিকাটা হাতে নিয়েই দরজার একটি পাট্টা ধাক্কা দেয়। বিনযের সুরে বলে-
-আসবো স্যার।
ওসি সাহেব চশমা নামিয়ে একবার দেখেন তাকে। ধ্ক করে উঠে কায়েসের মন। এই প্রথম নরম সুরে ওসি সাহেব বললেন-
-আসুন। এ সময় ওসির রুমে আর কেউ ছিল না। ওসিও একজন লোক খুজছিলেন ছবির মেয়েটিকে নিয়ে কথা বলার জন্য। 
-স্যার একটা বিষয়ে কথা বলতে এসেছিলাম। 
-বলেন।
পত্রিকার ছবিটা দেখায় কায়েস। স্যার যে মেয়েটাকে ধরিয়ে দিতে বলছে সেই মেয়ে আমাদের থানা এলাকায় থাকে- গর্বের ভঙ্গিতে বলে কায়েস। ওসির মুখে হাসি ফোটে।
-তাই নাকি। আপনি সিওর?
-জ্বি স্যার-সিওর।
-ভেরিগুড। এই প্রথম দেখলাম যে আসলে আপনি কাজের লোক। আমি ছবিটা নিয়ে ভাবছিলাম। ওর বাসা কি আপনি চেনেন?
-না স্যার।
-তা হলে সে এই থানা এলাকার সেটা জানেন কি করে?
-স্যার আমি এই থানায় দু’বছর ধরে আছি। মেয়েটিকে থানার সামনে দিয়ে যেতে দেখেছি অনেকবার। 
-আর সুন্দরী মেয়ে বলে তার দিকে বেশি বেশি তাকিয়েছেন, তাইতো। হাসে ওসি। লজ্জা পায় দারোগা। ওসি আশ্বস্থ করেন-
-এইটা দোষের কিছু না। মানুষ সুন্দরের পুজারী। আপনি তাকে দেখতেই পারেন। আমি হলেও বোধ হয় দেখতাম। বোধহয় কি বলছি, দেখতাম-ই। যাই হোক, আপনি এর বাড়ির ঠিকানাটা বের করার চেষ্টা করেন। দেখেন যদি আমরা তাকে ধরে ফেলতে পারি তা হলে কিন্তু বেশ নাম হবে। মিডিয়া কাভারেজ ভাল পাবেন। আরে দুইটা ডাকাত বা অস্ত্র যদি ধরেন তাহলে কি খবর ছাপা হয় পত্রিকায়? টিভি চ্যানেল ছুটে আসে? আসে না। এই মেয়েকে ধরে ফেলতে পারলে ব্যাপক নাম হবে বুঝলেন। কিন্তু একটা বিষয় মাথায় রাখবেন। কি কারনে তাকে ধরিয়ে দেওয়ার বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে সে বিষয়টি আগে ক্লিয়ার হতে হবে। 
-স্যার, ধরে ফেলি পরে জানতে পারবো।
-এইতো মাথা মোটার মতো কথা কইলেন। ধইরা গিয়া বিপদে পড়বেন নাকি।
-স্যার, বিপদ কি? সেতো অপরাধী। তা না হলেতো আর পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হতো না। 
-কিন্তু বিজ্ঞাপনেতো কিছুই উল্লেখ নেই। এটাতো অন্য কোন কারনও হতে পারে। আমি বলিকি, আপনি বাসাটা চিহ্নিত করে রাখেন। যোগাযোগ করে দেখি গ্রেফতারের বিষয় হলেই তাকে নিয়ে আসবো। যান।
-ঠিক আছে স্যার। স্যালুট দিয়ে বেরিয়ে যায় কায়েস। তার মনটা আজ ফুরফুরে। প্রথমবারের মতে ওসি তার সঙ্গে ভালভাবে কথা বললেন। 
কায়েসের দেরী সয় না। থানা কম্পাউন্ড থেকে মোটর সাইকেল নিয়ে সে যায় তাদের থানা এলাকায় একটি হাউজিংয়ে। সে বুঝতে পারে মেয়েটি ওই এলাকায়ই থাকে।
হাউজিংয়ে ঢোকার মুখেই একটি মুদি দোকান। তার সামনে মোটর সাইকেল থামিয়ে দোকানে যায় কায়েস। সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধ দোকানীর মুখ শুকিয়ে আসে। আগেই বলতে থাকে স্যার-আজকেতো মাসের ২৮ তারিখ স্যার। বেচা বিক্রি ভাল না স্যার। বৃদ্ধের ভীতির কারন বুঝতে কষ্ট হয়না কায়েসের। 
এদিনই প্রথম কায়েসের ভাল ব্যবহার করতে ইচ্ছে করলো বৃদ্ধের সঙ্গে। হাসে কায়েস। চমকে যায় দোকানী। কায়েস আপন জনের মতো বলে-
চাচা, আমি আজ অন্য কাজে এসেছি। ভয়ের কোন কারন নেই। আমারে একটু সহযোগিতা করেন। দারোগার কথা শুনে এবার বুড়োর পিলে চমকানো অবস্থা। তার মতো একজন দোকানী কি না করবে দারোগার সহযোগিতা। প্রথমে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না বুড়ু। শেষ পর্যন্ত কায়েস যখন পত্রিকা খুলে নিশির ছবি দেখায় তখন হেসে ফেলে বুড়–। কায়েস বুঝতে পারে তার কাজ হাসিল হবে। বুড়–র হাসিই বলে দিচেছ সে তাকে চেনে।
বুড়– জানায়, এই মেয়েটি হাউজিংয়ের মাঝামাঝি একটি বাড়িতে থাকে। এটা তাদের নিজেদের বাড়ি। এমনকি তার বাবা-মাসহ সবার বিষয়েই তথ্য দেয় সে। তথ্য পেয়ে মহা খুশী কায়েস। কিন্তু সে এতো খুশী হয়েছে কেন নিজের মনেই একবার প্রশ্নটা ধাক্কা দেয়। যখনই কোন মামলার তদন্তের দায়িত্ব পরে তার উপর তখনই তার মন খারাপ হয়। এই প্রথম কোন কাজ করতে তার ভাল লাগছে। ওসি সাহেব খোজ খবর নিতে বলতেই তার মনে আনন্দ খেলা করে যায়।
কায়েস মোটর সাইকেল হাকিয়ে যখন  নিশিদের বাড়ির সামনে যায় তখন দুপুর সাড়ে ১২ টা। গিয়ে দেখে অনেক লোক গেটের সামনে দাড়িয়ে আছে। সবারই এক প্রশ্ন কি এমন অপরাধ করলো মেয়েটা যে তার ছবি ছেপে ধরিয়ে দেওয়ার বিজ্ঞাপন দিতে হয়েছে। 
লোকজনের ভিড় দো’তলা থেকে একবার দেখেছেন নাহিদ আহমেদ। তিনি বিষয়টি বুঝতে পেরে নিজের ঘরে গিয়ে বসে আছেন। দারোয়ানকে ডেকে বলে দিয়েছেন নিশির বিষয়ে কেউ কিছু জানতে চাইলে যেন সে কিছুই জানে না বলে জানিয়ে দেয়। এই লোকগুলোকে দেখে প্রথমে নাহিদ আহমেদের মেজাজ বিগড়ে যায়। পরক্ষনই নিজেকে সামলে নেন। জানেন এরা এরকমই। নিজের চেয়ে পরের বিষয় নিয়ে ঘাটতে পছন্দ করে। কোথাও আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের পথ আগলে রাখে। কোথাও সড়ক দুর্ঘটনা হলে দাড়িয়ে দেখে লোকটি কিভাবে রক্ত ঝড়ে মারা যাচ্ছে। আফসোস করে বটে সেটা দেখানো আফসোস। তার মেয়ের ছবি ছাপা হয়েছে পত্রিকায় আর হাউজিংয়ের লোকজন বাসা দেখতে চলে এসেছে। বাহ। 
দারোগা কায়েসও ভিড় করা লোকজনের মাঝখানে গিয়ে দাড়ায়। গায়ে পুলিশের পোশাক না থাকায় তার দিকে লোকজন খুব একটা তাকিয়েও দেখে না। তাকে চেনে শুধু দোকানী ও চোর ডাকাতরা। সাধারন মানুষ তাকে চেনে না। এটা সেখানে দাড়িয়েই কয়েস উপলব্দি করতে পারে। 
লোকজনের কথা থেকে যে সারমর্ম পেয়েছে কায়েস তাতে করে মেয়েটির নাম নিশি। সে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে পড়ছে। বাবা সরকারের বড় কর্মকর্তা ছিলেন। এখন অবসরে। 
এসব তথ্য পেয়েই মহা-খুশি কায়েস। ছোট্ট একটা নোটবুকে লিখেও রাখে তথ্যে গুলো। কারন সে জানে, থানা পর্যন্ত যেতে যেতে অনার্স হয়ে যাবে মাস্টার্স অথবা ইন্টামিডিয়েট। বাবা চাকুরে থেকে হয়ে যাবে ব্যবসায়ী বা অন্য কিছু। পরে আবার ওসি সাহেবের কাছ থেকে ধমক খেতে হবে। এটা সে কোনভাবেই চায় না।
কায়েস যখন ওসি সাহেবের সামনে গিয়ে দাড়ালো ততক্ষনে এ খবর ওই বিভাগের ডিসি পর্যন্ত পৌছে গেছে। ওসিই বা কেন নিজের কৃতিত্বের সুযোগ হাতছাড়া করবেন। তিনি ডিসি সাহেবকে জানিয়েছেন, তারা গোয়েন্দাগিরী করে জানতে পেরেছেন মেয়েটি এই থানা এলাকায় বসবাস করে। ডিসি সাহেব তার কথা শুনে প্রথমে একটু অবাকই হয়েছেন। পত্রিকায় ছবি দেখেই থানা পুলিশ গোয়েন্দাগিরী শুরু করে দিলো। এতো তৎপরতার কারন কি তিনি তা বুঝার চেষ্টাও করলেন। কিস্ম পুরোটা বুঝে উঠতে পারলেন না।
 
০৬
নাহিদ আহমেদের ইচেছ করছিলো না বেলকনীতে যাওয়ার। সেখানে গেলেই কিছু অপদার্থ লোককে তার চোখে পড়ে। সকাল থেকেই তারা তার বাড়ির সামনে জড়ো হয়েছে। এ কারনে নাহিদ আহমেদ বেলকনী থেকে শোয়ার রুমে গিয়ে বসেছিলেন। কিন্তু বেলকনীটা যে তার খুব প্রিয়। সেখানে বসে পত্রিকা না পড়লে কি যেন একটা মিস করেন তিনি। মানুষের প্রেম শুধু মানুষের প্রতিই নয় কখনো কখনো জড় পদার্থের প্রতিও জন্মে যায়। এ এক অদ্ভুদ ব্যাপার। 
নাহিদ আহমেদ যে প্রাইভেটকারটি ব্যবহার করছেন তা ১৫ বছর আগে কেনা। এই দিনগুলোতে কত রকমের গাড়ির মডেল বদলেছে কিন্তু ওই প্রাইভেটকারটিকে বদলানোর প্রয়োজন মনে করেননি তিনি। বরং তার ওই গাড়িটিকে এতো আপন মনে হয় যে মাঝে মাঝে তার সঙ্গে কথাও বলেন তিনি। এই গাড়িটি তাকে দেশের কত জায়গায় নিয়ে গেছে তার ইয়ত্তা নেই। নিজের চাকা কাদার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে নাহিদ আহমেদকে বাচিয়েছে। গরমের আছ যাতে না লাগে সে দিকেও নজর রেখেছে এই গাড়িটি। এসব কথা মনে হওয়ায় গাড়ির প্রতি তার প্রেম বাড়তে থাকে। কত গাড়িইতো আছে রাস্তায় গিয়ে নষ্ট হয়ে যায়। মালিককে ঠেলতে পর্যন্ত বাধ্য করে। কোন কোন গাড়ি কথা না শুনে সোজা চলে যায় রাস্তার নিচে। হয়তো মালিকের প্রতি খুশি না থাকায়ই গাড়িরা এমন কাজ করে থাকে। কিন্তু নাহিদ আহমেদের গাড়িটি ১৫ টি বছরে একদিনও এমন ঝামেলায় ফেলেনি। 
নাহিদ আহমেদ অবশেষে বেলকনীতে গিয়ে ইজি চেয়ারে বসলেন। পত্রিকাটা তার হাতেই ছিল। চেয়ারে বসেই দেখতে পান জড়ো হওয়া ক’জন মানুষ একে অপরকে আঙ্গুলের ইশারায় নাহিদ আহমেদকে দেখাচ্ছে। নাহিদ আহমেদের বুঝতে কষ্ট হয় না তারা কি বলছে। তিনি কোন দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে চেয়ারে বসে পত্রিকা পড়ায় মনোযোগ দেন।
হঠাৎ নাহিদ আহমেদ তার কাধে একটি হাতের উপস্থিতি টের পান। নরম সেই হাত আজ বেশ শক্তই মনে হচ্ছে। নাহিদ আহমেদ পত্রিকা ভাজ করে উপরের দিকে তাকান। অন্য দিনের মতোই একগাল হাসি দিয়ে নিশি বলে উঠে-
‘আব্বু, পত্রিকায় আজ মন খারাপ করার মতো কোন খবর নেই?’ নাহিদ আহমেদ প্রায় প্রতিদিনই মেয়েকে সাবধান থাকার জন্য পত্রিকার নেতিবাচক খবর গুলো পড়ে শোনান। ছিনতাইকারীর হাতে পথচারী খুন, এক মহিলার ভ্যানেটি ব্যাগ টেনে নিয়েছে ছিনতাইকারীরা। এক মেয়েকে রাস্তা থেকে অপহরন করে নিয়ে গেছে। এমন সব খবর নিশিকে শোনানোটা যেন নিত্য দিনের অভ্যাসে দাড়িয়েছে নাহিদ আহমেদের। নিশির বুঝতে কষ্ট হয় না নাহিদ আহমেদ কেন তাকে এই খবর গুলো পড়ে শোনান। 
কিন্তু আজ আর তিনি কিছু বললেন না। বড় একটা নিশ্বাস নিলেন। ততক্ষনে জড়ো হওয়া লোকজনের মধ্যে সরগোল সৃষ্টি হয়েছে। নাহিদ আহমেদ বুঝতে পারছেন নিশিকে দেখেই তারা এমন করছে। কিন্তু নিশির প্রথমে নিচ দিকে চোখ যায়নি। সরগোল শুনে চোখ ফেলে নিচে। দেখে সবাই তাদের দিকে তাকিয়ে কি যেন বলাবলি করছে। কোন কিছু বুঝে উঠতে না পেরে বাবার কাছে জানতে চায়-
-আব্বু, আমাদের বাড়ির সামনে এতো মানুষ কেন? মেয়ের প্রশ্নের কি উত্তর দেবেন তা বুঝে উঠতে পারেন না নাহিদ আহমেদ। তার চোখ ছল ছল করছে। বিষয়টি নজরে আসে নিশির। আৎকে উঠে। বাবাকেতো সে কোন দিন কাদতে দেখেনি। আজ এমন কি হলো যে তার চোখ বেয়ে আষাঢ়ের ডল নামবে। কিছুক্ষন বোকার মতো বাবার দিকে তাকিয়ে রইলো সে। নাহিদ আহমেদও তাই। দৃশ্যটা কোন  শিল্পীর চোখে পড়লে এমন কোন ছবি হয়তো আকতে পারতেন যা লিউনার্দো দা ভিঞ্চির মোনালিসাকেও হয়তো হার মানাতো। 
কিছুক্ষন পরই বাসার সামনে জড়ো হওয়া লোকজনের সংখ্যা বাড়তে দেখে নিশি। একজন চিৎকার করে আরেকজনকে বলতে থাকে-
‘হ্যা ওর নামই নিশি। বিশ্বাস না হয় ডাক দিয়ে দেখেন?’ শ্রোতা হয়তো অনেক কষ্টে তাকে ডাক দেওয়া থেকে বিরত থাকে। কিন্তু কথাটি কানে আসে নিশির। এবার নিশি নিশ্চিত তাকে নিয়েই কিছু একটা ঝামেলা হয়েছে। কিন্তু কি সেই ঝামেলা! পর ক্ষনেই মনে পড়ে মোবাইল ফোনের মিসড কল লিস্টের কথা। সেই ঝামেলার কথা তার বাবাও জানে। এ কারনেই তার চোখ ছলছল করছে। নিশি কি করবে বুঝে উঠতে পারে না। বাবাকে প্রশ্ন করে
-আব্বু আমাকে নিয়ে কোন ঝামেলা হয়েছে নাকি? 
নাহিদ আহমেদ কোন উত্তর দেন না। মেয়ের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। কি উত্তর তিনি দেবেন ভেবে পাচিছলেন না। প্রথমে ভেবেছিলেন কোন ভাবেই মেয়ের সামনে তিনি ভেঙ্গে পড়বেন না। নিশি উঠে বেলকনীতে আসার সঙ্গে সঙ্গে পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত দুটো ভাল সংবাদ পড়ে শোনাবেন। এর পেছনে একটা যুক্তিও কাজ করে তার। অনেক দিন ধরেইতো তিনি মেয়েকে খারাপ খবর পড়ে শুনিয়ে সাবধান করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কি হলো। বরং তার উল্টোটাই হয়েছে। তা হলে এখন থেকে তিনি উল্টো কাজটাই করবেন বলে স্থির করেন। কিন্তু নাহিদ আহমেদ তার দু:খ কষ্টের বিষয়টি লুকোতে পারলেন না। নিজের অজান্তেই চোখে পানি এসে যায়। 
অনেক্ষন পর মুখ খোলেন নাহিদ আহমেদ-
‘হ্যা তোকে নিয়েই ঝামেলা হয়েছে। নে পত্রিকার তিন নম্বর পাতাটায় চোখ বুলা।’ নাহিদ আহমেদের কাছ থেকে পত্রিকা নিয়ে বেড রুমের দিকে চলে যায় নিশি। নাহিদ আহমেদের চোখ বেয়ে পানি নিচে গড়িয়ে পড়তে থাকে। 
০৭

ডেপুটি পুলিশ কমিশনার (ডিসি)কে জানিয়ে অনেকটা অস্বস্থিতেই পড়ে গেছেন থানার ওসি। তিনি মনে মনে ভাবছেন ধরিয়ে দেওয়ার পুরো ঘটনা না জেনে ডিসি সাহেবকে জানানোটা ঠিক হয়নি। নিজের উপর বিরক্ত হয় ওসি। রাগ ধরে যায় দারোগা কায়েসের প্রতি। ওর জন্যই তিনি বিষয়টি অতি উৎসাহের সঙ্গে বড় সাহেবকে জানিয়েছেন। এতে তিনি কোন বেকায়দায় পড়েন সে জন্য বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েন।
করিৎ কর্মা ওসি বসে নেই। তিনি পত্রিকা অফিসে গিয়ে ঘটনাটি আবিস্কারের চেষ্টা করেছেন। সেখানকার বিজ্ঞাপন বিভাগ থেকে জানতে পেরেছেন রামপুরার একটি প্রতিষ্ঠান থেকে এ বিজ্ঞাপনটি দেওয়া হয়েছে। তিনি প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা নিয়ে সেখানে গিয়ে যখন হাজির হন তখন ভর দুপুর। রোদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গরম পড়েছিল বেশ। সরকারি গাড়িতে এয়ার কন্ডিশানার না থাকায় তিনি ঘামছিলেন। তার চেয়ে বেশি ঘামছিলেন ডিসি সাহেবের কথা মনে করে। যানজটে গাড়ি আটকে যাওয়ার পরও দু’তিন বার চালককে ধমকেছেন তিনি। কনস্টেবল পদ মর্যাদার চালক বিনা প্রতিবাদে তার ধমক শুনেছে। বড় অফিসারদের নিয়ে গাড়ি চালাতে গেলে এমন ধমকের পাল্লায় পাড়া নতুন কিছু নয়। ধমক  তার গা সওয়া। 
গলদ গর্ম হয়ে রামপুরার ওই প্রতিষ্ঠানে ঢুকে কিছুটা স্বস্তি পান ওসি। প্রতিষ্ঠানের গেট থেকেই এয়ার কন্ডিশনারের বাতাস। তার শরীরকে ঠান্ডা করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু মনের গরম কিছুতেই ঠান্ডা হচ্ছিল না। 
প্রতিষ্ঠানের চীফ এক্সিকিউটিভ অফিসার (সিইও) বেশ সম্মানের সঙ্গেই ওসি সাহেবকে তার কক্ষে যেতে বললেন। ওসি তার কাছে বিজ্ঞাপনের বিষয়টি জানতে চান। কিন্তু সিইও যা বললেন তাতে ওসি সাহেব বেশ হতাশ হয়ে গেলেন। তার চোখের সামেন ডিসি সাহেবের মুখটা ভেসে উঠলো। ওসি সাহেব ভেবে ছিলেন সিইও বলবেন তার প্রতিষ্ঠানে মেয়েটি চাকরি করতো। টাকা পয়সা নিয়ে পালিয়ে গেছে এ কারনে পত্রিকায় ধরিয়ে দেওয়ার বিজ্ঞান দিয়েছেন। কিন্তু সিইও বললেন অন্য কথা। বললেন-
‘ধরিয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কি ধরিয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে তা কিন্তু বিজ্ঞাপনে নেই। এটাও নেই যে পুলিশে ধরিয়ে দিন। আসলে তাদের আমদানীকৃত টুথ পেস্টের বিজ্ঞাপনি চমক দেখাতে গিয়েই এমন কৌশলের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। আগামী কালের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে ওই তরুনীর হাতে একটি টুথপেষ্ট ধরিয়ে দেওয়ার কথা বলা হবে। আর এটাই বিজ্ঞাপনের আকর্ষন।’ এবার ক্ষেপে যান ওসি সাহেব। বলেন-
‘এটাতো এক ধরনের প্রতারনা’। যুক্তি দেখান সিইও।
‘দেখুন- আপনি বিষয়টিকে আইনী চোখে দেখছেন। আর আমরা দেখছি মার্কেটিংয়ের কৌশল হিসেবে। নতুন পণ্যে বাজারে চালাতে হলেতো আমাদেরকে ব্যতিক্রমী কিছু করতেই হবে, তাই না?
সিইওর কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু ডিসি সাহেবকে কোন যুক্তি দিয়ে বুঝাবেন তা ভেবে কুল কিনারা করতে পারছেন না ওসি। 
‘আপনি যাই বলুন, এটা স্রেফ প্রতারনা। এ কারনে আপনাদের শাস্তি হওয়া উচিত’। এবার সিইও তার যুক্তি তুলে ধরেন।
‘দেখুন ওসি সাহেব বেশ কিছুদিন আগে পত্রিকায় দেশের জনপ্রিয় এক টিভি অভিনেত্রীর ছবি ছাপিয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল যে তিনি নিখোজ। এই নিয়ে কাগজে অনেক লেখালেখিও হয়েছে। কই আপনারাতো সেটাকে প্রতারনা হিসেবে দেখেননি। আমরাতো সে ধরনের কিছু করিনি। শুধু ওই বিজ্ঞাপনের আইডিয়া নিয়ে এই ধরনের বিজ্ঞাপন দিয়েছি। তবে বিজ্ঞাপনে বড় ধরনের একটি ভুল হয়ে গেছে। সেই ভুলটির কথা কি শুনবেন?
‘না। সরি। আমার আর সময় নেই। আপনারা ভুল করতেই থাকেন,  আর আমাদের কাজের চাইতে অকাজের পেছনে দৌড়ানোর জন্য ব্যস্ত রাখেন। কথা গুলো বলেই বেরিয়ে যেতে চান ওসি সাহেব। সিইও তাকে কফি খেয়ে যেতে অনুরোধ করেন। কিন্তু ওসি সাহেব তার কথা না রেখে বেরিয়ে যান। 
গাড়িতে উাঠার আগেই ডিসি সাহেব ফোন করেন ওসি সাহেবকে। মোবাইলের মনিটরে ডিসির নম্বর দেখেই ওসির হাত কাপতে শুরু করে। তার চাকরি জীবনে এমন ভুল কখনো করেননি। আজ কিনা এমন একটা ভুল করলেন যার সঙ্গে এক তরুনী সম্পৃক্ত। যা তাকে বিব্রত করে তুলেছে। ওসি ভীত হয়ে ফোন ধরেন। ডিসি সাহেব বলতে থাকেন-
-শুনেন, আমি খোজ নিয়েছি তরুনীর ছবি ছাপিয়ে একটি প্রতিষ্ঠান তাদের টুথ পেস্টের বিজ্ঞাপনের জন্য আকর্ষনীয় করতে এমন করেছে। এই নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না।
‘জ্বী স্যার।’
‘আপনাকে ধন্যবাদ, এই কারনে যে, আপনি বিষয়টি আমলে নিয়েছেন। তা না হয়ে অন্য ঘটনাওতো হতে পারতো।’
‘থ্যাংক ইউ স্যার’
ডিসি সাহেব ফোন কাটতেই বুকের উপর থেকে যেন একটা বড় পাথর নেমে যায় ওসির। গাড়িতে না উঠে বুক ভরে নিশ্বাস নেন তিনি। ডাকেন গাড়ি চালক কনস্টেবল মজিদকে। মাজিদ গিয়ে তার সামনে দাড়িয়ে স্যার স্যার করতে থাকে। ওসি সাহেব বলেন-
‘মজিদ, কফি খাবে?’ ওসির কথা শুনে চমকে যায় মজিদ। একটু আগেই যার কাছ থেকে অযতাই গালাগাল খেয়েছে তিনি নাকি তাকে কফি খাওয়াতে চাচেছ। এটা দেখে কে না চমকাবে। মজিদ হ্যা না কোন উত্তর না দিয়ে ‘স্যার স্যার’ করতে থাকে। 
ওসি সাহেব বুঝতে পারেন কফি খাওয়ালে মজিদের আপত্তি নেই। তিনি গাড়িতে উঠে বসে বেইলী রোডের একটি দোকানের সামনে যেতে বলেন। সেই দোকানের কফিই তাকে খাওয়াবেন। মজিদও দোকানের নাম শুনে বুঝতে পারে তার স্যার সত্যি সত্যিই তাকে কফি খাওয়াবে। 
গাড়ি বেইলী রোড মুখী। কিন্তু যানজটের কারনে এগুতেই চাচ্ছে না। কিন্তু একটুও বিরক্ত হচ্ছেন না ওসি সাহেব। তার মনে ফুর্তি রয়েছে। যেখানে তার গালাগাল শোনার কথা সেখানে কি না ডিসি সাহেব তার কাজের প্রশংসা করেছেন ফুর্তি থাকাটাই স্বাভাবিক। গাড়িতে যেতে যেতেই ওসি সাহেবের মনে পড়ে তার এক শিক্ষকের কথা। সেই শিক্ষক তাকে একদিন বলেছিলেন-
‘ ভাল কাজের ফল ভালই হয়। তবে কোন কোন ভাল কাজের ফল খারাপ আসতে পারে। কিন্তু কোন খারাপ কাজের ফল কখোনই ভাল আসতে পারে না। তিনি আরো বলেছিলেন, সব চেষ্টারই একটি ভাল ফল পাওয়া যায়। সেটা হোক দু’দিন আগে বা পড়ে।’
আজ ওসি সাহেবের মনে কথাগুলো দাগ কেটে যাচিছল। তিনি মেয়েটির বিষয়টি নিয়ে ঘাটাঘাটি না করলে এমন প্রশংসা পেতেন না। তিনি চেষ্টা করেছেন বলেই হয়তো এমন প্রশংসা জুটেছে। 
০৮
ওসি চলে যাওয়ার পর টুথপেস্ট কোম্পানীর সিইও জামিল আহমেদ তার অধস্তনদের নিয়ে সভা করতে বসেন। তিনি মার্কেটিং ম্যানেজার আশফাকের কাছে জানতে চান বিজ্ঞাপনে একজন জনপ্রিয় চিত্র নায়িকার ছবি যাওয়ার কথা ছিল। সেই জন্য সেই নায়িকাকে এক লাখ টাকা অগ্রিমও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পত্রিকায় ছবি ছাপা হয়েছে অন্য তরুনীর-এর কারন কি? 
মার্কেটিং ম্যানেজার সকাল থেকেই ধারনা করছিলেন এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে তাকে। তিনিওতো অবাক হয়েছেন। কিভাবে এমন ঘটনা ঘটলো। সিইও জানালেন এরই মধ্যে ওই চিত্র নায়িকা তাকে দু’দফা ফোন করে তাকে অপমান করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন।
সিইওর কোন প্রশ্নের উত্তরই দিতে পারছে না মার্কেটিং ম্যানেজার। শুধু আমতা আমতা করে যাচেছন। তিনি পত্রিকায় নায়িকার ছবি না দেখে গ্রাফিক্স ডিজাইনার ইমরানকে ফোন করেছিলেন। কিন্তু ইমরানের ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে। সে কারনে জানা গেল না আসলে কিভাবে কি হয়েছে। ইমরানকেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল বিজ্ঞাপনটা তৈরি করার জন্য। 
সিইও যতোটা চটে যাওয়ার কথা ছিল ততটা চটলেন না। বিষয়টায় অবাক হয়েছেন সবাই। পার্সেস আফিসারসহ অন্য কর্মকর্তারা ধরেই নিয়েছিলেন এই অপরাধের কারনে মার্কেটিং ম্যানেজারের চাকরিটা বোধ হয় এবার আর থাকবে না। কিন্তু সিইও বললেন অন্য কথা। যে নায়িকার ছবি ছাপা হওয়ার কথা ছিল তার চেয়ে অধিক সুন্দরী এই তরুনী। পরিচিত জনের কয়েকটি ফোনও পেয়েছেন তিনি। তার পরিচয় জানতে চেয়েছেন তারা। এ ছাড়া ওসি চলে আসায় তার কাছে মনে হয়েছে বিজ্ঞাপনটি বেশ কার্যকরি হয়েছে। তিনি সিনেমার নায়িকার অভিযোগ শুনে না জেনেই বলে দিয়েছেন, দেখুন আপনার ছবির চেয়ে এই মেয়ের ছবি পেয়ে যাওয়ায় আসলে বিজ্ঞাপনটি পরিবর্তন করা হয়েছে। আপনি যে এক লাখ টাকা নিয়েছেন তা ফেরত দিতে হবে না। ফটো সেসনের ছবি গুলোও চাইলে আপনি নিয়ে যেতে পারেন। 
তিনি এও জানালেন, বিজ্ঞাপনে  ছবির মেয়েটির চোখ, নাক কান সবই যেন কথা বলছে। ঠোটের কোনের হাসিটা কার না চোখে পড়েছে। এতো সুন্দর হাসি এর আগে তিনি দেখেছেন বলে মনে করতে পারছেন না। দুটো চোখ যেন পত্রিকার সব পাঠকের সঙ্গেই কথা বলে যাচ্ছে। হেয়ার স্টাইল একেবারে ভিন্ন। ছবিটি তুলার আগে যে তাকে সাজিয়েছে তিনি নিশ্চয়ই বড় মাপের রূপ বিশেষজ্ঞ। 
সিইও মেয়েটির সম্পর্কে জানতে চাইলেন মার্কেটিং ম্যানেজারের কাছে। মার্কেটিং ম্যানেজার নিরবতা ভেঙ্গে বললেন-
‘স্যার, আমাকে ক্ষমা করবেন। আসলে এই মেয়েটিকে আমি চিনি না। কিভাবে নায়িকার জায়গায় তার ছবি ছাপা হলো তাও বুঝতে পারছি না। গ্রাফিক্স ডিজাইনার ইমরানকে সকাল থেকে ফোনে ধরার জন্য ট্রাই করছি। কিন্তু তার দুটো মোবাইল ফোনই বন্ধ। 
ক্ষ্যাপে যান সিইও। 
‘তারতো একটা অফিস আছে, নাকি? আপনিতো একবার অফিসে গিয়ে খোজ নিতে পারতেন। আপনি এখনি ইমরানের কাছ থেকে জেনে আসুন এই মেয়েটি কে। কি তার পরিচয়। কিভাবে নায়িকার জায়গায় এই মেয়ের ছবি ছাপা হলো। বিস্তারিত জেনে আসুন’।
কাতর হয়ে মার্কেটিং ম্যানেজার বললেন-
‘জ্বি স্যার, জ্বি স্যার’
‘আপনি এখনি যান। মনে রাখবেন মেয়েটির নাম ঠিকানা আমার চাই। তাকে আমার খুব প্রয়োজন। 
সিইওর কথা শুনে এবার সভায় উপস্থিত সবাই কেমন একটু নড়েচড়ে বসলেন। পার্সেস অফিসার ভাবলেন, সিইও সাহেবের ঘরেতো সুন্দরী স্ত্রী আছে। এর পরও...। সবাই হিসাব মেলানোর চেষ্টা করছেন। ছবির তরুনীকে মার্কেটিং ম্যানেজারেরও খুব পছন্দ হয়েছে। কিন্তু সিইও’র চোখ পড়ে গেছে দেখতে পেয়ে তিনি মনে মনে হতাশ হলেন। বিজ্ঞাপনের কোন মডেলের সঙ্গে সাধারনত তারই সম্পর্ক গড়ে উঠে। সিইও এ নিয়ে মাথা ঘামান না। প্রথমবার তিনি এই তরুনীর প্রতি কেন আগ্রহী হয়ে উঠলেন তা ভেবে কুল কিনারা করতে পারেন না। 
সভা শেষ করার পর মার্কেটিং ম্যানেজারের রুমে যান পার্সেস অফিসার। তাদের আলাপের বিষয় হয়ে উঠে ছবির তরুনী। পার্সেস অফিসারেরও খুব ভাল লেগেছে। বিষয়টি তিনি চেপে রাখার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু  সিইওর চোখ পড়ায় যেন তার আরো বেশি ভাল লেগে যায়। এই মেয়েটির সঙ্গে তিনি পরিচিত হতে চান। কিন্তু মার্কেটিং ম্যানেজার ছাড়া সেটি সম্ভব নয়।  সে কারনেই তিনি মার্কেটিং ম্যানেজারের রুমে গিয়ে তরুনীর কথা উঠান। 
মার্কেটিং ম্যানেজারও বেশ চতুর। পার্সেস অফিসার তার রুমে এসে ছবির তরুনীকে নিয়ে কথা উঠাতেই তার মতলব বুঝে যান। তিনি এ পেশায় আছেন ১২ বছর। এর আগে দুটি বড় কোম্পানীর মার্কেটিং ম্যানেজার ছিলেন। তিনি বিজ্ঞাপনের মডেলদের নিয়ে কাজ করেন দীর্ঘ কাল। কোন মডেল কেমন তা তার চেয়ে এই অফিসে আর কেউ জানে না। হিসাব-নিকাশে মিল না পরায় বিজ্ঞাপন থেকে কত মডেল শুটিংয়ের আগের দিন বদলে গেছে তার হিসাব নেই তার কাছে। নতুন  কোম্পানীর সিইও মডেল হিসেবে ওই চিত্রনায়িকাকে পছন্দ করার কারনেই তার সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছিল। তিনি নিজে দায়িত্ব পেলে কখোনোই এই চিত্রনায়িকাকে নিতেন না তিনি। এর আগের কোম্পানীগুলোতে ওই নায়িকাকে দিয়ে তিনি চারটি বিজ্ঞাপন করিয়েছেন। ফলে ওই চিত্র নায়িকার এহেন বিষয় নেই যা তার অজানা।

০৯
গ্রাফিক্স ডিজাইনার ইমরান ভেঙ্গে পড়েছে। কী একটা বাজে কাজ সে করে ফেলেছে। এর দায় এখন কে বহন করবে। এতো দ্রুত কাজ করাটা তার ঠিক হয়নি। এতোদিন তার কাজের প্রশংসা ছিল। টুথপেস্ট কোম্পানীর আর কোন কাজ সে পাবে না। শুধুতো তাই নয় যার ছবি ছাপা হয়েছে তাকেই বা কি উত্তর দেবে সে। পুরো ঘটনাটার জন্যতো সেই দায়ী। এসব ভেবে অস্থির হয়ে উঠেছে ইমরান। 
সে সকালে অফিসে গিয়েছিল। পত্রিকাটা হাতে নিয়ে বিজ্ঞাপনটা দেখেই ভীত হয়ে পড়ে। আর কোন চিন্তা করতে না পেরে অফিসে তালা লাগিয়ে সোজা বাসায় চলে আসে। দুটো মোবাইল ফোনের সুইচ অফ করে রেখেছে সে। যে কারনে ছবি নিয়ে কি হচেছ সে ব্যাপারে সে কিছু জানতে পারেনি। তবে তোলপাড় যে হয়ে যাচ্ছে তা সে বুঝতে পারে। তার চোখের সামনে টুথপেস্ট কোম্পানীর সিইওর মুখটা ভেসে ওঠে। লোকটা বজ্জাতের হাড্ডি। হাসি হাসি মুখে খুব শক্ত শক্ত কথা বলে। ইমরানের কাছে তাকে চামার টাইপের লোকই মনে হয়। তবে মার্কেটিং ম্যানেজার আশফাক সাহেব নরম প্রকৃতির মানুষ। কিন্তু আশফাক সাহেবতো তাকে রক্ষা করতে পারবে না। এ মুহূর্তে আশফাকের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মাচ্ছে ইমরানের। তিনি একজন বড় অফিসার তিনি এতো নরম টাইপের হবেন কেন? তার হাক ডাকে ভয় পাবে অন্য কর্মকর্তারা। সিইও তাকে কোন খারাপ মন্তব্য করতে সাহস পাবে না।
মানুষের এই এক স্বভাব। নরম টাইপের মানুষকে অন্যরা খুব পছন্দ করে। কিন্তু যখনই নিজে বিপদে পড়ে তখন চিন্তা করে তার উপর একজন শক্ত টাইপের লোক থাকলে সহজে রক্ষা পাওয়া যেতো। মাঝে মাঝে ইমরান নিজেকে শক্ত হিসেবে জাহির করতে চেষ্টা করে। কিন্তু কারো সঙ্গে মেজাজ দেখানোর পর নিজে নিজে পুড়তে থাকে। ফলে সে সাধারন ভাবেই থাকতে চায়।
এমনিতে খুব একটা চা পানের অভ্যাস নেই ইমরানের। মালিবাগ এলাকায় একটি ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের একটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে সাবলেট থাকে সে। তবে ফ্ল্যটের সব কক্ষেই যাওয়া তর অনুমতি আছে। ফ্ল্যাটের মালিক বুড়ো-বুড়ি। তারা ইমরানকে সন্তানের মতোই øেহ করে। তাদের কাজের বুয়া ইমরানের জন্য রান্না করে দিয়ে যায়।
আজ ফ্ল্যাটের অন্য বাসিন্দারা কোথায় যেন বেড়াতে গেছে। ইমরান তার নিজের কক্ষে বসে ভাবছে কি করে সময় কাটাবে। সে বারে বারে পত্রিকার তিন নম্বর পাতায় চোখ বুলিয়ে ক্লান্ত হয়ে গেছে। মনে মনে ভাবলো চা বানিয়ে খেলে একটু অন্য কাজে রাখা যেতো মস্তিস্ককে। কিন্তু তার রুমে তো চায়ের কেটলী, কাপ, চিনি, চা পাতা কিছুই নেই। তাতে কি ইমরান বেরিয়ে চা বানানোর সমস্ত সরঞ্জাম কিনে নিয়ে আসে। জীবনের প্রথমবার সে চা বানাবে। নিজের মধ্যে অন্যরকম একটা অনুভুতি কাজ করছে। 
কেটলী চুলায় চাপাতেই বেজে উঠে কলিং বেল। ইমরান খুশি হয়। নিশ্চয়ই চাচা-চাচি চলে এসেছে।  মনে মনে লজ্জাও পায়। চাচা-চাচি এসে যখন তার চা বানানো দেখবে তখন হাসিতে ফেটে পড়বে। তখন ইমরান কি করবে সে প্রস্তুতি নিতে থাকে। সে দরজা খুলে চমকে যায়। দরজার সামনে দাড়িয়ে আছে মার্কেটিং ম্যনেজার আশফাক। 
এই বাসার ঠিকানা কেউ জানে না। কিন্তু আশফাক সাহেব কোত্থেকে জানলেন সে চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠে সে। বেশ কিছুক্ষন হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে থাকে ইমরান। আশফাকের কথায়ই নিরবতা ভাঙ্গে। 
‘কি বিশ্বাস করতে পারছেন না।’
‘না মানে ইয়ে’ আমতা আমতা করতে থাকে ইমরান। 
‘আপনি এই বাসায় সাবলেট থাকেন। এখন বাসায় কেউ নেই। তাই না?’
আরো চমকায় ইমরান। এতোসব আশফাক সাহেব জানলেন কি করে। তিনি কি তা হলে পত্রিকায় ভুল করে যে তরুনীর ছবি ছাপা হয়েছে তার সম্পর্কেও খোজ খবর নিয়ে এসেছে। কিছুই মেলাতে পারে না সে। হাত জোর করে বলে-
‘সরি, আই অ্যাম রিয়েলি সরি। আমার একটা ভুলের জন্যে আপনার নিশ্চয়ই খুব সমস্যা হয়েছে।’
‘ভেতরে বসতে বলবেন না।’ হাসি মুখেই বললেন আশফাক সাহেব। এবার অবাক হওয়ার পালা ইমরানের। যেখানে তাকে গালাগালি করার কথা তা না করে তিনি হাসি মুখে ভেতরে যেতে চাইলেন। ইমরান ধারনা করে নিল নিয়ে মিস্টি মিষ্টি কথার মারপ্যাচে তাকে অপমান করবেন আশফাক সাহেব। বড় অফিসারদের অপমান করার ধরনই আলাদা। অবশ্য এখন পর্যন্ত ইমরানের তেমন অভিজ্ঞতা হয়নি। তবে বন্ধুদের কাছ থেকে বড় অফিসারদের বিষয়ে ঢের শুনেছে সে। 
এতোক্ষনে ইমরানের মনে পড়লো সে দরজার সামনে দাড়িয়েই কথা বলছে। সে আশফাক সাহেবকে তার রুমে নিয়ে গেল। আশফাক সাহেব গুছানো ঘর দেখে অবাক না হয়ে পারলেন না। ইমরান এখনো বিয়ে করেনি। তার ঘরে নারীর ছোয়া থাকার কথা নয়। কিন্তু এতো সুন্দর করে ঘরটা সাজানো যে, কোন সৌখিন নারী ছাড়া এমন ঘর গুছিয়ে রাখতে পারে কেউ তা তা আশফাক সাহেবের মাথায়ই আসে না। কিন্তু এতো গুছানো একটা লোক কিভাবে এতো বড় একটা ভুল করলো তা ভেবে পাচ্ছেন না তিনি। 
চুলার উপর কেটলী দিয়ে আসার কথা মনে পড়ে যায় ইমরানের। আশফাক সাহেবকে বলেন-
‘স্যার চা খাবেন তো’? কিছুটা সময় নিয়ে বলেন-
‘না না চা আনা লাগবে না।’
‘চা আনতে হবে না। আমি বাসায়ই বানাই। অলরেডি পানি ফুটানোর জন্য চুলোয় কেটলী চাপানো হয়েছে।’ ইমরানের কথা শুনে আরো অবাক হলেন আশফাক সাহেব। শুধু ঘর গুছানোই নয় সব দিকেই হাত আছে ইমরানের। এবার আর চা খেতে আপত্তি করলেন না আশফাক।
চায়ে চুমুক দিয়েই আশফাক সাহেবের মুখ তেতো হয়ে যায়। ইমরান যে চা বানিয়ে এনেছে তা মুখে দেওয়ার মতো নয়। কিন্তু বিষয়টা বুঝতে দিলেন না আশফাক। বললেন-ভাল চা হয়েছে। ইমরান খুশি। তখনো ইমরানের কাপের চা থেকে ধুয়া উড়ছিল। খুশি মনেই ইমরান চায়ে চুমুক দিয়ে লজ্জায় পড়ে যায়। 
‘চায়ে সম্ভবত বেশি পাতা দিয়ে ফেলেছি। তেতো হয়ে গেছে। সরি স্যার।’
‘আমি এম চা-ই পছন্দ করি। কিন্তু পাই না। আপনার চা আমার ভাল লাগছে।’ এ কথা শুনে স্বস্থি পায় ইমরান। এবার কাজের কথা বলার ছুতো খুজছেন আশফাক সাহেব। তরুনীর কথাটা কিভাবে উঠাবেন ভেবে স্থির করতে পারছিলেন না। 
এতে সমস্যা হয়নি। বরং কথাটা ইমরানই উঠালো। বললো-
‘স্যার, আই অ্যাম রিয়েটি সরি। এমন একটা উল্টা পাল্টা কাজ হয়ে যাবে ভাবতেই পারিনি। আমি কি বলে যে, আপনার কাছে দু:খ প্রকাশ করবো ভেবে পাচ্ছি না। আসলে হয়েছে কি, যে মেয়েটার ছবি ছাপা হয়েছে সে আমার বান্ধবী। নাম নিশি। ইন্টার মিডিয়েট পর্যন্ত এক কলেজে পড়শোনা করেছি আমরা। আমি ওকে ...। সারাক্ষনই আসলে ওকে নিয়ে আমি ভাবি। কিন্তু ও বিষয়টা বুঝে কি না আমি জানি না। আমার কম্পিউটারে তার কয়েকটি ছবি রয়েছে। সেদিন চিত্র নায়িকার ছবিটাকে সাইজ করে বিজ্ঞাপনটি তৈরি করছিলাম। হঠাৎই আপনার অফিসের পিয়নটা এসে দ্রুত বিজ্ঞাপনটি  চাইলো। আমি আসলে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে নায়িকার ছবির জায়গায় নিশির ছবি বসিয়ে দিয়েছি। টোটাল কাজটাই হয়েছে মনের অজান্তে। এই একটি ভুল অনেক বড় ঘটনার জন্ম দিয়েছে তা আমি আছ করতে পারছি। তবে নিশির কি অবস্থা হয়েছে আমি বলতে পারবো না। আমি তার কাছে কিভাবে সরি বলবো। জানি না এ জন্য তাকে কত মাশুল দিতে হচ্ছে।’ 
‘বুজতে পেরেছি’-কথাটা বলে ইমরানকে থামিয়ে দিলেন আশফাক সাহেব। এর নিজেদের বিপত্তির কথা তুলে ধরলেন। জানালেন, চিত্র নায়িকা, সিইও, পুলিশসহ সাবইকে কিভাবে ম্যানেজ করতে হয়েছে। এও জানালেন, পত্রিকা অফিস গরম করে দিয়েছে পাঠকরা ফোন করে। পুলিশ পর্যন্ত তদন্ত করতে চলে এসেছে। এতো কিছুর পরও আশফাক সাহেবের মুখে হাসি থাকে কি করে সেটা ভেবে পাচ্ছে না ইমরান। এ আবার কোন রহস্য। রহস্যর জট খুললেন আশফাক সাহেব নিজেই। জানালেন, চিত্র নায়িকার ছবি না চেপে নিশির ছবি ছাপায় কোম্পানীর সিইও খুব খুশি হয়েছেন। বিজ্ঞাপনটি এতো আলোচিত হবে তা তিনি ধারনাই করেননি। কিন্তু এতো সারা পড়েছে যে তিনি বিমোহিত। তিনি নিশিকে ব্রান্ড এ্যাম্বাসেডর হিসেবে ব্রেক দিতে চান। এ কথা শুনে পিলে চমকানোর মতো অবস্থা ইমরানের। মেঘ না ছাইতেই জল। ইমরানের অনেকদিন ধরে ইচ্ছে ছিল নিশিকে মডেল বানাবে। কিন্তু কোন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে পরেই বিষয়টি নিশিকে জানাবে। নিশিকে সে জোর করে হলেও রাজি করাবে। তা না হলে তার মা-বাবাকে বলে তাকে রাজি করাবে। কিন্তু বড় কোন কোম্পানীর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ করতে না পারায় সে তার সুপ্ত বাসনা মনে মনেই রেখেছিল এতোদিন। কিন্তু আজ এতো বড় কোম্পানীর বিজ্ঞাপনের মডেল হিসেবে সুযোগ একে বারেই দোড় গোড়ায় এর পরও খুশি হতে পারেনি ইমরান। 
এখন তার মডেলের চেয়ে বড় চিন্তা নিশির কি অবস্থা হয়েছে তা জানতে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো মার্কেটিং ম্যানেজার চলে যাওয়ার পরই সে নিশিদের বাসায় ফোন করবে।  
 
