ধারাবাহিক উপন্যাস- পর্ব-০৬
নিশিকথা
ওমর ফারুক
পত্রিকা অফিসের পিএবিএক্সের কর্মী জলিল একটু রগচটা টাইপের। প্রথম দুই তিন ঘন্টা ভালোই সামলায়। কিন্তু এরপর থেকেই মেজাজ গরম হতে থাকে। ফোনের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। যন্ত্রণায় অতিষ্ট হয়ে ওঠে সে। তখন মানুষের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতেও ছাড়ে না। তার বস ফোন করতে পারে সে বিষয়টিও তার মাথায় থাকে না। এ কারণে তিনবার তার চাকরি যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। কিন্তু সিনসিয়ারিটির কথা বিবেচনায় এনে তাকে ক্ষমা করে দেয়া হয়।
আজও তার মেজাজ গরম। ধরিয়ে দেন বিজ্ঞাপনের ছবির মেয়েটির নাম কি, কেন তাকে ধরিয়ে দিতে হব, এই মেয়ের কি অপরাধ ইত্যাদি প্রশ্ন করে পাঠকরা অতিষ্ট করে তুলছে। জলিল মনে মনে ভাবছিল যদি কোন ক্রাইম রিপোর্টার অফিসে চলে আসতো , তা হলে অনেকটা সামাল দেয়া যেত। কারণ বিষয়টা ক্রাইম রিলেটেড।
আর ক্রাইম রিলেটেড না হলেও এ ধরনের ফোন জলিল ক্রাইম ডিপার্টমেন্টেই পাঠায়। এ জন্য তাকে ধমকও খেতে হয়। এরপরও নিজে না সামলে ক্রাইম রিপোর্টারের ওপরই ছেড়ে দেয়ার পক্ষপাতি সে। তাদের অফিসে ক্রাইম রিপোর্টারা বিকার ৪ টার আগে আসে না। এখন বাজে দুপুর ১২ টা। আরও চার ঘন্টা পর আসবে তারা। এতক্ষণ সে কিভাবে সামলাবে, চিন্তায় পড়ে যায়।
জলিল নিজেও পত্রিকায় ছবিটার দিকে তাকিয়ে দেখে ফোন রিসিভের ফাঁকে ফাঁকে। সে বুঝতে পারছে এটা একটা বিজ্ঞাপন। কোনো প্রতিষ্ঠান দিয়েছে। সে সংবাদপত্রে প্রায় এক যুগ কাটিয়ে দিয়েছে অথচ এমন বিজ্ঞাপন আগে কখনো দেখেনি। কেউ কাউকে ধরিয়ে দেয়ার বিজ্ঞাপন দিলে সেখানে বিজ্ঞাপন দাতা প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির নাম ছাড়া হয়। কোন কোন বিজ্ঞাপনে পুরষ্কারের ঘোষণাও থাকে। কিন্তু এতে কিছুই নেই। শুধু পত্রিকা অফিসের বিজ্ঞাপনের একটি নাম্বার দেয়া আছে। কিছুক্ষণ মেয়েটির দিকে তাকিয়ে সে দ্রুত পত্রিকা ভাঁজ করে ফেলে। ভয় পেয়ে যায়। মনে পড়ে তার পঞ্চম শ্রেণী পড়ুযা মেয়ের কথা।
গত বছর পত্রিকার প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে একটি পাঁচতারা হোটেলের বলরুমে তারও থাকার সুযোগ হয়েছিল। ওই দিন পুরনো এক বান্ধবীর সঙ্গে দেথা হয়ে যায় জলিলের। একে অপরকে চিনতে পারছিল না। এ কারণে দু'জন দু'জনার দিকে অনেক্ষণ তাকিয়ে ছিল। বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর একজন আরেকজনকে চিনতে পারে। বান্ধবী আগ বাড়িয়ে এসে বলে - হায় তুমি জলিল না? জলিল বলে তুমি জুলি না? এরপর দু'জন হ্যান্ডশেকও করে।
