Main Logo
আপডেট : ১১ মার্চ, ২০২৪ ০৮:৫২

ধারাবাহিক উপন‍্যাস (শেষ পর্ব)

গহীনে নীল

বেলায়েত হোসেন

গহীনে নীল
সুমন দেশে ফিরে যথারীতি অফিসে যোগদান করে। কিন্তু তার মন পড়ে রয়েছে তুফানীর কাছে। তুফানীকে নিয়ে সুমনের মনোজগতে কতোরকমের স্বপ্নের আনাগোনা। চোখের সামনে ভেসে বেড়ায় রঙিন পাপড়িতে গাঁথা কাঙ্ক্ষিত মালা বদলের মধুময়ী দৃশ্য। অফিসে যোগদান করার পরও ছুটির জন‍্যে সপ্তাখানেক অপেক্ষা করতে হয় সুমনকে।কিছুতেই মানছে না মন! প্রবাসের সময়টা যেভাবেই হোক কেটেছে। কিন্তু দেশে ফিরে সময় কিছুতেই কাটতে চাইছে না। সুমনকে একটা অস্থির সময় পার করতে হচ্ছে ।
 
সুমন দেশে ফিরেছে সংবাদ পেয়ে তুফানীর হৃদয়ের নৌকায় পাল উড়ে। প্রতীক্ষার যবনিকায় উল্লাসের রঙ লাগে। মেঘ শেষের আলো মেলে তুফানীর মনের আকাশ জুড়ে। নিসৃত নিঃশ্বাসে ভেসে বেড়ায় সুখের ঘ্রাণ। এ যেনো এক অপূর্ব স্বাদের মিশ্রণ।
 
সময়ের কাঁটা সহসাই এগিয়ে চলছে। অতিক্রম করেছে  নিয়মের ঘর। সুমনের ছুটি মিলেছে যথারীতি। পুরো এক সপ্তাহের ছুটি পায় সে। হাজির হয় তুফানীর কাছে। ছুটির সবটুকু সময় তুফানীর সাথেই একত্রে কাটাতে চায় সুমন। 
 
সুমনের উপস্থিতি তুফানীকে মোহাবিষ্ট করে তোলে! সুমনও তাই । দু'জনই চায় একে অপরকে আরো কাছে পেতে। খুব কাছে। নিয়মের বেড়াজালে আটকে যায় তারা। বিয়ের সার্টিফিকেট ছাড়া প্রাপ্ত বয়স্ক দু'জন মানুষের একত্রে  বসবাস, অবাধে চলাফেরা, তার কোনোটাই বৈধতায় স্বীকৃত নয়। চলমান সমাজ তা কোনোভাবেই মেনে নেবে না। তা ছাড়া তাদের রয়েছে ধর্মের ভিন্নতা। লোকসমাজের সম্মুখে কতোদিনই বা নিজেদের এ বিষয়টা আড়াল করে রাখবে? তুফানী খুব ভাবনায় পড়ে যায়। 
 
সুমন মরিয়া হয়ে ওঠে প্রণয় থেকে পরিণয়ের সুখ নিতে। তুফানী নানাভাবে বুঝাতে থাকে সুমনকে। একটা নিয়মের পথে এগোবার জন্য। কারণ দু'জন দুই ধর্মের মানুষ। দুজনকেই যে কোনো এক সারিতে অবস্থান নিতে হবে। তুফানী সুমনকে কয়েকটাদিন সবুর করতে বলে। পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝেশুনে এগোতে চায় তুফানী। কিন্তু সুমন এসব নিয়মের তোয়াক্কা করতে চায় না। তার চিন্তায় পৃথিবীতে সবাই রক্তমাংসের মানুষ। সবার গায়ের রক্তের রঙই এক। সেখানে ধর্মের কোনো পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায় না। ধর্মের দোহাই দিয়ে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ তৈরি কেনো? তুফানী সুমনকে নানাভাবে বুঝিয়ে চলছেই। তুফানী বলে-এই রীতি আমাদের তৈরি নয়। এটা চলে আসছে অনাদিকাল থেকেই। আমরা এর বাইরে যেতে পারি না। সুমন তার নিজ গোঁড়ামিতেই অটল। সুমনের এমন পাগলামো দেখে তুফানী একটু বেশিই বেকায়দায় পড়ে যায়। তুফানী এ অবস্থাতে কী করবে তা কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে অবশেষে গোপনে শ্রাবণীকে খবর দেয়। শ্রাবণী খবর পেয়ে তার দুই বান্ধবী বীথি এবং ঋতুকে সাথে নিয়ে সোজা চলে আসে তুফানীর বাড়িতে। 
 