১০
জবা আহমেদ যখন বাসায় ফিরলেন ঘড়িতে ঠিক তখন দুপুর একটা। চাকরি জীবনে আজই প্রথম একটার সময় বাসায় এসেছেন তিনি। যা দেখে বিস্মিত না হয়ে পড়েননি নাহিদ আহমেদ। একবার নিশি প্রচন্ড অসুস্থ ছিল তাও তিনি অফিসের কাজ ফেলে আসেননি। আর সেই মানুষ যদি একটার সময় বাড়ি ফেরে তা হলে কে না চমকাবে। 
জবার চোখে যেন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। প্রথমে দেখে ভয়-ই পেয়ে যান নাহিদ আহমেদ। এতো দীর্ঘ সময়ের দাম্পত্য জীবনে তাকে কোনদিন এমনটি দেখেননি। কখনো রাগ করলে নাহিদ আহমেদ হাসতেন শুধু। কিছুক্ষন গুমরো মুখে থাকার পর জবাও হেসে ফেলতেন। বলতেন-দূর তোমার সঙ্গে রাগও করা যায় না। আজ তার চোখ দেখেই নাহিদ আহমেদ বুঝতে পারছেন কতটা রেগে আছেন জবা। রাগ হবেই বা না কেন। তার মেয়ের যেভাবে ছবি ছাপা হয়েছে তাতেতো রাগ হওয়ারই কথা। বরং নাহিদ আহমেদ নিজেই ভাবছেন তিনি কেন এমন রাগ হলেন না। পত্রিকায় ছবি দেখার পরইতো তার এমন রাগ করা উচিৎ ছিল। তাহলে কি তিনি আজ পর্যন্ত রাগ জিনিসটা রপ্ত করতে পারেনি। তার মেয়েওতো তার মতোই হয়েছে।
জবা কলিং বেল চাপলে নিশি দরজা খুলে দেয়। নিশিকে সামনে পেয়েও কিছুই বলেননি জবা আহমেদ। নিশি জানতে চেয়েছিল-
‘আম্মু এতো তাড়াতাড়ি ফিরে এলে শরীর খারাপ লাগছে?’ মেয়ের প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে জবা সোজা নাহিদ আহমেদের ঘরে চলে যান। 
জবার ব্যবহারে একটুও কষ্ট পেল না নিশি। পত্রিকায় ছবি দেখার পর সে যে কষ্ট পেয়েছে এর চেয়ে বড় কষ্ট আর কি হতে পারে। তার মাও ছবি দেখেই তার দিকে এমন রাগ করেছে তা তার বুঝতে বাকি রইলো না। তা না হলে অন্যদিনের মতো একগাল হেসে মেয়েকে জিজ্ঞেস করতেন- কিরে কি খবর। ইউনিভার্সিটি গিয়েছিলি। মনটা ভালতো- ইত্যাদি জানতে চাইতেন। 
রাগ দু:খ সইতে না পেরেই হয়তো তিনি বাসায় ফিরে এসেছেন। নিশি তার সামনে গিয়ে কিভাবে দাড়াবে তাই খুজছিল। এক সময় তার মনে হলো আমিতো কোন দোষ করিনি তা হলে দাড়াতে পারবো না কেন। নিশি সাহস করে মায়ের সামনে যাওয়ার জন্য নাহিদ আহমেদের রুমের দিকে যেতে শুরু করে। কিন্তু দরজায় ফেলা পর্দা সড়ানোর আগেই জবা আহমেদের চিৎকার শোনে সে থমকে যায়। আর না এগিয়ে মা কি বলছে তাই শুনার চেষ্টা করে। জীবনে কখনো আড়ি পেতে কিছু শুনেছে বলে সে মনে করতে পারছে না। আজ কেন জানি আড়ি পাততে ভাল লাগছে তার।
জবা আহমেদ যখন ঢুকলেন তখন নাহিদ আহমেদ শুয়ে ছিলেন। মেয়েকে নিয়ে চিন্তা করছিলেন। ভাবছিলেন শুধু কি সমাজের চোখে তারা মান হারিয়েছেন। বিয়ে দিতে গেলেওতো কত ধরনের প্রশ্ন উঠবে। পাশের বাড়ির রহমত সাহেবের পরিবারতো তাদের বিরুদ্ধে লেগেই আছে অনেক আগে থেকে। এমনকি নিশি পাড়াশোনায় ভাল এই বিষয়টিও তাদের অপছন্দ। দুই বাড়ির পাশের এক হাত জমিই এই বিরোধের সৃষ্টি করেছে। বাড়ি করার সময় রহিম সাহেব নাহিদ আহমেদকে এক হাত ছেড়ে বাড়ি করার জন্য প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু নাহিদ আহমেদ তা করেননি। এর পর থেকেই তাদের মধ্যে বিরোধ চলে আসছে। এমনকি পাশাপাশি বাড়ি হলেও দুই পরিবারের কোন যোগাযোগ নেই। দুটি বাড়ির বেলকনিও লাগোয়া। এর পরও কথা হয় না দুই বাড়ির মানুষের মধ্যে। 
জবা ঢুকেই চিৎকার চেচামেছি শুরু করে দেন। নাহিদ আহমেদ তাকে বারন করতে বলেন। কিন্তু নাহিদ আহমেদের কোন কথাই শুনতে চাচ্ছেন না জবা আহমেদ। এক নাগারে মেয়েকে লাই দিয়ে বড় করার কথা বলে যাচ্ছেন জবা। নাহিদ আহমেদ সব কথার কাউন্টার দেওয়ার চেষ্টা করছেন না। দু’একটি কথার উত্তর দিতে চাইলে জবা তাকে বাধা দেয়। নিশি তার বাবার অসহায়ত্ব দেখে কষ্ট পায়। এক পর্যায়ে জবা আহমেদ বলতে শুরু করেন- 
‘তোমার লাই পেয়েই মেয়েটা উচ্চন্নে গেছে। রাস্তা থেকে কুড়িয়ে আনা মেয়ে এর চেয়ে আর কি ভাল হতে পারে? আমি তোমাকে বলেছিলাম কোন ভদ্র ঘরের মেয়েকে পালিত কন্যা হিসেবে আনার জন্য। আর আনলে কি না রাস্তা থেকে একটাকে। আজ দেখ রাস্তার মেয়ের কান্ড দেখ। তোমার মান ইজ্জত কিভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে।
নাহিদ আহমেদ কি বলে স্ত্রীকে শান্ত করবেন বুঝে উঠতে পারেন না। তিনি শুধু চাপা স্বরে বললেন-চুপ করো। মেয়েটা শুনবে।
‘শুনুক। ওর জন্ম পরিচয় জানা উচিত। সে যে আমাদের মেয়ে না এ বিষয়টা তাকে আগেই বলা দরকার ছিল। তা হলে হয়তো বেপরোয়া ভাবে চলতো না। আজ তার ছবিও ছাপা হতো না পত্রিকায়।’
এবার ধমকে উঠেন নাহিদ আহমেদ-
‘বলছি, চুপ করো’
নিশি এসব কি শুনলো! কথা গুলো তার বিশ্বাস হতে চাইলো না। কিন্তু বাবাতো প্রতিবাদ করলেন না। তার মানেতো এই সে তাদের সন্তান না। রাস্তায় পড়েছিল সে। যা প্রায়ই পত্রিকায় দেখতে পায় যে নবজাতকের লাশ উদ্ধার। 
তার চোখ বেয়ে দড় দড় করে পানি গড়িয়ে পড়ে মেঝেতে। তার কি করা উচিৎ বুঝে উঠতে পারে না। মনে পড়ে একটি পত্রিকার নিউজের কতা। যেখানে লেখা ছিল বড় হয়ে পালিত কন্যার কথা জানতে পেরে মেয়েটি আত্মহত্যা করেছিল। তারও তো একই অবস্থা তা হলে সে কি করবে। সেও কি আত্মহত্যা করবে। নিশি কিছু সময়ের জন্য স্ট্যাচু হয়ে দাড়িয়ে থাকে।
সে কি চিৎকার করে কাদবে। নাকি বাসা থেকে পালিয়ে যাবে। নাকি প্রতিবাদ করবে মায়ের কথার। কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। অবশেষে সিদ্ধান্ত নেয় চুপ থাকবে। সে কিছুই শুনেনি। তার মা যা বলেছে রাগ করে বলেছে। সেও হয়তো মায়ের জায়গায় থাকলে এমনটিই করতো। 
নিশি খুব ঠান্ডা প্রকৃতির মেয়ে। খুব সহজে তার মাথা গরম হয় না। বিনা দোষে অন্য কোন মেয়ের ছবি এভাবে পত্রিকায় ছাপা হলে এতোক্ষনে হয়তো পত্রিকা অফিস গরম করে ফেলতো। কিন্তু নিশি চুপচাপ। একেবারে চুপচাপ। সে বুঝার চেষ্টা করছে কেন এমনটি হলো। তার যুক্তি- না বুঝে লাফ দেওয়াটা তার স্বভাবের বাইরে। সে একটু ঢিলা টাইপের মেয়ে এটাও সে জানে। কোন কাজ করলে সে কাজের মতোই করে। চটফটানি একদম অপছন্দ তার। 
পরীক্ষার হলে তার অনেক বান্ধবীকে দেখেছে প্রশ্ন হাতে পেলে মাথা গরম করে ফেলে। কিন্তু নিশির কোনদিনও এমনটি হয়নি। এ কারনে কখনো কখনো তার বন্ধুরা তাকে রোবট বলেও আখ্যা দিতে ছাড়েনি। তাতে কি, নিশি মজাই পায় তাদের কথায়। রোবট হওয়াটা খারাপের কি! কম কথা, কম পাপ, কম ঝামেলা-এ কথায় বিশ্বাসি সে। এ ছাড়া ছোট বেলা থেকেই তার খুব একটা কথা বলতে ভাল লাগে না। তবে কথা শুনতে তার খারাপ লাগে না। এ কারনে তার যেসব সহাপাঠি অধিক কথা বলে (বাচালের পর্যায়ে) তারা নিশির সঙ্গে আড্ডা দিতে পছন্দ করতো। অন্যদের মঙ্গে তারা আড্ডা দিয়ে মজা পেতো না। কারন বাচাল বন্ধু যাই বলুক তাই মাথা পেতে নেয় নিশি। যে কারনে বাচাল বন্ধুরা কথা বলে বেশ মজা পায়। নিজেকে জাহির করারও চেষ্টা করে। আর নিশি যে দু’একটা কথার উত্তর দেয় তা তাদের প্রশংসাই থাকে শুধু।
নিশি সোজা চলে যায় বাথরুমে। চোখ ধুয়ে নিজের কান্না মুছে ফেলার চেষ্টা করে সে। দু’বার আয়নায় তাকিয়ে দেখে কাদলে আসলে তাকে কেমন লাগে। চোখ দুটো লাল দেখা যায়। এমন লাল চোখ থাকলে কান্নার বিষয়টি তার বাবা ধরে ফেলতে পারেন। হয়তো তিনি কান্নাও শুরু করে দিতে পারেন। এ কারনে নিশি যতোটা পারে চোখে পানি দিয়ে লাল ভাবটা কাটানোর চেষ্টা করে। চোখের কান্না মুছলেও ভেতরের কান্না সে কিভাবে মুছবে তার হিসাব কষতে শুরু করে। বার বার মনকে বুঝানোর চেষ্টা করে সে যা শুনেছে তা একেবারেই মিথ্যা। এমনটি হতেই পারে না। যদি তাই হতো তা হলে তার মা তাকে এতো আদর করতো না। কখনো না কখনো সে বুঝতেই পারতো। শুধু কি জন্ম দিলেই মা হওয়া যায়? হয়তো জন্ম  দেয়া নারী তাকে এতো আদর-øেহ করতো না যতটুকু সে জবা আহমেদের কাছ থেকে পেয়েছে। তা হলে কেন সে তার মা হবে না? নিজে নিজেই যুক্তি পাল্টা যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করছে আয়নার ভেতরের নিশির সঙ্গে। 
বাবার ডাক বাথরুম থেকে শুনতে পায় নিশি। ততক্ষনে জবা আহমেদ তার কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেছে। নিশি বাবার সামনে গিয়ে কি করবে কাদবে নাকি স্বাভাবিক থাকবে সে প্লান করতে থাকে।

১১
ইমরান নিশির কাছে কিভাবে ক্ষমা চাইবে তার চিন্তা করতে থাকে। নিশির সঙ্গে তার অনেক দিন দেখা নেই। কিন্তু তার ওই ছবিটার সঙ্গে তার প্রতিনিয়ত দেখা হয়। তার একটি মাত্র ছবি সেই তুলেছিল। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পর বন্ধুরা মিলে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে গিয়েছিল। আর তখনই ইমরানের ক্যামেরায় নিশির ছবিটি ধরা পড়ে।
ঢাকায় ফিরে ছবিটি যখন কম্পিউটারে ঢালে তখন ইমরান বুঝতে পারে নিশি আসলে কতটা ফটোজেনিক। হবে বা না কেন, তার হেয়ার স্টাইল, মেকাপ বোধ একজন বিশেষজ্ঞের চেয়ে কোন অংশেই কম নয়। ইমরানের স্পষ্ট মনে আছে। নিশি হোটেল থেকে ম্যাডামদের সঙ্গে বেরিয়ে যখন বাসে উঠতে যাচ্ছিল তখন সবারই চোখ ছিল নিশির দিকে। সেদিন খুব বেশি বাতাস বইছিলো না। তবুও উড়ছিল নিশির চুল। লম্বা চুলগুলোতে যেন তখন সমুদ্রের ঢেউ। সমুদ্র দেখতে আসার কারনেই হয়তো ইমরানের কাছে তার উড়ন্ত চুলগুলোকে সমুদ্রের ঢেউ মনে হচ্ছিল। 
ইমরান কলেজের ভর্তি হওয়ার পর নিশিকে ওভাবে দেখতে পায়নি। কিন্তু নবীন বরন অনুষ্ঠানের দিন নিশিকে চোখে পড়ে তার। সেই যে চোখে পড়া এর পর একদিন না দেখলে যেন কি একটা অপূর্ন থেকে যায় তার কাছে। কত ছুতোয় সে নিশির সঙ্গে কথা বলতে যেতো তার হিসাব নেই। তবে নিশি কখোনোই রাগ করতো ন। তবে বুঝতো কোন একটা ছুতোয় ইমরান তার সঙ্গে কথা বলতে এসেছে। তাতে রাগ করার কি? কত জনইতো তার সঙ্গে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে আসে। এ নিয়ে অন্য ধরনের চিন্তা মাথায় আসে না নিশির। তবে ইমরান কেন বারবার নিশির সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগতো তা বুঝতে পারতো না। তার মাঝে তার প্রতি যে একটা ভাল লাগা তৈরি হয়েছিল সে তা অনুমান করতে পারে। কিন্তু গম্ভীর প্রকৃতির নিশির সামনে গিয়ে তার ভালবাসার কথা বলার মতো সাহস তার কেন কলেজের ছাত্র সংসদের নেতাদেরও নেই। 
আর বড় ভাইদের অনেকের চোখইতো পরে থাকতো নিশির দিকে। যে কারনে নিশির সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ইমরানের একটা ভয় কাজ করতো। 
একদিন প্রচণ্ড বৃষ্টিতে কলেজে আটকে গিয়েছিল নিশি। বের হতে হতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। তখন নিশিদের বাড়ির কাছেই ছিনতাইকারীদের বেশ উৎপাত ছিল। এ কারনে সন্ধ্যার আগেই নিশি বাসায় ফিরে যেতো। তাতেই বা কি একদিন বিকালেই তার কাছ থেকে ভ্যানিটি ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়েছিল ছিনতাইকারীরা। এ কারনে ইমরানের সহযোগিতা চেয়েছিল নিশি। তার সঙ্গে বাসা পর্যন্ত তাকে পৌছে দেয়ার অনুরোধ করলে ক্ষনকাল দেরী না করে রাজি হয়েছিল ইমরান। 
রিক্সায় পাশাপাশি নিশির সঙ্গে বসার সুযোগ পাবে সে সেটা সে চিন্তার মধ্যেই আনেনি। খুব খুশি ইমরান। নিশিও সেটা বুঝতে পারে। এ নিয়ে কোন ধরনের মন্তব্যও করেনি নিশি। ইমরান যতোটা পারে নিশির গায়ে যেন গা না লাগে সেরকম চেষ্টা করে যায়। রিক্সায় উাঠার পর পরই নিশি বাম দিকে এমনভাবে সরে বসে মনে হচ্ছিল যেন আর একটু সড়লে নিচে পড়ে যাবে। তার কাধে যাতে ইমরানের কাধ লেগে না যায় সে কারনেই হয়তো নিশি এমন দূরত্ব রাখার চেষ্টা করছে। নিশির সঙ্গে এক রিক্সায় চাপতে পেরেছে এটাই ইমরানের জন্য অনেক বড় পাওয়া। কাধে কাধ লাগার কারনে তাকে নেমে যেতে হয় কি-না এ ভয়টাও কাজ করে তার মধ্যে। তরুন রিক্সাচালক খুব বেগেই রিক্সা চালিয়ে নিচ্ছিল। একটি স্পিড ব্রেকারে পার হওয়ার সময় রিক্সা প্রচন্ড ঝাকুনি খায়। আর তখন এক হয়ে যায় ইমরান ও নিশির কাধ। সজোরে ধাক্কা খায়। নিশির কাধের নরম অংশের ধাক্কাটা এখনো মনে পড়ে তার। এমন অনুভূতি সে আজ পর্যন্ত ভুলতে পারে না। পরবর্তীতে যখনই সে নিশিকে দেখতো তখন তার চোখ পড়তো নিশির বাম কাধের দিকে। 
একবার অবশ্য নিশিকে খুব জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছিল ইমরানের। ঠিক সেই সময় নিশি তাকিয়েছিল তার দিকে। নিশি নরম চোখে তাকালেও ইমরানের কাছে শক্ত মনে হয়েছিল। মহূর্তেই তার মোহ ভঙ্গ হয়ে গিয়েছিল তার। ভয় পেয়ে যায় ইমরান। নিজের অজান্তেই ‘সরি’ বেরিয়ে আসে। নিশি সেদিন বিস্মিত না হয়ে পরেনি। 
সরির ব্যাখ্যাও চেয়েছিল নিশি। ইমরান তার মনের ইচ্ছে গোপন করে বলেছিল-
‘না তোমার গায়ে আমার গা লেগে গিয়েছিলতো তাই ’।
ইমরানের কথা শুনে সেদিন নিশি খুব হেসেছিল। সেই হাসিতে কোন কৃত্রিমতা ছিল না। এরপরও ভয় পেয়ে গিয়েছিল ইমরান। লাল হয়ে গিয়েছিল তার মুখ। নিশি শুধু বলেছিল-
‘ইমরান তুমি না একটু বোকা টাইপের। সেটা কি তুমি জানো’?। ইমরান বিস্মিত-
‘নাতো’। এর পর আরো হেসেছিল নিশি। হাসি ঠাঠ্রার মধ্যেই সেদিন রিক্সাটি পৌছে গিয়েছিল নিশিদের বাসার সামনে। আর নিশিকে নামিয়ে দিয়ে একই রিক্সায় চলে গিয়েছিল ইমরান।
ওই দিন তাদের দু’জনকে এক রিক্সায় দেখেছে অনেক বন্ধু। ফলে নিশির সঙ্গে ইমরানের প্রেম হয়েছে সেটি বেশ চাওড় হয়। কিন্তু ইমরানতো জানে রিক্সার কাহিনী। কে শুনে কার কথা। ঈর্ষায় জ্বলে যাচিছল ইমরানের ক’জন সহপাঠি। 
ইমরান নিশির কথাগুলো এক বড় ভাইয়ের সঙ্গে আলোচনাও করেছিল। সেই বড় ভাই তাকে বুঝিয়েছিল কথা শুনে বুঝা যাচ্ছে মেয়েটি তোমার প্রেমে পড়েছে। সেদিন থেকেই ইমরান নিশিকে ভাল বাসে। কিন্তু নিশি তাকে ভালবাসে কি না তা বুঝতে পারে না। 
ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর ইমরানও নিশি একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিযেছিল। কিন্তু নিশির হলেও ইমরান পারেনি। পরে সে একটি কলেজে ভর্তি হয়। পাশাপাশি কম্পিউটারের প্রশিক্ষন নিতে শুরু করে। বেশ কিছুদিন কাজ করে সে গ্রাফিক্স ডিজাইনের উপর পাকা হয়ে যায়। বিভিন্ন কোম্পানীর কাজ পেতে থাকে সে।
নিশির সঙ্গে শেষ কবে কোথায় দেখা হয়েছিল তা এ মুহূর্তে মনে পড়ছে না তার। তবে মাঝে মাঝে মোবাইল ফোনে কথা হতো। রাত ১২ টার পর ইমরান তাকে ফোন করলেও বিরক্ত হতো না। বরং খুশিই হতো নিশি। কারন তখন সে পড়ে বিছানায় যেতো। আর ওই সময় নিজেকে একটু ফ্রেস করে নেওয়ার জন্য নিজের মনটাকে বইয়ের বাইরে নেওযার সুযোগ পেতো। এ কথাটা কয়েকদিন ইমরানকে বলেছেও নিশি। 
নিশির অবস্থা জানতে ইমরান মোবাইল হাতে নেয়। তার হাত কাপছে। কিভাবে বলবে যে তার সামান্য ভুলের কারনে এতো বড় একটা কান্ড ঘটে গেছে। এর পরওতো বলতে হবে। সে যে অপরাধী। সে ক্ষমা চাইবে নাকি হেসে বিষয়টাকে হালকা করবে ভেবে পায় না। বন্ধুর কাছে কি ক্ষমা চাওয়া যায়। কেন চাওয়া যাবে না। এতো তো প্রেস্টিজ যাওয়ার কথা নয়। বরং মহত্ব বাড়ার কথা। কি করবে ইমরান বুঝে উঠতে পারে না। শেষমেষ সিদ্ধান্ত নেয় সে প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নেবে। প্রয়োজনে পায়ে ধরে ক্ষমা চাওয়ার কথা বলবে সে। এতে মান-ইজ্জত গেলে যাবে। নিশির বিপদের চেয়ে তার ইজ্জতটা এ মুহূর্তে বড় নয়।
ইমরান মোবাইলের সেইভ করা নম্বর থেকে নিশির নম্বরটা বের করে। সেন্ড বাটনে চাপ দেওয়ার পর পরই তার হাত আরো বেশি কাপতে থাকে। এভাবে তার হাত কাপছে কেন? এর আগেতো কোনদিন এমন হয়নি তার। তা হলে নিশ্চয়ই সে যে ভুলটা করেছে তা বড় ধরনের অন্যায় হয়েছে। কিভাবে সে এই অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত করবে। সেকি প্রায়শ্চিত্ত করছে না। হাত কাপা কি প্রায়শ্চিত্তের অংশ নয়।
অনেক্ষন ধরে ফোনটি বাজলো। কিন্তু কোন উত্তর মিললো না। মোবাইলের মনিটরে ভেসে উঠলো নো আনাসার। ইমরান ধারনা করলো নিশি মোবাইলের কাছে নেই। তা না হলে অবশ্যই তার ফোনটি ধরতো। মোবাইল কেনার পর যতবার নিশিকে ফোন করেছে সব বারই তার ফোন ধরেছে সে। তা হলে আজকে ধরবে না কেন। নিশ্চয়ই সে মোবাইল থেকে দূরে কোথাও আছে। আবারো ফোন করে ইমরান। এবারও একই ফল। ইমরানের তর সাইছে না। সে একের পর এক ফোন করেই যাচ্ছে। কিন্তু নো আনসার। ৫০ বারের মতো ফোন করে সে বিরক্ত হয়ে যায়। বুঝতে পারে নিশি ইচ্ছে করেই তার ফোন ধরছে না। ঠিক তখন তার বুকের মধ্যে কেমন একটা কষ্ট চেপে বসে। কাদতেও ইচ্ছে করে তার। কাদলে ফ্ল্যাটের অন্য বাসিন্দারা তাকে বোকা ভাববে এ কারনে কান্না লুকোনোর চেষ্টা করে। কিন্তু ভেতরের কান্না চলতেই থাকে অবিরত। 
ইমরান কখনো বিছানায় যায় কখনো রুম তালাবদ্ধ করে বাইরে হাটতে যায়। কোথাও শান্তি পায় না সে। এক বার ভাবে রমনা পার্কে চলে গেলে হয়তো কিছুটা ভাল লাগবে। কিন্তু সেখানে গিয়ে যখন প্রেমিক-প্রেমিকার জুটি দেখবে তখন হয়তো তার মনে নিশির ছবিটা আরো বেশি করে ভাসতে থাকবে। ফল হবে উল্টো। তা হলে কোথায় যাওয়া যায়। সে বরং টুথ পেষ্ট কোম্পানীতে যাওয়াই স্থির করলো। 
১২
নিশি পত্রিকায় পড়েছিল - এক নবজাতককে কে বা কারা রাজধানীর একটি জায়গায় ডাস্টবিনের ভেতর ফেলে যায়। শিশুটি পলিথিনের প্যাকেটে মুড়ানো ছিল। যেন এটি কোন বস্তু। যেমনটি মুড়িয়ে ডাস্টবিনে ফেলে দেওযা যায়। কি করার ছিল সেই শিশুর। নিশ্চয়ই পলিথিনে মুড়ানোর সময় শিশুটি কান্না করেছে। পাষন্ড মায়ের দিকে তাকিয়ে নিজের অসহায়ত্বের কথা বুঝানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু কারোরই মন গলেনি। তাকে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে জঞ্জাল দূরের মতো একটা ব্যবস্থা করেছে তারা। 
পত্রিকার সংবাদ অনুযায়ী খুব ভোরেই তাকে ওই ডাস্টবিনে ফেলে যাওয়া হয়। তখন হয়তো পুরো এলাকা ছিল নিঝুম। আর ওই সুযোগেই পলিথিনে মোড়ানো প্যাকেটটি সহজেই ফেলে যাওয়া সম্ভব হয়েছে। ভোরে কাকের দল খাবারের খুজে বেরিয়ে ডাস্টবিনের মধ্যে নরম দেহের এই শিশুকে পেয়ে উল্লাস করেছিল। নিষ্পাপ এই মানুষটির প্রতি কাকও দয়া দেখায়নি। বরং উৎকৃষ্ট খাবার মনে করে তারা শিশুর নাকে মুখে ঠোকর বসাচ্ছিল। আর অসহায় এই শিশু গগন বিদারী চিৎকার করতে থাকে। এইটুকু শিশুর কিইবা চিৎকারের শব্দ আছে। কত দূরেই বা যেতে পারে তার কান্নার আওয়াজ। 
কিন্তু সেই কান্নার শব্দ পাষন্ড মায়ের কানে না পৌছালেও পৌছেছিল এক হৃদবান রিক্সাচালকের কানে। ওই সময় রিক্সাচালক প্যাসেঞ্জারের আশায় রাজধানীর বুক ছিড়ে রিক্সা চালাচ্ছিলেন। ডাস্টবিনের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময়ই তিনি কান্নার আওয়াজ পান। প্রথমে বুঝতে পারছিলেন না। কান্না শুনেই তিনি থামিয়ে দেন তার রিক্সার গতি। দেখলেন ডাস্টবিনের ভেতরে কাকের দল কি একটা নিয়ে ঠানাটানি করছে। আর সেখান থেকেই ভেসে আসছে শিশুর কান্না।  তখন হাহাকার করে উঠে রিক্সা চালকের মন। তিনি দৌড়ে যান ডাস্টবিনের কাছে। দেখতে পান কাকের দল তার নাক কান ক্ষত বিক্ষত করে দিয়েছে। ক্ষত স্থান থেকে রক্ত ঝরছে। চোখ থেকে ঝরছে পানি।
খবরটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। অনেক মানুষ ছুটে যান সেখানে। শিশুটিকে ভর্তি করা হয় হাসপাতালে। সেখান থেকে পিতৃ øেহে বড় করার জন্য তাকে নিয়ে যান এক মহান ব্যক্তি। 
নিশির মনে আছে ওই সংবাদটি পড়ে তার চোখের জলে পত্রিকার পাতা ভিজে গিয়েছিল। যে তাকে জন্ম দিয়েছে তাকে হত্যা করতে ইচ্ছে করছিল তার। যে শিশুকে রাস্তায় ফেলে দিতে হবে তেমন শিশু জন্ম দিতে কে তাকে অধিকার দিয়েছে। শুধু ওই মায়ের প্রতিই নয় সমাজের প্রতিও তার ক্ষোভ জন্মায়। সমাজের চোখে নিজেকে কুমারী বলে পরিচয় দেওয়ার জন্যই হয়তো সেই মা তার শিশুকে রাস্তায় ফেলে দেওয়ার বিকল্প কিছু পায়নি। শিশুর অপরাধ কি ছিল? এই পাপ কি সমাজকে একটুও তারিত করবে না? 
নিশি সেদিন আরো ভেবেছিল ওই শিশুটির সংবাদ সে যেমন পড়ছে পত্রিকার পাতায় সেটি কি তার মায়ের চোখে পড়ছে না। নাকি তার মা অশিক্ষিত। যদি তার মায়ের চোখে তার সন্তানের কাক ঠুকরানোর সংবাদটি পড়ে থাকে তা হলে তার কি অবস্থা হয়েছে। রিপোর্টার যতোটা আবেগ দিয়ে রিপোর্টটি লিখেছে সেই আবেগ তার পাষন্ড মাকে কতটা দোলাতে পেরেছে তা তার জানার খুব ইচ্ছে করছিল নিশির।  
শিশুকে নিয়ে যাওয়া সেই মহান ব্যক্তির পা ছুয়ে সালাম করতে ইচ্ছে করছিল নিশির। তার বড় জানতে ইচ্ছে করছিল সেই শিশুটি এখন কেমন আছে। সে যখন বড় হবে তখন তা জেনে তার কেমন লাগবে। কাক ঠুকরানোর সেই দৃশ্যটি চোখের সামনে দেখতে পায় নিশি।
কিন্তু কে জানতো সে নিজেও তেমনি একজন শিশু। যাকে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে এনে বড় করেছে মহান নাহিদ আহমেদ। নিজের অজান্তেই চোখ ভেজে যায় নিশির। আজ ইচ্ছে করে ওই মহান ব্যক্তি নয় নাহিদ আহমেদকে তার সালাম করা উচিত। জবা আহমেদের কথা যদি ঠিক হয় তা হলে নাহিদ আহমেদ ওই মহান ব্যক্তির চেয়ে কোন অংশেই কম নয়। মনে মনে ভাবে এখন কি সে বাবার সামনে গিয়ে দাড়াবে। সালাম করার জন্য দুটো পা এগিয়ে দিতে বলবে।  
কিছুই সিদ্ধান্ত নিতে পারে না নিশি। তার মনে অনেক ধরনের কথা খেলা করে যাচ্ছে। ভাবছে তা হলে সে কোন রাস্তার পাশে পড়েছিল? তার গায়ে কি কোন কাপড় ছিল? নাকি পাষন্ড মা খালি গায়েই ফেলে দিয়েছিল রাস্তার পাশে বা ডাস্টবিনে। তার দেহে কি কাক ঠুকরোচ্ছিল। নাকি ব্যাগের ভেতর তাকে ফেলে পালিয়ে গেছে তার পাষন্ড মা। পত্রিকার পাতায় এসব খবর সে প্রায়ই পড়ে থাকে। তা হলে কি সে নিজেই এর শিকার বলে ওই সংবাদগুলো তাকে নাড়া দিয়ে যেতো। তার জানতে বড় ইচ্ছে করছে। কিন্তু সে যে তার মা বাবাকে বুঝতে দিচ্ছে না যে সব শুনেছে। ক’দিন পরই বিয়ে হওয়ার পর সে অন্যের ঘরে চলে যাবে। তা হলে এই সময়ে এসে এসব নিয়ে ঝামেলা করতে তার পছন্দ হলো না। তবে তার খুব জানতে ইচ্ছে করছে তার বাবা-মা আসলে কে? 
নিশির ঘরে থাকা নাহিদ ও জবা আহমেদ দম্পতির একটি ছবি নিয়ে বাথরুমে যায়। ছবির সঙ্গে তার মুখের মিল খোজার চেষ্টা করে। কিন্তু না একদমই মিলছে না। অন্যর সন্তান কেন তাদের সঙ্গে মিলবে। তবে সে এতো সুন্দরী হলো কি করে। তা হলে নিশ্চয়ই তার প্রকৃত বাবা-মা বেশ সুন্দর-সুন্দরী ছিলেন। তা হলে তারা তাকে রাস্তায় ফেলে গেলো কেন? নাকি মায়ের বিয়েই হয়নি। সে অবৈধ সন্তান। যে কারনেই তাকে তার মা রাস্তায় ফেলা ছাড়া বিকল্প পায়নি। সে কোথায় জন্মেছে, কোন নার্সিং হোমে, নাকি কোন বাসায়। জন্মানোর পর পরই কি তাকে রাস্তায় ফেলে দেওয়া হয়েছিল। মায়ের স্তন পান কি সে করতে পারেনি। কিন্তু রাস্তা থেকে নাহিদ আহমেদ তাকে কিভাবে নিয়ে এলো। 
কষ্টের মধ্যেও হাসতে ইচ্ছে করলো নিশির। কি আশ্চর্য তার জন্ম। হয়তো কোন বস্তির মেয়ের ঘরে সে জন্মেছে। কিন্তু বড় হয়েছে একজন উর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তার বাসায়। যার সুনাম, প্রতিপত্তি রয়েছে। যদি সে তার প্রকৃত মায়ের কাছে থাকতো তা হলে কি সে বস্তিতে বড় হতো? মানুষের বাসায় ঝি এর কাজ করতো? গৃহকত্রীর কাজ পছন্দ না হলে তার গায়ে কুন্তির ছ্যাকা দিতো? নাকি সুন্দরী হওয়ার কারনে সাহেবদের লালসার শিকার হতো সে। যা একদম অপছন্দ তার।  প্রায় দিনইতো এমন খবর পত্রিকার পাতায় পড়ছে নিশি। এ কারনেই কি তার নাম নিশি অর্থাৎ রাত রাখা হয়েছে। আসলেইতো তার জীবনটা রাতের মতো অন্ধকারই।
সেদিন রাতে নিশি আর তার ঘর থেকে বের হয়নি। তবে সে দরজা আটকায়নি। তার বাবা-মাও তার তেমন খোজ নেয়নি। সন্ধ্যার দিকে দু’বার নাহিদ আহমেদ পর্দা সরিয়ে ঘরে চোখ ফেলেছে যা চোখ এড়ায়নি নিশির। মধ্যরাত পর্যন্ত তার ঘুম হয়নি। না না চিন্তা তার মনে গেথে ছিল। এতো চিন্তার মধ্যেই এক সময় সে  ঘুমিয়ে গিয়েছিল। 
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখতে পেয়েছিল তার গায়ে কাথা রয়েছে। সে কাথা ছাড়াই ঘুমিয়েছিল। বুঝতে বাকি নেই বাবা অথবা মায়ের দু’জনের কেউ তাকে নজরে রেখেছে। রাতের কোন এক সময় যখন বৃষ্টি শুরু হয়েছে তখন তাদের একজন তার গায়ে কাথা জড়িয়ে দিয়েছে। যাতে শীতে সে কষ্ট না পায়। রাস্তা থেকে কুড়িয়ে পাওয়া একটি মেয়েকে কেন এতো আদর করতে হবে সেটাও মেলাতে পারে না নিশি। শুধু একবার তার হাসতে ইচ্ছে করে। আরেকবার কাদতে। আবার সে এটাও জানে। এমনটা শুধু বোকাদের ক্ষেত্রেই হয়। তা হলে কি সে বোকা। হিসাব মেলানোর চেষ্টা করে নিশি। এ হিসাব মেলানোর কোন ক্যালকুলেটর পৃথিবীতে আবিস্কার হয়েছে কি না তা জানা নেই তার।
১৩

