Main Logo
আপডেট : ১৪ মে, ২০২৪ ১০:৩১

ধারাবাহিক উপন্যাস- পর্ব- ২৬

নিশিকথা

ওমর ফারুক


নিশিকথা

দিবাকে দেখতে পেয়ে নাহিদের মনে হাহাকার। মনে পড়ে যায় ২১ বছর আগের কথা। দিবা চুলের ভেতর চিরুনী চালিয়ে একদিন অনেক সোহাগ করেছিল নাহিদকে। তখন দিবার কোলে ছিল তার মাথা। দিবা উপুর হয়ে নাহিদ আহমেদের ঠোটে লম্বা একটা চুমু এঁকে দিয়েছিল। নাহিদ তখন দিবার পিঠে দু'হাত রেখেছিলেন। দিবা সেদিন কি সুখ পেয়েছিল জানে না নাহিদ। দিবা নাহিদের বুকের উপর থেকে বুক সরিয়ে পশমের মধ্যে অনেক্ষন  ধরে হাত চালিয়েছিল। এ সময় নাহিদের সারা শরীরে বিদ্যুত খেলে যায়। এরপর শুধু দু'জনের গোঙানোর শব্দ। 
জবার সঙ্গে ঘর সংসার করলেও সেই গোঙানোর শব্দ এখনো নাহিদ আহমেদকে তাড়িয়ে বেড়ায়। দিবার গায়ের গন্ধে সেদিন বিমোহিত হয়েছিল নাহিদ। সেই গন্ধ স্ত্রীর মধ্যে খুঁজে বেরিয়েছে কত। কিন্তু কোনোদিন তার সন্ধান পায়নি। 
চুক্তি হয়েছিল সকাল ১০ টার দিকে। ওই সময় তারিক উপস্থিত ছিলেন। চুক্তির পর কাজী অফিসে গিয়ে বিয়েটাও করেছিলেন তারা। সেখানে একমাত্র সাক্ষী তারিক। তখন কাজী অফিসের দু'জনকে স্বাক্ষী করে নিকাহ নামা লেখা হয়েছিল। 
দিবার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে নাহিদের। আইনত  দিবা তার স্ত্রী। হোটেল কক্ষের বিছানায় যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নাহিদের চোখে ভেসে উঠে প্রথম স্ত্রী জবার মুখ। তার সঙ্গে বাসরের কথা মনে পড়ে। কিন্তু আজ তিনি দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে বিছানায় যাচ্ছেন। প্রথমবারের মতো উচ্ছ্বাস নেই। একেবারেই নিস্প্রভ।
নাহিদ দরজা আটকে দেয়ার সময় বিছানার উপর বসেছিল দিবা। হাতে কোনো মেহেদী নাই। গায়ে নেই স্বর্ণালংকার, বিয়ের পোশাক। অথচ বিয়ের সময় নাকি স্বর্ণালংকার দিতে হয়। নাহিদ অবশ্য কিনে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু বাধা দেয় দিবা। এটাতো চুক্তির বিয়ে। শুধু একটা বিশেষ প্রয়োজন মেটানোর জন্য। তাতে এত নিয়ম মানার কিছু নেই। 
নাহিদের মনে আছে, দরজা লাগিয়ে কাছে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দিবার চোখের দিকে তাকিয়েছিলেন। দেখেছিলেন চোখ কেমন ছলছল করছে। পানির ভেতর দিয়ে চোখের তারা চোখে পড়ে নাহিদের। মায়াবী দুটো চোখ যেন তাকে অনেক কথা বলতে চায়। নাহিদ দিবাকে অনেকদিন ধরে চিনে। কিন্তু তার চোখ যে এতো সুন্দর এত মায়াবী তা একবারও এর আগে চোখে পড়েনি। চোখে চুমু খেতে নাহিদের লোভ হয়। কিন্তু নিজেকে সামলে নেয়।