ঋতু এবং বীথি সুমনের আসল পরিচয় জানে না। শ্রাবণী এসে তুফানীকে কানে কানে বলে দেয় সুমন যেন তার আসল পরিচয় গোপন রাখে। নইলে ঝামেলা হতে পারে। শ্রাবণী এখানকার পরিস্থিতি বুঝে দুই তিনজন ছেলে বন্ধুর নাম দিয়ে ঋতু এবং বীথিকে পাঠায় তাদেরকে নিয়ে আসার জন্য। এই ফাঁকে সুমন, তুফানীর বান্ধবী হিসাবে শ্রাবণীকে অনুরোধ জানায় তুফানীর সাথে তার বিয়ের ব্যবস্থাটা দ্রুত সম্পন্ন করে দিতে। সুমন শ্রাবণীকে চিনে না। শ্রাবণী সুমনের সামনে আসার পর তুফানী তার বান্ধবী হিসাবে পরিচয় করিয়ে দেয় সুমনের সাথে। এর বাইরে সুমন আর কিছু জানে না। শ্রাবণী ভেবেছিলো সুমন তাকে চিনবে। না চিনলেও অন্তত শ্রাবণীর নামটি শুনে একটু হলেও ভাববে। কিন্তু না, অবশেষে তার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত হলো। সুমনকে এতো বছর পর সামনাসামনি পেয়েও শ্রাবণী তাকে আজ আর কিছুই বলার সুযোগ নেই। সে আজ তার না। সুমন ভুলে গেছে আদি আকাশের সীমানা। যেখানটায় ছিলো তার অবাধ বিচরণ। সে এখন তারই বান্ধবীর আকাশের নক্ষত্র হয়ে আলো ছড়াচ্ছে । বিধির কী নির্মম খেলা, যে খেলায় হেরে গিয়ে শ্রাবণী আজ তারই নিজ হাতে বরণ ডালা সাজাচ্ছে সুমন ও তুফানীর জন্য। শ্রাবণীর ভেতরে কষ্টের চাপা শ্বাসটা শেষ পর্যন্ত ভেতরেই চাপা রয়ে গেলো। পথ খুঁজে  পেলো না বেরুবার। 
 
শ্রাবণী দু'জনের উদ্দেশ্যেই বলে, দু'জন যেহেতু দুই ধর্মের অনুসারী, সেখান থেকে যে কোনো একজনকে ছাড় দিয়ে বেরিয়ে আসতে হবে। নইলে কাজটি সম্পন্ন করা সম্ভব হবে না। সুমন শ্রাবণীকে প্রশ্ন ছুঁড়ে বলে-কেনো সম্ভব হবে না? আমরাতো সবাই মানুষ। তাহলে সম্ভব হবে না কেন? শ্রাবণী উত্তরে জানায়-আমরা মানুষ ঠিকই, তবে বিয়ের ব্যাপারে দুই ধর্মেই সামাজিক কিছু রীতিনীতি আছে। সেগুলো অনুসরণ করতে হয়। নইলে বিপরীত পক্ষ বাধা হয়ে দাঁড়াবে। দু'জনই বিষয়টি গভীরভাবে উপলব্ধি করে। তাদের ভালোবাসা অটুট রাখতে গিয়ে তুফানী আগ বাড়িয়ে শ্রাবণীকে জানায়, আমি আপাতত ধর্ম বিচ্যুতি ঘটাতে চাই না। কারণ, প্রথমত কাকাবাবুর বাড়িভিটা ঠিক রাখতে হবে। কাকাবাবুর প্রয়াণের পর অনেক ঝক্কিঝামেলা পার করে মাতব্বরের নিকট থেকে বাড়িভিটা নিজ দখলে এনেছি। এখন আমাদের এই বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেলে মাতব্বর আবারও কোনো সুযোগের পথ তৈরি করে বসবে। দ্বিতীয়ত এখানে আমার শৈশব কেটেছে, বড় হয়েছি, একটা পরিবেশ গড়ে উঠেছে। হুট করে ধর্মান্তারিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে না। সুমনকে এখাখকার কেউ ভালোভাবে চিনে না। তাই পরিচয়টা গোপন রেখেই আমাদের বিয়ের ব্যবস্থাটা সেরে দে। পরবর্তীতে আমরা আমাদের মাঝে পরামর্শ করে প্রচলিত আইনি ব্যবস্থায় আমাদের সমস্যাটা সমাধান করে নেবো। সুমনও তাতে মত দেয়।
এরই মধ্যে ঋতু এবং বীথি, তাদের বন্ধুদেরকে নিয়ে হাজির হলে, কথামতো বিয়ের কাজটি সম্পন্ন করতে সকলে মিলে রওয়ানা হয় মন্দিরের উদ্যেশ্যে। নিজ গ্রামে ঝামেলা হতে পারে ভেবে হাজির হয় অন্য গ্রামের একটি মন্দিরে। সেখানকার পুরোহিত মশাইকে বিয়ের ব্যবস্থা করতে বলে। পুরোহিত মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে বিয়ের আসর বসায়। বিষয়টি এককান দুইকান করে করে গ্রামের অনেকের কানে পৌঁছে যায়। তা নিয়ে পাড়াপ্রতিবেশীদের মাঝে সমালোচনার ঝড় ওঠে। শেষাব্দি মাতবর নিরঞ্জন বাবুর কানেও পৌঁছে যায় সুমন তুফানীর বিয়ের খবর।
 