টুথপেস্ট কোম্পানীর সিইও মার্কেটিং ম্যানেজার আশফাককে তার কক্ষে ডাকলেন। নিশির সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়েছে কি না জানতে চাইলেন। তাকেই বানানো হবে ব্রান্ড এ্যাম্বাসেডর। যতো টাকা চায় ততো টাকাই তাকে দেওয়া হবে। সিইও নিশ্চিত এই মেয়েকে দিয়ে বিজ্ঞাপন বানানোর পর টিভিতে প্রচার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মানুষের নজর কাড়বে। সিইওর সঙ্গে একমত মার্কেটিং ম্যানেজার আশফাকও। তার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে সিইওকে আশ্বস্থ করা হয়েছে। কিন্তু ইমরান যেভাবে ছবি উল্টা পাল্টা করেছে তা জেনে না আবার নিশি বেকে বসে সে চিন্তাও হচ্ছে আশফাক সাহেবের। 
সিইও কোন কথা শুনতে চান না। কামান্ডিং স্টাইলে মার্কেটিং ম্যানেজারকে বলেন-
‘এই মেয়ে আমাদের টুথ পেষ্ট কোম্পানীর ব্রান্ড অ্যাম্বাসেডর। ব্যাস।’ 
বেশ বিপাকেই পড়েছেন মার্কেটিং ম্যানেজার। তাকে বুঝানোর চেষ্টা করলেন-
‘স্যার মেয়েটির সঙ্গে এখনো আমাদের কথা বলা সম্ভব হয়নি। স্যার সেতো রাজি নাও হতে পারে। ইমরানের মুখ থেকে যা শুনলাম তাতেতো মেয়েটির বাবা একজন পদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। মাও একজন ব্যংক কর্মকর্তা। স্যার, সেতো রাজি নাও হতে পারে।’
‘মেয়ের চেহারাইতো বলে দেয় যে সে সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। এতো খোজ নিয়ে সেটা বুঝতে হবে কেন? আমি এ কারনেইতো বলছি, এই মেয়েই হবে আমাদের টুথ পেস্ট কোম্পানীর ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর। ’
‘স্যার তবুও আরেকবার চিন্তা করে দেখলে হয় না?’ আশফাক সাহেবের গলায় কাকুতির সুর। এবার ধমকে উঠেন সিইও। 
‘আপনি জানেন না আমি এক কথা মানুষ। এক কথা দু’বার বলা পছন্দ করি না।’ আশফাক সাহেব মাথা নিচু করলেন। তিনি জানেন, এখন আর কোন কথা বলা যাবে না। তা হলে তার চাকরিটাও হয়তো নিরাপদ থাকবে না। কথা কথায় চাকরি খাওয়া অভ্যাস আছে এই সিইওর। ১ বছরের প্রতিষ্ঠানে এ পর্যন্ত ২০ জনের বেশি কর্মকর্তা কর্মচারিকে চাটাই করা হয়েছে। তাদের অপরাধ শুধু সিইওর কথা যথাযথভাবে পালন করতে পারেনি। 
আশফাক সাহেবের দুটি ছেলে। দুটো ছেলেকেই তিনি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াচ্ছেন। অনেক খরচ। তার স্ত্রী এক সময় চাকরি করলেও এখন বেকার। এ মহূর্তে টুথপেস্ট কোম্পানীর চাকরি চলে গেলে মহা বেকায়দায় পড়তে হবে তাকে। বাসায়ও গোলমাল শুরু হয়ে যাবে। আগের কোম্পানী থেকে আশফাক সাহেব ছাটাই হয়েছেন। এর পর মাস দুয়েক বেকার ছিলেন। ওই সময়ই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন স্ত্রীর ভালবাসা আসলে চাকরির জন্যই বেশি। সুতরাং বিজ্ঞাপনের মডেলের কারনে তিনি চাকরি হারাতে রাজি নন। সিইও যা বলছেন সেই মতো কাজ করাই ভাল। কিন্তু কিভাবে তিনি নিশিকে বিজ্ঞাপনের মডেল বানাবেন সে চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়লেন। এক দিকে সিইওর কঠিন মুখ, অন্যদিকে একটা চ্যালেঞ্জ। দুই চিন্তায় তিনি এসি রুমের মাঝে বসে ঘামতে শুরু করলেন। ক্রমশই তার ঘাম পিঠের দিকে শার্ট ভিজিয়ে দিচ্ছে। তিনি অনুমান করেন কিছুক্ষন পর বুকের দিকের শার্টও ভিজে যাবে। কপালের ঘাম এরই মধ্যে সিইওর চোখে পড়েছে। তিনি বিরক্ত নিয়ে টিস্যু পেপারের বক্স এগিয়ে দিয়ে বলেন-
‘নেন ঘাম মোছেন।’ এ সময় তার শরীর দিয়ে আরো বেশি ঘাম বেরুতে শুরু করে। আশফাক সাহেব অনুভব করছেন সারা শরীরের যতো পানি আছে লুম কুপ দিয়ে এখন সব বেরিয়ে যেতে চাইছে। বেজায় অস্বস্থিতে পড়ে গেলেন তিনি।
এর মধ্যেই দরজা ঠেলে পিয়ন রইস আসে ভেতরে। মাথা নিচু করে সিইওর সামনে দাড়িয়ে জানায়, একজন তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। সিইও ভেতের পাঠানোর অনুমতি দেয়।
দরজা ঠেলে যুবক ভেতরে ঢুকতেই আশফাক সাহেবের চোখ চড়ক গাছ। ইমরান তার কাছে না গিয়ে সিইওর কাছে এসেছে কেন? সিইও’র সঙ্গেতো তার কোন পরিচয়ই নেই। 
সিইওর জিজ্ঞেস করতে হয়নি ইমরান নিজে থেকেই পরিচয় দেয়। বিজ্ঞাপনের ছবি বদলে যাওয়ার কথাও খুলে বলে সে। ইমরানের স্মার্টনেস দেখে খুশী হন সিইও।  
এর পর দীর্ঘক্ষন ধরে সিইও কথা বলেন ইমরানের সঙ্গে। সিইওর হাসি খুশি ভাব দেখে আশফাক সাহেবের ঘাম শুকাতে থাকে। এবার ঝামেলাটা বোধ হয় তার মাথার উপর থেকে ইমরানের উপরই পরবে। তিনি মনে মনে খুশি। আশফাক সাহেবের মনে হয় যে ভুল হয়েছে, এর পর তাকে মডেল বানানোর অফার করতে গেলে মার খাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। এমনকি পুলিশেও দিতে পারে। 
নিশিকে টুথপেস্টের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর বানানোর কথা জানায় ইমরানকে। ইমরান খুশি। তবে আশংকা কাজ করে যায়। সে কম করে হলেও নিশির মোবাইলে ৫০ বার ফোন করেছে। একবারও নিশি তার ফোন রিসিভ করেনি। এমনকি মিসড কল দেখে অনেক সময় পেরিয়ে গেলেও একটি কল পর্যন্ত করেনি। তা হলে বোধ হয় সে বুঝে গেছে এই কাজ তার হাত দিয়েই হয়েছে। সে নিশ্চয়ই জানে তার কাছে এই ছবিটি রয়েছে। যদি ধরতে না পারতো তা হলে সে নিশ্চয়ই তার মোবাইল ফোনটি ধরতো। আর যদি তেমন সমস্যাই হতো তা হলে নিশ্চয়ই তার মোবাইল ফোন খোলা থাকার কথা নয়। অনেক কিছু মনের মাঝে ঘুরপাক খেয়ে যাচ্ছে ইমরানের। 
আশফাক ইমরান দু’জনকে চিন্তিত দেখে সিইও নিজেও চিন্তায় পড়ে গেলেন। তা হলে কি তার আশা পূরন হবে না। নিশিকে তিনি ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর বানাতে পারবেন না। যেখানে দেশের জনপ্রিয় চিত্রা নায়িকা, মডেলরা একবার বললে লাফিয়ে পড়তো সেখানে অখ্যাত একটি মেয়েকে বিজ্ঞাপনের মডেল হিসেবে পাওয়া যাবে না? জেদ ধরলেন সিইও, যেভাবেই হোক নিশিকে মডেল বানাতেই হবে। এটা তার একটা চ্যালেঞ্জ।
সেদিন তার চ্যালেঞ্জের কথা ইমরান ও আশফাক সাহেবকে জানিয়েও ছিলেন সিইও। ইমরান তাকে শতভাগ সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল সিইওর কক্ষ থেকে।  
১৪

কোন দিক দিয়ে রাত আড়াইটা বেজে গেছে ঠেরই পায়নি নিশি। মন খারাপ থাকায় আজ আর ঘড়ির দিকে তাকানো হয়নি তার। সুইচ টিপে ঘরের আলো তাড়িয়ে দিয়ে বেলকনীতে বসেছিল ও।  দক্ষিন দিকের আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল অপলক। 
শরৎকাল না হলেও আকাশটা পরিস্কারই ছিল। ক’টি তারা খেলা করছিল। কেমন যেন একটা তারা সরে গিয়েছিল পশ্চিম দিকে। ওই সময় পুর্ব দিক থেকে আরেকটা তারা এসে শূন্যস্তান পূরন করে। তারারা এভাবে জায়গা বদল করে নাকি সে ভুল দেখেছে তাও আন্দাজ করতে পারে না। যাই হোক তার সময়তো কাটছে। অন্তত মনটাকে একটু প্রশান্তি দেওয়ার জন্য তারার দিকে তাকিয়ে তাকাই বা খারাপ কি? 
রাতে মা-বাবার সঙ্গে খেতে বসলেও অন্য দিনের মতো পেট পুড়ে খেতেও পারেনি নিশি। বার বার মনে পড়েছিল আমিতো ওদের সন্তান নই। কিন্তু নিশি বিষয়টা জানে তা বুঝতে দেয়নি। নাহিদ আহমেদ ভেবে নিয়েছেন-পত্রিকায় ছবি দেখেই নিশির মনটা খারাপ। তারাও কিছু বললেন না। 
নিশি বেলকনীতে বসেই রবীন্দ্রনাথের কোন একটি গান আওড়নোর চেষ্টা করে। কিন্তু কোনটা গাইবে তা নিয়েও ঝামেলায় পড়ে যায়। 
এর মাঝেই একটি ফোন আসে তার মোবাইল ফোনে। আজ সকাল থেকেই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কারো কোন ফোন ধরবে না। কিন্তু মনিটরে দেখতে পেলো দেশের বাইরের একটা নাম্বার থেকে ফোন এসেছে। অনিচছা  সত্ত্বেও সে ফোনটা ধরে। এক মহিলা ফোন করেছে। ফোন ধরার সঙ্গে সঙ্গেই ওই মহিলা উৎকণ্ঠিত হয়ে জানতে চান। 
‘তুমি কেমন আছো আম্মু।’ চমকে যায় নিশি। তার পরিচিত জন কেউ এমন ভাবে আম্মু ডাকে তা মনে করতে পারলো না সে। জবা আহমেদ তাকে নাম ধরেই ডাকে। কখনো আদর করে তাকে আম্মু বলেছে তাও নিশি মনে করতে পারেনি। তবে আমার নিশি মনি বলে ডাকতো জবা আহমেদ। আম্মু ডাকটা শুনার পর কেমন যেন আবেগ প্রবন হয়ে উঠে নিশি। কে এই মহিলা যে কিনা তাকে এতো মধুর সুরে আম্মু বলে ডাকলো। কিছুক্ষন তার মুখ দিয়ে রা বেরুলো না। কি জবাব দেবে তা খুজছিল। কোন শব্দ সে ব্যবহার করবে তাও মাথায় আসছিল না। আজ শব্দরাও যেন নিশির কাছ থেকে দূরে সরে গেছে। কিছুক্ষন চুপ থাকার পর আবারো ওই পার থেকে প্রশ্ন-
‘তুমি কি আমাকে শুনতে পাচ্ছো আম্মু?’ এবারের আম্মু ডাকটা তাকে আরো আবেগী করে তুলে। শব্দ এবার খুজে পায় নিশি।
‘কে বলছেন আমি ঠিক..?’
‘চিনতে পারছো না এইতো? আমি তোমার শুভাকাঙ্কি। পত্রিকায় তোমাকে ধরিয়ে দেওয়ার বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছে তা আমি জানি। আমি জানি তুমি এমন কোন কাজই করতে পারো না যে, পত্রিকায় তোমাকে ধরিয়ে দেওয়ার বিজ্ঞাপন দেওয়া হতে পারে। নিশ্চয়ই কোথাও ভুল হচ্ছে।’
মহিলার কথায় আরো বিস্মিত নিশি। কে তিনি। নাম্বারটা দেখেই বুঝেছে লন্ডনের নাম্বার। লন্ডন থেকে এক মহিলা তার খবরা খবর রাখে! ইন্টারনেটে যে পত্রিকা বিদেশের লোকজন দেখতে পারে সেখানেতো বিজ্ঞাপনের অংশ দেওয়া হয় না। তা হলে এই মহিলা কিভাবে জানলো তার ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছে পত্রিকায়। 
নিশি এবার ভয় পেয়ে যায়। মহিলার সঙ্গে কথা বাড়ানোটাও সুবিধার মনে হচ্ছে না তার কাছে। কোন প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই নিশি দ্রুত ফোন কাটে। এর পর আবারো তার মোবাইলে ওই নম্বর থেকে কল আসে। কেটে দেয় নিশি। কয়েকবার এমন করার পর মোবাইল ফোনটি বন্ধ করে দেয় সে।  
কি সব উদ্ভট বিষয়ের মাঝে আছে নিশি। এই ফোনটাকেও তার কাছে উদ্ভটই মনে হলো। তার মনে হতে থাকলো সে বিশেষ কেউ হয়ে গেছে। যা শুধু ঢাকা নয় তার পরিচিতি ছড়িয়ে পড়েছে সদুর লন্ডনেও। 
নিশি এক গ্লাস পানি খেয়ে সব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে ঘুমানোর জন্য যখন বিছানায় যায় তখন রাত তিনটা। নিজের অজান্তেই চোখ গড়িয়ে পানি পড়তে থাকে নিচে। বালিশ মহা মমতায় নাকি হাস্যরস করে তার সেই চোখের পানি চুষে নেয় তা আন্দাজ করতে পারেনি নিশি। এক সময় ঘুমিয়েও যায়।

১৫
পরদিন সকালে নিশির ঘুম ভাঙ্গে বাবার চিৎকার শুনে। তার বাবা চিৎকার করে স্ত্রী জবার সঙ্গে কথা বলছে। ছোট বেলা থেকে আজ পর্যন্ত যা চোখে পড়েনি নিশির। বাবা নাহিদ আহমেদ তার স্ত্রীকে বলছেন-
‘তুমি আসলে কি চাও। নিশিকে বাড়ি থেকে বের করে দেবো?’ জবা আহমেদ ঠান্ডা মাথায় বললেন-
‘তুমি উত্তেজিত হচ্ছো কেন? তোমার প্রেসারটা বাড়বে।’
‘বাড়–ক, বেড়ে মরে যাই তা হলে যদি তোমার শান্তি হয়।’
‘কি ধরনের অলুক্ষনে কথা বলছো তুমি’
‘এতোক্ষন ধরে যেসব প্যাচাল শুরু করেছো তার মানে কি?
‘আমি বলছি যে, মাথা গরম না করে পত্রিকা অফিসে গিয়ে আসল বিষয়টা জেনে আসো। আসলে নিশি কোন অন্যায় করেছে কি না?
‘যদি করে থাকে তা হলে কি করবে?’
‘সেটা পড়ে দেখা যাবে’
‘নিশি তোমার পেটের সন্তান না হলেওতো তোমার সন্তান নাকি। আর সেই সন্তানের বিরুদ্ধে তুমি অ্যাকশনে যেতে চাচ্ছো, সেটা আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি।’ এবার রেগে যান জবা আহমেদ
‘শোন, আমার পেটের না হলেও আমি নিশিকে নিজের সন্তানই মনে করি। আর তাকে সেভাবেই বড় করা হয়েছে। বুঝতে দেইনি আমি তার মা নই। যদি সে আমার পেটের সন্তান হওযার পরও কোন অন্যায় কাজে জড়াতো তা হলে আমি নিশ্চয়ই তাকে শাস্তি দিতাম।’ 
‘ কি শাস্তি দিতে জানতে পারি?’
‘বাড়ির বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দিতাম।’
‘নিশিকেও দাও। অসুবিধাটা কোথায়?’
‘অসুবিধাটা তুমি।’
‘আমি!’
‘হ্যাঁ তুমি। আমি বন্ধ করে দিলে তুমি বাইরে যাওয়ার অনুমতি দিয়ে দিবে।’
‘নাওতো দিতে পারি।’
‘তোমাকেতো ২৫ বছরের বেশি সময় ধরে চিনি নাকি?’
‘এখন নিশিকে কি করতে চাও?’
‘আগে প্রকৃত খবরটা নিয়ে এসো। দেখি সে কত বড় অপরাধের সঙ্গে জড়িয়েছে। এর পর ব্যবস্থা নেবো।’  জবা বেশ শক্তভাবেই কথাগুলো বলে যায়। নাহিদ আহমেদের মনে ছুট লাগে। 
‘ তার মানে নিশি তোমার সন্তান নয় বলে তুমি তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে চাইছো।’
‘এমন ভাবে বললে মনে হচ্ছে যেন সে তোমার প্রকৃত সন্তান।’
‘হ্যা, সে তোমার সন্তান না হলেও প্রকৃত অর্থেই সে আমার সন্তান। আমার সন্তান বলেই তোমার মতো গরম মেজাজ পায়নি। হয়েছে ঠান্ডা মেজাজের মানুষ।’
কথাটা শুনে খুব একটা চমকায়নি জবা। পিতৃ øেহের কারনেই পরের সন্তানকে নিজের সন্তান বলে দাবী করছে। তার নিজেরওতো খারাপ লাগছে নিশিকে পরের সন্তান বলতে। 
কতগুলো বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর তাদের সুখের সংসারে কেন এ সমস্যার সৃষ্টি হলো তাও চিন্তা করে দেখার চেষ্টা করেন জবা আহমেদ। নিশিকে আনার পর তিনিইতো তাকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছেন। কতদিন তার গায়ে হাগু মুতো করেছে নিশি। একবারওতো জবা আহমেদের মনে পড়েনি সেতো তার সন্তান নয় তা হলে কেন তিনি হাগু মুতো পরিস্কার করবেন। বরং বিছানায় নিশির মুতের উপর কত রাত শুয়ে কাটিয়েছেন জবা আহমেদ তার হিসাব নেই। সেই মেয়েকে তিনি নিজেই পরের সন্তান বলে আখ্যায়িত করলেন। 
না করেই বা কি করবেন। ব্যাংকের লোকগুলো যেভাবে তাকিয়েছে। প্রথম দিকে না বললেও পরে যেভাবে নিশিকে নিয়ে তার সামনে সমালোচনা করেছে তাতে কার মাথা ঠিক থাকে? জবার মনে হয় যদি তার পেটের সন্তান হতো তা হলে নিশ্চয়ই সে কোন অপরাধের সঙ্গে জড়াতো না। কিন্তু তার হাতেইতো বড় হয়েছে নিশি। তা হলে তার ব্যাপারে খোজ খবর রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন জবা আহমেদ। 
পরক্ষনেই জবার মনে পড়ে তার স্বামীর কথা। লোকটা কি বললো! তার প্রকৃত মেয়ে নিশি। তা কিভাবে সম্ভব। রাস্তা থেকে কুড়িয়ে পাওয়া একটা শিশু কি করে নাহিদের সন্তান হতে পারে? নিশিকে যখন নিয়ে আসা হয়েছিল তখন তার বয়স ছিল ১ দিন। নাহিদ ও তারিক এক সঙ্গে গাড়িতে করে নিশিকে নিয়ে বাসায় এসেছিলেন। তারিক জানিয়েছিল এক দরিদ্র ঘরে জন্ম নিয়েছে মেয়েটি। তার মা তাকে খাওযাতে পরাতে পারবে না বলে নব জাতককে রাসতায় ফেলে দিচিচল তখন তাদের চোখে পড়ে। তারা তার কাছ তেকে মেয়েটিকে নিয়ে আসে। 
বিনিময়ে নাহিদ তাকে দুই হাজার টাকা দিয়েছে। সেই মহিলা কোনদিন তার সন্তানকে নিজের সন্তান বলে দাবী করতে আসবে না এ কারনেই টাকা দেওয়া। কিনে আনা হয়েছে বিষয়টি এমন নয়। এর পর থেকেইতো নিশি জবার কোলে কাকে থেকে বেড়ে উঠেছে। আজ সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। 
নাহিদের সঙ্গে আর কোন কথা বললেন না জবা। তিনি বেরিয়ে গেলেন। নাহিদ অবাক। প্রকৃত সন্তান বলার পরও সে কোন ব্যাখ্যা না চেয়েই চলে গেলো। এমনতো হওয়ার কথা নয়। জবা আহমেদ কোন বিষয়ই শেষ না দেখে ছাড়েন না। ২৫ বছরের দাম্পত্য জীবনে এমনটিই দেখেছেন তিনি। আজ তার কি হলো। সব কিছু কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। মানুষের জীবনটা কি এমনই। কোন ঘটনা কি মানুষের জীবনকে এভাবে বদলে দিতে পারে? হয়তো পারে। তা না হলে জবাই বা কেন এমন বদলে গেলো। নাহিদ আপন মনে হিসাব করে যেতে থাকে অনেক কিছুর। 
১৬ 
দেশে আসার জন্য লন্ডনে বিমান ধরতে ঝামেলা হয়নি দিবার। প্রথমে টেনশনে পড়ে গিয়েছিলেন বিমানের টিকিট পান কি না। একদিন আগে টিকিট পাওয়াতো কষ্টকর। যেখানে কখনো কখনো ১০-১২ দিন আগেই বিমানের টিকিট পাওয়া যায় না। 
যে বিমানে সে দেশে এসেছে তারও কোন সীট ফাকা ছিল না। লন্ডন থেকে ঢাকা গামী এক ইংল্যান্ড নাগরিক শেষ সময়ে সীট বাতিল করে। সেই সীটটিই ধরতে পারে দিবা। দিবার মাল্টিপল ভিসা থাকায় আসা যাওয়ায় কোন সমস্যা নেই। 
দিবা দেশের মাটিতে বিমান থেকে নেমেই প্রচন্ড গরম অনুভব করে। সে যখন হিথ্রো বিমান বন্দরে বিমানে চাপে তখন তাপমাত্রা ছিল ১২ ডিগ্রী সেলসিয়াস। বিমান থেকে নেমেই ৩৯ ডিগ্রীর তাপে পড়তে হয় তাকে। যেন কেউ তার গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। অবশ্য দিবা জেনে শুনেই এসেছে যে, দেশে গরমের পরিমান বেড়েছে। ঢাকার তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি পর্যন্ত উঠে যাচ্ছে। তা একটি পত্রিকায় পড়ে বেশ কষ্টই হয়েছিল তার। কিন্তু শীতের ভেতর বসে থেকেতো আর চরম গরমের বিষয়টি আচ করা কঠিন হয়ে যায়। বিমান থেকে নেমে সেটি সহজেই আচ করতে পারে।  
দিবা বিমান বন্দরে নেমেই ফোন করে বন্ধু তারিককে। তারিকের মোবাইলে বাংলাদেশের নম্বর দেখে ফোন ধরে তারিক। সেই নম্বরে দিবার কণ্ঠ পেয়ে তিনি বিস্মত। দিবার সঙ্গে খুব বেশি আগে কথা হয়নি। এরই মধ্যে সে ঢাকায়। কিভাবে সম্ভব! এর পরওতো সে ভুল শুনছে না। দিবাকে বিমান বন্দরে থাকতে বলে তারিক। কিন্তু দিবা সরাসরি নাহিদের বাসায় চলে যেতে চায়। তারিককে বলে নাহিদের বাসায় চলে আসার জন্য। 
তারিক প্রথমে দিবাকে আটকে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু তার আবেগী ভাব বুঝতে পেরে আর তা করেনি। তা হলে হয়তো তারিককে সে ভাল মনে করবে না। তারিক মনে মনে ভাবে ২০ বছর ধরে দেখা নেই দিবার। কেমন হয়েছে ও। বুড়ো হয়ে গেছে! মোটা হয়েছে নাকি আগের মতোই স্লিম সুন্দরী আছে। 
এসব চিন্তা করতে করতেই তার সম্বিত ফিরে। মনে পরে তাকে নাহিদের বাসায় যেতে হবে। তা না হলে দিবাই বরং তার আগে ওই বাড়িতে চলে যাবে। তারিক দিবার কাছে জানতে চেয়েছিল সে বাসাটা চিনে কি না। দিবা জানিয়েছে তার ভুল হওয়ার কথা নয়। ঢাকা শহর ২০ বছরে যতোই বদলে যাক নাহিদের বাসা চেনা তার জন্য কষ্টকর হবে না। এ ছাড়া যে বাসায় নিশি রয়েছে সেটিতো ভুলার সুযোগই নেই। এও জানিয়েছিল তার রাস্তা ঘাট খুব মনে থাকে। লন্ডন শহরে একাই গিয়েছিল। নিজে নিজেই বাসা খুজে বের করেছে, চাকরি জুটিয়েছে। বিয়ে করেছে ভারতীয় এক নাগরিককে। তাদের ঘরে এক ছেলে জন্ম নিয়েছে। 
তারিক মোবাইল ফোন আর কথা বাড়ায়নি। যে কারনে দিবা দেশে ফিরেছে তা আগে সমাধান হওয়া দরকার। কিন্তু তার মনের মাঝে আশংকা কাজ করে যায় জবা বিষয়টিকে কিভাবে নেয়। নিশিও কিভাবে নেয়। তারিক না আবার তাদের পরিবারে ভিলেন হয়ে যায়। কিন্তু সেতো কখনো নাহিদের পরিবারের অমঙ্গল কামনা করেনি। সব সময় চেয়েছে নাহিদের পরিবার ভাল থাকুক। তা হলে তার মনে এসব চিন্তা আসছে কেন। তা হলে কি ঘঁনাটি সামলাতে পারবে কি না এমন ভয় পাচ্ছে। 
তারিকতো এমন ভীতু ছিল না। হঠাৎ সে এমন ভিতু হলো কি করে। ভেবে রাগ হচ্ছিল তার। সৎ অফিসার হওয়ার কারনে অফিসের সবাই তাকে ভয় পেতো। তারিককেও কাউকে পরোয়া করে চলতে হয়নি। বরং তার বিগ বস তাকে ম্যানেজ করেই দুর্নীতি করে যেতো। তারিক শুধু তাকিয়ে দেখতো। ক্ষোভ প্রকাশ করতো বন্ধু নাহিদ আহমেদের কাছে। কারন নাহিদও একই পথের যাত্রী। 
১৭

দিবাকে বাড়ির দরজায় দেখে আকাশ থেকে পড়েন জবা আহমেদ। এক সঙ্গে কতগুলো বছর তারা কাটিয়েছে। হরিহর আত্মা ছিল দু’জনের মাঝে। তারিক আর নাহিদের মধ্যে যে রকম ঘনিষ্ট সম্পর্ক তাদের মাঝেও এর চেয়ে কম ছিল না। ছিল না নয় কি এখনো নয়। কিন্তু জবার বিয়ের তিন বছর পর দিবা ল´£ন  চলে যায়। এর পর আর কোন যোগাযোগ রাখেনি জবার সঙ্গে। 
জবার বিয়ের সময়ই নাহিদ ও তারিকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল দিবার। তারিক যদি আগেই বিয়ে না করে ফেলতো তা হলে দিবাকে তার সঙ্গে বিয়ে দিতো জবা। এ নিয়ে তার আফসোসও কম ছিল না। নাহিদ ও তারিক যেমন ঘনিষ্ট জবা ও দিবাও তেমন। দু’জন যদি এই দু’জনের স্ত্রী হতো তা হলে কতোই না ভাল লাগতো। জবা তখন ভাবতো তারিককে অবশ্যই পছন্দ করতো দিবা। একদিন কথায় কথায় জানতেও চেয়েছিল। দিবা বিষয়টিকে পাত্থা না দিলেও জবা বুঝতে পারছিল তারিককে সে পছন্দ করে। কিন্তু বিবাহিত লোকের সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্ক তৈরি না করাই ভাল বলে যুক্তি দাড় করিয়েছিল দিবা। 
এ নিয়ে সেদিন দু’জন হাসাহাসিও কম করেনি। তবে তারিক ও নাহিদ দিবার বন্ধু হয়ে যায়। যেন সেও জবার মতোই একজন বন্ধু। তাদের মধ্যে ছেলে-মেয়ের বিষয়টি থাকেনি। কারো প্রতি কারো চাহিদাও তৈরি হয়নি। জবার কথা শুনে দু’একবার তারিকের প্রতি চাহিদার বিষয়টি উকি দিলেও দিবা তা সংবরন করতে পেরেছে। সে ক্ষমতা তার রয়েছে। তবে তারিকের মাঝে একবারও তেমন বিষয় কাজ করেনি। দিবাকে শুধু বন্ধু হিসেবেই দেখেছে সে। 
দরজা খুলতেই জবা দেখে তার বাসার দরজায় দিবা। প্রথমে চিনতে একটু কষ্ট হয়। দিবারও জবাকে চিনতে কম কষ্ট হয়নি। ২০ বছরে জবা কতটা মুটিয়ে গেছে দেখে অবাক হওয়ার কথা। জবা দিবাকে চিনতে পেরেই ‘দিবা তুই’ বলে চিৎকার করে উঠে। মেয়ের এই সমস্যার মধ্যে কি করে জবা এমন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলো তা দেখতে পেয়ে আৎকে উঠে দিবা। নিশ্চিত হয় নিশিকে খুব একটা ভালবাসে না জবা। কেনই বা ভাসবে সেতো তার প্রকৃত মা না। 
জবার উচ্ছ্বাস দেখে দিবার কোন প্রতিক্রিয়া হয়নি। বিষয়টা বুঝতে পেরে চমকে যায় জবা। তা হলে কি দিবা আমূল পরিবর্তন হয়ে গেছে। এই দিবা কি ওই দিবা। যে সারাক্ষন কথা বলতে পছন্দ করতো। কখনো কখনো জবা বিরক্ত হয়ে তাকে ধমক দিয়ে বলতো-
‘মানুষ তোকে বাচাল বলবে।’
‘বলুক। বাচাল হলে কি হয়। সবাইতো আর তোর মতো গুমরো মুখো থাকবে না।’
দুই বান্ধবীর মধ্যে এ নিয়ে মাঝে মাঝেই ঝসড়া হতো। কিছুক্ষনের মধ্যেই আবার ঝগড়া মিটে দু’জনে মিলে যেতো। সপ্তাহে দু’তিন দিন দিবাদের বাসায় যাওয়া পড়তো জবার। তা না হলে দিবার মা খুব রাগ করতো। দিবার মা না খাইয়ে ছাড়তো না। দিবাকেও যেতে হতো জবাদের বাসায়। তাদের দু’জনের ঘনিষ্টতা দেখে হিংসেও করতো অনেক বান্ধবী।
একবার দিবার মা-বাবা জবাদের বাড়ি গিয়েছিল। তারা দুই বান্ধবীর ঘনিষ্টতার বিষয়ে আলোচনা করছিল। এক পর্যায়ে দিবার মা বলছিল এক টাকে ছেড়ে আরেকটা কিভাবে থাকবে তা নিয়ে তিনি চিন্তিত। তখন জবার মা রসিকতা করে বলছিলেন, এদের দু’জনকে এক জনের কাছে বিয়ে দিতে হবে। তা হলেই এক সঙ্গে থাকতে পারবে। তাদের এই কথা গুলো পাশের কক্ষ থেকে স্পষ্ট শুনতে পেয়েছিল দিবা ও জবা। তারা দু’জন তখন মুখ টিপে হাসছিল। ড্রয়িং রুমে বসে যখন মুরব্বিরা কথা বলছিল তখন দু’বান্ধবী পাশের রুমে চলে গিয়েছিল। আর তাদের বিষয়ে কথা শুরু হতেই কান খাড়া করে দু’জনই।
এ কথা শুনার পর থেকে দু’জন দুষ্ঠুমি করে বলতো চল এক জনকেই দু’জন বিয়ে করবো। জবা বলেছিল-
‘বিষয়টা মন্দ হয় না। তা হলে আমাদের দু’জনকে কেউ আলাদা করতে পারবে না।’
‘ঠিকই বলেছিস। তবে সমস্যা কি জানিস?’
‘কি?’
‘হাজব্যান্ড কিন্তু আমাকেই বেশি ভাল বাসবে। তাতে তোর খুব হিংসে হবে।’
‘মোটেও না। আচ্ছা যদি এর উল্টোটা হয় তা হলে?’ কিছুক্ষন ভাবে দিবা। বলে-
‘মনে হয় আমি হিংসা করবো।’
‘কেন ছাড় দিবি না?’
‘সেটা ভেবে দেখা যেতে পারে।’
তাদের দু’জন এর পর থেকে প্রায়ই এক স্বামী নিয়ে গল্পে মশগুল হতো। নাহিদের সঙ্গে জবার বিয়ের পরও বিষয়টি ভুলেনি তারা। জবাই বলেছিল-
‘নাহিদকে বলবো নাকি তোকেও নিয়ে আসার জন্য।’ সেদিন সিরিয়াস হয়ে গিয়েছিল দিবা।
‘শোন সময়টা কিন্তু বদলে গেছে। এখন এসব কথা বলিস না। এসব কথা বললে নাকি সংসারের অমঙ্গল হয়।’ 
দিবার কথা শুনে সেদিন জবা অবাক না হয়ে পারেনি। কার মুখ থেকে সে এসব কথা শুনছে। যে কোন ধরনের কুসংস্কারে বিশ্বাস করে না, তার কাছ থেকে। 
এর পর থেকে জবাও আর এসব বিষয় নিয়ে কথা বলেনি দিবার সঙ্গে। দিবাও উঠায়নি। জবার বিয়ের চার বছর পরই দিবা দেশ ছাড়ে। যাওয়ার বছর খানেক আগে থেকেই কেমন যেন বদলে যেতে থাকে দিবা। জবাকে ফোনতো করতোই না। বরং জবা তাকে ফোন করলে বিরক্ত হতো। কেন এমন করতো তা জানার চেষ্টা করে বার কয়েক ব্যর্থ হয়েছে জবা। জবাও এক সময় জেদ করে তাকে আর ফোন করেনি। করেনি মানে উচিৎ মনে করেনি। তার আত্ম সম্মানেও বাধে। দিবা তখন একটি শপিং মলে চাকরিও করতো। শপিং মলের চাকরিটাকেও জবা ভাল চোখে দেখেনি। তাকে বার কয়েক পরামর্শ দিয়েছে এটা ভাল কাজ না। তার মতো শিক্ষিতা সহজেই ভাল জব জুটিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু দিবা জবার কথায় পাত্থাই দেয়নি। এর পর থেকেই তাদের দুজনের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে। 
দিবার তখন থেকেই টার্গেট বিদেশ চলে যাবে। সে শুনেছে লন্ডনে বাংলাদেশী মেয়েরা শপিং মলে সেলস গার্লের কাজ করে ভাল রোজগারই করে। সেখানে ওটা সম্মান জনক পেশা। সে সেখানে ডক্টরেট ডিগ্রী করতে যাবে। পড়াশোনার পাশাপাশি শপিং মলে কাজ করে খরচ জুটিয়ে নেবে। আর এ কারনেই দেশে সে শপিং মলে কাজ শুরু করেছিল। কিন্তু তার মনের ইচ্ছেটা কখোনোই প্রকাশ করেনি জবার কাছে পর্যন্ত। কিন্তু লন্ডন গিয়ে পিএইচডি শেষ করে তাকে আর শপিং মলে কাজ করতে হয়নি। একটি স্কুলে তার চাকরি জুটে। ইংরেজদের স্কুল। সেখানে সে দক্ষতার সঙ্গেই শিক্ষকতা করে যাচ্ছে দীর্ঘ দিন ধরে। 
দিবা যেদিন লন্ডনে চলে যাবে ঠিক একদিন আগে ফোন করে জানিয়েছিল জবাকে। জবা সেদিন আশ্চর্য না হয়ে পাড়েনি। এতো কিছু হয়ে গেল কিন্তু সে কিছুই জানতে পারলো না। তা হলে কি তার সঙ্গে দিবার যে ঘনিষ্টতা সেটি মেকি ছিল-এমন প্রশ্নও তার মনে খেলা করে যায়। 
লন্ডন যাওয়ার পর কোন যোগাযোগ করেনি জবার সঙ্গে। বছর দুয়েক পর জবাকে একবার ফোন করেছিল  দিবা। আর সে সময় জবা দিবাকে জানায় তার একটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়েছে। নাম রেখেছে নিশি। সে এখন গর্বিত মা। দিবা সেদিনও খুব বেশি কথা বাড়ায়নি। 
নিশির সঙ্গে জবা তার সমস্ত বন্ধু-বান্ধবীর গল্প করেছে। কিন্তু কোন দিন দিবার কথা উচ্চারনও করেনি। তার একটা বান্ধবী লন্ডনে আছে তার কথা তার ভুলে যাওয়ার কথা নয়।  জবা দিবার আচরনে কষ্ট পেয়েছিল। এও মনে করেছিলেন দিবা বন্ধু হওয়াল যোগ্য নয়। অযোগ্য কোন বন্ধুর কথা মেয়েকে না জানানোই সব সময় ভাল মনে করেছেন জবা। যে কারনেই নিশিকে দিবা ফোন করলেও চিনতে পারেনি।
জবা দরজার সামনে দিবার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে অনেক্ষন ধরে। দিবার চোখ দুটোতে কেমন যেন মনে হচ্ছে তার। দিবার এমন চোখতো কোনদিন চোখে পড়েনি জবার। আজ এমন দেখাচ্ছে কেন। চোখের মনির পাশে লালচে দাগ স্পষ্ট চোখে পড়ে। 
দিবা জবাকে দেখে প্রথমে চিনতে পারেনি। জবা এতো মোটা হয়ে গেছেন তা ভাবতেই কষ্ট হচ্ছিল দিবার। মনে মনে ভাবে দেশের মানুষ গুলো ভেজাল খেয়ে খেয়ে গায়ে চর্বিই জমিয়ে যাচ্ছে শুধু। অর্থনীতিতে কোন চর্বি হচ্ছে না। দিন দিন শুকিয়েই যাচ্ছে।
‘দিবা তুই? মুখ খোলেন জবা আহমেদ। ডাকটার মাঝে কেমন একটা কৃত্রিমতা খুজে পেলেন দিবা। এই প্রথম তার এমন মনে হলো। 
‘হ্যা আমি। ভাল আছিস?’ 
প্রশ্নটার কোন উত্তর তার কাছে এ মুহূর্তে নেই। নিজের মনকেই জিজ্ঞেস করেন আসলে তিনি ভাল আছেন কি না। কোন উত্তর তিনি খুজে পান না। এতো বছর পর বান্ধবী খারাপ আছি শুনলে হয়তো কষ্ট পেতে পারে। জবা বলেন-
‘হ্যা-ভাল আছি। আয় ভেতরে আয়।’ জবা দিবাকে ভেতরের রুমে নিয়ে দরজা আটকে দেন। লাগেজ হাতে নিয়ে দরজার ওপাশেই দাড়িয়ে ছিলেন দিবা। আশ-পাশে তাকিয়ে দিবা বলেন- 
‘আমার নিশি কোথায়?’ কথাটা শুনে বিস্মিত জবা। নিশিকে সে খুজতেই পারে। কিন্তু আমার নিশি কোথায়। এটা কেমন কথা বললো দিবা। খটকা লেগে যায় জবার কাছে। এ ছাড়া নিশির কথা জানিয়েছে ২০ বছর আগে। এর পর আর তার সঙ্গে জবার যোগাযোগ নেই। তা হলে কিভাবে সে নিশির নামটি মনে রেখেছে। জবার সব কিছু কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। মেয়ের ছবি পত্রিকায় দেখে যতোটা অবাক না হয়েছিলেন তার চেয়ে বেশি অবাক হলেন দিবার মুখে এ কথা শুনে। 
‘নিশি তোর মেয়ে মানে!’
‘তোর মেয়ে কি আমার মেয়ে না?’ জবার বুকের উপর থেকে যেন বড় একটা পাথর সরে গেল। ‘ওহ’ বলে তাকে ভেতরের রুমে নিয়ে যায়। কল বেলের শব্দ শুনেই নিশি দরজা খুলতে গিয়েছিল। জবাকে আসতে দেখে সে সরে যায়। আাড়লে দাড়িয়ে দু’বান্ধবীর কথাও শুনে সে। নিশি নিশ্চিত হয় গত রাতে এই মহিলাই তাকে ফোন করেছিল। আজ তাদের বাসায় এসেছে। লন্ডন থেকে ঢাকায়! কেন? কি কারনে। কে তিনি- বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন খেলা করে যায় নিশির মনে।

১৮

দিবা পৌছার আগেই নাহিদের বাসায় এসেছেন তারিক। তারিক, জবা ও নাহিদ কথা বলছিলেন নাহিদের ঘরে বসে। কল বেলের শব্দ হতেই তারিক বুঝতে পারেন দিবা এসেছে। দিবার কল বেল চাপাটাতেও এক ধরনের আবেগ খুজে পান তারিক। এর আগে কখনো তার কল বেল চাপার শব্দ শুনেননি তিনি। এরপরও তার মনে কেন এলো। অনেক সময় মানুষের মনই বলে দেয় কি হতে যাচ্ছে। বিশেষ করে খারাপ সংবাদ গুলোই বেশি মনকে নাড়িয়ে যায়। 
জবা দরজা খুলতে গিয়েছে। বুঝতে পেরেও বাধা দেননি তারিক। তবে তার মনের মধ্যে প্রচন্ড ঝড় বয়ে যাচ্ছিল। সেই ঝড়ের পূর্বাভাস দেননি নাহিদকেও। তার কথা বারবার জড়িয়ে যাচ্ছিল। একবার নাহিদ তাকে জিজ্ঞেসও করেছিল তারিকের শরীর খারাপ লাগছে কি না। প্রেসার বেড়েছে কি না ইত্যাদি। সত্যিই তারিকের প্রেসার বেড়েছে। কিন্তু এই প্রেসারে তার ঘাড় ও মাথা ব্যথা হয়নি। প্রেসার বাড়লে মস্তিস্কে রক্তক্ষরন হয় বলে শুনেছেন তারিক। কিন্তু আজকের প্রেসারে মস্তিস্কে নয় তার হƒদয়ে রক্ত ক্ষরন শুরু হয়েছে। 
দরজার সামনে দাড়িয়ে দিবার সঙ্গে জবার কি কথা হচ্ছে কে জানে। সেই কথা শুনার জন্য নাহিদের আগ্রহ ব্যাপক। বারবার তিনি দরজার দিকে তাকান। হয়তো কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই জবা দিবাকে নিয়ে এ কক্ষেই আসবেন। এই ক’টা সেকেন্ড যেন তারিকের কাছে কয়েক বছর সম মনে হচ্ছে। তারিক একবার উঠে দরজা পর্যন্ত যেতে চেযেছিল। শেষ পর্যন্ত বিষয়টি জবা ও নাহিদ বুঝে ফেলবে ভেবে আর যায়নি। মোবাইল ফোনে দিবার কণ্ঠ আগের মতোই মিস্টি মনে হয়েছে। ২০ বছর পর তার চেহারা কেমন হয়েছে তা দেখার আগ্রহ তারিকেরও থাকার কথা। কিন্তু এই মুহূর্তে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চিন্তাই করছেন তারিক। 
প্রায় মিনিট খানেক পরই তারিকের অপেক্ষার পালা শেষ হয়। জবা দিবাকে নিয়ে আসে তাদের কক্ষে। নাহিদ তখন বিছানায় শুয়ে বালিশের উপর হাত রেখে অর্ধ শোয়া ছিলেন। দিবাকে দেখে চমকে উঠেন তিনি। তারিকও চমকান। তবে নাহিদের মতো নয়। 
১৯