হ্যান্ডশেক শেষ করে জলিল তার মেয়েকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য পাশে তাকায়। দেখে তার মেয়ে নেই। বেশ চিন্তায় পড়ে যায় সে। জলিল ও জুলি অনুষ্ঠানস্থলে অনেক্ষণ মেয়েকে খােঁজে। কিন্তু পায়নি। অবশেষে অনুষ্ঠান উপভোগ না করেই ক্লান্ত অবসাদ মন নিয়ে বাসায় ফেরে জলিল। বাসায় গিয়ে মেয়ে হারানোর কথা বলার আগেই , তার স্ত্রী তাকে দেখে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে। বলে সে মেয়ে মানুষের সঙ্গে হাসি তামাশা করে। আজ মেয়ের কাছে ধরা পড়েছে। কথাটা শুনে জলিলের মনে কিছুটা স্বস্থি ফিরে। তা হলে তার মেয়ে হারিয়ে যায়নি। সে বাসায় চলে এসেছে।
স্ত্রী বলে তার মেয়ে যদি ওই অনুষ্ঠানে না যেত তা হলে বিষয়টা জানতেই পারতো না। সেদিন অনেক্ষণ স্ত্রীকে বুঝিয়েছিল বিষয়টি। কিন্তু তার স্ত্রী দু'দিন পর্যন্ত তার সঙ্গে কথা বলেনি। এরপর থেকেই জলিল কোন নারীকে তাকিয়ে পর্যন্ত দেখে না। আর যতটা পারে নিজের মেয়েকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। মেয়েও তাই। কখনো কখনো সামনে পড়ে গেলে লজ্জায় মুখ ঢাকে জলিল।
সেদিন জলিল তার স্ত্রীকে বলেছিল, জুলি আর সে একই কলেজে পড়েছে। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে জুলি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। তার আর পড়া হয়ে ওঠেনি। জুলি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে এখন বড় চাকরি করছে। ফার্স্টক্লাস অফিসার। এতদিন পর পর তার সঙ্গে অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছে। একে অপরে বর্তমান পরিচয় জনেছে। জলিল সামান্য একটা টেলিফোন অপারেটর এ কথা শুনেও তাকে জুলি তুচ্ছ করেনি। বরং তার ভিজিটিং কার্ড দিয়ে বলেছিল তার সঙ্গে দেখা করার জন্য। সুযোগ পেলে তাকে একটা ভালো কাজ জুটিয়ে দেবে।
ভালো কাজের কথা শুনলে সব সময়ই খুশী হয় তার স্ত্রী। কিন্তু এদিন আর তার চোখ নেচে ওঠেনি। তা দেখে জলিল খুব একটা অবাক হয়নি। সে বুঝেছে তার হ্যান্ডশেক বান্ধবী তাকে চাকরি দিক এটা তার পছন্দ নয়। বরং স্ত্রী বলেছিল- আদার বেপারি জাহাজের খবর নেওয়ার দরকার নাই। যেখানে আছ সেখানেই কাজ করো।
তখন রসিকতা করে জলিল স্ত্রীকে বলেছিল- দেখাে আদার বেপারীদেরই কিন্তু জাহাজের খবরাখবর রাখার কথা। তুমি কি জানো এখন দেশে বেশিরভাগ আদা জাহাজে করে বিদেশ থেকে আসে। তা হলে জাহাজের খবর কে রাখবে এই টেলিফোন অপারেটর নাকি আদার বেপারী। জলিলের কথা শুনে মুড অফ স্ত্রী হেসে ফেলেছিল।
পরে জানায় বান্ধবীর সঙ্গে হ্যান্ডশেকের বিষয়টি তার মেয়ে সহজভাবে নেয়নি। তাই সে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে তার মায়ের কাছে অভিযোগ করে বাবার চরিত্র নিয়ে। এখনো কোন সুন্দরী নারীকে দেখলেই জলিলের সেই কথাটি মনে পড়ে যায়।
আজও নিশির ছবিটি দেখে ওই ঘটনা মনে পড়তেই দ্রুত পত্রিকাটি ভাঁজ করে রেখে দেয় সে। তার মনে হচ্ছিল, মেয়েটির ছবি দেখার সময় তার কন্যা পেছন থেকে দেখে তার মায়ের কাছে দৌড়ে যাচ্ছে।
চলবে....