মাতব্বর নিরঞ্জন বাবুর মনে তুফানীর প্রতি ভেতরে পোষা প্রতিশোধের পুরোনো আগুন পুনরায় জ্বলে ওঠে। মাতব্বর তার দলবলসহ বিয়ের আসরে গিয়ে হাজির। মাতব্বরকে দলবলসহ বিয়ের আসরে হাজির হতে দেখে সুমন ও তুফানী চমকে ওঠে। কারণ দু'জনই মাতব্বরের পুরোনো শত্রু। মাতব্বর ব্যঘ্র গর্জনে বলে ওঠে-আজ দুজনকেই হাতের নাগালে পেয়েছি। এক ঢিলে দুই পাখি শিকার করে নেবো। কারো মুখে রা নেই। সবাই তখন নিশ্চুপ হয়ে আছে। মাতব্বর হুঙ্কার ছেড়ে বলে-এই বিয়ে বন্ধ করো। মাতব্বরের চোখেমুখে আগুনের ফুল্কি উড়ে। এ অবস্থা দেখে জীবন বাঁচাতে বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়ে যায় পুরোহিত। এদিকে মাতব্বরের দলবল ঝাঁপিয়ে পড়ে তুফানী ও সুমনের উপর। শুরু হয় এলোপাতাড়ি মারপিট। তুফানীকে বাঁচাতে মারপিটের মাঝখানে গিয়ে তুফানীকে ঝাপটে ধরে থাকে শ্রাবণী। হুলস্থুলের মধ্যে একটা লাঠির আঘাত এসে শ্রাবণীর মাথায় পড়ে। শ্রাবণীর চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসতে থাকে। আস্তে আস্তে সে আসরের নীচে পড়ে যায়। শ্রাবণী শরীরের শেষ শক্তির বিনিময়ে শুধু চিৎকার করে এইটুকুই বলে-সুমন তুফানীকে বাঁচাও। আমি তোমাদের শেষ রক্ষা করতে পারলাম না। তুফানী খুব দুঃখী মেয়ে। তাকে তুমি সুখ দিও। তোমরা দুজনকেই আমি খুব ভালোবাসি। তোমরা ভালো থেকো এপার ওপারে। কথাটুকু বলার সাথে সাথে শ্রাবণী জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। মুখ দিয়ে ফেনা বের হতে থাকে। আর কিছুই বলতে পারে না  শ্রাবণী।
সুমন শ্রাবণীর বন্ধুদের নিয়ে মাতব্বরের
লোকবলের সাথে জীবন বাজি রেখে লড়ে যাচ্ছে। হঠাৎ চোখ যায় তুফানীর দিকে। চেয়ে দেখে তুফানীকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে লম্পট মাতব্বর। সুমন যেই মাতব্বরের হাত থেকে তুফানীকে রুখতে যায়! ঠিক তখনই পেছন থেকে একজন এসে সুমনকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে উপুর্যুপরি আঘাত করতে শুরু করে। সুমন একপর্যায়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। সুমনের এ অবস্থা দেখে তুফানী সুমন সুমন বলে চিৎকার করতে থাকে! সুমনও একইভাবে তুফানী তুফানী করে চিৎকারে আকাশ বাতাস ভারী করে তোলে। সুমন আর শক্তি