দিবাকে চিনতে পেরে নাহিদের মনে হাহাকার করে উঠে। মনে পড়ে যায় ২১ বছর আগের কথা। দিবা চুলের ভেতর চিরুনী চালিয়ে একদিন অনেক সোহাগ করেছিল নাহিদ আহমেদকে। তখন দিবার কোলে ছিল তার মাথা। দিবা উপুর হয়ে নাহিদ আহমেদের ঠোটে লম্বা একটা চুমু  একে দিয়েছিল। নাহিদ তখন  দিবার পিঠে দু’হাত রেখেছিলেন। দিবা সেদিন কি সুখ পেয়েছিল জানে না নাহিদ। দিবা নাহিদের বুকের উপর থেকে বুক সরিয়ে পশমের মধ্যে অনেক্ষন ধরে হাত চালিয়েছিল। এ সময় নাহিদের সারা শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যায়। এর পর শুধু দু’জনের গোঙানোর শব্দ। জবার সঙ্গে ঘর সংসার করলেও সেই গোঙানোর শব্দ এখনো নাহিদ আহমেদকে তারিয়ে বেড়ায়। দিবার গায়ের গন্ধে সেদিন বিমোহিত হয়েছিল নাহিদ। সেই গন্ধ সে তার স্ত্রীর মধ্যে খুজে বেরিয়েছে কত। কিন্তু কোনদিন তার সন্ধান পায়নি। 
চুক্তি হয়েছিল সকাল ১০ টার দিকে। ওই সময় তারিক উপস্থিত ছিলেন। চুক্তির পর  কাজী অফিসে গিয়ে বিয়েটাও করেছিলেন তারা। সেখানেও এক মাত্র সাক্ষী তারিক। তখন কাজী অফিসের দু’জনকে স্বাক্ষী করে নিকাহ নামা লেখা হয়েছিল। 
দিবার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে নাহিদের। আইনত দিবা তার স্ত্রী। হোটেল কক্ষের বিছানায় যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নাহিদের চোখে ভেসে উঠে প্রথম স্ত্রী জবার মুখ। তার সঙ্গে বাসরের কথা মনে পরে যায়। কিন্তু আজ তিনি দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে বিছানায় যাচ্ছেন। প্রথম বারের মতো উচ্ছাস নেই। একেবারেই যেন নি¯প্রভ। 
নাহিদ দরজা আটকে দেওয়ার সময় বিছানার উপর বসে ছিল দিবা। হাতে কোন মেহেদী নেই। গায়ে নেই স্বর্নালংকার, বিয়ের পোশাক। অথচ বিয়ের সময় নাকি স্বর্নালংকার দিতে হয়। নাহিদ অবশ্য কিনে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু বাধ সাধে দিবাই। এটাতো শুধু চুক্তির বিয়ে। শুধু একটি বিশেষ প্রয়োজন মেটানোর  জন্য। তাতে এতো নিয়ম কানুন মানার কিছু নেই। 
নাহিদের মনে আছে, দরজা লাগিয়ে কাছে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দিবার চোখের দিকে তাকিয়েছিলেন তিনি। দেখেছিলেন চোখ কেমন ছলছল। পানির ভেতর দিয়ে চোখের তারা চোখে পড়ে নাহিদের। মায়াবী দুটো চোখ যেন তাকে অনেক কথা বলতে চায়। নাহিদ দিবাকে অনেক দিন ধরে চিনে। কিন্তু তার চোখ যে, এতো সুন্দর, মায়াবী তা একবারও চোখে পড়েনি। চোখে চুমু খেতে নাহিদের লোভ হয়। কিন্তু নিজেকে সামলে নেন। 
কি বলে কথা শুরু করবেন তা খোজে পান না নাহিদ। দিবাও একই রকম। এর পরওতো তাদেরকে কথা বলতে হবে। ভাড়া করা হোটেল কক্ষটিও ছেড়ে দিতে হবে। কারন এই হোটেলের কক্ষটি তিন ঘন্টার জন্য ভাড়া করেছে তারা। ভাড়াটাও তারিকই করে দিয়েছে। 
কোন কথা না পেয়ে নাহিদ দিবার গালে হাত বুলায়। দিবা উপরের দিকে নাহিদের মুখের দিকে তাকায়। দু’জনের মুখই মলিন। এক সময় নাহিদ কিছুই না বলে দিবাকে আদর করতে শুরু করে। দিবা এর মানে জানে। সে জন্যইতো সে হোটেল কক্ষে এসেছে। নাহিদ যখন উত্তেজিত দিবা তখন শুধু শরীরটা এলিয়ে দেয়। 
ঘন্টা তিনেক আগেই হোটেল কক্ষ ছেড়ে যার যার বাড়িতে ফিরে যায় নাহিদ ও দিবা। দিবা যখন বাসায় ফিরে তখন বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যার দিকে যাচ্ছে সূর্য। তার এতো বড় একটা ঘটনা ঘটে গেছে তা বাসার কাউকে বুঝতেই দেয়নি। তার মা শুধু জানতে চেয়েছিল এতো দেরী হলো কেন? সে তখন বান্ধবীর কথা বলে কাটিয়ে গিয়েছিল সহজেই। 
রাতে যখন ইংরেজী প্রশিক্ষন কোর্সের বইটা হাতে নিয়ে পড়তে যায় তখনি মনে পড়ে নাহিদের কথা। রাত ১০ টা বাজে। নাহিদ এখন কি করছে?  নিশ্চয়ই তার স্ত্রী জবাকে নিয়ে হাসি তামসা করছে। কিন্তু পড়ন্ত দূপরে নাহিদ তার সঙ্গে যা করেছে সেটা কি রং তামসা?
নাহিদ যখন তাকে আদর করছিল তখন তারতো মোমের মতো গলে যাওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু কেন গলে গেল সে। নাহিদ মুখটা তার দিকে এগিয়ে দিতেই তার কেন ইচ্ছে করেছিল ঠোটে ঠোট রাখতে? সেওতো নাহিদকে ধরে কম জোরে চাপাচাপি করেনি। তা হলে কি সে নাহিদকে ভাল বেসে ফেলেছে। না চুক্তি অনুযায়ী ভালবাসা যাবে না। শুধু শরীর দেওয়া যাবে। 
নাহিদ এক বিকেলে সংসদ ভবনের পাশ দিয়ে হাটছিলেন। তার সামনে দিয়েই যাচ্ছিল দু’জন নারী গার্মেন্টস কর্মী। ঠিক সমান্তরাল রাস্তার উল্টো পাশে হেটে যাচ্ছিল দুই তরুনী। তাদের দু’জনের পরনেই ছিল হাতাকাটা সালোয়ার। ফলে শ্যামলা চেহারা হলেও পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষন করতে ব্যর্থ হয়নি তারা। নাহিদ আহমেদেও দু’বার দেখেছিলেন তাদের। ঠিক ওই সময় তার কানে আসে দুই গার্মেন্ট কর্মীর বক্তব্য। এক গার্মেন্ট কর্মী হাতাকাটা তরুনীদের দেখিয়ে জানতে চায় এরা কি করে। তখন অপর কর্মী বলতে থাকে বুঝস না। তারা টাকার বিনিময়ে মানুষের বিছানায় যায়।
‘ছি, ছি।’ তার ছি ছি শুনে যেন খুশি হতে পারেনি ওই গার্মেন্ট কর্মী। সে বলতে থাকে-
‘ওরাই ভাল আছে।’ এবার বিস্মিত হওয়ার পালা ওই গার্মেন্টস কর্মীর।
‘আরে কস কি তুই’। 
‘ঠিকই কই। আমরা সকাল ৮ টার সময় গার্মেন্টেসে ঢুইকা রাত ৮ পর্যন্ত কাম করি। বিনিময়ে পাই মাস শেষে ১৫ শ থাইকা ২ হাজার টাকা। আর এরা কোন পরিশ্রম ছাড়াই প্রত্যেক মাসে হাজার হাজার টেহা কামাই করতাছে। আমাগো যারা বড় অফিসার হেরা আমাগো দিয়া কাজ করাইয়া নিয়া টাকা কামাই কইরা ওই সব মাইয়াগো পিছে খরচ করতাছে। এইটা কি একবার ভাইবা দেখছস। আরেকটা জিনিস ভাইবা দেখ হেরাও তো রোজ রাইতেই মজা পাইতাছে। টাকার অভাবে রিক্সায় যাইতে না পাইরা হাইটা বাসায় যাইতাছি।’
কথা গুলো কষ্ট দেয় নাহিদ আহমেদকে। অল্প শিক্ষিত গার্মেন্ট কর্মীর মনের কষ্টটা নিজের মতো করে বুঝার চেষ্টা করে নাহিদ।
নাহিদের মনে পরে সে যা করছে তাওতো হাতাকাটা ওই দুই তরুনীর মতোই। দিবার সঙ্গে বিছানায় যাওয়ার আগে তাকে পতিবার কয়েক হাজার টাকা হোটেল ভাড়া গুনতে হয়। কিন্তু দিবাকেতো সে এক টাকা দিয়েও কিছু কিনে দেয়নি। সেতো তার বিবাহিত স্ত্রী। তারতো তাকে কিছু দেওয়া দরকার। কিন্তু কিছু দিতে গেলে যদি আবার দিবা মাইন্ড করে বসে তাও তাকে ভাবিয়ে তুলে। হাতাকাটা তরুনীদের সঙ্গেতো আর দিবাকে তুলনা করা যায় না। এতোক্ষন গার্মেন্ট কর্মীদের  কষ্টের কথা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল নাহিদের। এবার তার হাসতে ই্েচছ করলো। একেবারে অটটহাসি। কিন্তু লোকজন কি ভাববে সেটা ভেবে তা থেকে বিরত থাকে নাহিদ। 

২০
তারিক আর সইএত পারএলন না। মএনর মাএঝ যৈ ঝড় বইএছ তাএক আর আটকাএনা উচিত মএন করএলন না তিনি। ইৈ ঝড় স্টধু তার মন নয় ছিএড় ফৈলএত পাএর সজ্ঞক্সএকট্টর সম’¦ ব®¬নও। হয়এতা সব কিছু জানার পর জবা আর জীবএন কখএনা তারিএকর সএব্দ ক^া বলএব না। মৈনকি নাম স্টনএলও ^ু^ু ছিটাএবন। রৈপরও তিনি ঘটনাটা বএলই ফৈলএলন। বলএত গৈএল কৈ দএমই শৈষ কএরএছন পুএরা ঘটনাটা। অবশঞ্ঝ সংপ্টিক্র¦ আকাএর। কিস্ম ইৈ সংপ্টিক্র¦ আকার ^ৈএকই সবাই বুএঝ গৈএছ নিশির জ¯ঞ্ছ রহসঞ্ঝ।  
ঘটনাটা স্টনার পর জবা মিনিট দুএয়ক পিে^বী ছাড়া ছিএলন। যৈমনটা পিণ্ঠয় কাএরা মতেুঞ্ঝ সংবাদ স্টনএলও হয়এতা হয় না। নিশিও ঘটনাটা স্টনছিল দরজার পাশ ^ৈএকই। সৈ যা স্টএনএছ তা স্টএন ভাল ও মএক্টদর মাঝামাঝি কৈটা জটিল অবর্’ার মএধঞ্ঝ পএড় যায়। ইৈ স্টএন তার কি করা উচিত ভৈএব পাœিছল না। কিস্ম সৈ নিএজর অজাএ¯¦ই নাহিএদর রূএম ঢুএক পএড় নিশি। তারিএকর কাএছ জানএত চায়-
‘আংএকল, আপনি যা বলএলন তা আমি আবার স্টনএত চাই। ’ক্স”¡ কএর স্টনএত চাই। সতিঞ্ঝ স্টনএত চাই। বার বার  স্টনএত চাই। আমি নিøিত হএত চাই আমি রা’¦ার মৈএয় নই। কুড়িএয় পাওয়া মৈএয় নই।’
নিশির গলায় ঝাঝ আর গাল বৈএয় অএঝার ধারায পানি ঝরএত স্টরূ কএরএছ। এচাখ ভৈএব্দ পানি বইএত চাএœছ  নাহিদ  ও তারিএকরও। কা®ক্ষ্মা নৈই দিবা ও জবার মাএঝ। তারা এৈক অপএরর দিএক তাকিএয় আএছন। যৈন কত অপরিচিত এৈক অপএরর। চৈনা মুখ বড় অএচনা লাগএছ। নতুন কএর পরিচয় জানএত ইএœছ করএছ। জবার জানএত ইএœছ কএর সতিঞ্ঝই কি দিবা তার ব®¬বী না অনঞ্ঝ কিছু। 
কিছুপ্টন পর যৈন পরির্’িতি ’ঙ্কাভাবিক হয়। তারিক বলএত স্টরূ কএরন পুএরা ঘটনা। বএলন, জবা ও নাহিএদর বিএয়র পর তিন বছর পৈরিএয় গৈএলও কৈান স¯¦ান হœিছল না। ৈ কারএন অ’ঙ্কর্’িএত পএর জবা। এৈকর পর কৈ ডাল্ফদ্ধার দৈখিএয়ও কৈান ফল হয়নি। জবার স¯¦ান জ¯ঞ্ছ দৈওয়ার অপ্টমতার ক^া ডাল্ফদ্ধাএরর কাছ ^ৈএক নাহিদ তারিক দু’জনই স্টএনছিএলন। কিস্ম তা জবাএক জানএনা হয়নি। কারন জবা স¯¦াএনর জনঞ্ঝ কৈদিন আñহতঞ্ঝা পযট্ট¯¦ করএত চৈএয়ছিল। যদি সৈ জানএত পাএর যৈ সৈ কৈানদিন মা হএত পারএব না তা হএল তাএক বাচিএয় রাখা কঠিন। ইৈ ভৈএব তারা দু’জন সৈদিন বিষয়টি চৈএপ যান। তএব জবা হয়এতা বুঝএত পৈএরছিএলন। ৈ কারএনই িৈতম খানা ^ৈএক কৈটি স¯¦ান আনার জনঞ্ঝ নাহিদএক বারবার চাপ দিœিছএলন। শৈষ পযট্ট¯¦ মাএয়র ’ঙ্কাদ পাওয়ার জনঞ্ঝ জবার কৈাএল কৈটি শিস্ট এৈন দৈওয়ার পণ্ঠতিুা কএরছিএলন নাহিদ আহএমদ। পুএরা বিষয়টি জানএতন দিবাও। 
বা®¬বীর দু:খ ঘৈাচাএত িৈগএয় আএসন দিবা-ই। তিনিই পণ্ঠ’¦াব কএরন যদি তার গবট্ট ^ৈএক কৈটি স¯¦ান নিএয় নাহিদ জবার কৈাএল তুএল দৈয় তা হএল হয়এতা সমসঞ্ঝার সমাধান হএত পাএর। ক^াটা মএন ধএর তারিএকর। রৈ পর তারিকই তাএদর দু’জএনর চুল্ফিদ্ধ ভিল্ফিক বিএয়র আএয়াজন কএরন। স¯¦াএনর জনঞ্ঝ বিএয় মৈএন নিএয়ছিএলন দু’জনই। তাএদর স¯¦ান আসএতও সমসঞ্ঝা হয়নি। মাস খাএনএকর মএধঞ্ঝই দিবার পৈএট বাসা বৈএধছিল সৈই স¯¦ান। 
৯ মাস ৭ দিন পর স¯¦ান জ¯ঞ্ছ দিএয়ই সৈই স¯¦ানএক তুএল দিএয়ছিএলন নাহিএদর কৈাএল। নাহিদ কৈটি কিÑনিক ^ৈএক ইৈ কনঞ্ঝা স¯¦ানএক কিএন এৈনএছন বএল তুএল দিএয়ছিএলন জবার কৈাএল। স¯¦ান পৈএয় জবার কি খুশি। নিএজএক মা বানাএনার জনঞ্ঝ কত নাটকই না সাজিএয়ছিএলন। তার আñীয় ’ঙ্কজনএক জানিএয়ছিএলন তিনি কনঞ্ঝা স¯¦াএনর জ¯ঞ্ছ দিএয়এছন। বিশঙ্কাসও কএরছিল তারা। 
সৈই কনঞ্ঝার নাম নিএয়ও কম বিপল্ফি হয়নি। যখন তাএক জবা আহএমএদর কৈাএল দৈওয়া হএয়ছিল তখন জবা তার নাম রাখএত চৈএয়ছিএলন কিংকর। যুল্ফিদ্ধ দৈখিএয়ছিল বিশঙ্ক সুক্টদরী কিÑওএপটড্ডার অদঞ্ঝাপ্টএর তার নামটি রাখএবন তিনি। কিস্ম বাধ সাএধন নাহিদ আহএমদ। তিনি বএলছিএলন মৈএয়র নাম বাবার অদঞ্ঝপ্টর অনুযায়ি রাখা হয়। তখন জবা আহএমদ বএলছিএলন-
‘সৈএতা তৈামার মৈএয় না, যৈ তৈামার অদঞ্ঝাপ্টর অনুযায়ী রাখএত হএব। যদি কখএনা আমাএদর স¯¦ান হয় তা হএল রৈএখা।’ শৈষ পযট্ট¯¦ নাহিদ আহএমএদর যুল্ফিদ্ধ মৈএন নিএয় তার অদঞ্ঝাপ্টর ‘নৈ’ অনুযায়ী নাম রাখা হয় নিশি। অবশঞ্ঝ ইৈ ঝাএমলা মৈটাএতও তারিএকর মধঞ্ঝর্’তার পণ্ঠএয়াজন পএড়ছিল।
নিশিএক কৈাএল দিএয়ই মাস দুএয়ক পর দিবা চুল্ফিদ্ধ অনুযায়ী ডিএভাসট্ট দৈন নাহিদএক। ’¡ুএড´Ÿ ভিসায় চএল যান ইংলঞ্ঝাএ´£। 
২১
সব জানার পর জবা বিশঙ্কাস করএত পারছিএলন না। তএব মএন মএন যৈ তিনি খুশি হএয়ছিএলন তা বুঝএত পৈএরছিএলন সবাই। তা না হএল জবা দিবাএক তির’ক্সার না কএর মৈনভাএব জড়িএয় ধরএব কৈন। জড়িএয় ধএরই হাউমাউ কএর কা®ক্ষ্মা জুএড় দিএয়ছিএলন। দিবাও চৈাখএক পানিএত ভাসিএয়ছিএলন। যৈন কৈ মহা মিলন নাহিদ, তারিক ও নিশির সামএন। 
নিশিরও ক”¡ অএনক কএম যায়। আর কিছু না হৈাক গত দু’দিএন যৈ ক”¡ তাএক বএয় বৈড়াএত হএয়এছ তা ^ৈএক তৈা মুল্ফিদ্ধ পাওয়া গৈল। নিøিত হওয়া গৈল রা’¦ার মৈএয় সৈ নয়। তার পণ্ঠকতে বাবার কৈাএলই মা^া রৈএখএছ সৈ। মা না হএলও জবা তাএক যৈভাএব আদর ’ৈক্ষ্মহ দিএয় মানুষ কএরএছ তাএত পণ্ঠকতে মাও হয়এতা তৈমনটা করএতা না। তএব নাহিদ লব্ধায় লাল হএয় যাœিছএলন। চুল্ফিদ্ধ অনুযায়ী কৈান দিন তারিক ছাড়া আর কাএরার ইৈ ঘটনা জানার ক^া নয়। জবাএতা নয়-ই। রৈ পরও ইৈ পরির্’িতিএত কী-ই বা করএত পারএতন নাহিদ। মএন মএন ভাবএলন বিষয়টা খৈালাসা হওয়ায় কএ”¡র চৈএয় আনক্টদটাইএতা বৈশি। জবা স্টধু বএলছিল --আমি ক”¡ পাœিছনা। ভাবএত ভাবএত কÑা¯¦ হএয় গৈছি।
সবার মুএখই যৈন কৈমন কৈটা খুশি খুশি ভাব। জবা দিবাএক কৈবার বএলও দিএয়এছ নাহিএদর দিএক যৈন দিে”¡ দৈয়। সৈ যৈন সম’¦ কিছু ভুএল যায়। দিবা হাসি মুএখই এমএন নৈয়। দিবা ভাবএতও পাএরনি সতিঞ্ঝই কৈানদিন সবার সামএন নিশির মা হিএসএব নিএজএক হাজির করএত পারএব। 
স®¬ঞ্ঝার দিএক দিবার মএন পএর নিশির বিপএদর ক^া জৈএনই তিনি তৈ দƒর ^ৈএক এৈসএছন। কৈন তার মৈএয়এক ধরিএয় দৈওয়ার বিুাপন দৈওয়া হএলা তা নিএয় নিএজই ক^া উঠাএলন। দিবার ক^া স্টএন বিষয়টি সবার মা^ায় আএস। দিবা আসার পর তারা সবাই পষ্ণিকার বিুাপএনর ক^া ভুএলই গিএয়ছিএলন। বিষয়টি সামএন আসায় নিশি জৈার দিএয় বএল সৈ মৈন কৈান কিছু কএরনি যৈ তাএক ধরিএয় দৈওয়ার বিুাপন দৈওযা হএব পষ্ণিকায়। কিস্ম নিশি বুএঝ উঠএত পাএর না মৈন কৈন হএলা। ইৈ ছবিটিই বা পষ্ণিকা অফিএস গৈল কি কএর। সৈ মৈন পৈাএজ ছবি তুএলএছ কখএনা তাও মএন করএত পারএছ না। তার কাএছ ইৈ ছবির কৈান কপিও নৈই। তা হএল বিষয়টি কিভাএব ঘটএলা। সব প্পএলা ক^াই বাড়ির সবার সএব্দই শৈয়ার কএর নিশি। সব স্টএন দিবাই পরামশট্ট দৈয় পষ্ণিকা অফিএস গিএয় পণ্ঠ^এম জানএত হএব। রৈ পর পরবতীট্ট করনীয় তারা ঠিক করএবন। 
নাহিদ ও তারিক রৈডি হয় পষ্ণিকা অফিএস যাওয়ার জনঞ্ঝ। সএব্দ নিশিও যৈএত চায়। কিস্ম তারা তাএক সএব্দ নিএত চান না। দুই ব®¬ু বাসা ^ৈএক বৈর হওয়ার ঠিক আগ মুহƒএতট্ট কৈটি দামী গাড়ি এৈস ^াএম নিশিএদর বাড়ির সামএন। গাড়ি ^ৈএক তিন জন নৈএম আএসন নিশিএদর বাসায়। তাএদর কৈ জএনর হাএত ফুএলর তৈারা। 
কল বৈএলর শষ্ফ পৈএয় নাহিদ দরজা খুএল দৈন। টু^এপ’¡ কৈাজ্ঞক্সানীর সিইও নিএজই তার পরিচয় দিএলন। নাহিদ তাএদর নিএয় ডণ্টয়িং রূএম বসান। তারিএকর সএব্দও পরিচয় করিএয় দৈওয়া হয়। ৈ সময় জবা দিবা ও নিশি পাএশর কএপ্ট বএস ’ঞ্ছিেত রৈামর্¯ন করছিল। কিস্ম ডণ্টয়িং রূএম সিইওর কাছ ^ৈএক নিশির পষ্ণিকায় বিুাপন ছাপার বিষয়টি জৈএন হতভজ্ঞঙ্ক না হএয় পাএড়ননি। নিশিএক টু^ পৈ’¡ কৈাজ্ঞক্সানী বত্তঞ্ঝা´£ অঞ্ঝাজ্ঞঙ্কাএসডর করার ক^া স্টএন নাহিদ আএরা চমএক যায়। যা তিনি কৈানদিন ’ঙ্কএক্রক্ষ্মও ভাএবননি যৈ, তার মৈএয় সারাএদএশর মানুএষর কাএছ পরিচিতি লাভ করএব। টিভি ও পষ্ণিকায় তার মৈএয়র ছবি পণ্ঠচার হএব।
সব কিছু স্টএন পাএশর রূএম যান নাহিদ আহএমদ। তারিক চুপ হএয় বএস আএছন সৈাফার কৈ কৈানায়। নাহিদ গিএয়ই সবাইএক বিষয়টি জানান। সবাইএক সিইওর সএব্দ পরিচয় করিএয় দৈওয়ার জনঞ্ঝ ডণ্টয়িং রূএম আসএত বএলন।
জবা দিবা ও নিশি কৈ সএব্দই যান ডণ্টয়িং রূএম। ঢুএকই নিশির চৈাখ পএড় ইমরাএনর দিএক। চমএক যায় সৈ। ইমরান খৈাএন কৈন। তা হএল পুএরা ঘটনার সএব্দ ইমরান জড়িত। ইমরানকি কৈান কারএন তার উপর পণ্ঠতিএশাধ নিএয়এছ। কিস্ম মৈন কৈান ঘটনাএতা তার সএব্দ ঘএটনি যৈ সৈ মৈন কাজ করএলা। নিশির দিএক ইমরান হাত জৈাড় কএর প্টমা চায়। সৈই জানায়, তার ইৈ ছবিটা কন্সবাজার ^ৈএক ডিজিটাল কঞ্ঝাএমরাই তৈালা হএয়ছিল। যা নিশি বুঝএতও পাএরনি। 
ইমরাএনর ক^া স্টএন খুব রাগ হয় নিশির। তাএক কিছুটা ভাল লাগএতা তার। ৈ মুহƒএতট্ট নিশির সম’¦ ভাল লাগা উএব গৈএছ। ইএœছ করএছ কএষ কৈটি ^াক্রগুর লাগাএত। পরপ্টএনই মএন পএর তার জ¯ঞ্ছ পরিচএয়র ক^া। কৈটি ভুল তার জীবনএক কতটা বদএল দিএয়এছ। কত সতিঞ্ঝর কাছা কাছি দাড়িএয়এছ সৈ। যা হয়এতা জীবএনও সজ্ঞ¿ব ছিল না। 
নিশিএক আএরক দফা সিইও ঘটনাটি খুএল বলএলন। জানাএলন, নিশিএকই তার টু^ পৈ’¡ কৈাজ্ঞক্সানীর বত্তা´£ অঞ্ঝাজ্ঞঙ্কাএসডর করার জনঞ্ঝ তিনি এৈসএছন। কাতর সুএর বএলন যৈন তাএক ফিরিএয় না দৈয় নিশি। নিশি ফিরিএয় দৈএব কী! সৈএতা মৈন কৈটা সুএযাগ পাএব জীবএন ভাবএতও পাএরনি। তার চৈএয ঢৈর সুক্টদরী রাজধানী ঢাকার অলিএত গলিএত দৈখা যায়। নিশি সজ্ঞঞ্ছতি দৈয়। আর সৈদিন ^ৈএকই বদএল যৈএত স্টরূ কএর নিশির জীবন। 

২২
এৈতা কিছু কৈন ঘটএলা তার কৈটা হিসাব মৈলাএত চৈ”¡া কএরন নাহিদ আহএমদ। রাএত বৈল কনীর ইজি চৈয়াএর বএস ভাএবন স¯¦াএনর জনঞ্ঝ চুল্ফিদ্ধ করা হয়এতা  পাপ ছিল তার। জীবএন কৈান অনঞ্ঝায় না করএলও সৈই পাএপই নিশিএক ক”¡ পৈএত হএয়এছ। আবার ওৈ ভাএবন পাপই যদি হএব তা হএলএতা সকএলরই ধগ্ধংস হএয় যাওয়ার ক^া। বরং তা না হএয় সব যৈন কৈমন সুক্টদর, ঝলমল হএয় উএঠএছ। উব্ধল হএয় উএঠএছ নিশির জীবন। বৈলকনীএত বএস নাহিদ আহএমদ পাপ পƒএনঞ্ঝর হিসাব মিলাœিছএলন যখন তখনই পাএশর ঘর ^ৈএক জবা ও দিবা কৈ সএব্দ ডৈএক উএঠন তাএক। 
ভৈতএরর ঘএর যাওয়ার ডাক স্টএন চমএক যান নাহিদ আহএমদ। সৈখাএন গিএয় দৈখএত পান টিভিএত টু^েএপএ’¡র বিুাপএন তার মৈএয়এক দৈখাএœছ। এৈতা সুক্টদর লাগএছ নিশিএক যৈন বিশঙ্কাস হএœছ না তার। গএবট্ট বুক ভএর উএঠ নাহিদ আহএমএদর। মএন পএর তিনি চৈএয়ছিএলন নিশি টিভি নাটএক অভিনয় করূক। কিস্ম নিশি রাজি হয়নি। টিভিএত কাজ করার যৈাগঞ্ঝ সৈ নয় বএল জানিএয়ছিল বাবাএক। যৈ কারএন আর ওই লাইএন যাওয়া হয়নি তার।
পণ্ঠ^ম দিন টিভিএত টু^ পৈএ’¡র বিুাপন পণ্ঠচার হওয়ার পরই পরিচিত সব জন চিনএত পাএর নিশিএক। পরদিন বঞ্ঝাংএক যাওয়ার পর জবা আহএমএদর কদর বৈএড় যায়। সবাই নিশির গÍগু স্টনার জনঞ্ঝ িৈগএয় আএস। গএবট্ট বুক ভএর যায় জবা আহএমএদর। এমএয়র পণ্ঠশংসা স্টএন নিএজর অজাএ¯¦ই জবা আহএমদ বএল উএঠন-
‘দৈখএত হএব না মৈএয়টা কার’।

 


 

 

 

 

 

 

নিশি কথা
০১
পূবে সূর্য উঠলেও বরাবরের মতো দেখা যায়নি আজও। আশপাশের বিল্ডিংয়ের ফাক গলে নাহিদ আহমেদের বাসার বেলকনি ছুতে পারে না রোদ। অথচ এই রোদটা খুব প্রিয় নাহিদ আহমেদের। দো’তলা বাড়িটা যখন তিনি বানিয়েছিলেন তখন চারপাশ বলতে গেলে খালিই ছিল। সে সময় শুধু বেলকনীতে নয় ঘরের ভেতর পর্যন্ত রোদ খেলা করতো। গত ১০ বছরে তার বাড়ির চারদিকে ছ’তলা ১০ তলা ভবন উঠেছে। এর পর থেকেই তার বাড়ির বেলকনী থেকে রোদ পালিয়েছে। এ নিয়ে প্রথম প্রথম খারাপ লাগলেও এখন মানিয়ে গেছে নাহিদ আহমেদের।
আজ সকাল থেকেই চির চেনা বাড়িটা তার কাছে অচেনা লাগছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। সকাল ছাড়িয়ে দুপুরের দিকে যাচ্ছে সময়। সূর্য বাড়িয়েছে তার প্রখরতা।
কিন্তু নাহিদ আহমেদের কাছে যেন সূর্যটা ডুবে যাচেছ অথবা পূর্ণ গ্রাস হচ্ছে। এমনতো তার কোনদিন হয় না। বিষয়টি ভাবতে গিয়ে হোচট খান তিনি। আবারও খবরের কাগজটা হাতে নেন। তিন নম্বর পাতায় চোখ বুলান। নিচের দিকেই একটি বক্স আইটেমের মধ্যে তার মেয়ে নিশির ছবি। ছবির ঠিক নিচে লেখা ‘একে ধরিয়ে দিন।’ 
প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেননি নাহিদ আহমেদ। কম করে হলেও ১০ মিনিটের মতো তিনি তাকিয়ে ছিলেন ছবিটির দিকে। ৫০ বারের বেশি পড়েছেন নিচের লেখাটি। এরপরও বিশ্বাস হয় না তার। তার মেয়ের ছবি পত্রিকায় থাকবে কেন? কেনই বা ধরিয়ে দেয়ার বিজ্ঞাপন থাকবে? তা হলে কি তার মেয়ে ক্রাইমের সঙ্গে জড়িয়েছে? তার মেয়ে ক্রাইমের সঙ্গে জড়াতে পারে এওকি তাকে বিশ্বাস করতে হবে?
অবশেষে শান্তি খুঁজে পান নাহিদ আহমেদ। ভাল করে চোখ বুলিয়ে মনে মনে সিদ্ধান্ত নেন এ ছবিটি তার মেয়ের নয়। হয়তো দেখতে একই রকম হওয়ায় ছবিটি তার মেয়ের মনে হচেছ। গতকাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফেরার পর থেকেইতো নিশি বাড়িতে। তার সামনেই ঘোরাফেরা করেছে। রাতে দু’জন বেলকনীতে বসে চা খেয়েছে। নাহিদ আহমেদকে একটা গানও শুনিয়েছে নিশি। গান বলতে বাথ রুম সিঙ্গার যাকে বলে। কিন্তু এই গলাই নাহিদ আহমেদের ভাল লাগে। মেয়েও তার আবদার রক্ষা করে। গান শেষে  রাত ১২ টার দিকে মা মেয়ে ঘুমাতে গিয়েছে। সকালে উঠেই পত্রিকায় কেন দেখা যাবে ‘একে ধরিয়ে দিন’ বিজ্ঞাপন। তার বদ্ধমূল ধারনা হয় ছবির মেয়েটা দেখতে নিশির মতো। তবে নিশি নয়।
এরই মধ্যে দু’বার নিশির ঘরে উকি দিয়ে এসেছেন নাহিদ আহমেদ। দেখেছেন নিশি কোল বালিশ জড়িয়ে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। শান্তির ঘুম। এমন ঘুম নাহিদ আহমেদ অনেক দিন ঘুমাননি। যে কারনে মেয়েকে ডাকতে গিয়েও ডাকেননি। এ ছাড়া ঘুম থেকে ডেকে তুললে নিশির মেজাজ খারাপ হয় সে বিষয়টাও মনে পড়ে তার। 
পরের বার নাহিদ আহমেদ পত্রিকার পাতাটা নিয়েই নিশির ঘরে গিয়েছিলেন।  পত্রিকার ছবি ও মেয়ের মুখের দিকে বারবার তাকাচ্ছিলেন। কখনো মনে হচিছল এটা নিশির ছবিই। আবার মনে হচ্ছিল না। নিশির ঘরের জানালার পর্দা পড়া থাকায় মুখটা পুরোপুরি দেখাও যাচিছল না। নাহিদ আহমেদ লাইট জ্বালানোর সাহস পেলেন না। তিনি জানেন লাইট জ্বালানোর সঙ্গে সঙ্গেই নিশি জেগে যাবে। আর সারাটা দিন চিৎকার চেচামেছি করবে। সংসারের অশান্তি চান না তিনি। এর আগে একবার মেয়েকে ডেকে তুলে এই বিপত্তিতে পরেছিলেন।
বেলকনীর চেয়ারটাকেও আজ নাহিদ আহমেদের অচেনা মনে হচ্ছে। চেয়ারটাও যেন তাকে দেখে উপহাস করছে। দেখেই সরে যেতে চাইছে। কিন্তু যখন মনে মনে স্থির হলেন ছবিটা তার মেয়ের নয়-নিশ্চিত অন্য কারো তখন সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে আসতে থাকলো।
নাহিদ আহমেদ চেয়ারে বসে পত্রিকার অন্য পাতাগুলোতে চোখ বুলাতে লাগলেন। খেলার পাতায় বাংলাদেশের মাশরাফি বিন মর্তুজা ও  মোহাম্মদ আশরাফুলের আইপিলে যোগ দেয়া ও কত ডলারে বিক্রি হলো সে বিষয়টি পড়ায় মনোযোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু এরপরও তার সেই তিন নম্বর পাতায় যেতে ইচ্ছে করে। এই সংবাদে তার মন টানে না। সত্যিই কি মেয়েটার ছবি নিশির কিনা আরও একবার নিশ্চিত হতে চান। পরক্ষনই সিদ্ধান্ত  নেন তিনি তিন নম্বর পাতাটা  আর খুলবেনই না। 
মিনিট দশেক পরই তার মোবাইল ফোন বেজে উঠে। মনিটরে ভেসে উঠে বন্ধু তারিকের নাম। খুশি হন নাহিদ আহমেদ। তারিক অনেক দিন পর ফোন করেছে। কত বছর এক সঙ্গে তারা পড়াশোনা করেছে। চাকরিও করেছে এক সঙ্গেই। অবসরে যাওয়াটাও এক সঙ্গে। তাদের দু’জনের পরিবারেই মাত্র একটি করে সন্তান। দু’জনের স্ত্রীই ব্যাংকে চাকরি করেন। দু’জনই চায়ের চেয়ে কফি খেতে বেশি পছন্দ করেন। দু’জনের বাড়িও দো’তলা। একই নামের পত্রিকা পড়েন দু’জনই। পত্রিকা বদল করলে একসঙ্গেই বদলান। দু’জনের অদ্ভুদ মিল। শুধু দু-একটা অমিল আছে। এর একটা নাহিদের মেয়ে আর তারিকের ছেলে।
তারিকের কণ্ঠে করুনার সুর-‘দোস্ত ঠিক আছিস তুই?  প্রশ্ন শুনে আৎকে উঠেন নাহিদ আহমেদ।
‘কেন কি হয়েছে আমার’ গলা কেপে উঠে নাহিদের।
‘ না না, তোর কিছু হয়নি। পত্রিকা পড়েছিস আজ?’
‘হাঁ পড়েছি, কেন কি হয়েছে?’
‘না মানে ইয়ে’-আমতা আমতা করতে থাকেন তারিক। 
‘কি হয়েছে আমতা আমতা করছিস কেন?’
‘না মানে, আজকের পত্রিকায় বিশেষ কোন ঘটনা চোখে পড়েছে তোর?’
‘খুলে বলতো তুই কি হয়েছে?’
এ প্রশ্ন শুনে তারিক নিশ্চিত মেয়ের সংবাদ পড়া হয়নি নাহিদের। কিন্তু এমন একটা সংবাদ তিনি কি করে দেবেন-ইতস্তত করছিলেন। এ ছাড়া নাহিদের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে। কি থেকে কি হয়ে যায়। যদি কিছু হয়ে যায় তা হলে নিজেকে অপরাধী মনে হবে। তারিক বুদ্ধি খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন। হঠাৎ তিনি বললেন-
‘নাহিদ তুই পত্রিকার তিন নম্বর পাতার নিচের দিকে তাকিয়ে দেখ একটি বিজ্ঞাপন আছে। সেই বিজ্ঞাপনটি দেখার পর আমি তোর সঙ্গে কথা বলছি’
‘ওহ এই কথা। আমি দেখেছি। ছবিটা আমার মেয়ের মতো মনে হয়তো? আরে না সে আমার নিশি না। দেখতে তার মতো।’
‘তাই’ স্বস্থির নিশ্বাস ছাড়লেন তারিক। 
তবে তিনি চমকে গেছেন। তিনি তা হলে ভুল দেখলেন। এমন ভুলতো তার কখনো হয় না। তা হলে তার চোখের পাওয়ার আরও কমে গেছে। হয়তো তাই হবে। ভাবলেন, নাহিদ যেহেতু বলেছে তাহলে তার মেয়ের ছবিই নয় এটি। আবারও তিনি চশমার কাচ পরিস্কার করে পত্রিকার পাতায় চোখ বুলালেন। কিন্তু তার কাছে নিশিই মনে হচ্ছে। কিন্তু নাহিদের কেন মনে হচ্ছে না তাই নিয়ে আবার চিন্তায় পড়ে গেলেন তারিক। 
এবার মোবাইল ফোন নয় বেজে উঠেছে ল্যান্ড ফোন।  নাহিদ আহমেদ ফোন ধরতে দেরি করলেন না। 
ফোনটি করেছে নিশির বান্ধবী নিলি। সেই ফোনেও নিশির খোঁজ নেয়। নাহিদ আহমেদের কাছ থেকে জানতে চায় নিশির কোন সমস্যা হয়েছে কি না। পর পর আরও ক’টি ফোন রিসিভ করেন নাহিদ আহমেদ। সবারই পশ্ন প্রায় একই ধরনের। 
নাহিদ আহমেদ তার বিশ্বাস থেকে সড়ে আসেন। তিনিও নিশ্চিত এ ছবি নিশিরই। তা না হলে সবাই কেন ফোন করে জানতে চাইবে? সবাইতো আর ভুল করতে পারে না। নিশি কখন ঘুম থেকে উঠবে সে কারনে এ রুম ও রুম পায়চারি শুরু করেন নাহিদ আহমেদ। 
নাহিদ আহমেদ ভাবনায় আসে কোন পাপের কারনেই হয়তো আজ এই পরিণতি। তার মেয়ে বিপথগামী হয়েছে। ছবি উঠেছে পত্রিকায়। কিন্তু কি পাপ তিনি করেছেন বুঝে উঠতে পারেন না। জীবনে কারো কাছ থেকে দু’টাকা ঘুষ নিয়েছেন তাওতো মনে করতে পারছেন না। কারো উপকার করতে না পারলেও অপকার করেছেন তাও মনে পড়ে না। সরকারি বড় কর্মকর্তা হয়েও বাড়ি বানিয়েছেন গ্রামের বাড়ি থেকে জমি বিক্রি করা টাকায়। অথচ তিনি শুনেছেন তার অফিসের পিয়নেরও নাকি ঢাকায় ৬ তলা ৮ তলা বাড়ি আছে। তবে কোন পাপে আজ তার মেয়ে বিপথ গামী? বাবা-মা’র পাপ নাকি সন্তানদের ছুয়ে যায়-এমন বিশ্বাস তার। পাপ-পূণ্যের হিসাব মিলাতে গিয়ে ঘামতে থাকেন তিনি।
 
০২
নাহিদ আহমেদের স্ত্রী জবা আহমেদ ব্যাংকের বড় চাকুরে। প্রতিদিন সকাল ৮টায় বাসা থেকে বের হন ব্যাংকের উদ্দেশ্যে। আজও তার অন্যথা করেননি। বাড়িতে সকাল ৮ টার দিকে পত্রিকা এলেও তিনি পত্রিকার হেডলাইন গুলো ছাড়া আর কিছু পড়ার সুযোগ পান না। ভেতরের পাতাগুলো কাজের ফাকে অফিসেই পড়ে থাকেন। আজও তৈরি হতে হতে পত্রিকার প্রথম পাতার খবরের শিরোনামগুলো দেখে নাহিদ আহমেদের কছে দিয়ে বেরিয়ে যান।
অফিসে ঢোকার পর সবাই যেন কি একটা বিষয় নিয়ে বলাবলি করছিলেন। জবা আহমেদ ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই চুপ করে গেলেন সবাই। বিষয়টা ভাল ঠেকেনি তার কাছে। কিন্তু কি নিয়ে তারা আলোচনা করছিলেন সে বিষয়টি জানার আগ্রহ বোধ করেননি জবা। কারো কোন বিষয়ে নাক গলাতে তিনি একদমই পছন্দ করেন না। এসব নিয়ে ভাবতেও ভাল লাগে না তার। তিনি জানেন, বেশিরভাগ মানুষই ফিসফাস করে কথা বলতে পছন্দ করে। অফিসে কোন একটা ঝামেলা হলে তা নিয়ে সমালোচনার শেষ থাকে না। এক জনের কাছ থেকে আরেকজন শোনার জন্য অতি আগ্রহে চেষ্টা করে। কেউ কেউ কাজ ফেলে রেখে ক্যান্টিনে গিয়ে চায়ের কাপে ঝড় তুলে। সেখানেও আবার কয়েকটি ভাগে ভাগ হয়। সেখানে বুঝা যায় কোন সহকর্মীর সঙ্গে কার খুব মিল, বিশ্বাস। বিশ্বাসী লোক না হলে গসিপিং করে মজাও নেই। যদি কোন কথা বলতে গিয়ে ভেটো আসে তা হলে গসিপিংয়ের মজাটাও থাকে না। এসব বিষয় ব্যাংকে যোগদানের পর থেকেই দেখছেন তিনি। ২৫ বছরে এসব তার গা সওয়া হয়ে গেছে। তবে ফিসফিসানি, গসিপিং একদম অপছন্দ জবার। তবে কাউকে তিনি তার অপছন্দের কথা বলেননি। তাতে কী! সহকর্মীরাতো আর মুর্খ নন। এ কারনেই তারা কোন গসিপিংয়ে জবার সঙ্গে শরিক হন না। আজও অফিসের কোন ঘটনা নিয়ে হয়তো তারা গসিপিং করছিল। জবা  তার টেবিলে বসেই ফাইল নাড়াচাড়া শুরু করেন। 
জবার পাশের টেবিলেই বসেন সিনিয়র অফিসার  হায়াৎ আলী। তিনি একবার তার মেয়ের কথাটা উঠাতে গিয়েও নিজেকে সামলে নেন। তবে হায়ৎ আলী জানেন, জবা আর কারো সঙ্গে বিষয়টা শেয়ার না করতে চাইলেও তার সঙ্গে করবে। আধাঘন্টার বেশি হয়ে গেল কিন্তু জবা কোন কথাই বলছে না। তা হলে নিশ্চয়ই তার মনটা আজ ক্ষুব্দ। যদি তার মেয়েকে নিয়ে এমন একটি বিষয় ছাপা হতো তা হলে তার কেমন লাগতো। মনে মনে আন্দাজ করার চেষ্টা করছেন হায়াৎ আলী। অন্য টেবিল থেকেও কোন কোন অফিসার বার বার তাকাচ্ছিলেন জবার দিকে। বিষয়টি জবার চোখে পড়ে। একবার মনে হয় কপালের টিপটা বোধ হয় ঠিক জায়গায় বসানো হয়নি। সেটাই সবাই দেখছেন বারবার। এতো ব্যস্ততার মধ্যে যখন বাসা থেকে বেরিয়ে আসতে হয় তখনতো টিপটা ঠিক জায়গায় বসতে নাও পারে। তাতে এতো দেখার  কি আছে? এক পর্যায়ে তিনি নিশ্চিত হওয়ার জন্য ফ্রেস রুমে যান। আয়নায় দেখতে পান না সব ঠিক আছে। বরং অন্যদিনের চেয়ে আজই তাকে বেশি সুন্দরী লাগছে। তা হলে কি তার সহকর্মীরা তার সৌন্দর্য্য দেখছে। এই বুড়– বয়সে সৌন্দর্য্য দেখারই বা কি আছে- ভেবে কোন কুল কিনারা করতে পারেন না জবা।
আয়নায় চোখ ফেলে খানিক হেসে ফেলেন জবা। ২৫ বছরে দু’বার কপালের টিপটা ফ্রেস রুমের আয়নায় গিয়ে দেখলেন তিনি। প্রথম বারের কথা তার মনে পড়ে যায়। সে দিনটির কথা মনে হতেই আরো কিছুক্ষন নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করলো তার। জবার স্পষ্ট মনে আছে সেদিনটির কথা। ব্যাংকের ক্যাশ কাউন্টারে বসে টাকা দিচ্ছিলেন লোকজনকে। হঠাৎ এক যুবক টাকা নিতে গিয়ে তার দিকে অপলক তাকিয়ে ছিলো। যা বিরুক্তির উদ্রেক করার কথা কিন্তু সেদিন মোটেও বিরক্ত হননি জবা। বরং তিনিও এক ফাকে যুবককে নয়নভরে দেখে নিয়েছিলেন। এর পর টাকা নিয়ে যুবক চলে যায়। ব্যাংকের প্রধান গেট পেরুনোর আগেও একবার পেছন ফিরে তাকিয়েছিল সেই যুবক। সেদিন জবার মনে পড়েছিল কি এমন সৌন্দর্য তার মধ্যে দেখতে পেল ওই যুবক। এই কারনে জবা কিছুক্ষন পরই ফ্রেস রুমে গিয়ে আয়নায় নিজের চেহারাটা দেখে ছিলেন। সেদিন তার কপালের টিপটা ঠিক আজকের মতো ছিল। আজকের মতোই সুন্দরী লাগছিল তাকে।
যুবক চলে যাওয়ার দু’দিন পর আরেক যুবক এসে সরাসরি ব্যাংকের ম্যানেজারের কাছে গিয়েছিল। বন্ধুর জন্য জবাকে পছন্দ হয়েছে এমন কথা অকপটে বলে ফেলতেও দ্বিধা করেনি সে। স্পষ্টভাসি যুবককে বেশ পছন্দ হয়েছিল ব্যাংক ম্যানেজারের। যুবক ম্যানেজারকে জানিয়েছিল ব্যাংকের সুন্দরী মেয়েটিকে তার বন্ধুর পছন্দ হয়েছে। তার বন্ধুটি বড় পদে সরকারি চাকরি করে। পাত্র হিসেবেও খারাপ না। ব্যাংক ম্যানেজার খুশি হয়েই ঘটকালি করেছিলেন সেদিন। আর বড় কর্মকর্তা নাহিদ আহমেদের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন জবাকে। পরবর্তীতে জবা জানতে পেরেছিলেন, নাহিদ আহমেদ তাকে দেখেই পছন্দ করে ফেলেছিলেন।  কিভাবে কি করা যায় তা নিয়ে পরামর্শ করেছিলেন বন্ধু তারিকের সঙ্গে। তারিকই ম্যানেজারের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে গিয়েছিলেন। বিয়ের পর থেকে তারিকও জবার বন্ধু বনে যায়। তবে তারিক তাকে ভাবী বলেই সম্বোধন করে। হঠাৎ জবার সম্বিত ফিরে। মনে পড়ে টেবিলে অনেক কাজ পড়ে আছে। দ্রুত তিনি ফ্রেস রুম থেকে নিজ টেবিলে গিয়ে বসেন।  
আরও একবার জুনিয়ার অফিসার মনির হাসান তার দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলেন খাতার দিকে। বিষয়টি চোখে পড়ে জবার। তার তাকানোটা সুবিধের মনে হয়নি জবার কাছে। মনির অন্যদিন তাকে দেখেই দাড়িয়ে সালাম দেয়। আজ টেবিল থেকে নড়লই না। তা ভেবেও খটকা লাগে জবার। অথচ মনিরের সঙ্গে  নিশির বিয়ের কথা বার্তা চলছে।
যখন থেকে কথা বার্তা শুরু হয়েছে তখন থেকেই তাকে শ্বাশুরির মতোই সম্মান করে মনির। আজ এমন কি হলো যেন সব পাল্টে যাচ্ছে। তা হলে কি গতকাল কোন কাজে জবা ভুল করে গেছে। তাতে ব্যাংকের সুনাম নষ্ট হওয়াসহ ক্ষতিও হয়েছে। কিন্তু এমনতো হওয়ার কথা নয়। ক্যাশ মিলানোর পর তিনি বেরিয়েছেন। ম্যানেজার সাহেব তাকে ডেকে বরং কাজের প্রশংসাই করলেন। বললেন, বয়স হলেও কাজে কোন ধরনের অলসতা তিনি জবার মধ্যে দেখতে পান না। এমন যদি সব অফিসারই হতো তা হলে জন বল আরো কম দিয়েও ব্যাংক চালানো যেতো। 
কাজে মনোযোগ দেন জবা আহমেদ। অনেক ফাইল তার সামনে। গতকাল সব কাজ শেষ করে যেতে পারেননি। তিনি একের পর এক ফাইলে চোখ ফেলতে শরূ করলেন। 
ঠিক ওই সময় তার মোবাইলে ফোন আসে। টেবিলের এক পাশে রাখা ব্যাগের ভেতর মোবইলটা বেজে উঠে। বিরক্ত হন জবা। প্রতিদিন তিনি রিংগার সুইচ অফ করে কাজ শুরু করেন। আজ কেন যে করলেন না এ জন্য নিজের উপরই রাগ হচ্ছিল তার। শব্দটা শুধু তাকে নয় অন্যদেরও কানে লাগে। 
পাশের টেবিল থেকে হায়াৎ আলী বললেন-
‘আপা আপনার ফোন বাজছে’। হায়াৎ আলীর কথায় ব্যাগ থেকে মোবাইল ফোন বের করেন। তার ইচ্ছে ছিল যেই ফোন করুক না ধরে সুইচ স্টপ করে দেবেন। কিন্তু মনিটরে দেখতে পান তারিকের নাম ভাসছে। এই ফোনটা তাকে ধরতেই হবে। কেন না তারিকের ফোন তিনি ধরেননি এমন ঘটনা মনে করতে পারছেন না। অনিচ্ছা সত্বেও ফোনটি ধরলেন তিনি।
‘হ্যালো- স্লামালেকুম’- তার গলা স্বাভাবিক। চমকে যায় তারিক। মেয়ের এতো বড় সমস্যা হচ্ছে আর তার বাবা-মা নাকি স্বাভাবিক আচরন করছে! অথচ তারিক নিজেই জ্বলে পোড়ে মরছে। 
‘ভাবী, ভাল আছেন।’
‘ভাল আছি ভাই’
‘আপনি কি অফিসে?’
প্রশ্ন শুনে রসিকতা করতে ইচ্ছে করলো জবা আহমেদের
‘অফিসে নয়তো কোথায়। আপনার বন্ধু কি আমাকে নিয়ে মঙ্গল গ্রহে ঘুরতে যাবেন নাকি। তারিক ভাই জরুরী কোন কাজে ফোন করেছেন?’
কি বলবে তারিক ভেবে পাচ্ছেন না। তিনি নিশির বিষয়টা তার সঙ্গে তুলবেন সে সাহস হলো না। তারিকও স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলেন-
‘না ভাবী আপনার কথা মনে পড়লো তাই ফোন করা। ভেবে ছিলাম আপনি বাসায় আছেন। নাহিদের সঙ্গে একটু কথা বলা দরকার। তার ফোনটা বন্ধ পেয়ে আপনাকে ফোন করলাম’
‘বলেন কি তার ফোনতো কখনো বন্ধ থাকে না। আমি দেখছি।’
‘না না ভাবী আপনার এই ব্যস্ত সময়ে তাকে ফোন করার দরকার নেই। আমার মনে হয় নেটওয়ার্কে প্রবলেম। যা হয়েছে না এই ফোন কোম্পানীগুলোর। ফোন খোলা থাকলেও অনেক সময় বলে ক্যাননট বি রিজড এট দিস মোমেন্ট, অথবা আপনার নাম্বারটি সঠিক নয় ইত্যাদি’
‘ঠিকই বলেছেন।’
‘আমি আবার নাহিদকে ট্রাই করছি। আপনি কাজ করুন।’
‘জ্বি ঠিক আছে। স্লামালেকুম’ 
ফোন কাটেন জবা আহমেদ। তার মনে সন্দেহ দানা বেধে উঠেছে। তারিকতো জেনে শুনেই তাকে ফোন করেছে। কিছু একটা বলতে চেয়েছিল। কিন্তু বললো না কেন। কোন সমস্যা হয়েছে নাকি তার পরিবারে? কোন সমস্যা হলেইতে এই লোকটি এগিয়ে আসেন। তাদের পরিবারের সমস্যাকে নিজের সমস্যা মনে করেন। সুসময়ে তার যোগাযোগ কম থাকলেও দু:সময়ে ঝাপিয়ে পড়েন। এমন লোক পৃথিবীতে ক’জন আছে হয়তো হিসাব করে বের করা যাবে। 
অফিসে ঢোকার সময় লোকজনের ফিসফিসানি চোখে পড়েছে তার। হায়াৎ আলী, মনিরের তাকানোটাও সুবিধের মনে হয়নি। তাদের আচরন মনে হয়নি আর দশটা দিনের মতো। নিজে নিজে হিসাব মিলানোর চেষ্টা করছেন জবা আহমেদ। কিন্তু কি ঝামেলা হয়েছে সেটা তিনি বুঝে উঠতে পারছেন না।  
তিনি কিছু হয়েছে কি না তা জানার জন্য নাহিদকে ফোন করেন। কিন্তু তার ফোন ব্যস্ত। জবা আহমেদ ফোনটি বন্ধ করে বিড়বিড় করতে করতে ব্যাগের ভেতর রেখে ফাইলের দিকে নজর দেন।  

০৩
পত্রিকা অফিসের পিএবিএক্সের কর্মী জলিল একটু রগচটা টাইপের লোক। প্রথম দুই তিন ঘন্টা ভালই সামলায়। কিন্তু এর পর থেকেই মেজাজ গরম হতে থাকে। ফোনের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। যন্ত্রনায় অতীষ্ট হয়ে উঠে সে। তখন মানুষের সঙ্গে খারাপ ব্যবহারও করতেও ছাড়ে না। তার বস ফোন করতে পারে সে বিষয়টিও তার মাথায় থাকে না। এ কারনে তিনবার চাকরি যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। কিন্তু সিনসিয়ারিটির কথা বিবেচনায় এনে তাকে ক্ষমা করে দেয়া হয়। 
আজও তার মেজাজ গরম। ধরিয়ে দিন বিজ্ঞাপনের ছবির মেয়েটির নাম কি, কেন তাকে ধরিয়ে দিতে হবে, এই মেয়ের অপরাধ কি, ইত্যাদি প্রশ্ন করে পাঠকরা অতীষ্ট করে তুলছে। জলিল মনে মনে ভাবছিল যদি কোন ক্রাইম রিপোর্টার অফিসে চলে আসতো তা হলে অনেকটা সামাল দেয়া যেতো। কারন বিষয়টা ক্রাইম রিলেটেড।
আর ক্রাইম রিলেটেড না হলেও এ ধরনের ফোন জলিল ক্রাইম ডিপার্টমেন্টেই পাঠায়। এ জন্য তাকে জারিও খেতে হয়। এর পরও নিজে না সামলে ক্রাইম রিপোর্টারের উপরই ছেড়ে দেয়ার পক্ষপাতি সে। তাদের অফিসে ক্রাইম রিপোর্টাররা বিকাল ৪ টার আগে আসে না। এখন বাজে দুপুর ১২ টা। আরও চার ঘণ্টা পর আসবে তারা। এতোক্ষন সে কিভাবে সামলবে এ চিন্তায় পড়ে যায়। 
জলিল নিজেও পত্রিকায় ছবিটার দিকে তাকিয়ে দেখে ফোন রিসিভের ফাকে ফাকে। সে বুঝতে পারছে এটা একটা বিজ্ঞাপন। কোন এক প্রতিষ্ঠান দিয়েছে। সে সংবাদ পত্রে প্রায় এক যুগ কাটিয়ে দিচেছ এমন বিজ্ঞাপন দেখেনি। কেউ কাউকে ধরিয়ে দেয়ার বিজ্ঞাপন দিলে সেখানে বিব্ধাপন দাতা প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির নাম ছাপা হয়। কোন কোন বিজ্ঞাপনে পুরস্কারের ঘোষনাও থাকে। কিন্তু এতে কিছুই নেই। শুধু পত্রিকা অফিসের বিজ্ঞাপনের একটি নাম্বার লেখা রয়েছে। কিছুক্ষন মেয়েটির দিকে চোখ রেখে সে দ্রুত পত্রিকা ভাজ করে ফেলে। ভয় পেয়ে যায়। মনে পড়ে তার পঞ্চম শ্রেনী পড়–য়া কন্যার কথা। 
গত বছর পত্রিকার প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী অনুষ্ঠানে একটি পাচতারা হোটেলের বল রুমে তারও যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। ওই দিন পুরনো এক বান্ধবীর সঙ্গে দেখা হয়ে যায় জলিলের। একে অপরকে চিনতে পারছিল না। এ করনে দু’জন দু’জনার দিকে অনেক্ষন তাকিয়েও ছিল। বেশ কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকার পর একজন আরেকজনকে চিনতে পারে। বন্ধবী আগ বাড়িয়ে এসে বলে ‘হায় তুমি জলিল না? জলিল বলেছিল তুমি জুলি না? এর পর দু’জন হ্যান্ডশেকও করে। 
হ্যান্ডশেক শেষ করে জলিল তার মেয়েকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য পাশে তাকায়। দেখে তার মেয়ে নেই। মহা চিন্তায় পড়ে যায় সে। জলিল ও জুলি অনুষ্ঠান স্থলে অনেক্ষন ধরে মেয়েকে খুজে। কিন্তু পায়নি। অবশেষে অনুষ্ঠান উপভোগ না করেই ক্লান্ত অবসাদ মনে বাসায় ফিরে জলিল। বাসায় গিয়ে মেয়ে হারানোর কথা বলার আগেই তার স্ত্রী তাকে দেখে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে। বলে, সে মেয়ে মানুষের সঙ্গে হাসি তামশা করে। আজ মেয়ের কাছে ধরা পড়েছে। কথাটা শুনে জলিলের মনে কিছুটা স্বস্থি ফিরে। তা হলে তার মেয়ে হারিয়ে যায়নি। সে বাসায় চলে এসেছে। 
স্ত্রী বলে যেতে থাকে, তার মেয়ে যদি ওই অনুষ্ঠানে না যেতো তা হলে বিষয়টা জানতেই পারতো না। সেদিন অনেক্ষন ধরে তার স্ত্রীকে বুঝিয়েছিল বিষয়টি। কিন্তু তার স্ত্রী দু’দিন পর্যন্ত তার সঙ্গে কথা বলেনি। এর পর থেকেই জলিল কোন নারীকে তাকিয়ে পর্যন্ত দেখে না। আর যতোটা পারে নিজের মেয়েকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। মেয়েও তাই। কখনো কখনো সামনে পড়ে গেলে লজ্জায় মুখ ঢাকে জলিল।
একদিন অনেক্ষ ধরে জলিল ভাবছিল একটি হ্যান্ডশেক কত গরমই না ছড়িয়ে দিল তার পরিবারে। সুখী পরিবারে হয়তো এভাবে ভুল বুঝাবুঝিতে অবিশ্বাসের সৃষ্টি হয়। ভেঙ্গেও যায়।
সেদিন জলিল তার স্ত্রীকে বলছিল জুলি আর সে একই কলেজে পড়েছে। ইন্টামিডিয়েট পাশ করে জুলি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। তার আর পড়া হয়ে উঠেনি। জুলি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে এখন বড় চাকরি করছে। ফার্স্ট ক্লাস অফিসার। এতোদিন পর তার সঙ্গে অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছে। একে অপরে কি করছে জানতে চাইছিল। জলিল সামান্য একটা টেলিফোন অপারেটর এ কথা শুনেও তাকে জুলি তুচ্ছ করেনি। বরং তার ভিজিটিং কার্ড দিয়ে বলেছিল তার সঙ্গে দেখা করার জন্য। সুযোগ পেলে তাকে একটা ভাল কাজ জুটিয়ে দেবে। 
ভাল কাজের কথা শুনলে সব সময়ই খুশী হয় তার স্ত্রী। কিন্তু এদিন আর তার চোখ নেচে উঠেনি। তা দেখে জলিল খুব একটা অবাক হয়নি। সে বুঝতে পারে হ্যান্ডশেক বান্ধবী তাকে চাকরি দিক এটা তার পছন্দ নয়। বরং তার স্ত্রী বলেছিল-
-আদার বেপারী জাহাজের খবর নেওয়ার দরকার নাই। যেখানে আছ সেখানেই কাজ করো। তখন রসিকতা করে জলিল স্ত্রীকে বলেছিল- দেখ আদার বেপারীদেরই কিন্তু  জাহাজের খবরা খবর রাখার কথা। তুমি কি জানো এখন দেশে বেশিরভাগ আদা জাহাজে করে বিদেশ থেকে আসে। তা হলে জাহাজের খবর কে রাখবে এই টেলিফোন অপারেটর নাকি আদার বেপারী। জলিলের কথা শুনে মুড অফ স্ত্রী হেসে ফেলেছিল। 
পরে জানায়, বান্ধবীর সঙ্গে হ্যান্ডশেকের বিষয়টি তার মেয়ে সহজভাবে নিতে পারেনি। তাই সে কাদতে কাদতে বাড়ি ফিরে তার মায়ের কাছে অভিযোগ করে বাবার চরিত্র নিয়ে। এখনো কোন সুন্দরী নারীকে দেখলেই জলিলের সেই কথাটি মনে পড়ে যায়।
আজও নিশির ছবিটি দেখে ওই ঘটনা মনে পড়তেই দ্রুত পত্রিকাটি ভাজ করে রেখে দেয় জলিল। তার মনে হচ্ছিল মেয়েটির ছবি দেখার সময় তার কন্যা পেছন থেকে দেখে তার মায়ের কাছে দৌড়ে যাচেছ। 

০৪
নিশি বড়ই ঘুম কাতরে মেয়ে। ঘুম থেকে জেগে মোবাইলটা হাতে নেয়। দেখে ১৬৪ টি মিসড কল হয়ে আছে। চমকে যায় সে। ভুল দেখলো কি না সে জন্য দু’বার চোখ কচলায়। না সে ভুল দেখছে না। যা দেখছে সত্যি। চিন্তায় পড়ে যায় সে। কোনদিনতো এমন হয় না। কি হয়েছে দেশে?  নিশ্চয়ই বড় ধরনের কোন ঘটনা ঘটেছে। 
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্র“য়ারি পিলখানায় যখন বিডিআররা বিদ্রোহ করেছিল সেদিনও সে সকালের দিকে খুব ঘুমিয়েছিল। উঠে দেখতে পায় তার মোবাইলে ২৫ টি মিসড কল হয়ে আছে। কল খুলে দেখতে পায় তার ঘনিষ্ট বন্ধুরাই ফোন করেছিল তাকে। তবে রিংগার টোন বন্ধ করে রাখায় সে কারো ফোনই ধরতে পারেনি। আজ কি হলো এ নিয়ে চিন্তায় পড়ে যায় সে। একবার ভাবে প্রায়ই পত্রিকায় সংবাদ ছাপা হয় দেশে ভয়াবহ ভূমিকম্প হবে। তা হলে কি ভূমিকম্প হয়েছে। সে ঘরের চারদিকে তাকায়। এতো বড় ভূমিকম্প হলে তাদের বাড়িতেও কিছু একটা হতো। সবইতো ঠিকঠাক আছে। তা হলে কি হয়েছে? দেশের প্রধানমন্ত্রীর কোন সমস্যা হলো। কিছুই ঠাহর করতে উঠতে পারে না নিশি। এরই মাঝে নিশি মনে মনে বিরক্তও হলো। বিডিআর বিদ্রোহ হলে এমনকি যে, তাকে খবর জানানোর জন্য ২৫ জন বন্ধু ফোন করে বসে ছিল। সেতো একজন সাধারন নাগরিক। তা হলে তাকে এতো খবর জানানোর কি আছে। তার কিইবা করার ক্ষমতা আছে? হিসাব মিলাতে না পেরে বিছানা ছেড়ে উঠে। ভাবে একজনকে অন্তত কল ব্যাক করে জানা দরকার কেন ফোন করেছিল। কিন্তু কাকে সে ফোন করবে বুঝে উঠতে পারছে না। কারন যাদের ফোন মিসড কল হয়ে আছে তার মধ্যে বেশিরভাগ সেইভ করা নাম রয়েছে ফালতু-১ , ফালতু-২ এমন ৪০ টির বেশি ফালতু নাম্বার। 
নিশি যা পছন্দ করে না এসব বিষয়ই তার জীবনে বেশি ঘটে। মোবাইল ফোনে জরুরী কথা ছাড়া বাড়তি কথা একদম অপছন্দ তার। আর যদি কেউ ফলতু প্যাচাল পাড়তে চায় তা হলে তার মেজার বিগড়ে যায়। এ পর্যন্ত সে তিনবার তিনটা সীম বদলেছে। এর পরও কোত্থেকে যে লোকজন তার নাম্বার পেয়ে যায়? আর রাত বিরাতে বিরক্ত করে। পরে বিরক্ত করা ফোন নম্বরগুলোকে সে ফালতু নাম দিয়ে সেইভ করে রেখেছে। ফালতু নম্বর থেকে ফোন আসার সঙ্গে সঙ্গে সে রিসিভ করে কোন কথা না বলে খাটের উপর, টেবিলের উপর বা অন্য কোথাও রেখে দেয়।
প্রথম প্রথম অনেক অনুরোধ করেছে সে ফোনকারীকে ফোন না করার জন্য। কিন্তু কে কার কথা শুনে। সবাই তাকে পটাতে চায়। কিন্তু জরুরী থাকার কারনে সে ফোনটা বন্ধও করে রাখতে পারে না। এরই মধ্যে তার এক বন্ধু তাকে রিসিভ করার বুদ্ধিটা দেয়। এর পর কাজ হয়েছে। একজনতো রোজ ১০ বার ফোন করতো। এখন সে একবারও ফোন করে না। ফালতুদের বিরক্তি থেকে বেচে বেশ শান্তিতেই ছিল নিশি। হঠাৎ আজ এক সঙ্গে সব ফালতুরা তাকে ফোন করলো কেন বুঝে উঠতে পারছে না। গোলক ধাধায় পড়ে গেছে নিশি। 

০৫
বিজ্ঞাপনের বিষয়টি থানা পর্যন্তও গড়িয়ে গেছে। থানার ওসি পত্রিকা হাতে পাওয়ার পরই তার চোখ যায় ওই বিজ্ঞাপনটির দিকে। তিনি ঘটনা বুঝে উঠতে পারেন না। বিজ্ঞাপনটার মানে বুঝার চেষ্টা করেন বার কয়েক। বিজ্ঞাপনের চারপাশে প্রতিষ্ঠানের নাম খুজেন। কারা তাকে ধরিয়ে দিতে বলছে তাও বুঝতে পারছেন না। 
ডিউটি অফিসারের রুমেও তখন বিজ্ঞাপনটি নিয়ে আলোচনা চলছিল। কায়েস নামের এক সাব-ইন্সপেক্টর ডিউটি অফিসারকে জানালেন তিনি এই মেয়েটিকে চিনেন। কথা শুনে ডিউটি অফিসার বিস্মিত। পর মূহূর্তেই তার বিস্ময় কাটে। সাব-ইন্সপেক্টর জানান, এই মেযেটির বড়ি এই থানা এলাকায়ই। প্রায় প্রতিদিনই থানার সামনে দিয়ে রিক্সায় যেতে দেখেন। তার কথা শুনে দরজার সামনে দায়িত্বপালনকারী এক কনস্টেবলও ভেতরে আসেন। ডিউটি অফিসারের কাছ থেকে পত্রিকাটা নেয়ার জন্য কাচুমাচুৃ করতে থাকেন। বিষয়টি সহজেই বুঝতে পারেন ডিউটি অফিসার। তিনি কনস্টেবলকে বলেন-
কি হাকিম মিয়া পত্রিকাটা দেখতে চাচ্ছেন? বুড়– কনস্টেবল আগ্রহ নিয়ে বলেন-
‘স্যার যদি একটু দেন’। 
ডিউটি অফিসারের কাছ থেকে পত্রিকাটা নিয়ে বুড়– কনস্টেবলও নিশ্চিত করে এ মেয়েটিকে তিনি অনেকবার থানার সামনে দিয়ে যেতে দেখেছেন। সাব-ইন্সপেক্টর ভাবলেন বিষযটা ওসি সাহেবের কানে দেওয়া দরকার। এই সুযোগে একটু তেলও মারা যাবে। নতুন ওসি এসেই তার উপর ক্ষেপে রয়েছেন। যোগদানের দু’দিন পরই তাকে রুমে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে তাই গালাগালি করেছেন। বলেছেন কায়েসের বিরুদ্ধে তিনি চাদাবাজির অভিযোগ পেয়েছেন। ডিউটিও ঠিকমতো করে না বলে জানতে পেরেছেন। 
কায়েস পত্রিকাটা হাতে করে নিয়ে দ্রুত ওসির রুমে যেতে গিয়ে দরজার সামনে দাড়িয়ে যায়। ৮০ কিলোমিটার বেগে যাওয়া কোন গাড়ির হঠাৎ ব্রেক কষার মতো। কিছুক্ষন চিন্তা করেন-এই মেয়েটার কথা ওসি সাহেবের সামনে বললে হিতে আবার বিপরীত হবে নাতো। তিনি আবার বলে বসবেন নাতো যে, শুধু চাদাবাজি, ফাকিবাজিই করেন না, কোন রাস্তা দিয়ে কোন সুন্দরী মেয়ে মানুষ যায় তার খররও রাখেন। কিন্তু এ কথা তো তিনি নাও বলতে পারেন। হতে পারেতো উল্টোটাও। ওসি সাহেব ভাবতে পারেন কায়েসের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ থাকলেও আসলে সে থানা এলাকার খোজ খবর ভালই রাখে। 
শেষ চিন্তাটাই তার মনে ধরে। সে পত্রিকাটা হাতে নিয়েই দরজার একটি পাট্টা ধাক্কা দেয়। বিনযের সুরে বলে-
-আসবো স্যার।
ওসি সাহেব চশমা নামিয়ে একবার দেখেন তাকে। ধ্ক করে উঠে কায়েসের মন। এই প্রথম নরম সুরে ওসি সাহেব বললেন-
-আসুন। এ সময় ওসির রুমে আর কেউ ছিল না। ওসিও একজন লোক খুজছিলেন ছবির মেয়েটিকে নিয়ে কথা বলার জন্য। 
-স্যার একটা বিষয়ে কথা বলতে এসেছিলাম। 
-বলেন।
পত্রিকার ছবিটা দেখায় কায়েস। স্যার যে মেয়েটাকে ধরিয়ে দিতে বলছে সেই মেয়ে আমাদের থানা এলাকায় থাকে- গর্বের ভঙ্গিতে বলে কায়েস। ওসির মুখে হাসি ফোটে।
-তাই নাকি। আপনি সিওর?
-জ্বি স্যার-সিওর।
-ভেরিগুড। এই প্রথম দেখলাম যে আসলে আপনি কাজের লোক। আমি ছবিটা নিয়ে ভাবছিলাম। ওর বাসা কি আপনি চেনেন?
-না স্যার।
-তা হলে সে এই থানা এলাকার সেটা জানেন কি করে?
-স্যার আমি এই থানায় দু’বছর ধরে আছি। মেয়েটিকে থানার সামনে দিয়ে যেতে দেখেছি অনেকবার। 
-আর সুন্দরী মেয়ে বলে তার দিকে বেশি বেশি তাকিয়েছেন, তাইতো। হাসে ওসি। লজ্জা পায় দারোগা। ওসি আশ্বস্থ করেন-
-এইটা দোষের কিছু না। মানুষ সুন্দরের পুজারী। আপনি তাকে দেখতেই পারেন। আমি হলেও বোধ হয় দেখতাম। বোধহয় কি বলছি, দেখতাম-ই। যাই হোক, আপনি এর বাড়ির ঠিকানাটা বের করার চেষ্টা করেন। দেখেন যদি আমরা তাকে ধরে ফেলতে পারি তা হলে কিন্তু বেশ নাম হবে। মিডিয়া কাভারেজ ভাল পাবেন। আরে দুইটা ডাকাত বা অস্ত্র যদি ধরেন তাহলে কি খবর ছাপা হয় পত্রিকায়? টিভি চ্যানেল ছুটে আসে? আসে না। এই মেয়েকে ধরে ফেলতে পারলে ব্যাপক নাম হবে বুঝলেন। কিন্তু একটা বিষয় মাথায় রাখবেন। কি কারনে তাকে ধরিয়ে দেওয়ার বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে সে বিষয়টি আগে ক্লিয়ার হতে হবে। 
-স্যার, ধরে ফেলি পরে জানতে পারবো।
-এইতো মাথা মোটার মতো কথা কইলেন। ধইরা গিয়া বিপদে পড়বেন নাকি।
-স্যার, বিপদ কি? সেতো অপরাধী। তা না হলেতো আর পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হতো না। 
-কিন্তু বিজ্ঞাপনেতো কিছুই উল্লেখ নেই। এটাতো অন্য কোন কারনও হতে পারে। আমি বলিকি, আপনি বাসাটা চিহ্নিত করে রাখেন। যোগাযোগ করে দেখি গ্রেফতারের বিষয় হলেই তাকে নিয়ে আসবো। যান।
-ঠিক আছে স্যার। স্যালুট দিয়ে বেরিয়ে যায় কায়েস। তার মনটা আজ ফুরফুরে। প্রথমবারের মতে ওসি তার সঙ্গে ভালভাবে কথা বললেন। 
কায়েসের দেরী সয় না। থানা কম্পাউন্ড থেকে মোটর সাইকেল নিয়ে সে যায় তাদের থানা এলাকায় একটি হাউজিংয়ে। সে বুঝতে পারে মেয়েটি ওই এলাকায়ই থাকে।
হাউজিংয়ে ঢোকার মুখেই একটি মুদি দোকান। তার সামনে মোটর সাইকেল থামিয়ে দোকানে যায় কায়েস। সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধ দোকানীর মুখ শুকিয়ে আসে। আগেই বলতে থাকে স্যার-আজকেতো মাসের ২৮ তারিখ স্যার। বেচা বিক্রি ভাল না স্যার। বৃদ্ধের ভীতির কারন বুঝতে কষ্ট হয়না কায়েসের। 
এদিনই প্রথম কায়েসের ভাল ব্যবহার করতে ইচ্ছে করলো বৃদ্ধের সঙ্গে। হাসে কায়েস। চমকে যায় দোকানী। কায়েস আপন জনের মতো বলে-
চাচা, আমি আজ অন্য কাজে এসেছি। ভয়ের কোন কারন নেই। আমারে একটু সহযোগিতা করেন। দারোগার কথা শুনে এবার বুড়োর পিলে চমকানো অবস্থা। তার মতো একজন দোকানী কি না করবে দারোগার সহযোগিতা। প্রথমে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না বুড়ু। শেষ পর্যন্ত কায়েস যখন পত্রিকা খুলে নিশির ছবি দেখায় তখন হেসে ফেলে বুড়–। কায়েস বুঝতে পারে তার কাজ হাসিল হবে। বুড়–র হাসিই বলে দিচেছ সে তাকে চেনে।
বুড়– জানায়, এই মেয়েটি হাউজিংয়ের মাঝামাঝি একটি বাড়িতে থাকে। এটা তাদের নিজেদের বাড়ি। এমনকি তার বাবা-মাসহ সবার বিষয়েই তথ্য দেয় সে। তথ্য পেয়ে মহা খুশী কায়েস। কিন্তু সে এতো খুশী হয়েছে কেন নিজের মনেই একবার প্রশ্নটা ধাক্কা দেয়। যখনই কোন মামলার তদন্তের দায়িত্ব পরে তার উপর তখনই তার মন খারাপ হয়। এই প্রথম কোন কাজ করতে তার ভাল লাগছে। ওসি সাহেব খোজ খবর নিতে বলতেই তার মনে আনন্দ খেলা করে যায়।
কায়েস মোটর সাইকেল হাকিয়ে যখন  নিশিদের বাড়ির সামনে যায় তখন দুপুর সাড়ে ১২ টা। গিয়ে দেখে অনেক লোক গেটের সামনে দাড়িয়ে আছে। সবারই এক প্রশ্ন কি এমন অপরাধ করলো মেয়েটা যে তার ছবি ছেপে ধরিয়ে দেওয়ার বিজ্ঞাপন দিতে হয়েছে। 
লোকজনের ভিড় দো’তলা থেকে একবার দেখেছেন নাহিদ আহমেদ। তিনি বিষয়টি বুঝতে পেরে নিজের ঘরে গিয়ে বসে আছেন। দারোয়ানকে ডেকে বলে দিয়েছেন নিশির বিষয়ে কেউ কিছু জানতে চাইলে যেন সে কিছুই জানে না বলে জানিয়ে দেয়। এই লোকগুলোকে দেখে প্রথমে নাহিদ আহমেদের মেজাজ বিগড়ে যায়। পরক্ষনই নিজেকে সামলে নেন। জানেন এরা এরকমই। নিজের চেয়ে পরের বিষয় নিয়ে ঘাটতে পছন্দ করে। কোথাও আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের পথ আগলে রাখে। কোথাও সড়ক দুর্ঘটনা হলে দাড়িয়ে দেখে লোকটি কিভাবে রক্ত ঝড়ে মারা যাচ্ছে। আফসোস করে বটে সেটা দেখানো আফসোস। তার মেয়ের ছবি ছাপা হয়েছে পত্রিকায় আর হাউজিংয়ের লোকজন বাসা দেখতে চলে এসেছে। বাহ। 
দারোগা কায়েসও ভিড় করা লোকজনের মাঝখানে গিয়ে দাড়ায়। গায়ে পুলিশের পোশাক না থাকায় তার দিকে লোকজন খুব একটা তাকিয়েও দেখে না। তাকে চেনে শুধু দোকানী ও চোর ডাকাতরা। সাধারন মানুষ তাকে চেনে না। এটা সেখানে দাড়িয়েই কয়েস উপলব্দি করতে পারে। 
লোকজনের কথা থেকে যে সারমর্ম পেয়েছে কায়েস তাতে করে মেয়েটির নাম নিশি। সে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে পড়ছে। বাবা সরকারের বড় কর্মকর্তা ছিলেন। এখন অবসরে। 
এসব তথ্য পেয়েই মহা-খুশি কায়েস। ছোট্ট একটা নোটবুকে লিখেও রাখে তথ্যে গুলো। কারন সে জানে, থানা পর্যন্ত যেতে যেতে অনার্স হয়ে যাবে মাস্টার্স অথবা ইন্টামিডিয়েট। বাবা চাকুরে থেকে হয়ে যাবে ব্যবসায়ী বা অন্য কিছু। পরে আবার ওসি সাহেবের কাছ থেকে ধমক খেতে হবে। এটা সে কোনভাবেই চায় না।
কায়েস যখন ওসি সাহেবের সামনে গিয়ে দাড়ালো ততক্ষনে এ খবর ওই বিভাগের ডিসি পর্যন্ত পৌছে গেছে। ওসিই বা কেন নিজের কৃতিত্বের সুযোগ হাতছাড়া করবেন। তিনি ডিসি সাহেবকে জানিয়েছেন, তারা গোয়েন্দাগিরী করে জানতে পেরেছেন মেয়েটি এই থানা এলাকায় বসবাস করে। ডিসি সাহেব তার কথা শুনে প্রথমে একটু অবাকই হয়েছেন। পত্রিকায় ছবি দেখেই থানা পুলিশ গোয়েন্দাগিরী শুরু করে দিলো। এতো তৎপরতার কারন কি তিনি তা বুঝার চেষ্টাও করলেন। কিস্ম পুরোটা বুঝে উঠতে পারলেন না।
 