পায় না ওঠে দাঁড়াবার। অধিক রক্তক্ষরণের ফলে সুমনের সারা শরীর শীতল হয়ে আসতে থাকে। এ অবস্থায় তুফানী  মাতব্বরের হাত থেকে ছুটতে না পেরে কৌশলে মাতব্বরের গোপন জায়গায় লাথি মারে। লাথির চোটে মাতব্বর তুফানীর হাত ছেড়ে কুঁকড়ে যায়। তুফানী সুযোগ বুঝেই মাতব্বরের আরেক হাতে থাকা ছুরিটা নিয়ে মাতব্বরের তলপেটে ঢুকিয়ে দেয়। মুহুর্তেই মাতব্বরের প্রাণ বায়ু উড়ে যায় ।  
সুমনের মুখের উচ্চারণে শুধুই তুফানী। তুফানী দৌড়ে এসে হাঁটু গেড়ে বসে সুমনকে কোলে তুলে বুকে জড়িয়ে নেয়। সুমন তুফানীর বুকে মাথা বেখে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে-আমি চলে যাচ্ছি তুফানী। তোমার ভালোবাসার স্বপ্ন পূরণের শেষ ইচ্ছাটুকু রক্ষা করতে পারলাম না। ওরা ধর্মের মই টেনে আমাদের বুকভরা স্বপ্নগুলো অকালেই ধুলোয় মিশিয়ে দিলো। বুকের পাঁজর সরিয়ে দেখো যেখানে সাজিয়েছিলাম তোমার আমার স্বপ্নবাসর। যেখানে মিলিত হবার কথা ছিলো দু'জনের। পাষণ্ডের দলেরা কথিত সমাজধর্মের দোহাই দিয়ে আমাদেরকে আলাদা করেছে। আবার জন্মিলে মানুষ হবো। অনন্ত অসীমে হারাবো দু'জন। যেখানে থাকবে না কোনো ধর্মের আস্ফালন। থাকবে না সমাজের চোখ রাঙানি। 
কথাগুলো বলতে বলতে সুমনের কণ্ঠ ভারী হয়ে আসে । ঠোঁটের শেষ উচ্চারণে সুমনের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়- তুফানী তোমায় বড্ড বেশি ভালোবাসি। 
I love you Tufanee. I love you...
তুফানী সুমনের শেষ কথাগুলো নির্লিপ্ত হয়ে শোনে। তুফানীর চোখের জলের ধারা সুমনের মাথায় ঝরে পড়ে । ক্ষতস্থানের রক্তের ধারায় জলের মিশ্রণে রক্ত-জলের বন্যা বইতে থাকে চারপাশে। দিনশেষের সূর্যটা তখন ক্লান্তির রেশ টেনে পশ্চিম আকাশের সীমানা পেরোয়। 
তুফানী সুমনের কপালে এক টুকরো চুম্বন এঁকে দেয়- সুমনের ভালোবাসায় ভালোবাসার রঙ মিশিয়ে বলে উঠে- I love you too sumon. I love you too.  তুফানীর মুখ থেকে মধু ঝরানো উচ্চারিত শব্দটি সুমনের কানে মিষ্টি ঝঙ্কার তোলে। ঠোঁটের কোণ বেয়ে উড়ে যায় এক চিলতে হাসি। তার পাখায় ভর করে পাড়ি জমায় সুমনের প্রাণ বায়ু,অসীমের ঠিকানায়। 
 
এদিকে তুফানীর হাতে পরানো হাতকড়া যেনো, ফর্সা হাতের নীল চুড়ির মতো গহীনে নীল হয়ে আছে....
উপরে