০৬
নাহিদ আহমেদের ইচেছ করছিলো না বেলকনীতে যাওয়ার। সেখানে গেলেই কিছু অপদার্থ লোককে তার চোখে পড়ে। সকাল থেকেই তারা তার বাড়ির সামনে জড়ো হয়েছে। এ কারনে নাহিদ আহমেদ বেলকনী থেকে শোয়ার রুমে গিয়ে বসেছিলেন। কিন্তু বেলকনীটা যে তার খুব প্রিয়। সেখানে বসে পত্রিকা না পড়লে কি যেন একটা মিস করেন তিনি। মানুষের প্রেম শুধু মানুষের প্রতিই নয় কখনো কখনো জড় পদার্থের প্রতিও জন্মে যায়। এ এক অদ্ভুদ ব্যাপার। 
নাহিদ আহমেদ যে প্রাইভেটকারটি ব্যবহার করছেন তা ১৫ বছর আগে কেনা। এই দিনগুলোতে কত রকমের গাড়ির মডেল বদলেছে কিন্তু ওই প্রাইভেটকারটিকে বদলানোর প্রয়োজন মনে করেননি তিনি। বরং তার ওই গাড়িটিকে এতো আপন মনে হয় যে মাঝে মাঝে তার সঙ্গে কথাও বলেন তিনি। এই গাড়িটি তাকে দেশের কত জায়গায় নিয়ে গেছে তার ইয়ত্তা নেই। নিজের চাকা কাদার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে নাহিদ আহমেদকে বাচিয়েছে। গরমের আছ যাতে না লাগে সে দিকেও নজর রেখেছে এই গাড়িটি। এসব কথা মনে হওয়ায় গাড়ির প্রতি তার প্রেম বাড়তে থাকে। কত গাড়িইতো আছে রাস্তায় গিয়ে নষ্ট হয়ে যায়। মালিককে ঠেলতে পর্যন্ত বাধ্য করে। কোন কোন গাড়ি কথা না শুনে সোজা চলে যায় রাস্তার নিচে। হয়তো মালিকের প্রতি খুশি না থাকায়ই গাড়িরা এমন কাজ করে থাকে। কিন্তু নাহিদ আহমেদের গাড়িটি ১৫ টি বছরে একদিনও এমন ঝামেলায় ফেলেনি। 
নাহিদ আহমেদ অবশেষে বেলকনীতে গিয়ে ইজি চেয়ারে বসলেন। পত্রিকাটা তার হাতেই ছিল। চেয়ারে বসেই দেখতে পান জড়ো হওয়া ক’জন মানুষ একে অপরকে আঙ্গুলের ইশারায় নাহিদ আহমেদকে দেখাচ্ছে। নাহিদ আহমেদের বুঝতে কষ্ট হয় না তারা কি বলছে। তিনি কোন দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে চেয়ারে বসে পত্রিকা পড়ায় মনোযোগ দেন।
হঠাৎ নাহিদ আহমেদ তার কাধে একটি হাতের উপস্থিতি টের পান। নরম সেই হাত আজ বেশ শক্তই মনে হচ্ছে। নাহিদ আহমেদ পত্রিকা ভাজ করে উপরের দিকে তাকান। অন্য দিনের মতোই একগাল হাসি দিয়ে নিশি বলে উঠে-
‘আব্বু, পত্রিকায় আজ মন খারাপ করার মতো কোন খবর নেই?’ নাহিদ আহমেদ প্রায় প্রতিদিনই মেয়েকে সাবধান থাকার জন্য পত্রিকার নেতিবাচক খবর গুলো পড়ে শোনান। ছিনতাইকারীর হাতে পথচারী খুন, এক মহিলার ভ্যানেটি ব্যাগ টেনে নিয়েছে ছিনতাইকারীরা। এক মেয়েকে রাস্তা থেকে অপহরন করে নিয়ে গেছে। এমন সব খবর নিশিকে শোনানোটা যেন নিত্য দিনের অভ্যাসে দাড়িয়েছে নাহিদ আহমেদের। নিশির বুঝতে কষ্ট হয় না নাহিদ আহমেদ কেন তাকে এই খবর গুলো পড়ে শোনান। 
কিন্তু আজ আর তিনি কিছু বললেন না। বড় একটা নিশ্বাস নিলেন। ততক্ষনে জড়ো হওয়া লোকজনের মধ্যে সরগোল সৃষ্টি হয়েছে। নাহিদ আহমেদ বুঝতে পারছেন নিশিকে দেখেই তারা এমন করছে। কিন্তু নিশির প্রথমে নিচ দিকে চোখ যায়নি। সরগোল শুনে চোখ ফেলে নিচে। দেখে সবাই তাদের দিকে তাকিয়ে কি যেন বলাবলি করছে। কোন কিছু বুঝে উঠতে না পেরে বাবার কাছে জানতে চায়-
-আব্বু, আমাদের বাড়ির সামনে এতো মানুষ কেন? মেয়ের প্রশ্নের কি উত্তর দেবেন তা বুঝে উঠতে পারেন না নাহিদ আহমেদ। তার চোখ ছল ছল করছে। বিষয়টি নজরে আসে নিশির। আৎকে উঠে। বাবাকেতো সে কোন দিন কাদতে দেখেনি। আজ এমন কি হলো যে তার চোখ বেয়ে আষাঢ়ের ডল নামবে। কিছুক্ষন বোকার মতো বাবার দিকে তাকিয়ে রইলো সে। নাহিদ আহমেদও তাই। দৃশ্যটা কোন  শিল্পীর চোখে পড়লে এমন কোন ছবি হয়তো আকতে পারতেন যা লিউনার্দো দা ভিঞ্চির মোনালিসাকেও হয়তো হার মানাতো। 
কিছুক্ষন পরই বাসার সামনে জড়ো হওয়া লোকজনের সংখ্যা বাড়তে দেখে নিশি। একজন চিৎকার করে আরেকজনকে বলতে থাকে-
‘হ্যা ওর নামই নিশি। বিশ্বাস না হয় ডাক দিয়ে দেখেন?’ শ্রোতা হয়তো অনেক কষ্টে তাকে ডাক দেওয়া থেকে বিরত থাকে। কিন্তু কথাটি কানে আসে নিশির। এবার নিশি নিশ্চিত তাকে নিয়েই কিছু একটা ঝামেলা হয়েছে। কিন্তু কি সেই ঝামেলা! পর ক্ষনেই মনে পড়ে মোবাইল ফোনের মিসড কল লিস্টের কথা। সেই ঝামেলার কথা তার বাবাও জানে। এ কারনেই তার চোখ ছলছল করছে। নিশি কি করবে বুঝে উঠতে পারে না। বাবাকে প্রশ্ন করে
-আব্বু আমাকে নিয়ে কোন ঝামেলা হয়েছে নাকি? 
নাহিদ আহমেদ কোন উত্তর দেন না। মেয়ের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। কি উত্তর তিনি দেবেন ভেবে পাচিছলেন না। প্রথমে ভেবেছিলেন কোন ভাবেই মেয়ের সামনে তিনি ভেঙ্গে পড়বেন না। নিশি উঠে বেলকনীতে আসার সঙ্গে সঙ্গে পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত দুটো ভাল সংবাদ পড়ে শোনাবেন। এর পেছনে একটা যুক্তিও কাজ করে তার। অনেক দিন ধরেইতো তিনি মেয়েকে খারাপ খবর পড়ে শুনিয়ে সাবধান করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কি হলো। বরং তার উল্টোটাই হয়েছে। তা হলে এখন থেকে তিনি উল্টো কাজটাই করবেন বলে স্থির করেন। কিন্তু নাহিদ আহমেদ তার দু:খ কষ্টের বিষয়টি লুকোতে পারলেন না। নিজের অজান্তেই চোখে পানি এসে যায়। 
অনেক্ষন পর মুখ খোলেন নাহিদ আহমেদ-
‘হ্যা তোকে নিয়েই ঝামেলা হয়েছে। নে পত্রিকার তিন নম্বর পাতাটায় চোখ বুলা।’ নাহিদ আহমেদের কাছ থেকে পত্রিকা নিয়ে বেড রুমের দিকে চলে যায় নিশি। নাহিদ আহমেদের চোখ বেয়ে পানি নিচে গড়িয়ে পড়তে থাকে। 
০৭

ডেপুটি পুলিশ কমিশনার (ডিসি)কে জানিয়ে অনেকটা অস্বস্থিতেই পড়ে গেছেন থানার ওসি। তিনি মনে মনে ভাবছেন ধরিয়ে দেওয়ার পুরো ঘটনা না জেনে ডিসি সাহেবকে জানানোটা ঠিক হয়নি। নিজের উপর বিরক্ত হয় ওসি। রাগ ধরে যায় দারোগা কায়েসের প্রতি। ওর জন্যই তিনি বিষয়টি অতি উৎসাহের সঙ্গে বড় সাহেবকে জানিয়েছেন। এতে তিনি কোন বেকায়দায় পড়েন সে জন্য বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েন।
করিৎ কর্মা ওসি বসে নেই। তিনি পত্রিকা অফিসে গিয়ে ঘটনাটি আবিস্কারের চেষ্টা করেছেন। সেখানকার বিজ্ঞাপন বিভাগ থেকে জানতে পেরেছেন রামপুরার একটি প্রতিষ্ঠান থেকে এ বিজ্ঞাপনটি দেওয়া হয়েছে। তিনি প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা নিয়ে সেখানে গিয়ে যখন হাজির হন তখন ভর দুপুর। রোদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গরম পড়েছিল বেশ। সরকারি গাড়িতে এয়ার কন্ডিশানার না থাকায় তিনি ঘামছিলেন। তার চেয়ে বেশি ঘামছিলেন ডিসি সাহেবের কথা মনে করে। যানজটে গাড়ি আটকে যাওয়ার পরও দু’তিন বার চালককে ধমকেছেন তিনি। কনস্টেবল পদ মর্যাদার চালক বিনা প্রতিবাদে তার ধমক শুনেছে। বড় অফিসারদের নিয়ে গাড়ি চালাতে গেলে এমন ধমকের পাল্লায় পাড়া নতুন কিছু নয়। ধমক  তার গা সওয়া। 
গলদ গর্ম হয়ে রামপুরার ওই প্রতিষ্ঠানে ঢুকে কিছুটা স্বস্তি পান ওসি। প্রতিষ্ঠানের গেট থেকেই এয়ার কন্ডিশনারের বাতাস। তার শরীরকে ঠান্ডা করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু মনের গরম কিছুতেই ঠান্ডা হচ্ছিল না। 
প্রতিষ্ঠানের চীফ এক্সিকিউটিভ অফিসার (সিইও) বেশ সম্মানের সঙ্গেই ওসি সাহেবকে তার কক্ষে যেতে বললেন। ওসি তার কাছে বিজ্ঞাপনের বিষয়টি জানতে চান। কিন্তু সিইও যা বললেন তাতে ওসি সাহেব বেশ হতাশ হয়ে গেলেন। তার চোখের সামেন ডিসি সাহেবের মুখটা ভেসে উঠলো। ওসি সাহেব ভেবে ছিলেন সিইও বলবেন তার প্রতিষ্ঠানে মেয়েটি চাকরি করতো। টাকা পয়সা নিয়ে পালিয়ে গেছে এ কারনে পত্রিকায় ধরিয়ে দেওয়ার বিজ্ঞান দিয়েছেন। কিন্তু সিইও বললেন অন্য কথা। বললেন-
‘ধরিয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কি ধরিয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে তা কিন্তু বিজ্ঞাপনে নেই। এটাও নেই যে পুলিশে ধরিয়ে দিন। আসলে তাদের আমদানীকৃত টুথ পেস্টের বিজ্ঞাপনি চমক দেখাতে গিয়েই এমন কৌশলের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। আগামী কালের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে ওই তরুনীর হাতে একটি টুথপেষ্ট ধরিয়ে দেওয়ার কথা বলা হবে। আর এটাই বিজ্ঞাপনের আকর্ষন।’ এবার ক্ষেপে যান ওসি সাহেব। বলেন-
‘এটাতো এক ধরনের প্রতারনা’। যুক্তি দেখান সিইও।
‘দেখুন- আপনি বিষয়টিকে আইনী চোখে দেখছেন। আর আমরা দেখছি মার্কেটিংয়ের কৌশল হিসেবে। নতুন পণ্যে বাজারে চালাতে হলেতো আমাদেরকে ব্যতিক্রমী কিছু করতেই হবে, তাই না?
সিইওর কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু ডিসি সাহেবকে কোন যুক্তি দিয়ে বুঝাবেন তা ভেবে কুল কিনারা করতে পারছেন না ওসি। 
‘আপনি যাই বলুন, এটা স্রেফ প্রতারনা। এ কারনে আপনাদের শাস্তি হওয়া উচিত’। এবার সিইও তার যুক্তি তুলে ধরেন।
‘দেখুন ওসি সাহেব বেশ কিছুদিন আগে পত্রিকায় দেশের জনপ্রিয় এক টিভি অভিনেত্রীর ছবি ছাপিয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল যে তিনি নিখোজ। এই নিয়ে কাগজে অনেক লেখালেখিও হয়েছে। কই আপনারাতো সেটাকে প্রতারনা হিসেবে দেখেননি। আমরাতো সে ধরনের কিছু করিনি। শুধু ওই বিজ্ঞাপনের আইডিয়া নিয়ে এই ধরনের বিজ্ঞাপন দিয়েছি। তবে বিজ্ঞাপনে বড় ধরনের একটি ভুল হয়ে গেছে। সেই ভুলটির কথা কি শুনবেন?
‘না। সরি। আমার আর সময় নেই। আপনারা ভুল করতেই থাকেন,  আর আমাদের কাজের চাইতে অকাজের পেছনে দৌড়ানোর জন্য ব্যস্ত রাখেন। কথা গুলো বলেই বেরিয়ে যেতে চান ওসি সাহেব। সিইও তাকে কফি খেয়ে যেতে অনুরোধ করেন। কিন্তু ওসি সাহেব তার কথা না রেখে বেরিয়ে যান। 
গাড়িতে উাঠার আগেই ডিসি সাহেব ফোন করেন ওসি সাহেবকে। মোবাইলের মনিটরে ডিসির নম্বর দেখেই ওসির হাত কাপতে শুরু করে। তার চাকরি জীবনে এমন ভুল কখনো করেননি। আজ কিনা এমন একটা ভুল করলেন যার সঙ্গে এক তরুনী সম্পৃক্ত। যা তাকে বিব্রত করে তুলেছে। ওসি ভীত হয়ে ফোন ধরেন। ডিসি সাহেব বলতে থাকেন-
-শুনেন, আমি খোজ নিয়েছি তরুনীর ছবি ছাপিয়ে একটি প্রতিষ্ঠান তাদের টুথ পেস্টের বিজ্ঞাপনের জন্য আকর্ষনীয় করতে এমন করেছে। এই নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না।
‘জ্বী স্যার।’
‘আপনাকে ধন্যবাদ, এই কারনে যে, আপনি বিষয়টি আমলে নিয়েছেন। তা না হয়ে অন্য ঘটনাওতো হতে পারতো।’
‘থ্যাংক ইউ স্যার’
ডিসি সাহেব ফোন কাটতেই বুকের উপর থেকে যেন একটা বড় পাথর নেমে যায় ওসির। গাড়িতে না উঠে বুক ভরে নিশ্বাস নেন তিনি। ডাকেন গাড়ি চালক কনস্টেবল মজিদকে। মাজিদ গিয়ে তার সামনে দাড়িয়ে স্যার স্যার করতে থাকে। ওসি সাহেব বলেন-
‘মজিদ, কফি খাবে?’ ওসির কথা শুনে চমকে যায় মজিদ। একটু আগেই যার কাছ থেকে অযতাই গালাগাল খেয়েছে তিনি নাকি তাকে কফি খাওয়াতে চাচেছ। এটা দেখে কে না চমকাবে। মজিদ হ্যা না কোন উত্তর না দিয়ে ‘স্যার স্যার’ করতে থাকে। 
ওসি সাহেব বুঝতে পারেন কফি খাওয়ালে মজিদের আপত্তি নেই। তিনি গাড়িতে উঠে বসে বেইলী রোডের একটি দোকানের সামনে যেতে বলেন। সেই দোকানের কফিই তাকে খাওয়াবেন। মজিদও দোকানের নাম শুনে বুঝতে পারে তার স্যার সত্যি সত্যিই তাকে কফি খাওয়াবে। 
গাড়ি বেইলী রোড মুখী। কিন্তু যানজটের কারনে এগুতেই চাচ্ছে না। কিন্তু একটুও বিরক্ত হচ্ছেন না ওসি সাহেব। তার মনে ফুর্তি রয়েছে। যেখানে তার গালাগাল শোনার কথা সেখানে কি না ডিসি সাহেব তার কাজের প্রশংসা করেছেন ফুর্তি থাকাটাই স্বাভাবিক। গাড়িতে যেতে যেতেই ওসি সাহেবের মনে পড়ে তার এক শিক্ষকের কথা। সেই শিক্ষক তাকে একদিন বলেছিলেন-
‘ ভাল কাজের ফল ভালই হয়। তবে কোন কোন ভাল কাজের ফল খারাপ আসতে পারে। কিন্তু কোন খারাপ কাজের ফল কখোনই ভাল আসতে পারে না। তিনি আরো বলেছিলেন, সব চেষ্টারই একটি ভাল ফল পাওয়া যায়। সেটা হোক দু’দিন আগে বা পড়ে।’
আজ ওসি সাহেবের মনে কথাগুলো দাগ কেটে যাচিছল। তিনি মেয়েটির বিষয়টি নিয়ে ঘাটাঘাটি না করলে এমন প্রশংসা পেতেন না। তিনি চেষ্টা করেছেন বলেই হয়তো এমন প্রশংসা জুটেছে। 
০৮
ওসি চলে যাওয়ার পর টুথপেস্ট কোম্পানীর সিইও জামিল আহমেদ তার অধস্তনদের নিয়ে সভা করতে বসেন। তিনি মার্কেটিং ম্যানেজার আশফাকের কাছে জানতে চান বিজ্ঞাপনে একজন জনপ্রিয় চিত্র নায়িকার ছবি যাওয়ার কথা ছিল। সেই জন্য সেই নায়িকাকে এক লাখ টাকা অগ্রিমও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পত্রিকায় ছবি ছাপা হয়েছে অন্য তরুনীর-এর কারন কি? 
মার্কেটিং ম্যানেজার সকাল থেকেই ধারনা করছিলেন এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে তাকে। তিনিওতো অবাক হয়েছেন। কিভাবে এমন ঘটনা ঘটলো। সিইও জানালেন এরই মধ্যে ওই চিত্র নায়িকা তাকে দু’দফা ফোন করে তাকে অপমান করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন।
সিইওর কোন প্রশ্নের উত্তরই দিতে পারছে না মার্কেটিং ম্যানেজার। শুধু আমতা আমতা করে যাচেছন। তিনি পত্রিকায় নায়িকার ছবি না দেখে গ্রাফিক্স ডিজাইনার ইমরানকে ফোন করেছিলেন। কিন্তু ইমরানের ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে। সে কারনে জানা গেল না আসলে কিভাবে কি হয়েছে। ইমরানকেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল বিজ্ঞাপনটা তৈরি করার জন্য। 
সিইও যতোটা চটে যাওয়ার কথা ছিল ততটা চটলেন না। বিষয়টায় অবাক হয়েছেন সবাই। পার্সেস আফিসারসহ অন্য কর্মকর্তারা ধরেই নিয়েছিলেন এই অপরাধের কারনে মার্কেটিং ম্যানেজারের চাকরিটা বোধ হয় এবার আর থাকবে না। কিন্তু সিইও বললেন অন্য কথা। যে নায়িকার ছবি ছাপা হওয়ার কথা ছিল তার চেয়ে অধিক সুন্দরী এই তরুনী। পরিচিত জনের কয়েকটি ফোনও পেয়েছেন তিনি। তার পরিচয় জানতে চেয়েছেন তারা। এ ছাড়া ওসি চলে আসায় তার কাছে মনে হয়েছে বিজ্ঞাপনটি বেশ কার্যকরি হয়েছে। তিনি সিনেমার নায়িকার অভিযোগ শুনে না জেনেই বলে দিয়েছেন, দেখুন আপনার ছবির চেয়ে এই মেয়ের ছবি পেয়ে যাওয়ায় আসলে বিজ্ঞাপনটি পরিবর্তন করা হয়েছে। আপনি যে এক লাখ টাকা নিয়েছেন তা ফেরত দিতে হবে না। ফটো সেসনের ছবি গুলোও চাইলে আপনি নিয়ে যেতে পারেন। 
তিনি এও জানালেন, বিজ্ঞাপনে  ছবির মেয়েটির চোখ, নাক কান সবই যেন কথা বলছে। ঠোটের কোনের হাসিটা কার না চোখে পড়েছে। এতো সুন্দর হাসি এর আগে তিনি দেখেছেন বলে মনে করতে পারছেন না। দুটো চোখ যেন পত্রিকার সব পাঠকের সঙ্গেই কথা বলে যাচ্ছে। হেয়ার স্টাইল একেবারে ভিন্ন। ছবিটি তুলার আগে যে তাকে সাজিয়েছে তিনি নিশ্চয়ই বড় মাপের রূপ বিশেষজ্ঞ। 
সিইও মেয়েটির সম্পর্কে জানতে চাইলেন মার্কেটিং ম্যানেজারের কাছে। মার্কেটিং ম্যানেজার নিরবতা ভেঙ্গে বললেন-
‘স্যার, আমাকে ক্ষমা করবেন। আসলে এই মেয়েটিকে আমি চিনি না। কিভাবে নায়িকার জায়গায় তার ছবি ছাপা হলো তাও বুঝতে পারছি না। গ্রাফিক্স ডিজাইনার ইমরানকে সকাল থেকে ফোনে ধরার জন্য ট্রাই করছি। কিন্তু তার দুটো মোবাইল ফোনই বন্ধ। 
ক্ষ্যাপে যান সিইও। 
‘তারতো একটা অফিস আছে, নাকি? আপনিতো একবার অফিসে গিয়ে খোজ নিতে পারতেন। আপনি এখনি ইমরানের কাছ থেকে জেনে আসুন এই মেয়েটি কে। কি তার পরিচয়। কিভাবে নায়িকার জায়গায় এই মেয়ের ছবি ছাপা হলো। বিস্তারিত জেনে আসুন’।
কাতর হয়ে মার্কেটিং ম্যানেজার বললেন-
‘জ্বি স্যার, জ্বি স্যার’
‘আপনি এখনি যান। মনে রাখবেন মেয়েটির নাম ঠিকানা আমার চাই। তাকে আমার খুব প্রয়োজন। 
সিইওর কথা শুনে এবার সভায় উপস্থিত সবাই কেমন একটু নড়েচড়ে বসলেন। পার্সেস অফিসার ভাবলেন, সিইও সাহেবের ঘরেতো সুন্দরী স্ত্রী আছে। এর পরও...। সবাই হিসাব মেলানোর চেষ্টা করছেন। ছবির তরুনীকে মার্কেটিং ম্যানেজারেরও খুব পছন্দ হয়েছে। কিন্তু সিইও’র চোখ পড়ে গেছে দেখতে পেয়ে তিনি মনে মনে হতাশ হলেন। বিজ্ঞাপনের কোন মডেলের সঙ্গে সাধারনত তারই সম্পর্ক গড়ে উঠে। সিইও এ নিয়ে মাথা ঘামান না। প্রথমবার তিনি এই তরুনীর প্রতি কেন আগ্রহী হয়ে উঠলেন তা ভেবে কুল কিনারা করতে পারেন না। 
সভা শেষ করার পর মার্কেটিং ম্যানেজারের রুমে যান পার্সেস অফিসার। তাদের আলাপের বিষয় হয়ে উঠে ছবির তরুনী। পার্সেস অফিসারেরও খুব ভাল লেগেছে। বিষয়টি তিনি চেপে রাখার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু  সিইওর চোখ পড়ায় যেন তার আরো বেশি ভাল লেগে যায়। এই মেয়েটির সঙ্গে তিনি পরিচিত হতে চান। কিন্তু মার্কেটিং ম্যানেজার ছাড়া সেটি সম্ভব নয়।  সে কারনেই তিনি মার্কেটিং ম্যানেজারের রুমে গিয়ে তরুনীর কথা উঠান। 
মার্কেটিং ম্যানেজারও বেশ চতুর। পার্সেস অফিসার তার রুমে এসে ছবির তরুনীকে নিয়ে কথা উঠাতেই তার মতলব বুঝে যান। তিনি এ পেশায় আছেন ১২ বছর। এর আগে দুটি বড় কোম্পানীর মার্কেটিং ম্যানেজার ছিলেন। তিনি বিজ্ঞাপনের মডেলদের নিয়ে কাজ করেন দীর্ঘ কাল। কোন মডেল কেমন তা তার চেয়ে এই অফিসে আর কেউ জানে না। হিসাব-নিকাশে মিল না পরায় বিজ্ঞাপন থেকে কত মডেল শুটিংয়ের আগের দিন বদলে গেছে তার হিসাব নেই তার কাছে। নতুন  কোম্পানীর সিইও মডেল হিসেবে ওই চিত্রনায়িকাকে পছন্দ করার কারনেই তার সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছিল। তিনি নিজে দায়িত্ব পেলে কখোনোই এই চিত্রনায়িকাকে নিতেন না তিনি। এর আগের কোম্পানীগুলোতে ওই নায়িকাকে দিয়ে তিনি চারটি বিজ্ঞাপন করিয়েছেন। ফলে ওই চিত্র নায়িকার এহেন বিষয় নেই যা তার অজানা।

০৯
গ্রাফিক্স ডিজাইনার ইমরান ভেঙ্গে পড়েছে। কী একটা বাজে কাজ সে করে ফেলেছে। এর দায় এখন কে বহন করবে। এতো দ্রুত কাজ করাটা তার ঠিক হয়নি। এতোদিন তার কাজের প্রশংসা ছিল। টুথপেস্ট কোম্পানীর আর কোন কাজ সে পাবে না। শুধুতো তাই নয় যার ছবি ছাপা হয়েছে তাকেই বা কি উত্তর দেবে সে। পুরো ঘটনাটার জন্যতো সেই দায়ী। এসব ভেবে অস্থির হয়ে উঠেছে ইমরান। 
সে সকালে অফিসে গিয়েছিল। পত্রিকাটা হাতে নিয়ে বিজ্ঞাপনটা দেখেই ভীত হয়ে পড়ে। আর কোন চিন্তা করতে না পেরে অফিসে তালা লাগিয়ে সোজা বাসায় চলে আসে। দুটো মোবাইল ফোনের সুইচ অফ করে রেখেছে সে। যে কারনে ছবি নিয়ে কি হচেছ সে ব্যাপারে সে কিছু জানতে পারেনি। তবে তোলপাড় যে হয়ে যাচ্ছে তা সে বুঝতে পারে। তার চোখের সামনে টুথপেস্ট কোম্পানীর সিইওর মুখটা ভেসে ওঠে। লোকটা বজ্জাতের হাড্ডি। হাসি হাসি মুখে খুব শক্ত শক্ত কথা বলে। ইমরানের কাছে তাকে চামার টাইপের লোকই মনে হয়। তবে মার্কেটিং ম্যানেজার আশফাক সাহেব নরম প্রকৃতির মানুষ। কিন্তু আশফাক সাহেবতো তাকে রক্ষা করতে পারবে না। এ মুহূর্তে আশফাকের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মাচ্ছে ইমরানের। তিনি একজন বড় অফিসার তিনি এতো নরম টাইপের হবেন কেন? তার হাক ডাকে ভয় পাবে অন্য কর্মকর্তারা। সিইও তাকে কোন খারাপ মন্তব্য করতে সাহস পাবে না।
মানুষের এই এক স্বভাব। নরম টাইপের মানুষকে অন্যরা খুব পছন্দ করে। কিন্তু যখনই নিজে বিপদে পড়ে তখন চিন্তা করে তার উপর একজন শক্ত টাইপের লোক থাকলে সহজে রক্ষা পাওয়া যেতো। মাঝে মাঝে ইমরান নিজেকে শক্ত হিসেবে জাহির করতে চেষ্টা করে। কিন্তু কারো সঙ্গে মেজাজ দেখানোর পর নিজে নিজে পুড়তে থাকে। ফলে সে সাধারন ভাবেই থাকতে চায়।
এমনিতে খুব একটা চা পানের অভ্যাস নেই ইমরানের। মালিবাগ এলাকায় একটি ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের একটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে সাবলেট থাকে সে। তবে ফ্ল্যটের সব কক্ষেই যাওয়া তর অনুমতি আছে। ফ্ল্যাটের মালিক বুড়ো-বুড়ি। তারা ইমরানকে সন্তানের মতোই øেহ করে। তাদের কাজের বুয়া ইমরানের জন্য রান্না করে দিয়ে যায়।
আজ ফ্ল্যাটের অন্য বাসিন্দারা কোথায় যেন বেড়াতে গেছে। ইমরান তার নিজের কক্ষে বসে ভাবছে কি করে সময় কাটাবে। সে বারে বারে পত্রিকার তিন নম্বর পাতায় চোখ বুলিয়ে ক্লান্ত হয়ে গেছে। মনে মনে ভাবলো চা বানিয়ে খেলে একটু অন্য কাজে রাখা যেতো মস্তিস্ককে। কিন্তু তার রুমে তো চায়ের কেটলী, কাপ, চিনি, চা পাতা কিছুই নেই। তাতে কি ইমরান বেরিয়ে চা বানানোর সমস্ত সরঞ্জাম কিনে নিয়ে আসে। জীবনের প্রথমবার সে চা বানাবে। নিজের মধ্যে অন্যরকম একটা অনুভুতি কাজ করছে। 
কেটলী চুলায় চাপাতেই বেজে উঠে কলিং বেল। ইমরান খুশি হয়। নিশ্চয়ই চাচা-চাচি চলে এসেছে।  মনে মনে লজ্জাও পায়। চাচা-চাচি এসে যখন তার চা বানানো দেখবে তখন হাসিতে ফেটে পড়বে। তখন ইমরান কি করবে সে প্রস্তুতি নিতে থাকে। সে দরজা খুলে চমকে যায়। দরজার সামনে দাড়িয়ে আছে মার্কেটিং ম্যনেজার আশফাক। 
এই বাসার ঠিকানা কেউ জানে না। কিন্তু আশফাক সাহেব কোত্থেকে জানলেন সে চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠে সে। বেশ কিছুক্ষন হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে থাকে ইমরান। আশফাকের কথায়ই নিরবতা ভাঙ্গে। 
‘কি বিশ্বাস করতে পারছেন না।’
‘না মানে ইয়ে’ আমতা আমতা করতে থাকে ইমরান। 
‘আপনি এই বাসায় সাবলেট থাকেন। এখন বাসায় কেউ নেই। তাই না?’
আরো চমকায় ইমরান। এতোসব আশফাক সাহেব জানলেন কি করে। তিনি কি তা হলে পত্রিকায় ভুল করে যে তরুনীর ছবি ছাপা হয়েছে তার সম্পর্কেও খোজ খবর নিয়ে এসেছে। কিছুই মেলাতে পারে না সে। হাত জোর করে বলে-
‘সরি, আই অ্যাম রিয়েলি সরি। আমার একটা ভুলের জন্যে আপনার নিশ্চয়ই খুব সমস্যা হয়েছে।’
‘ভেতরে বসতে বলবেন না।’ হাসি মুখেই বললেন আশফাক সাহেব। এবার অবাক হওয়ার পালা ইমরানের। যেখানে তাকে গালাগালি করার কথা তা না করে তিনি হাসি মুখে ভেতরে যেতে চাইলেন। ইমরান ধারনা করে নিল নিয়ে মিস্টি মিষ্টি কথার মারপ্যাচে তাকে অপমান করবেন আশফাক সাহেব। বড় অফিসারদের অপমান করার ধরনই আলাদা। অবশ্য এখন পর্যন্ত ইমরানের তেমন অভিজ্ঞতা হয়নি। তবে বন্ধুদের কাছ থেকে বড় অফিসারদের বিষয়ে ঢের শুনেছে সে। 
এতোক্ষনে ইমরানের মনে পড়লো সে দরজার সামনে দাড়িয়েই কথা বলছে। সে আশফাক সাহেবকে তার রুমে নিয়ে গেল। আশফাক সাহেব গুছানো ঘর দেখে অবাক না হয়ে পারলেন না। ইমরান এখনো বিয়ে করেনি। তার ঘরে নারীর ছোয়া থাকার কথা নয়। কিন্তু এতো সুন্দর করে ঘরটা সাজানো যে, কোন সৌখিন নারী ছাড়া এমন ঘর গুছিয়ে রাখতে পারে কেউ তা তা আশফাক সাহেবের মাথায়ই আসে না। কিন্তু এতো গুছানো একটা লোক কিভাবে এতো বড় একটা ভুল করলো তা ভেবে পাচ্ছেন না তিনি। 
চুলার উপর কেটলী দিয়ে আসার কথা মনে পড়ে যায় ইমরানের। আশফাক সাহেবকে বলেন-
‘স্যার চা খাবেন তো’? কিছুটা সময় নিয়ে বলেন-
‘না না চা আনা লাগবে না।’
‘চা আনতে হবে না। আমি বাসায়ই বানাই। অলরেডি পানি ফুটানোর জন্য চুলোয় কেটলী চাপানো হয়েছে।’ ইমরানের কথা শুনে আরো অবাক হলেন আশফাক সাহেব। শুধু ঘর গুছানোই নয় সব দিকেই হাত আছে ইমরানের। এবার আর চা খেতে আপত্তি করলেন না আশফাক।
চায়ে চুমুক দিয়েই আশফাক সাহেবের মুখ তেতো হয়ে যায়। ইমরান যে চা বানিয়ে এনেছে তা মুখে দেওয়ার মতো নয়। কিন্তু বিষয়টা বুঝতে দিলেন না আশফাক। বললেন-ভাল চা হয়েছে। ইমরান খুশি। তখনো ইমরানের কাপের চা থেকে ধুয়া উড়ছিল। খুশি মনেই ইমরান চায়ে চুমুক দিয়ে লজ্জায় পড়ে যায়। 
‘চায়ে সম্ভবত বেশি পাতা দিয়ে ফেলেছি। তেতো হয়ে গেছে। সরি স্যার।’
‘আমি এম চা-ই পছন্দ করি। কিন্তু পাই না। আপনার চা আমার ভাল লাগছে।’ এ কথা শুনে স্বস্থি পায় ইমরান। এবার কাজের কথা বলার ছুতো খুজছেন আশফাক সাহেব। তরুনীর কথাটা কিভাবে উঠাবেন ভেবে স্থির করতে পারছিলেন না। 
এতে সমস্যা হয়নি। বরং কথাটা ইমরানই উঠালো। বললো-
‘স্যার, আই অ্যাম রিয়েটি সরি। এমন একটা উল্টা পাল্টা কাজ হয়ে যাবে ভাবতেই পারিনি। আমি কি বলে যে, আপনার কাছে দু:খ প্রকাশ করবো ভেবে পাচ্ছি না। আসলে হয়েছে কি, যে মেয়েটার ছবি ছাপা হয়েছে সে আমার বান্ধবী। নাম নিশি। ইন্টার মিডিয়েট পর্যন্ত এক কলেজে পড়শোনা করেছি আমরা। আমি ওকে ...। সারাক্ষনই আসলে ওকে নিয়ে আমি ভাবি। কিন্তু ও বিষয়টা বুঝে কি না আমি জানি না। আমার কম্পিউটারে তার কয়েকটি ছবি রয়েছে। সেদিন চিত্র নায়িকার ছবিটাকে সাইজ করে বিজ্ঞাপনটি তৈরি করছিলাম। হঠাৎই আপনার অফিসের পিয়নটা এসে দ্রুত বিজ্ঞাপনটি  চাইলো। আমি আসলে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে নায়িকার ছবির জায়গায় নিশির ছবি বসিয়ে দিয়েছি। টোটাল কাজটাই হয়েছে মনের অজান্তে। এই একটি ভুল অনেক বড় ঘটনার জন্ম দিয়েছে তা আমি আছ করতে পারছি। তবে নিশির কি অবস্থা হয়েছে আমি বলতে পারবো না। আমি তার কাছে কিভাবে সরি বলবো। জানি না এ জন্য তাকে কত মাশুল দিতে হচ্ছে।’ 
‘বুজতে পেরেছি’-কথাটা বলে ইমরানকে থামিয়ে দিলেন আশফাক সাহেব। এর নিজেদের বিপত্তির কথা তুলে ধরলেন। জানালেন, চিত্র নায়িকা, সিইও, পুলিশসহ সাবইকে কিভাবে ম্যানেজ করতে হয়েছে। এও জানালেন, পত্রিকা অফিস গরম করে দিয়েছে পাঠকরা ফোন করে। পুলিশ পর্যন্ত তদন্ত করতে চলে এসেছে। এতো কিছুর পরও আশফাক সাহেবের মুখে হাসি থাকে কি করে সেটা ভেবে পাচ্ছে না ইমরান। এ আবার কোন রহস্য। রহস্যর জট খুললেন আশফাক সাহেব নিজেই। জানালেন, চিত্র নায়িকার ছবি না চেপে নিশির ছবি ছাপায় কোম্পানীর সিইও খুব খুশি হয়েছেন। বিজ্ঞাপনটি এতো আলোচিত হবে তা তিনি ধারনাই করেননি। কিন্তু এতো সারা পড়েছে যে তিনি বিমোহিত। তিনি নিশিকে ব্রান্ড এ্যাম্বাসেডর হিসেবে ব্রেক দিতে চান। এ কথা শুনে পিলে চমকানোর মতো অবস্থা ইমরানের। মেঘ না ছাইতেই জল। ইমরানের অনেকদিন ধরে ইচ্ছে ছিল নিশিকে মডেল বানাবে। কিন্তু কোন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে পরেই বিষয়টি নিশিকে জানাবে। নিশিকে সে জোর করে হলেও রাজি করাবে। তা না হলে তার মা-বাবাকে বলে তাকে রাজি করাবে। কিন্তু বড় কোন কোম্পানীর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ করতে না পারায় সে তার সুপ্ত বাসনা মনে মনেই রেখেছিল এতোদিন। কিন্তু আজ এতো বড় কোম্পানীর বিজ্ঞাপনের মডেল হিসেবে সুযোগ একে বারেই দোড় গোড়ায় এর পরও খুশি হতে পারেনি ইমরান। 
এখন তার মডেলের চেয়ে বড় চিন্তা নিশির কি অবস্থা হয়েছে তা জানতে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো মার্কেটিং ম্যানেজার চলে যাওয়ার পরই সে নিশিদের বাসায় ফোন করবে।  
 
১০
জবা আহমেদ যখন বাসায় ফিরলেন ঘড়িতে ঠিক তখন দুপুর একটা। চাকরি জীবনে আজই প্রথম একটার সময় বাসায় এসেছেন তিনি। যা দেখে বিস্মিত না হয়ে পড়েননি নাহিদ আহমেদ। একবার নিশি প্রচন্ড অসুস্থ ছিল তাও তিনি অফিসের কাজ ফেলে আসেননি। আর সেই মানুষ যদি একটার সময় বাড়ি ফেরে তা হলে কে না চমকাবে। 
জবার চোখে যেন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। প্রথমে দেখে ভয়-ই পেয়ে যান নাহিদ আহমেদ। এতো দীর্ঘ সময়ের দাম্পত্য জীবনে তাকে কোনদিন এমনটি দেখেননি। কখনো রাগ করলে নাহিদ আহমেদ হাসতেন শুধু। কিছুক্ষন গুমরো মুখে থাকার পর জবাও হেসে ফেলতেন। বলতেন-দূর তোমার সঙ্গে রাগও করা যায় না। আজ তার চোখ দেখেই নাহিদ আহমেদ বুঝতে পারছেন কতটা রেগে আছেন জবা। রাগ হবেই বা না কেন। তার মেয়ের যেভাবে ছবি ছাপা হয়েছে তাতেতো রাগ হওয়ারই কথা। বরং নাহিদ আহমেদ নিজেই ভাবছেন তিনি কেন এমন রাগ হলেন না। পত্রিকায় ছবি দেখার পরইতো তার এমন রাগ করা উচিৎ ছিল। তাহলে কি তিনি আজ পর্যন্ত রাগ জিনিসটা রপ্ত করতে পারেনি। তার মেয়েওতো তার মতোই হয়েছে।
জবা কলিং বেল চাপলে নিশি দরজা খুলে দেয়। নিশিকে সামনে পেয়েও কিছুই বলেননি জবা আহমেদ। নিশি জানতে চেয়েছিল-
‘আম্মু এতো তাড়াতাড়ি ফিরে এলে শরীর খারাপ লাগছে?’ মেয়ের প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে জবা সোজা নাহিদ আহমেদের ঘরে চলে যান। 
জবার ব্যবহারে একটুও কষ্ট পেল না নিশি। পত্রিকায় ছবি দেখার পর সে যে কষ্ট পেয়েছে এর চেয়ে বড় কষ্ট আর কি হতে পারে। তার মাও ছবি দেখেই তার দিকে এমন রাগ করেছে তা তার বুঝতে বাকি রইলো না। তা না হলে অন্যদিনের মতো একগাল হেসে মেয়েকে জিজ্ঞেস করতেন- কিরে কি খবর। ইউনিভার্সিটি গিয়েছিলি। মনটা ভালতো- ইত্যাদি জানতে চাইতেন। 
রাগ দু:খ সইতে না পেরেই হয়তো তিনি বাসায় ফিরে এসেছেন। নিশি তার সামনে গিয়ে কিভাবে দাড়াবে তাই খুজছিল। এক সময় তার মনে হলো আমিতো কোন দোষ করিনি তা হলে দাড়াতে পারবো না কেন। নিশি সাহস করে মায়ের সামনে যাওয়ার জন্য নাহিদ আহমেদের রুমের দিকে যেতে শুরু করে। কিন্তু দরজায় ফেলা পর্দা সড়ানোর আগেই জবা আহমেদের চিৎকার শোনে সে থমকে যায়। আর না এগিয়ে মা কি বলছে তাই শুনার চেষ্টা করে। জীবনে কখনো আড়ি পেতে কিছু শুনেছে বলে সে মনে করতে পারছে না। আজ কেন জানি আড়ি পাততে ভাল লাগছে তার।
জবা আহমেদ যখন ঢুকলেন তখন নাহিদ আহমেদ শুয়ে ছিলেন। মেয়েকে নিয়ে চিন্তা করছিলেন। ভাবছিলেন শুধু কি সমাজের চোখে তারা মান হারিয়েছেন। বিয়ে দিতে গেলেওতো কত ধরনের প্রশ্ন উঠবে। পাশের বাড়ির রহমত সাহেবের পরিবারতো তাদের বিরুদ্ধে লেগেই আছে অনেক আগে থেকে। এমনকি নিশি পাড়াশোনায় ভাল এই বিষয়টিও তাদের অপছন্দ। দুই বাড়ির পাশের এক হাত জমিই এই বিরোধের সৃষ্টি করেছে। বাড়ি করার সময় রহিম সাহেব নাহিদ আহমেদকে এক হাত ছেড়ে বাড়ি করার জন্য প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু নাহিদ আহমেদ তা করেননি। এর পর থেকেই তাদের মধ্যে বিরোধ চলে আসছে। এমনকি পাশাপাশি বাড়ি হলেও দুই পরিবারের কোন যোগাযোগ নেই। দুটি বাড়ির বেলকনিও লাগোয়া। এর পরও কথা হয় না দুই বাড়ির মানুষের মধ্যে। 
জবা ঢুকেই চিৎকার চেচামেছি শুরু করে দেন। নাহিদ আহমেদ তাকে বারন করতে বলেন। কিন্তু নাহিদ আহমেদের কোন কথাই শুনতে চাচ্ছেন না জবা আহমেদ। এক নাগারে মেয়েকে লাই দিয়ে বড় করার কথা বলে যাচ্ছেন জবা। নাহিদ আহমেদ সব কথার কাউন্টার দেওয়ার চেষ্টা করছেন না। দু’একটি কথার উত্তর দিতে চাইলে জবা তাকে বাধা দেয়। নিশি তার বাবার অসহায়ত্ব দেখে কষ্ট পায়। এক পর্যায়ে জবা আহমেদ বলতে শুরু করেন- 
‘তোমার লাই পেয়েই মেয়েটা উচ্চন্নে গেছে। রাস্তা থেকে কুড়িয়ে আনা মেয়ে এর চেয়ে আর কি ভাল হতে পারে? আমি তোমাকে বলেছিলাম কোন ভদ্র ঘরের মেয়েকে পালিত কন্যা হিসেবে আনার জন্য। আর আনলে কি না রাস্তা থেকে একটাকে। আজ দেখ রাস্তার মেয়ের কান্ড দেখ। তোমার মান ইজ্জত কিভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে।
নাহিদ আহমেদ কি বলে স্ত্রীকে শান্ত করবেন বুঝে উঠতে পারেন না। তিনি শুধু চাপা স্বরে বললেন-চুপ করো। মেয়েটা শুনবে।
‘শুনুক। ওর জন্ম পরিচয় জানা উচিত। সে যে আমাদের মেয়ে না এ বিষয়টা তাকে আগেই বলা দরকার ছিল। তা হলে হয়তো বেপরোয়া ভাবে চলতো না। আজ তার ছবিও ছাপা হতো না পত্রিকায়।’
এবার ধমকে উঠেন নাহিদ আহমেদ-
‘বলছি, চুপ করো’
নিশি এসব কি শুনলো! কথা গুলো তার বিশ্বাস হতে চাইলো না। কিন্তু বাবাতো প্রতিবাদ করলেন না। তার মানেতো এই সে তাদের সন্তান না। রাস্তায় পড়েছিল সে। যা প্রায়ই পত্রিকায় দেখতে পায় যে নবজাতকের লাশ উদ্ধার। 
তার চোখ বেয়ে দড় দড় করে পানি গড়িয়ে পড়ে মেঝেতে। তার কি করা উচিৎ বুঝে উঠতে পারে না। মনে পড়ে একটি পত্রিকার নিউজের কতা। যেখানে লেখা ছিল বড় হয়ে পালিত কন্যার কথা জানতে পেরে মেয়েটি আত্মহত্যা করেছিল। তারও তো একই অবস্থা তা হলে সে কি করবে। সেও কি আত্মহত্যা করবে। নিশি কিছু সময়ের জন্য স্ট্যাচু হয়ে দাড়িয়ে থাকে।
সে কি চিৎকার করে কাদবে। নাকি বাসা থেকে পালিয়ে যাবে। নাকি প্রতিবাদ করবে মায়ের কথার। কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। অবশেষে সিদ্ধান্ত নেয় চুপ থাকবে। সে কিছুই শুনেনি। তার মা যা বলেছে রাগ করে বলেছে। সেও হয়তো মায়ের জায়গায় থাকলে এমনটিই করতো। 
নিশি খুব ঠান্ডা প্রকৃতির মেয়ে। খুব সহজে তার মাথা গরম হয় না। বিনা দোষে অন্য কোন মেয়ের ছবি এভাবে পত্রিকায় ছাপা হলে এতোক্ষনে হয়তো পত্রিকা অফিস গরম করে ফেলতো। কিন্তু নিশি চুপচাপ। একেবারে চুপচাপ। সে বুঝার চেষ্টা করছে কেন এমনটি হলো। তার যুক্তি- না বুঝে লাফ দেওয়াটা তার স্বভাবের বাইরে। সে একটু ঢিলা টাইপের মেয়ে এটাও সে জানে। কোন কাজ করলে সে কাজের মতোই করে। চটফটানি একদম অপছন্দ তার। 
পরীক্ষার হলে তার অনেক বান্ধবীকে দেখেছে প্রশ্ন হাতে পেলে মাথা গরম করে ফেলে। কিন্তু নিশির কোনদিনও এমনটি হয়নি। এ কারনে কখনো কখনো তার বন্ধুরা তাকে রোবট বলেও আখ্যা দিতে ছাড়েনি। তাতে কি, নিশি মজাই পায় তাদের কথায়। রোবট হওয়াটা খারাপের কি! কম কথা, কম পাপ, কম ঝামেলা-এ কথায় বিশ্বাসি সে। এ ছাড়া ছোট বেলা থেকেই তার খুব একটা কথা বলতে ভাল লাগে না। তবে কথা শুনতে তার খারাপ লাগে না। এ কারনে তার যেসব সহাপাঠি অধিক কথা বলে (বাচালের পর্যায়ে) তারা নিশির সঙ্গে আড্ডা দিতে পছন্দ করতো। অন্যদের মঙ্গে তারা আড্ডা দিয়ে মজা পেতো না। কারন বাচাল বন্ধু যাই বলুক তাই মাথা পেতে নেয় নিশি। যে কারনে বাচাল বন্ধুরা কথা বলে বেশ মজা পায়। নিজেকে জাহির করারও চেষ্টা করে। আর নিশি যে দু’একটা কথার উত্তর দেয় তা তাদের প্রশংসাই থাকে শুধু।
নিশি সোজা চলে যায় বাথরুমে। চোখ ধুয়ে নিজের কান্না মুছে ফেলার চেষ্টা করে সে। দু’বার আয়নায় তাকিয়ে দেখে কাদলে আসলে তাকে কেমন লাগে। চোখ দুটো লাল দেখা যায়। এমন লাল চোখ থাকলে কান্নার বিষয়টি তার বাবা ধরে ফেলতে পারেন। হয়তো তিনি কান্নাও শুরু করে দিতে পারেন। এ কারনে নিশি যতোটা পারে চোখে পানি দিয়ে লাল ভাবটা কাটানোর চেষ্টা করে। চোখের কান্না মুছলেও ভেতরের কান্না সে কিভাবে মুছবে তার হিসাব কষতে শুরু করে। বার বার মনকে বুঝানোর চেষ্টা করে সে যা শুনেছে তা একেবারেই মিথ্যা। এমনটি হতেই পারে না। যদি তাই হতো তা হলে তার মা তাকে এতো আদর করতো না। কখনো না কখনো সে বুঝতেই পারতো। শুধু কি জন্ম দিলেই মা হওয়া যায়? হয়তো জন্ম  দেয়া নারী তাকে এতো আদর-øেহ করতো না যতটুকু সে জবা আহমেদের কাছ থেকে পেয়েছে। তা হলে কেন সে তার মা হবে না? নিজে নিজেই যুক্তি পাল্টা যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করছে আয়নার ভেতরের নিশির সঙ্গে। 
বাবার ডাক বাথরুম থেকে শুনতে পায় নিশি। ততক্ষনে জবা আহমেদ তার কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেছে। নিশি বাবার সামনে গিয়ে কি করবে কাদবে নাকি স্বাভাবিক থাকবে সে প্লান করতে থাকে।

১১
ইমরান নিশির কাছে কিভাবে ক্ষমা চাইবে তার চিন্তা করতে থাকে। নিশির সঙ্গে তার অনেক দিন দেখা নেই। কিন্তু তার ওই ছবিটার সঙ্গে তার প্রতিনিয়ত দেখা হয়। তার একটি মাত্র ছবি সেই তুলেছিল। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পর বন্ধুরা মিলে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে গিয়েছিল। আর তখনই ইমরানের ক্যামেরায় নিশির ছবিটি ধরা পড়ে।
ঢাকায় ফিরে ছবিটি যখন কম্পিউটারে ঢালে তখন ইমরান বুঝতে পারে নিশি আসলে কতটা ফটোজেনিক। হবে বা না কেন, তার হেয়ার স্টাইল, মেকাপ বোধ একজন বিশেষজ্ঞের চেয়ে কোন অংশেই কম নয়। ইমরানের স্পষ্ট মনে আছে। নিশি হোটেল থেকে ম্যাডামদের সঙ্গে বেরিয়ে যখন বাসে উঠতে যাচ্ছিল তখন সবারই চোখ ছিল নিশির দিকে। সেদিন খুব বেশি বাতাস বইছিলো না। তবুও উড়ছিল নিশির চুল। লম্বা চুলগুলোতে যেন তখন সমুদ্রের ঢেউ। সমুদ্র দেখতে আসার কারনেই হয়তো ইমরানের কাছে তার উড়ন্ত চুলগুলোকে সমুদ্রের ঢেউ মনে হচ্ছিল। 
ইমরান কলেজের ভর্তি হওয়ার পর নিশিকে ওভাবে দেখতে পায়নি। কিন্তু নবীন বরন অনুষ্ঠানের দিন নিশিকে চোখে পড়ে তার। সেই যে চোখে পড়া এর পর একদিন না দেখলে যেন কি একটা অপূর্ন থেকে যায় তার কাছে। কত ছুতোয় সে নিশির সঙ্গে কথা বলতে যেতো তার হিসাব নেই। তবে নিশি কখোনোই রাগ করতো ন। তবে বুঝতো কোন একটা ছুতোয় ইমরান তার সঙ্গে কথা বলতে এসেছে। তাতে রাগ করার কি? কত জনইতো তার সঙ্গে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে আসে। এ নিয়ে অন্য ধরনের চিন্তা মাথায় আসে না নিশির। তবে ইমরান কেন বারবার নিশির সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগতো তা বুঝতে পারতো না। তার মাঝে তার প্রতি যে একটা ভাল লাগা তৈরি হয়েছিল সে তা অনুমান করতে পারে। কিন্তু গম্ভীর প্রকৃতির নিশির সামনে গিয়ে তার ভালবাসার কথা বলার মতো সাহস তার কেন কলেজের ছাত্র সংসদের নেতাদেরও নেই। 
আর বড় ভাইদের অনেকের চোখইতো পরে থাকতো নিশির দিকে। যে কারনে নিশির সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ইমরানের একটা ভয় কাজ করতো। 
একদিন প্রচণ্ড বৃষ্টিতে কলেজে আটকে গিয়েছিল নিশি। বের হতে হতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। তখন নিশিদের বাড়ির কাছেই ছিনতাইকারীদের বেশ উৎপাত ছিল। এ কারনে সন্ধ্যার আগেই নিশি বাসায় ফিরে যেতো। তাতেই বা কি একদিন বিকালেই তার কাছ থেকে ভ্যানিটি ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়েছিল ছিনতাইকারীরা। এ কারনে ইমরানের সহযোগিতা চেয়েছিল নিশি। তার সঙ্গে বাসা পর্যন্ত তাকে পৌছে দেয়ার অনুরোধ করলে ক্ষনকাল দেরী না করে রাজি হয়েছিল ইমরান। 
রিক্সায় পাশাপাশি নিশির সঙ্গে বসার সুযোগ পাবে সে সেটা সে চিন্তার মধ্যেই আনেনি। খুব খুশি ইমরান। নিশিও সেটা বুঝতে পারে। এ নিয়ে কোন ধরনের মন্তব্যও করেনি নিশি। ইমরান যতোটা পারে নিশির গায়ে যেন গা না লাগে সেরকম চেষ্টা করে যায়। রিক্সায় উাঠার পর পরই নিশি বাম দিকে এমনভাবে সরে বসে মনে হচ্ছিল যেন আর একটু সড়লে নিচে পড়ে যাবে। তার কাধে যাতে ইমরানের কাধ লেগে না যায় সে কারনেই হয়তো নিশি এমন দূরত্ব রাখার চেষ্টা করছে। নিশির সঙ্গে এক রিক্সায় চাপতে পেরেছে এটাই ইমরানের জন্য অনেক বড় পাওয়া। কাধে কাধ লাগার কারনে তাকে নেমে যেতে হয় কি-না এ ভয়টাও কাজ করে তার মধ্যে। তরুন রিক্সাচালক খুব বেগেই রিক্সা চালিয়ে নিচ্ছিল। একটি স্পিড ব্রেকারে পার হওয়ার সময় রিক্সা প্রচন্ড ঝাকুনি খায়। আর তখন এক হয়ে যায় ইমরান ও নিশির কাধ। সজোরে ধাক্কা খায়। নিশির কাধের নরম অংশের ধাক্কাটা এখনো মনে পড়ে তার। এমন অনুভূতি সে আজ পর্যন্ত ভুলতে পারে না। পরবর্তীতে যখনই সে নিশিকে দেখতো তখন তার চোখ পড়তো নিশির বাম কাধের দিকে। 
একবার অবশ্য নিশিকে খুব জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছিল ইমরানের। ঠিক সেই সময় নিশি তাকিয়েছিল তার দিকে। নিশি নরম চোখে তাকালেও ইমরানের কাছে শক্ত মনে হয়েছিল। মহূর্তেই তার মোহ ভঙ্গ হয়ে গিয়েছিল তার। ভয় পেয়ে যায় ইমরান। নিজের অজান্তেই ‘সরি’ বেরিয়ে আসে। নিশি সেদিন বিস্মিত না হয়ে পরেনি। 
সরির ব্যাখ্যাও চেয়েছিল নিশি। ইমরান তার মনের ইচ্ছে গোপন করে বলেছিল-
‘না তোমার গায়ে আমার গা লেগে গিয়েছিলতো তাই ’।
ইমরানের কথা শুনে সেদিন নিশি খুব হেসেছিল। সেই হাসিতে কোন কৃত্রিমতা ছিল না। এরপরও ভয় পেয়ে গিয়েছিল ইমরান। লাল হয়ে গিয়েছিল তার মুখ। নিশি শুধু বলেছিল-
‘ইমরান তুমি না একটু বোকা টাইপের। সেটা কি তুমি জানো’?। ইমরান বিস্মিত-
‘নাতো’। এর পর আরো হেসেছিল নিশি। হাসি ঠাঠ্রার মধ্যেই সেদিন রিক্সাটি পৌছে গিয়েছিল নিশিদের বাসার সামনে। আর নিশিকে নামিয়ে দিয়ে একই রিক্সায় চলে গিয়েছিল ইমরান।
ওই দিন তাদের দু’জনকে এক রিক্সায় দেখেছে অনেক বন্ধু। ফলে নিশির সঙ্গে ইমরানের প্রেম হয়েছে সেটি বেশ চাওড় হয়। কিন্তু ইমরানতো জানে রিক্সার কাহিনী। কে শুনে কার কথা। ঈর্ষায় জ্বলে যাচিছল ইমরানের ক’জন সহপাঠি। 
ইমরান নিশির কথাগুলো এক বড় ভাইয়ের সঙ্গে আলোচনাও করেছিল। সেই বড় ভাই তাকে বুঝিয়েছিল কথা শুনে বুঝা যাচ্ছে মেয়েটি তোমার প্রেমে পড়েছে। সেদিন থেকেই ইমরান নিশিকে ভাল বাসে। কিন্তু নিশি তাকে ভালবাসে কি না তা বুঝতে পারে না। 
ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর ইমরানও নিশি একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিযেছিল। কিন্তু নিশির হলেও ইমরান পারেনি। পরে সে একটি কলেজে ভর্তি হয়। পাশাপাশি কম্পিউটারের প্রশিক্ষন নিতে শুরু করে। বেশ কিছুদিন কাজ করে সে গ্রাফিক্স ডিজাইনের উপর পাকা হয়ে যায়। বিভিন্ন কোম্পানীর কাজ পেতে থাকে সে।
নিশির সঙ্গে শেষ কবে কোথায় দেখা হয়েছিল তা এ মুহূর্তে মনে পড়ছে না তার। তবে মাঝে মাঝে মোবাইল ফোনে কথা হতো। রাত ১২ টার পর ইমরান তাকে ফোন করলেও বিরক্ত হতো না। বরং খুশিই হতো নিশি। কারন তখন সে পড়ে বিছানায় যেতো। আর ওই সময় নিজেকে একটু ফ্রেস করে নেওয়ার জন্য নিজের মনটাকে বইয়ের বাইরে নেওযার সুযোগ পেতো। এ কথাটা কয়েকদিন ইমরানকে বলেছেও নিশি। 
নিশির অবস্থা জানতে ইমরান মোবাইল হাতে নেয়। তার হাত কাপছে। কিভাবে বলবে যে তার সামান্য ভুলের কারনে এতো বড় একটা কান্ড ঘটে গেছে। এর পরওতো বলতে হবে। সে যে অপরাধী। সে ক্ষমা চাইবে নাকি হেসে বিষয়টাকে হালকা করবে ভেবে পায় না। বন্ধুর কাছে কি ক্ষমা চাওয়া যায়। কেন চাওয়া যাবে না। এতো তো প্রেস্টিজ যাওয়ার কথা নয়। বরং মহত্ব বাড়ার কথা। কি করবে ইমরান বুঝে উঠতে পারে না। শেষমেষ সিদ্ধান্ত নেয় সে প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নেবে। প্রয়োজনে পায়ে ধরে ক্ষমা চাওয়ার কথা বলবে সে। এতে মান-ইজ্জত গেলে যাবে। নিশির বিপদের চেয়ে তার ইজ্জতটা এ মুহূর্তে বড় নয়।
ইমরান মোবাইলের সেইভ করা নম্বর থেকে নিশির নম্বরটা বের করে। সেন্ড বাটনে চাপ দেওয়ার পর পরই তার হাত আরো বেশি কাপতে থাকে। এভাবে তার হাত কাপছে কেন? এর আগেতো কোনদিন এমন হয়নি তার। তা হলে নিশ্চয়ই সে যে ভুলটা করেছে তা বড় ধরনের অন্যায় হয়েছে। কিভাবে সে এই অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত করবে। সেকি প্রায়শ্চিত্ত করছে না। হাত কাপা কি প্রায়শ্চিত্তের অংশ নয়।
অনেক্ষন ধরে ফোনটি বাজলো। কিন্তু কোন উত্তর মিললো না। মোবাইলের মনিটরে ভেসে উঠলো নো আনাসার। ইমরান ধারনা করলো নিশি মোবাইলের কাছে নেই। তা না হলে অবশ্যই তার ফোনটি ধরতো। মোবাইল কেনার পর যতবার নিশিকে ফোন করেছে সব বারই তার ফোন ধরেছে সে। তা হলে আজকে ধরবে না কেন। নিশ্চয়ই সে মোবাইল থেকে দূরে কোথাও আছে। আবারো ফোন করে ইমরান। এবারও একই ফল। ইমরানের তর সাইছে না। সে একের পর এক ফোন করেই যাচ্ছে। কিন্তু নো আনসার। ৫০ বারের মতো ফোন করে সে বিরক্ত হয়ে যায়। বুঝতে পারে নিশি ইচ্ছে করেই তার ফোন ধরছে না। ঠিক তখন তার বুকের মধ্যে কেমন একটা কষ্ট চেপে বসে। কাদতেও ইচ্ছে করে তার। কাদলে ফ্ল্যাটের অন্য বাসিন্দারা তাকে বোকা ভাববে এ কারনে কান্না লুকোনোর চেষ্টা করে। কিন্তু ভেতরের কান্না চলতেই থাকে অবিরত। 
ইমরান কখনো বিছানায় যায় কখনো রুম তালাবদ্ধ করে বাইরে হাটতে যায়। কোথাও শান্তি পায় না সে। এক বার ভাবে রমনা পার্কে চলে গেলে হয়তো কিছুটা ভাল লাগবে। কিন্তু সেখানে গিয়ে যখন প্রেমিক-প্রেমিকার জুটি দেখবে তখন হয়তো তার মনে নিশির ছবিটা আরো বেশি করে ভাসতে থাকবে। ফল হবে উল্টো। তা হলে কোথায় যাওয়া যায়। সে বরং টুথ পেষ্ট কোম্পানীতে যাওয়াই স্থির করলো। 
১২
নিশি পত্রিকায় পড়েছিল - এক নবজাতককে কে বা কারা রাজধানীর একটি জায়গায় ডাস্টবিনের ভেতর ফেলে যায়। শিশুটি পলিথিনের প্যাকেটে মুড়ানো ছিল। যেন এটি কোন বস্তু। যেমনটি মুড়িয়ে ডাস্টবিনে ফেলে দেওযা যায়। কি করার ছিল সেই শিশুর। নিশ্চয়ই পলিথিনে মুড়ানোর সময় শিশুটি কান্না করেছে। পাষন্ড মায়ের দিকে তাকিয়ে নিজের অসহায়ত্বের কথা বুঝানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু কারোরই মন গলেনি। তাকে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে জঞ্জাল দূরের মতো একটা ব্যবস্থা করেছে তারা। 
পত্রিকার সংবাদ অনুযায়ী খুব ভোরেই তাকে ওই ডাস্টবিনে ফেলে যাওয়া হয়। তখন হয়তো পুরো এলাকা ছিল নিঝুম। আর ওই সুযোগেই পলিথিনে মোড়ানো প্যাকেটটি সহজেই ফেলে যাওয়া সম্ভব হয়েছে। ভোরে কাকের দল খাবারের খুজে বেরিয়ে ডাস্টবিনের মধ্যে নরম দেহের এই শিশুকে পেয়ে উল্লাস করেছিল। নিষ্পাপ এই মানুষটির প্রতি কাকও দয়া দেখায়নি। বরং উৎকৃষ্ট খাবার মনে করে তারা শিশুর নাকে মুখে ঠোকর বসাচ্ছিল। আর অসহায় এই শিশু গগন বিদারী চিৎকার করতে থাকে। এইটুকু শিশুর কিইবা চিৎকারের শব্দ আছে। কত দূরেই বা যেতে পারে তার কান্নার আওয়াজ। 
কিন্তু সেই কান্নার শব্দ পাষন্ড মায়ের কানে না পৌছালেও পৌছেছিল এক হৃদবান রিক্সাচালকের কানে। ওই সময় রিক্সাচালক প্যাসেঞ্জারের আশায় রাজধানীর বুক ছিড়ে রিক্সা চালাচ্ছিলেন। ডাস্টবিনের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময়ই তিনি কান্নার আওয়াজ পান। প্রথমে বুঝতে পারছিলেন না। কান্না শুনেই তিনি থামিয়ে দেন তার রিক্সার গতি। দেখলেন ডাস্টবিনের ভেতরে কাকের দল কি একটা নিয়ে ঠানাটানি করছে। আর সেখান থেকেই ভেসে আসছে শিশুর কান্না।  তখন হাহাকার করে উঠে রিক্সা চালকের মন। তিনি দৌড়ে যান ডাস্টবিনের কাছে। দেখতে পান কাকের দল তার নাক কান ক্ষত বিক্ষত করে দিয়েছে। ক্ষত স্থান থেকে রক্ত ঝরছে। চোখ থেকে ঝরছে পানি।
খবরটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। অনেক মানুষ ছুটে যান সেখানে। শিশুটিকে ভর্তি করা হয় হাসপাতালে। সেখান থেকে পিতৃ øেহে বড় করার জন্য তাকে নিয়ে যান এক মহান ব্যক্তি। 
নিশির মনে আছে ওই সংবাদটি পড়ে তার চোখের জলে পত্রিকার পাতা ভিজে গিয়েছিল। যে তাকে জন্ম দিয়েছে তাকে হত্যা করতে ইচ্ছে করছিল তার। যে শিশুকে রাস্তায় ফেলে দিতে হবে তেমন শিশু জন্ম দিতে কে তাকে অধিকার দিয়েছে। শুধু ওই মায়ের প্রতিই নয় সমাজের প্রতিও তার ক্ষোভ জন্মায়। সমাজের চোখে নিজেকে কুমারী বলে পরিচয় দেওয়ার জন্যই হয়তো সেই মা তার শিশুকে রাস্তায় ফেলে দেওয়ার বিকল্প কিছু পায়নি। শিশুর অপরাধ কি ছিল? এই পাপ কি সমাজকে একটুও তারিত করবে না? 
নিশি সেদিন আরো ভেবেছিল ওই শিশুটির সংবাদ সে যেমন পড়ছে পত্রিকার পাতায় সেটি কি তার মায়ের চোখে পড়ছে না। নাকি তার মা অশিক্ষিত। যদি তার মায়ের চোখে তার সন্তানের কাক ঠুকরানোর সংবাদটি পড়ে থাকে তা হলে তার কি অবস্থা হয়েছে। রিপোর্টার যতোটা আবেগ দিয়ে রিপোর্টটি লিখেছে সেই আবেগ তার পাষন্ড মাকে কতটা দোলাতে পেরেছে তা তার জানার খুব ইচ্ছে করছিল নিশির।  
শিশুকে নিয়ে যাওয়া সেই মহান ব্যক্তির পা ছুয়ে সালাম করতে ইচ্ছে করছিল নিশির। তার বড় জানতে ইচ্ছে করছিল সেই শিশুটি এখন কেমন আছে। সে যখন বড় হবে তখন তা জেনে তার কেমন লাগবে। কাক ঠুকরানোর সেই দৃশ্যটি চোখের সামনে দেখতে পায় নিশি।
কিন্তু কে জানতো সে নিজেও তেমনি একজন শিশু। যাকে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে এনে বড় করেছে মহান নাহিদ আহমেদ। নিজের অজান্তেই চোখ ভেজে যায় নিশির। আজ ইচ্ছে করে ওই মহান ব্যক্তি নয় নাহিদ আহমেদকে তার সালাম করা উচিত। জবা আহমেদের কথা যদি ঠিক হয় তা হলে নাহিদ আহমেদ ওই মহান ব্যক্তির চেয়ে কোন অংশেই কম নয়। মনে মনে ভাবে এখন কি সে বাবার সামনে গিয়ে দাড়াবে। সালাম করার জন্য দুটো পা এগিয়ে দিতে বলবে।  
কিছুই সিদ্ধান্ত নিতে পারে না নিশি। তার মনে অনেক ধরনের কথা খেলা করে যাচ্ছে। ভাবছে তা হলে সে কোন রাস্তার পাশে পড়েছিল? তার গায়ে কি কোন কাপড় ছিল? নাকি পাষন্ড মা খালি গায়েই ফেলে দিয়েছিল রাস্তার পাশে বা ডাস্টবিনে। তার দেহে কি কাক ঠুকরোচ্ছিল। নাকি ব্যাগের ভেতর তাকে ফেলে পালিয়ে গেছে তার পাষন্ড মা। পত্রিকার পাতায় এসব খবর সে প্রায়ই পড়ে থাকে। তা হলে কি সে নিজেই এর শিকার বলে ওই সংবাদগুলো তাকে নাড়া দিয়ে যেতো। তার জানতে বড় ইচ্ছে করছে। কিন্তু সে যে তার মা বাবাকে বুঝতে দিচ্ছে না যে সব শুনেছে। ক’দিন পরই বিয়ে হওয়ার পর সে অন্যের ঘরে চলে যাবে। তা হলে এই সময়ে এসে এসব নিয়ে ঝামেলা করতে তার পছন্দ হলো না। তবে তার খুব জানতে ইচ্ছে করছে তার বাবা-মা আসলে কে? 
নিশির ঘরে থাকা নাহিদ ও জবা আহমেদ দম্পতির একটি ছবি নিয়ে বাথরুমে যায়। ছবির সঙ্গে তার মুখের মিল খোজার চেষ্টা করে। কিন্তু না একদমই মিলছে না। অন্যর সন্তান কেন তাদের সঙ্গে মিলবে। তবে সে এতো সুন্দরী হলো কি করে। তা হলে নিশ্চয়ই তার প্রকৃত বাবা-মা বেশ সুন্দর-সুন্দরী ছিলেন। তা হলে তারা তাকে রাস্তায় ফেলে গেলো কেন? নাকি মায়ের বিয়েই হয়নি। সে অবৈধ সন্তান। যে কারনেই তাকে তার মা রাস্তায় ফেলা ছাড়া বিকল্প পায়নি। সে কোথায় জন্মেছে, কোন নার্সিং হোমে, নাকি কোন বাসায়। জন্মানোর পর পরই কি তাকে রাস্তায় ফেলে দেওয়া হয়েছিল। মায়ের স্তন পান কি সে করতে পারেনি। কিন্তু রাস্তা থেকে নাহিদ আহমেদ তাকে কিভাবে নিয়ে এলো। 
কষ্টের মধ্যেও হাসতে ইচ্ছে করলো নিশির। কি আশ্চর্য তার জন্ম। হয়তো কোন বস্তির মেয়ের ঘরে সে জন্মেছে। কিন্তু বড় হয়েছে একজন উর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তার বাসায়। যার সুনাম, প্রতিপত্তি রয়েছে। যদি সে তার প্রকৃত মায়ের কাছে থাকতো তা হলে কি সে বস্তিতে বড় হতো? মানুষের বাসায় ঝি এর কাজ করতো? গৃহকত্রীর কাজ পছন্দ না হলে তার গায়ে কুন্তির ছ্যাকা দিতো? নাকি সুন্দরী হওয়ার কারনে সাহেবদের লালসার শিকার হতো সে। যা একদম অপছন্দ তার।  প্রায় দিনইতো এমন খবর পত্রিকার পাতায় পড়ছে নিশি। এ কারনেই কি তার নাম নিশি অর্থাৎ রাত রাখা হয়েছে। আসলেইতো তার জীবনটা রাতের মতো অন্ধকারই।
সেদিন রাতে নিশি আর তার ঘর থেকে বের হয়নি। তবে সে দরজা আটকায়নি। তার বাবা-মাও তার তেমন খোজ নেয়নি। সন্ধ্যার দিকে দু’বার নাহিদ আহমেদ পর্দা সরিয়ে ঘরে চোখ ফেলেছে যা চোখ এড়ায়নি নিশির। মধ্যরাত পর্যন্ত তার ঘুম হয়নি। না না চিন্তা তার মনে গেথে ছিল। এতো চিন্তার মধ্যেই এক সময় সে  ঘুমিয়ে গিয়েছিল। 
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখতে পেয়েছিল তার গায়ে কাথা রয়েছে। সে কাথা ছাড়াই ঘুমিয়েছিল। বুঝতে বাকি নেই বাবা অথবা মায়ের দু’জনের কেউ তাকে নজরে রেখেছে। রাতের কোন এক সময় যখন বৃষ্টি শুরু হয়েছে তখন তাদের একজন তার গায়ে কাথা জড়িয়ে দিয়েছে। যাতে শীতে সে কষ্ট না পায়। রাস্তা থেকে কুড়িয়ে পাওয়া একটি মেয়েকে কেন এতো আদর করতে হবে সেটাও মেলাতে পারে না নিশি। শুধু একবার তার হাসতে ইচ্ছে করে। আরেকবার কাদতে। আবার সে এটাও জানে। এমনটা শুধু বোকাদের ক্ষেত্রেই হয়। তা হলে কি সে বোকা। হিসাব মেলানোর চেষ্টা করে নিশি। এ হিসাব মেলানোর কোন ক্যালকুলেটর পৃথিবীতে আবিস্কার হয়েছে কি না তা জানা নেই তার।
১৩

টুথপেস্ট কোম্পানীর সিইও মার্কেটিং ম্যানেজার আশফাককে তার কক্ষে ডাকলেন। নিশির সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়েছে কি না জানতে চাইলেন। তাকেই বানানো হবে ব্রান্ড এ্যাম্বাসেডর। যতো টাকা চায় ততো টাকাই তাকে দেওয়া হবে। সিইও নিশ্চিত এই মেয়েকে দিয়ে বিজ্ঞাপন বানানোর পর টিভিতে প্রচার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মানুষের নজর কাড়বে। সিইওর সঙ্গে একমত মার্কেটিং ম্যানেজার আশফাকও। তার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে সিইওকে আশ্বস্থ করা হয়েছে। কিন্তু ইমরান যেভাবে ছবি উল্টা পাল্টা করেছে তা জেনে না আবার নিশি বেকে বসে সে চিন্তাও হচ্ছে আশফাক সাহেবের। 
সিইও কোন কথা শুনতে চান না। কামান্ডিং স্টাইলে মার্কেটিং ম্যানেজারকে বলেন-
‘এই মেয়ে আমাদের টুথ পেষ্ট কোম্পানীর ব্রান্ড অ্যাম্বাসেডর। ব্যাস।’ 
বেশ বিপাকেই পড়েছেন মার্কেটিং ম্যানেজার। তাকে বুঝানোর চেষ্টা করলেন-
‘স্যার মেয়েটির সঙ্গে এখনো আমাদের কথা বলা সম্ভব হয়নি। স্যার সেতো রাজি নাও হতে পারে। ইমরানের মুখ থেকে যা শুনলাম তাতেতো মেয়েটির বাবা একজন পদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। মাও একজন ব্যংক কর্মকর্তা। স্যার, সেতো রাজি নাও হতে পারে।’
‘মেয়ের চেহারাইতো বলে দেয় যে সে সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। এতো খোজ নিয়ে সেটা বুঝতে হবে কেন? আমি এ কারনেইতো বলছি, এই মেয়েই হবে আমাদের টুথ পেস্ট কোম্পানীর ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর। ’
‘স্যার তবুও আরেকবার চিন্তা করে দেখলে হয় না?’ আশফাক সাহেবের গলায় কাকুতির সুর। এবার ধমকে উঠেন সিইও। 
‘আপনি জানেন না আমি এক কথা মানুষ। এক কথা দু’বার বলা পছন্দ করি না।’ আশফাক সাহেব মাথা নিচু করলেন। তিনি জানেন, এখন আর কোন কথা বলা যাবে না। তা হলে তার চাকরিটাও হয়তো নিরাপদ থাকবে না। কথা কথায় চাকরি খাওয়া অভ্যাস আছে এই সিইওর। ১ বছরের প্রতিষ্ঠানে এ পর্যন্ত ২০ জনের বেশি কর্মকর্তা কর্মচারিকে চাটাই করা হয়েছে। তাদের অপরাধ শুধু সিইওর কথা যথাযথভাবে পালন করতে পারেনি। 
আশফাক সাহেবের দুটি ছেলে। দুটো ছেলেকেই তিনি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াচ্ছেন। অনেক খরচ। তার স্ত্রী এক সময় চাকরি করলেও এখন বেকার। এ মহূর্তে টুথপেস্ট কোম্পানীর চাকরি চলে গেলে মহা বেকায়দায় পড়তে হবে তাকে। বাসায়ও গোলমাল শুরু হয়ে যাবে। আগের কোম্পানী থেকে আশফাক সাহেব ছাটাই হয়েছেন। এর পর মাস দুয়েক বেকার ছিলেন। ওই সময়ই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন স্ত্রীর ভালবাসা আসলে চাকরির জন্যই বেশি। সুতরাং বিজ্ঞাপনের মডেলের কারনে তিনি চাকরি হারাতে রাজি নন। সিইও যা বলছেন সেই মতো কাজ করাই ভাল। কিন্তু কিভাবে তিনি নিশিকে বিজ্ঞাপনের মডেল বানাবেন সে চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়লেন। এক দিকে সিইওর কঠিন মুখ, অন্যদিকে একটা চ্যালেঞ্জ। দুই চিন্তায় তিনি এসি রুমের মাঝে বসে ঘামতে শুরু করলেন। ক্রমশই তার ঘাম পিঠের দিকে শার্ট ভিজিয়ে দিচ্ছে। তিনি অনুমান করেন কিছুক্ষন পর বুকের দিকের শার্টও ভিজে যাবে। কপালের ঘাম এরই মধ্যে সিইওর চোখে পড়েছে। তিনি বিরক্ত নিয়ে টিস্যু পেপারের বক্স এগিয়ে দিয়ে বলেন-
‘নেন ঘাম মোছেন।’ এ সময় তার শরীর দিয়ে আরো বেশি ঘাম বেরুতে শুরু করে। আশফাক সাহেব অনুভব করছেন সারা শরীরের যতো পানি আছে লুম কুপ দিয়ে এখন সব বেরিয়ে যেতে চাইছে। বেজায় অস্বস্থিতে পড়ে গেলেন তিনি।
এর মধ্যেই দরজা ঠেলে পিয়ন রইস আসে ভেতরে। মাথা নিচু করে সিইওর সামনে দাড়িয়ে জানায়, একজন তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। সিইও ভেতের পাঠানোর অনুমতি দেয়।
দরজা ঠেলে যুবক ভেতরে ঢুকতেই আশফাক সাহেবের চোখ চড়ক গাছ। ইমরান তার কাছে না গিয়ে সিইওর কাছে এসেছে কেন? সিইও’র সঙ্গেতো তার কোন পরিচয়ই নেই। 
সিইওর জিজ্ঞেস করতে হয়নি ইমরান নিজে থেকেই পরিচয় দেয়। বিজ্ঞাপনের ছবি বদলে যাওয়ার কথাও খুলে বলে সে। ইমরানের স্মার্টনেস দেখে খুশী হন সিইও।  
এর পর দীর্ঘক্ষন ধরে সিইও কথা বলেন ইমরানের সঙ্গে। সিইওর হাসি খুশি ভাব দেখে আশফাক সাহেবের ঘাম শুকাতে থাকে। এবার ঝামেলাটা বোধ হয় তার মাথার উপর থেকে ইমরানের উপরই পরবে। তিনি মনে মনে খুশি। আশফাক সাহেবের মনে হয় যে ভুল হয়েছে, এর পর তাকে মডেল বানানোর অফার করতে গেলে মার খাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। এমনকি পুলিশেও দিতে পারে। 
নিশিকে টুথপেস্টের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর বানানোর কথা জানায় ইমরানকে। ইমরান খুশি। তবে আশংকা কাজ করে যায়। সে কম করে হলেও নিশির মোবাইলে ৫০ বার ফোন করেছে। একবারও নিশি তার ফোন রিসিভ করেনি। এমনকি মিসড কল দেখে অনেক সময় পেরিয়ে গেলেও একটি কল পর্যন্ত করেনি। তা হলে বোধ হয় সে বুঝে গেছে এই কাজ তার হাত দিয়েই হয়েছে। সে নিশ্চয়ই জানে তার কাছে এই ছবিটি রয়েছে। যদি ধরতে না পারতো তা হলে সে নিশ্চয়ই তার মোবাইল ফোনটি ধরতো। আর যদি তেমন সমস্যাই হতো তা হলে নিশ্চয়ই তার মোবাইল ফোন খোলা থাকার কথা নয়। অনেক কিছু মনের মাঝে ঘুরপাক খেয়ে যাচ্ছে ইমরানের। 
আশফাক ইমরান দু’জনকে চিন্তিত দেখে সিইও নিজেও চিন্তায় পড়ে গেলেন। তা হলে কি তার আশা পূরন হবে না। নিশিকে তিনি ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর বানাতে পারবেন না। যেখানে দেশের জনপ্রিয় চিত্রা নায়িকা, মডেলরা একবার বললে লাফিয়ে পড়তো সেখানে অখ্যাত একটি মেয়েকে বিজ্ঞাপনের মডেল হিসেবে পাওয়া যাবে না? জেদ ধরলেন সিইও, যেভাবেই হোক নিশিকে মডেল বানাতেই হবে। এটা তার একটা চ্যালেঞ্জ।
সেদিন তার চ্যালেঞ্জের কথা ইমরান ও আশফাক সাহেবকে জানিয়েও ছিলেন সিইও। ইমরান তাকে শতভাগ সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল সিইওর কক্ষ থেকে।  
১৪

কোন দিক দিয়ে রাত আড়াইটা বেজে গেছে ঠেরই পায়নি নিশি। মন খারাপ থাকায় আজ আর ঘড়ির দিকে তাকানো হয়নি তার। সুইচ টিপে ঘরের আলো তাড়িয়ে দিয়ে বেলকনীতে বসেছিল ও।  দক্ষিন দিকের আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল অপলক। 
শরৎকাল না হলেও আকাশটা পরিস্কারই ছিল। ক’টি তারা খেলা করছিল। কেমন যেন একটা তারা সরে গিয়েছিল পশ্চিম দিকে। ওই সময় পুর্ব দিক থেকে আরেকটা তারা এসে শূন্যস্তান পূরন করে। তারারা এভাবে জায়গা বদল করে নাকি সে ভুল দেখেছে তাও আন্দাজ করতে পারে না। যাই হোক তার সময়তো কাটছে। অন্তত মনটাকে একটু প্রশান্তি দেওয়ার জন্য তারার দিকে তাকিয়ে তাকাই বা খারাপ কি? 
রাতে মা-বাবার সঙ্গে খেতে বসলেও অন্য দিনের মতো পেট পুড়ে খেতেও পারেনি নিশি। বার বার মনে পড়েছিল আমিতো ওদের সন্তান নই। কিন্তু নিশি বিষয়টা জানে তা বুঝতে দেয়নি। নাহিদ আহমেদ ভেবে নিয়েছেন-পত্রিকায় ছবি দেখেই নিশির মনটা খারাপ। তারাও কিছু বললেন না। 
নিশি বেলকনীতে বসেই রবীন্দ্রনাথের কোন একটি গান আওড়নোর চেষ্টা করে। কিন্তু কোনটা গাইবে তা নিয়েও ঝামেলায় পড়ে যায়। 
এর মাঝেই একটি ফোন আসে তার মোবাইল ফোনে। আজ সকাল থেকেই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কারো কোন ফোন ধরবে না। কিন্তু মনিটরে দেখতে পেলো দেশের বাইরের একটা নাম্বার থেকে ফোন এসেছে। অনিচছা  সত্ত্বেও সে ফোনটা ধরে। এক মহিলা ফোন করেছে। ফোন ধরার সঙ্গে সঙ্গেই ওই মহিলা উৎকণ্ঠিত হয়ে জানতে চান। 
‘তুমি কেমন আছো আম্মু।’ চমকে যায় নিশি। তার পরিচিত জন কেউ এমন ভাবে আম্মু ডাকে তা মনে করতে পারলো না সে। জবা আহমেদ তাকে নাম ধরেই ডাকে। কখনো আদর করে তাকে আম্মু বলেছে তাও নিশি মনে করতে পারেনি। তবে আমার নিশি মনি বলে ডাকতো জবা আহমেদ। আম্মু ডাকটা শুনার পর কেমন যেন আবেগ প্রবন হয়ে উঠে নিশি। কে এই মহিলা যে কিনা তাকে এতো মধুর সুরে আম্মু বলে ডাকলো। কিছুক্ষন তার মুখ দিয়ে রা বেরুলো না। কি জবাব দেবে তা খুজছিল। কোন শব্দ সে ব্যবহার করবে তাও মাথায় আসছিল না। আজ শব্দরাও যেন নিশির কাছ থেকে দূরে সরে গেছে। কিছুক্ষন চুপ থাকার পর আবারো ওই পার থেকে প্রশ্ন-
‘তুমি কি আমাকে শুনতে পাচ্ছো আম্মু?’ এবারের আম্মু ডাকটা তাকে আরো আবেগী করে তুলে। শব্দ এবার খুজে পায় নিশি।
‘কে বলছেন আমি ঠিক..?’
‘চিনতে পারছো না এইতো? আমি তোমার শুভাকাঙ্কি। পত্রিকায় তোমাকে ধরিয়ে দেওয়ার বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছে তা আমি জানি। আমি জানি তুমি এমন কোন কাজই করতে পারো না যে, পত্রিকায় তোমাকে ধরিয়ে দেওয়ার বিজ্ঞাপন দেওয়া হতে পারে। নিশ্চয়ই কোথাও ভুল হচ্ছে।’
মহিলার কথায় আরো বিস্মিত নিশি। কে তিনি। নাম্বারটা দেখেই বুঝেছে লন্ডনের নাম্বার। লন্ডন থেকে এক মহিলা তার খবরা খবর রাখে! ইন্টারনেটে যে পত্রিকা বিদেশের লোকজন দেখতে পারে সেখানেতো বিজ্ঞাপনের অংশ দেওয়া হয় না। তা হলে এই মহিলা কিভাবে জানলো তার ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছে পত্রিকায়। 
নিশি এবার ভয় পেয়ে যায়। মহিলার সঙ্গে কথা বাড়ানোটাও সুবিধার মনে হচ্ছে না তার কাছে। কোন প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই নিশি দ্রুত ফোন কাটে। এর পর আবারো তার মোবাইলে ওই নম্বর থেকে কল আসে। কেটে দেয় নিশি। কয়েকবার এমন করার পর মোবাইল ফোনটি বন্ধ করে দেয় সে।  
কি সব উদ্ভট বিষয়ের মাঝে আছে নিশি। এই ফোনটাকেও তার কাছে উদ্ভটই মনে হলো। তার মনে হতে থাকলো সে বিশেষ কেউ হয়ে গেছে। যা শুধু ঢাকা নয় তার পরিচিতি ছড়িয়ে পড়েছে সদুর লন্ডনেও। 
নিশি এক গ্লাস পানি খেয়ে সব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে ঘুমানোর জন্য যখন বিছানায় যায় তখন রাত তিনটা। নিজের অজান্তেই চোখ গড়িয়ে পানি পড়তে থাকে নিচে। বালিশ মহা মমতায় নাকি হাস্যরস করে তার সেই চোখের পানি চুষে নেয় তা আন্দাজ করতে পারেনি নিশি। এক সময় ঘুমিয়েও যায়।

১৫
পরদিন সকালে নিশির ঘুম ভাঙ্গে বাবার চিৎকার শুনে। তার বাবা চিৎকার করে স্ত্রী জবার সঙ্গে কথা বলছে। ছোট বেলা থেকে আজ পর্যন্ত যা চোখে পড়েনি নিশির। বাবা নাহিদ আহমেদ তার স্ত্রীকে বলছেন-
‘তুমি আসলে কি চাও। নিশিকে বাড়ি থেকে বের করে দেবো?’ জবা আহমেদ ঠান্ডা মাথায় বললেন-
‘তুমি উত্তেজিত হচ্ছো কেন? তোমার প্রেসারটা বাড়বে।’
‘বাড়–ক, বেড়ে মরে যাই তা হলে যদি তোমার শান্তি হয়।’
‘কি ধরনের অলুক্ষনে কথা বলছো তুমি’
‘এতোক্ষন ধরে যেসব প্যাচাল শুরু করেছো তার মানে কি?
‘আমি বলছি যে, মাথা গরম না করে পত্রিকা অফিসে গিয়ে আসল বিষয়টা জেনে আসো। আসলে নিশি কোন অন্যায় করেছে কি না?
‘যদি করে থাকে তা হলে কি করবে?’
‘সেটা পড়ে দেখা যাবে’
‘নিশি তোমার পেটের সন্তান না হলেওতো তোমার সন্তান নাকি। আর সেই সন্তানের বিরুদ্ধে তুমি অ্যাকশনে যেতে চাচ্ছো, সেটা আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি।’ এবার রেগে যান জবা আহমেদ
‘শোন, আমার পেটের না হলেও আমি নিশিকে নিজের সন্তানই মনে করি। আর তাকে সেভাবেই বড় করা হয়েছে। বুঝতে দেইনি আমি তার মা নই। যদি সে আমার পেটের সন্তান হওযার পরও কোন অন্যায় কাজে জড়াতো তা হলে আমি নিশ্চয়ই তাকে শাস্তি দিতাম।’ 
‘ কি শাস্তি দিতে জানতে পারি?’
‘বাড়ির বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দিতাম।’
‘নিশিকেও দাও। অসুবিধাটা কোথায়?’
‘অসুবিধাটা তুমি।’
‘আমি!’
‘হ্যাঁ তুমি। আমি বন্ধ করে দিলে তুমি বাইরে যাওয়ার অনুমতি দিয়ে দিবে।’
‘নাওতো দিতে পারি।’
‘তোমাকেতো ২৫ বছরের বেশি সময় ধরে চিনি নাকি?’
‘এখন নিশিকে কি করতে চাও?’
‘আগে প্রকৃত খবরটা নিয়ে এসো। দেখি সে কত বড় অপরাধের সঙ্গে জড়িয়েছে। এর পর ব্যবস্থা নেবো।’  জবা বেশ শক্তভাবেই কথাগুলো বলে যায়। নাহিদ আহমেদের মনে ছুট লাগে। 
‘ তার মানে নিশি তোমার সন্তান নয় বলে তুমি তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে চাইছো।’
‘এমন ভাবে বললে মনে হচ্ছে যেন সে তোমার প্রকৃত সন্তান।’
‘হ্যা, সে তোমার সন্তান না হলেও প্রকৃত অর্থেই সে আমার সন্তান। আমার সন্তান বলেই তোমার মতো গরম মেজাজ পায়নি। হয়েছে ঠান্ডা মেজাজের মানুষ।’
কথাটা শুনে খুব একটা চমকায়নি জবা। পিতৃ øেহের কারনেই পরের সন্তানকে নিজের সন্তান বলে দাবী করছে। তার নিজেরওতো খারাপ লাগছে নিশিকে পরের সন্তান বলতে। 
কতগুলো বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর তাদের সুখের সংসারে কেন এ সমস্যার সৃষ্টি হলো তাও চিন্তা করে দেখার চেষ্টা করেন জবা আহমেদ। নিশিকে আনার পর তিনিইতো তাকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছেন। কতদিন তার গায়ে হাগু মুতো করেছে নিশি। একবারওতো জবা আহমেদের মনে পড়েনি সেতো তার সন্তান নয় তা হলে কেন তিনি হাগু মুতো পরিস্কার করবেন। বরং বিছানায় নিশির মুতের উপর কত রাত শুয়ে কাটিয়েছেন জবা আহমেদ তার হিসাব নেই। সেই মেয়েকে তিনি নিজেই পরের সন্তান বলে আখ্যায়িত করলেন। 
না করেই বা কি করবেন। ব্যাংকের লোকগুলো যেভাবে তাকিয়েছে। প্রথম দিকে না বললেও পরে যেভাবে নিশিকে নিয়ে তার সামনে সমালোচনা করেছে তাতে কার মাথা ঠিক থাকে? জবার মনে হয় যদি তার পেটের সন্তান হতো তা হলে নিশ্চয়ই সে কোন অপরাধের সঙ্গে জড়াতো না। কিন্তু তার হাতেইতো বড় হয়েছে নিশি। তা হলে তার ব্যাপারে খোজ খবর রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন জবা আহমেদ। 
পরক্ষনেই জবার মনে পড়ে তার স্বামীর কথা। লোকটা কি বললো! তার প্রকৃত মেয়ে নিশি। তা কিভাবে সম্ভব। রাস্তা থেকে কুড়িয়ে পাওয়া একটা শিশু কি করে নাহিদের সন্তান হতে পারে? নিশিকে যখন নিয়ে আসা হয়েছিল তখন তার বয়স ছিল ১ দিন। নাহিদ ও তারিক এক সঙ্গে গাড়িতে করে নিশিকে নিয়ে বাসায় এসেছিলেন। তারিক জানিয়েছিল এক দরিদ্র ঘরে জন্ম নিয়েছে মেয়েটি। তার মা তাকে খাওযাতে পরাতে পারবে না বলে নব জাতককে রাসতায় ফেলে দিচিচল তখন তাদের চোখে পড়ে। তারা তার কাছ তেকে মেয়েটিকে নিয়ে আসে। 
বিনিময়ে নাহিদ তাকে দুই হাজার টাকা দিয়েছে। সেই মহিলা কোনদিন তার সন্তানকে নিজের সন্তান বলে দাবী করতে আসবে না এ কারনেই টাকা দেওয়া। কিনে আনা হয়েছে বিষয়টি এমন নয়। এর পর থেকেইতো নিশি জবার কোলে কাকে থেকে বেড়ে উঠেছে। আজ সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। 
নাহিদের সঙ্গে আর কোন কথা বললেন না জবা। তিনি বেরিয়ে গেলেন। নাহিদ অবাক। প্রকৃত সন্তান বলার পরও সে কোন ব্যাখ্যা না চেয়েই চলে গেলো। এমনতো হওয়ার কথা নয়। জবা আহমেদ কোন বিষয়ই শেষ না দেখে ছাড়েন না। ২৫ বছরের দাম্পত্য জীবনে এমনটিই দেখেছেন তিনি। আজ তার কি হলো। সব কিছু কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। মানুষের জীবনটা কি এমনই। কোন ঘটনা কি মানুষের জীবনকে এভাবে বদলে দিতে পারে? হয়তো পারে। তা না হলে জবাই বা কেন এমন বদলে গেলো। নাহিদ আপন মনে হিসাব করে যেতে থাকে অনেক কিছুর। 
১৬ 
দেশে আসার জন্য লন্ডনে বিমান ধরতে ঝামেলা হয়নি দিবার। প্রথমে টেনশনে পড়ে গিয়েছিলেন বিমানের টিকিট পান কি না। একদিন আগে টিকিট পাওয়াতো কষ্টকর। যেখানে কখনো কখনো ১০-১২ দিন আগেই বিমানের টিকিট পাওয়া যায় না। 
যে বিমানে সে দেশে এসেছে তারও কোন সীট ফাকা ছিল না। লন্ডন থেকে ঢাকা গামী এক ইংল্যান্ড নাগরিক শেষ সময়ে সীট বাতিল করে। সেই সীটটিই ধরতে পারে দিবা। দিবার মাল্টিপল ভিসা থাকায় আসা যাওয়ায় কোন সমস্যা নেই। 
দিবা দেশের মাটিতে বিমান থেকে নেমেই প্রচন্ড গরম অনুভব করে। সে যখন হিথ্রো বিমান বন্দরে বিমানে চাপে তখন তাপমাত্রা ছিল ১২ ডিগ্রী সেলসিয়াস। বিমান থেকে নেমেই ৩৯ ডিগ্রীর তাপে পড়তে হয় তাকে। যেন কেউ তার গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। অবশ্য দিবা জেনে শুনেই এসেছে যে, দেশে গরমের পরিমান বেড়েছে। ঢাকার তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি পর্যন্ত উঠে যাচ্ছে। তা একটি পত্রিকায় পড়ে বেশ কষ্টই হয়েছিল তার। কিন্তু শীতের ভেতর বসে থেকেতো আর চরম গরমের বিষয়টি আচ করা কঠিন হয়ে যায়। বিমান থেকে নেমে সেটি সহজেই আচ করতে পারে।  
দিবা বিমান বন্দরে নেমেই ফোন করে বন্ধু তারিককে। তারিকের মোবাইলে বাংলাদেশের নম্বর দেখে ফোন ধরে তারিক। সেই নম্বরে দিবার কণ্ঠ পেয়ে তিনি বিস্মত। দিবার সঙ্গে খুব বেশি আগে কথা হয়নি। এরই মধ্যে সে ঢাকায়। কিভাবে সম্ভব! এর পরওতো সে ভুল শুনছে না। দিবাকে বিমান বন্দরে থাকতে বলে তারিক। কিন্তু দিবা সরাসরি নাহিদের বাসায় চলে যেতে চায়। তারিককে বলে নাহিদের বাসায় চলে আসার জন্য। 
তারিক প্রথমে দিবাকে আটকে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু তার আবেগী ভাব বুঝতে পেরে আর তা করেনি। তা হলে হয়তো তারিককে সে ভাল মনে করবে না। তারিক মনে মনে ভাবে ২০ বছর ধরে দেখা নেই দিবার। কেমন হয়েছে ও। বুড়ো হয়ে গেছে! মোটা হয়েছে নাকি আগের মতোই স্লিম সুন্দরী আছে। 
এসব চিন্তা করতে করতেই তার সম্বিত ফিরে। মনে পরে তাকে নাহিদের বাসায় যেতে হবে। তা না হলে দিবাই বরং তার আগে ওই বাড়িতে চলে যাবে। তারিক দিবার কাছে জানতে চেয়েছিল সে বাসাটা চিনে কি না। দিবা জানিয়েছে তার ভুল হওয়ার কথা নয়। ঢাকা শহর ২০ বছরে যতোই বদলে যাক নাহিদের বাসা চেনা তার জন্য কষ্টকর হবে না। এ ছাড়া যে বাসায় নিশি রয়েছে সেটিতো ভুলার সুযোগই নেই। এও জানিয়েছিল তার রাস্তা ঘাট খুব মনে থাকে। লন্ডন শহরে একাই গিয়েছিল। নিজে নিজেই বাসা খুজে বের করেছে, চাকরি জুটিয়েছে। বিয়ে করেছে ভারতীয় এক নাগরিককে। তাদের ঘরে এক ছেলে জন্ম নিয়েছে। 
তারিক মোবাইল ফোন আর কথা বাড়ায়নি। যে কারনে দিবা দেশে ফিরেছে তা আগে সমাধান হওয়া দরকার। কিন্তু তার মনের মাঝে আশংকা কাজ করে যায় জবা বিষয়টিকে কিভাবে নেয়। নিশিও কিভাবে নেয়। তারিক না আবার তাদের পরিবারে ভিলেন হয়ে যায়। কিন্তু সেতো কখনো নাহিদের পরিবারের অমঙ্গল কামনা করেনি। সব সময় চেয়েছে নাহিদের পরিবার ভাল থাকুক। তা হলে তার মনে এসব চিন্তা আসছে কেন। তা হলে কি ঘঁনাটি সামলাতে পারবে কি না এমন ভয় পাচ্ছে। 
তারিকতো এমন ভীতু ছিল না। হঠাৎ সে এমন ভিতু হলো কি করে। ভেবে রাগ হচ্ছিল তার। সৎ অফিসার হওয়ার কারনে অফিসের সবাই তাকে ভয় পেতো। তারিককেও কাউকে পরোয়া করে চলতে হয়নি। বরং তার বিগ বস তাকে ম্যানেজ করেই দুর্নীতি করে যেতো। তারিক শুধু তাকিয়ে দেখতো। ক্ষোভ প্রকাশ করতো বন্ধু নাহিদ আহমেদের কাছে। কারন নাহিদও একই পথের যাত্রী। 
১৭

দিবাকে বাড়ির দরজায় দেখে আকাশ থেকে পড়েন জবা আহমেদ। এক সঙ্গে কতগুলো বছর তারা কাটিয়েছে। হরিহর আত্মা ছিল দু’জনের মাঝে। তারিক আর নাহিদের মধ্যে যে রকম ঘনিষ্ট সম্পর্ক তাদের মাঝেও এর চেয়ে কম ছিল না। ছিল না নয় কি এখনো নয়। কিন্তু জবার বিয়ের তিন বছর পর দিবা ল´£ন  চলে যায়। এর পর আর কোন যোগাযোগ রাখেনি জবার সঙ্গে। 
জবার বিয়ের সময়ই নাহিদ ও তারিকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল দিবার। তারিক যদি আগেই বিয়ে না করে ফেলতো তা হলে দিবাকে তার সঙ্গে বিয়ে দিতো জবা। এ নিয়ে তার আফসোসও কম ছিল না। নাহিদ ও তারিক যেমন ঘনিষ্ট জবা ও দিবাও তেমন। দু’জন যদি এই দু’জনের স্ত্রী হতো তা হলে কতোই না ভাল লাগতো। জবা তখন ভাবতো তারিককে অবশ্যই পছন্দ করতো দিবা। একদিন কথায় কথায় জানতেও চেয়েছিল। দিবা বিষয়টিকে পাত্থা না দিলেও জবা বুঝতে পারছিল তারিককে সে পছন্দ করে। কিন্তু বিবাহিত লোকের সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্ক তৈরি না করাই ভাল বলে যুক্তি দাড় করিয়েছিল দিবা। 
এ নিয়ে সেদিন দু’জন হাসাহাসিও কম করেনি। তবে তারিক ও নাহিদ দিবার বন্ধু হয়ে যায়। যেন সেও জবার মতোই একজন বন্ধু। তাদের মধ্যে ছেলে-মেয়ের বিষয়টি থাকেনি। কারো প্রতি কারো চাহিদাও তৈরি হয়নি। জবার কথা শুনে দু’একবার তারিকের প্রতি চাহিদার বিষয়টি উকি দিলেও দিবা তা সংবরন করতে পেরেছে। সে ক্ষমতা তার রয়েছে। তবে তারিকের মাঝে একবারও তেমন বিষয় কাজ করেনি। দিবাকে শুধু বন্ধু হিসেবেই দেখেছে সে। 
দরজা খুলতেই জবা দেখে তার বাসার দরজায় দিবা। প্রথমে চিনতে একটু কষ্ট হয়। দিবারও জবাকে চিনতে কম কষ্ট হয়নি। ২০ বছরে জবা কতটা মুটিয়ে গেছে দেখে অবাক হওয়ার কথা। জবা দিবাকে চিনতে পেরেই ‘দিবা তুই’ বলে চিৎকার করে উঠে। মেয়ের এই সমস্যার মধ্যে কি করে জবা এমন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলো তা দেখতে পেয়ে আৎকে উঠে দিবা। নিশ্চিত হয় নিশিকে খুব একটা ভালবাসে না জবা। কেনই বা ভাসবে সেতো তার প্রকৃত মা না। 
জবার উচ্ছ্বাস দেখে দিবার কোন প্রতিক্রিয়া হয়নি। বিষয়টা বুঝতে পেরে চমকে যায় জবা। তা হলে কি দিবা আমূল পরিবর্তন হয়ে গেছে। এই দিবা কি ওই দিবা। যে সারাক্ষন কথা বলতে পছন্দ করতো। কখনো কখনো জবা বিরক্ত হয়ে তাকে ধমক দিয়ে বলতো-
‘মানুষ তোকে বাচাল বলবে।’
‘বলুক। বাচাল হলে কি হয়। সবাইতো আর তোর মতো গুমরো মুখো থাকবে না।’
দুই বান্ধবীর মধ্যে এ নিয়ে মাঝে মাঝেই ঝসড়া হতো। কিছুক্ষনের মধ্যেই আবার ঝগড়া মিটে দু’জনে মিলে যেতো। সপ্তাহে দু’তিন দিন দিবাদের বাসায় যাওয়া পড়তো জবার। তা না হলে দিবার মা খুব রাগ করতো। দিবার মা না খাইয়ে ছাড়তো না। দিবাকেও যেতে হতো জবাদের বাসায়। তাদের দু’জনের ঘনিষ্টতা দেখে হিংসেও করতো অনেক বান্ধবী।
একবার দিবার মা-বাবা জবাদের বাড়ি গিয়েছিল। তারা দুই বান্ধবীর ঘনিষ্টতার বিষয়ে আলোচনা করছিল। এক পর্যায়ে দিবার মা বলছিল এক টাকে ছেড়ে আরেকটা কিভাবে থাকবে তা নিয়ে তিনি চিন্তিত। তখন জবার মা রসিকতা করে বলছিলেন, এদের দু’জনকে এক জনের কাছে বিয়ে দিতে হবে। তা হলেই এক সঙ্গে থাকতে পারবে। তাদের এই কথা গুলো পাশের কক্ষ থেকে স্পষ্ট শুনতে পেয়েছিল দিবা ও জবা। তারা দু’জন তখন মুখ টিপে হাসছিল। ড্রয়িং রুমে বসে যখন মুরব্বিরা কথা বলছিল তখন দু’বান্ধবী পাশের রুমে চলে গিয়েছিল। আর তাদের বিষয়ে কথা শুরু হতেই কান খাড়া করে দু’জনই।
এ কথা শুনার পর থেকে দু’জন দুষ্ঠুমি করে বলতো চল এক জনকেই দু’জন বিয়ে করবো। জবা বলেছিল-
‘বিষয়টা মন্দ হয় না। তা হলে আমাদের দু’জনকে কেউ আলাদা করতে পারবে না।’
‘ঠিকই বলেছিস। তবে সমস্যা কি জানিস?’
‘কি?’
‘হাজব্যান্ড কিন্তু আমাকেই বেশি ভাল বাসবে। তাতে তোর খুব হিংসে হবে।’
‘মোটেও না। আচ্ছা যদি এর উল্টোটা হয় তা হলে?’ কিছুক্ষন ভাবে দিবা। বলে-
‘মনে হয় আমি হিংসা করবো।’
‘কেন ছাড় দিবি না?’
‘সেটা ভেবে দেখা যেতে পারে।’
তাদের দু’জন এর পর থেকে প্রায়ই এক স্বামী নিয়ে গল্পে মশগুল হতো। নাহিদের সঙ্গে জবার বিয়ের পরও বিষয়টি ভুলেনি তারা। জবাই বলেছিল-
‘নাহিদকে বলবো নাকি তোকেও নিয়ে আসার জন্য।’ সেদিন সিরিয়াস হয়ে গিয়েছিল দিবা।
‘শোন সময়টা কিন্তু বদলে গেছে। এখন এসব কথা বলিস না। এসব কথা বললে নাকি সংসারের অমঙ্গল হয়।’ 
দিবার কথা শুনে সেদিন জবা অবাক না হয়ে পারেনি। কার মুখ থেকে সে এসব কথা শুনছে। যে কোন ধরনের কুসংস্কারে বিশ্বাস করে না, তার কাছ থেকে। 
এর পর থেকে জবাও আর এসব বিষয় নিয়ে কথা বলেনি দিবার সঙ্গে। দিবাও উঠায়নি। জবার বিয়ের চার বছর পরই দিবা দেশ ছাড়ে। যাওয়ার বছর খানেক আগে থেকেই কেমন যেন বদলে যেতে থাকে দিবা। জবাকে ফোনতো করতোই না। বরং জবা তাকে ফোন করলে বিরক্ত হতো। কেন এমন করতো তা জানার চেষ্টা করে বার কয়েক ব্যর্থ হয়েছে জবা। জবাও এক সময় জেদ করে তাকে আর ফোন করেনি। করেনি মানে উচিৎ মনে করেনি। তার আত্ম সম্মানেও বাধে। দিবা তখন একটি শপিং মলে চাকরিও করতো। শপিং মলের চাকরিটাকেও জবা ভাল চোখে দেখেনি। তাকে বার কয়েক পরামর্শ দিয়েছে এটা ভাল কাজ না। তার মতো শিক্ষিতা সহজেই ভাল জব জুটিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু দিবা জবার কথায় পাত্থাই দেয়নি। এর পর থেকেই তাদের দুজনের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে। 
দিবার তখন থেকেই টার্গেট বিদেশ চলে যাবে। সে শুনেছে লন্ডনে বাংলাদেশী মেয়েরা শপিং মলে সেলস গার্লের কাজ করে ভাল রোজগারই করে। সেখানে ওটা সম্মান জনক পেশা। সে সেখানে ডক্টরেট ডিগ্রী করতে যাবে। পড়াশোনার পাশাপাশি শপিং মলে কাজ করে খরচ জুটিয়ে নেবে। আর এ কারনেই দেশে সে শপিং মলে কাজ শুরু করেছিল। কিন্তু তার মনের ইচ্ছেটা কখোনোই প্রকাশ করেনি জবার কাছে পর্যন্ত। কিন্তু লন্ডন গিয়ে পিএইচডি শেষ করে তাকে আর শপিং মলে কাজ করতে হয়নি। একটি স্কুলে তার চাকরি জুটে। ইংরেজদের স্কুল। সেখানে সে দক্ষতার সঙ্গেই শিক্ষকতা করে যাচ্ছে দীর্ঘ দিন ধরে। 
দিবা যেদিন লন্ডনে চলে যাবে ঠিক একদিন আগে ফোন করে জানিয়েছিল জবাকে। জবা সেদিন আশ্চর্য না হয়ে পাড়েনি। এতো কিছু হয়ে গেল কিন্তু সে কিছুই জানতে পারলো না। তা হলে কি তার সঙ্গে দিবার যে ঘনিষ্টতা সেটি মেকি ছিল-এমন প্রশ্নও তার মনে খেলা করে যায়। 
লন্ডন যাওয়ার পর কোন যোগাযোগ করেনি জবার সঙ্গে। বছর দুয়েক পর জবাকে একবার ফোন করেছিল  দিবা। আর সে সময় জবা দিবাকে জানায় তার একটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়েছে। নাম রেখেছে নিশি। সে এখন গর্বিত মা। দিবা সেদিনও খুব বেশি কথা বাড়ায়নি। 
নিশির সঙ্গে জবা তার সমস্ত বন্ধু-বান্ধবীর গল্প করেছে। কিন্তু কোন দিন দিবার কথা উচ্চারনও করেনি। তার একটা বান্ধবী লন্ডনে আছে তার কথা তার ভুলে যাওয়ার কথা নয়।  জবা দিবার আচরনে কষ্ট পেয়েছিল। এও মনে করেছিলেন দিবা বন্ধু হওয়াল যোগ্য নয়। অযোগ্য কোন বন্ধুর কথা মেয়েকে না জানানোই সব সময় ভাল মনে করেছেন জবা। যে কারনেই নিশিকে দিবা ফোন করলেও চিনতে পারেনি।
জবা দরজার সামনে দিবার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে অনেক্ষন ধরে। দিবার চোখ দুটোতে কেমন যেন মনে হচ্ছে তার। দিবার এমন চোখতো কোনদিন চোখে পড়েনি জবার। আজ এমন দেখাচ্ছে কেন। চোখের মনির পাশে লালচে দাগ স্পষ্ট চোখে পড়ে। 
দিবা জবাকে দেখে প্রথমে চিনতে পারেনি। জবা এতো মোটা হয়ে গেছেন তা ভাবতেই কষ্ট হচ্ছিল দিবার। মনে মনে ভাবে দেশের মানুষ গুলো ভেজাল খেয়ে খেয়ে গায়ে চর্বিই জমিয়ে যাচ্ছে শুধু। অর্থনীতিতে কোন চর্বি হচ্ছে না। দিন দিন শুকিয়েই যাচ্ছে।
‘দিবা তুই? মুখ খোলেন জবা আহমেদ। ডাকটার মাঝে কেমন একটা কৃত্রিমতা খুজে পেলেন দিবা। এই প্রথম তার এমন মনে হলো। 
‘হ্যা আমি। ভাল আছিস?’ 
প্রশ্নটার কোন উত্তর তার কাছে এ মুহূর্তে নেই। নিজের মনকেই জিজ্ঞেস করেন আসলে তিনি ভাল আছেন কি না। কোন উত্তর তিনি খুজে পান না। এতো বছর পর বান্ধবী খারাপ আছি শুনলে হয়তো কষ্ট পেতে পারে। জবা বলেন-
‘হ্যা-ভাল আছি। আয় ভেতরে আয়।’ জবা দিবাকে ভেতরের রুমে নিয়ে দরজা আটকে দেন। লাগেজ হাতে নিয়ে দরজার ওপাশেই দাড়িয়ে ছিলেন দিবা। আশ-পাশে তাকিয়ে দিবা বলেন- 
‘আমার নিশি কোথায়?’ কথাটা শুনে বিস্মিত জবা। নিশিকে সে খুজতেই পারে। কিন্তু আমার নিশি কোথায়। এটা কেমন কথা বললো দিবা। খটকা লেগে যায় জবার কাছে। এ ছাড়া নিশির কথা জানিয়েছে ২০ বছর আগে। এর পর আর তার সঙ্গে জবার যোগাযোগ নেই। তা হলে কিভাবে সে নিশির নামটি মনে রেখেছে। জবার সব কিছু কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। মেয়ের ছবি পত্রিকায় দেখে যতোটা অবাক না হয়েছিলেন তার চেয়ে বেশি অবাক হলেন দিবার মুখে এ কথা শুনে। 
‘নিশি তোর মেয়ে মানে!’
‘তোর মেয়ে কি আমার মেয়ে না?’ জবার বুকের উপর থেকে যেন বড় একটা পাথর সরে গেল। ‘ওহ’ বলে তাকে ভেতরের রুমে নিয়ে যায়। কল বেলের শব্দ শুনেই নিশি দরজা খুলতে গিয়েছিল। জবাকে আসতে দেখে সে সরে যায়। আাড়লে দাড়িয়ে দু’বান্ধবীর কথাও শুনে সে। নিশি নিশ্চিত হয় গত রাতে এই মহিলাই তাকে ফোন করেছিল। আজ তাদের বাসায় এসেছে। লন্ডন থেকে ঢাকায়! কেন? কি কারনে। কে তিনি- বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন খেলা করে যায় নিশির মনে।

১৮

দিবা পৌছার আগেই নাহিদের বাসায় এসেছেন তারিক। তারিক, জবা ও নাহিদ কথা বলছিলেন নাহিদের ঘরে বসে। কল বেলের শব্দ হতেই তারিক বুঝতে পারেন দিবা এসেছে। দিবার কল বেল চাপাটাতেও এক ধরনের আবেগ খুজে পান তারিক। এর আগে কখনো তার কল বেল চাপার শব্দ শুনেননি তিনি। এরপরও তার মনে কেন এলো। অনেক সময় মানুষের মনই বলে দেয় কি হতে যাচ্ছে। বিশেষ করে খারাপ সংবাদ গুলোই বেশি মনকে নাড়িয়ে যায়। 
জবা দরজা খুলতে গিয়েছে। বুঝতে পেরেও বাধা দেননি তারিক। তবে তার মনের মধ্যে প্রচন্ড ঝড় বয়ে যাচ্ছিল। সেই ঝড়ের পূর্বাভাস দেননি নাহিদকেও। তার কথা বারবার জড়িয়ে যাচ্ছিল। একবার নাহিদ তাকে জিজ্ঞেসও করেছিল তারিকের শরীর খারাপ লাগছে কি না। প্রেসার বেড়েছে কি না ইত্যাদি। সত্যিই তারিকের প্রেসার বেড়েছে। কিন্তু এই প্রেসারে তার ঘাড় ও মাথা ব্যথা হয়নি। প্রেসার বাড়লে মস্তিস্কে রক্তক্ষরন হয় বলে শুনেছেন তারিক। কিন্তু আজকের প্রেসারে মস্তিস্কে নয় তার হƒদয়ে রক্ত ক্ষরন শুরু হয়েছে। 
দরজার সামনে দাড়িয়ে দিবার সঙ্গে জবার কি কথা হচ্ছে কে জানে। সেই কথা শুনার জন্য নাহিদের আগ্রহ ব্যাপক। বারবার তিনি দরজার দিকে তাকান। হয়তো কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই জবা দিবাকে নিয়ে এ কক্ষেই আসবেন। এই ক’টা সেকেন্ড যেন তারিকের কাছে কয়েক বছর সম মনে হচ্ছে। তারিক একবার উঠে দরজা পর্যন্ত যেতে চেযেছিল। শেষ পর্যন্ত বিষয়টি জবা ও নাহিদ বুঝে ফেলবে ভেবে আর যায়নি। মোবাইল ফোনে দিবার কণ্ঠ আগের মতোই মিস্টি মনে হয়েছে। ২০ বছর পর তার চেহারা কেমন হয়েছে তা দেখার আগ্রহ তারিকেরও থাকার কথা। কিন্তু এই মুহূর্তে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চিন্তাই করছেন তারিক। 
প্রায় মিনিট খানেক পরই তারিকের অপেক্ষার পালা শেষ হয়। জবা দিবাকে নিয়ে আসে তাদের কক্ষে। নাহিদ তখন বিছানায় শুয়ে বালিশের উপর হাত রেখে অর্ধ শোয়া ছিলেন। দিবাকে দেখে চমকে উঠেন তিনি। তারিকও চমকান। তবে নাহিদের মতো নয়। 
১৯

দিবাকে চিনতে পেরে নাহিদের মনে হাহাকার করে উঠে। মনে পড়ে যায় ২১ বছর আগের কথা। দিবা চুলের ভেতর চিরুনী চালিয়ে একদিন অনেক সোহাগ করেছিল নাহিদ আহমেদকে। তখন দিবার কোলে ছিল তার মাথা। দিবা উপুর হয়ে নাহিদ আহমেদের ঠোটে লম্বা একটা চুমু  একে দিয়েছিল। নাহিদ তখন  দিবার পিঠে দু’হাত রেখেছিলেন। দিবা সেদিন কি সুখ পেয়েছিল জানে না নাহিদ। দিবা নাহিদের বুকের উপর থেকে বুক সরিয়ে পশমের মধ্যে অনেক্ষন ধরে হাত চালিয়েছিল। এ সময় নাহিদের সারা শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যায়। এর পর শুধু দু’জনের গোঙানোর শব্দ। জবার সঙ্গে ঘর সংসার করলেও সেই গোঙানোর শব্দ এখনো নাহিদ আহমেদকে তারিয়ে বেড়ায়। দিবার গায়ের গন্ধে সেদিন বিমোহিত হয়েছিল নাহিদ। সেই গন্ধ সে তার স্ত্রীর মধ্যে খুজে বেরিয়েছে কত। কিন্তু কোনদিন তার সন্ধান পায়নি। 
চুক্তি হয়েছিল সকাল ১০ টার দিকে। ওই সময় তারিক উপস্থিত ছিলেন। চুক্তির পর  কাজী অফিসে গিয়ে বিয়েটাও করেছিলেন তারা। সেখানেও এক মাত্র সাক্ষী তারিক। তখন কাজী অফিসের দু’জনকে স্বাক্ষী করে নিকাহ নামা লেখা হয়েছিল। 
দিবার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে নাহিদের। আইনত দিবা তার স্ত্রী। হোটেল কক্ষের বিছানায় যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নাহিদের চোখে ভেসে উঠে প্রথম স্ত্রী জবার মুখ। তার সঙ্গে বাসরের কথা মনে পরে যায়। কিন্তু আজ তিনি দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে বিছানায় যাচ্ছেন। প্রথম বারের মতো উচ্ছাস নেই। একেবারেই যেন নি¯প্রভ। 
নাহিদ দরজা আটকে দেওয়ার সময় বিছানার উপর বসে ছিল দিবা। হাতে কোন মেহেদী নেই। গায়ে নেই স্বর্নালংকার, বিয়ের পোশাক। অথচ বিয়ের সময় নাকি স্বর্নালংকার দিতে হয়। নাহিদ অবশ্য কিনে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু বাধ সাধে দিবাই। এটাতো শুধু চুক্তির বিয়ে। শুধু একটি বিশেষ প্রয়োজন মেটানোর  জন্য। তাতে এতো নিয়ম কানুন মানার কিছু নেই। 
নাহিদের মনে আছে, দরজা লাগিয়ে কাছে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দিবার চোখের দিকে তাকিয়েছিলেন তিনি। দেখেছিলেন চোখ কেমন ছলছল। পানির ভেতর দিয়ে চোখের তারা চোখে পড়ে নাহিদের। মায়াবী দুটো চোখ যেন তাকে অনেক কথা বলতে চায়। নাহিদ দিবাকে অনেক দিন ধরে চিনে। কিন্তু তার চোখ যে, এতো সুন্দর, মায়াবী তা একবারও চোখে পড়েনি। চোখে চুমু খেতে নাহিদের লোভ হয়। কিন্তু নিজেকে সামলে নেন। 
কি বলে কথা শুরু করবেন তা খোজে পান না নাহিদ। দিবাও একই রকম। এর পরওতো তাদেরকে কথা বলতে হবে। ভাড়া করা হোটেল কক্ষটিও ছেড়ে দিতে হবে। কারন এই হোটেলের কক্ষটি তিন ঘন্টার জন্য ভাড়া করেছে তারা। ভাড়াটাও তারিকই করে দিয়েছে। 
কোন কথা না পেয়ে নাহিদ দিবার গালে হাত বুলায়। দিবা উপরের দিকে নাহিদের মুখের দিকে তাকায়। দু’জনের মুখই মলিন। এক সময় নাহিদ কিছুই না বলে দিবাকে আদর করতে শুরু করে। দিবা এর মানে জানে। সে জন্যইতো সে হোটেল কক্ষে এসেছে। নাহিদ যখন উত্তেজিত দিবা তখন শুধু শরীরটা এলিয়ে দেয়। 
ঘন্টা তিনেক আগেই হোটেল কক্ষ ছেড়ে যার যার বাড়িতে ফিরে যায় নাহিদ ও দিবা। দিবা যখন বাসায় ফিরে তখন বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যার দিকে যাচ্ছে সূর্য। তার এতো বড় একটা ঘটনা ঘটে গেছে তা বাসার কাউকে বুঝতেই দেয়নি। তার মা শুধু জানতে চেয়েছিল এতো দেরী হলো কেন? সে তখন বান্ধবীর কথা বলে কাটিয়ে গিয়েছিল সহজেই। 
রাতে যখন ইংরেজী প্রশিক্ষন কোর্সের বইটা হাতে নিয়ে পড়তে যায় তখনি মনে পড়ে নাহিদের কথা। রাত ১০ টা বাজে। নাহিদ এখন কি করছে?  নিশ্চয়ই তার স্ত্রী জবাকে নিয়ে হাসি তামসা করছে। কিন্তু পড়ন্ত দূপরে নাহিদ তার সঙ্গে যা করেছে সেটা কি রং তামসা?
নাহিদ যখন তাকে আদর করছিল তখন তারতো মোমের মতো গলে যাওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু কেন গলে গেল সে। নাহিদ মুখটা তার দিকে এগিয়ে দিতেই তার কেন ইচ্ছে করেছিল ঠোটে ঠোট রাখতে? সেওতো নাহিদকে ধরে কম জোরে চাপাচাপি করেনি। তা হলে কি সে নাহিদকে ভাল বেসে ফেলেছে। না চুক্তি অনুযায়ী ভালবাসা যাবে না। শুধু শরীর দেওয়া যাবে। 
নাহিদ এক বিকেলে সংসদ ভবনের পাশ দিয়ে হাটছিলেন। তার সামনে দিয়েই যাচ্ছিল দু’জন নারী গার্মেন্টস কর্মী। ঠিক সমান্তরাল রাস্তার উল্টো পাশে হেটে যাচ্ছিল দুই তরুনী। তাদের দু’জনের পরনেই ছিল হাতাকাটা সালোয়ার। ফলে শ্যামলা চেহারা হলেও পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষন করতে ব্যর্থ হয়নি তারা। নাহিদ আহমেদেও দু’বার দেখেছিলেন তাদের। ঠিক ওই সময় তার কানে আসে দুই গার্মেন্ট কর্মীর বক্তব্য। এক গার্মেন্ট কর্মী হাতাকাটা তরুনীদের দেখিয়ে জানতে চায় এরা কি করে। তখন অপর কর্মী বলতে থাকে বুঝস না। তারা টাকার বিনিময়ে মানুষের বিছানায় যায়।
‘ছি, ছি।’ তার ছি ছি শুনে যেন খুশি হতে পারেনি ওই গার্মেন্ট কর্মী। সে বলতে থাকে-
‘ওরাই ভাল আছে।’ এবার বিস্মিত হওয়ার পালা ওই গার্মেন্টস কর্মীর।
‘আরে কস কি তুই’। 
‘ঠিকই কই। আমরা সকাল ৮ টার সময় গার্মেন্টেসে ঢুইকা রাত ৮ পর্যন্ত কাম করি। বিনিময়ে পাই মাস শেষে ১৫ শ থাইকা ২ হাজার টাকা। আর এরা কোন পরিশ্রম ছাড়াই প্রত্যেক মাসে হাজার হাজার টেহা কামাই করতাছে। আমাগো যারা বড় অফিসার হেরা আমাগো দিয়া কাজ করাইয়া নিয়া টাকা কামাই কইরা ওই সব মাইয়াগো পিছে খরচ করতাছে। এইটা কি একবার ভাইবা দেখছস। আরেকটা জিনিস ভাইবা দেখ হেরাও তো রোজ রাইতেই মজা পাইতাছে। টাকার অভাবে রিক্সায় যাইতে না পাইরা হাইটা বাসায় যাইতাছি।’
কথা গুলো কষ্ট দেয় নাহিদ আহমেদকে। অল্প শিক্ষিত গার্মেন্ট কর্মীর মনের কষ্টটা নিজের মতো করে বুঝার চেষ্টা করে নাহিদ।
নাহিদের মনে পরে সে যা করছে তাওতো হাতাকাটা ওই দুই তরুনীর মতোই। দিবার সঙ্গে বিছানায় যাওয়ার আগে তাকে পতিবার কয়েক হাজার টাকা হোটেল ভাড়া গুনতে হয়। কিন্তু দিবাকেতো সে এক টাকা দিয়েও কিছু কিনে দেয়নি। সেতো তার বিবাহিত স্ত্রী। তারতো তাকে কিছু দেওয়া দরকার। কিন্তু কিছু দিতে গেলে যদি আবার দিবা মাইন্ড করে বসে তাও তাকে ভাবিয়ে তুলে। হাতাকাটা তরুনীদের সঙ্গেতো আর দিবাকে তুলনা করা যায় না। এতোক্ষন গার্মেন্ট কর্মীদের  কষ্টের কথা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল নাহিদের। এবার তার হাসতে ই্েচছ করলো। একেবারে অটটহাসি। কিন্তু লোকজন কি ভাববে সেটা ভেবে তা থেকে বিরত থাকে নাহিদ। 

উপরে