কি বলে কথা শুরু করবেন তা খুঁজে পাচ্ছিলেন না নাহিদ। দিবাও একই রকম। এর পরওতো তাদের কথা বলতে হবে। ভাড়া করা হােটেল কক্ষটিও ছেড়ে দিতে হবে। কারণ এই হোটেল কক্ষটি তিন ঘন্টার জন্য ভাড়া করা হয়েছে। ভাড়াটাও তারিকই করে দিয়েছে। 
কোন কথা না পেয়ে নাহিদ দিবার গালে হাত বুলায়। দিবা উপেরর দিকে নাহিদের মুখের দিকে তাকায়। দু'জনের মুখই মলিন। এক সময় নাহিদ কিছুই না বলে দিবাকে আদর করতে শুরু করে। দিবা এর মানে জানে। সে জন্যইতো সে হোটেল কক্ষ পর্যন্ত এসেছে। নাহিদ যখন উত্তেজিত দিবা তখন শুধু শরীরটা এলিয়ে দেয়। 
তিন ঘন্টা শেষ হওয়ার আগেই হোটেল কক্ষ ছেড়ে যার যান বাড়িতে ফিরে যায় নাহিদ ও দিবা। দিবা যখন বাসায় ফিরে তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার দিকে যাচ্ছে সূর্য। তার এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেছে, তা বাাসর কাউকে বুঝতে দেয়নি। তা মা শুধু জানতে চেয়েছিল এত দেরি হলো কেন? সে তখন বান্ধবীর কথা বলে কাটিয়ে গিয়েছিল সহজেই।
রাতে যখন ইংরেজী কোর্সের বইটা হাতে নিয়ে পড়তে যায় তখনি মনে পড়ে নাহিদের কথা। রাত ১০ টা বাজে। নাহিদ এখন কি করছে? নিশ্চয়ই তার স্ত্রী জবাকে নিয়ে হাসি তামাসা করছে। কিন্তু পড়ন্ত দুপুরে নাহিদ তার সঙ্গে যা করেছে সেটা কি তামাশা?
নাহিদ যখন তাকে আদর করছিল, তখন তার তো মোমের মতো গলে যাওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু কেন গলে গেল সে। নাহিদ মুখটা তার দিকে এগিয়ে দিতেই তার কেন ইচ্ছে করছিল ঠােঁটে ঠোঁট রাখতে? সে-ও তো নাহিদকে ধরে কম জোড়ে চেপে ধরেনি। তা হলে কি সে নাহিদকে ভালোবেসে ফেলেছে। না চুক্তি অনুযায়ী ভালোবাসা যাবে না। শুধু শরীর দেয়া যাবে।
নাহিদ এক বিকালে সংসদ ভবনের পাশ দিয়ে হাঁটছিলেন। তখন তার সামনে দিয়েই যাচ্ছিল দু'জন নারী গার্মেন্ট কর্মী। ঠিক সমান্তরাল রাস্তুর উল্টোপাশে হেঁটে যাচ্ছিল দুই তরুণী। তাদের দু'জনের পরনে ছিল হাতাকাটা পোশাক। ফলে শ্যামলা চেহারা হলেও পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়নি তারা। নাহিদ আহমেদও দু'বার দেখেছিলেন তাদের। ঠিক ওই সময় তার কানে আসে দুই গার্মেন্ট কর্মীর বক্তব্য। এক গার্মেন্ট কর্মী আরেক গার্মেন্ট কর্মী হাতাকাটা তরুণীদের দেখিয়ে জানতে চায় এরা কি করে। তখন অপর গার্মেন্ট কর্মী বলতে থাকে - বুঝস না? তারা টাকার বিনিময়ে মানুষের বিছানায় যায়।
ছি, ছি।
ছি ছি শব্দ শুনে খুশি হতে পারেনি অন্য গার্মেন্ট কর্মী। সে বলতে থাকে-
ওরাই ভাল আছে। 
এবার বিস্মিত হওয়ার পালা ওই গার্মেন্ট কর্মীর।
আরে কস কি?
ঠিকই কই। আমরা সকাল ৮ টার সময় গার্মেন্টেসে ঢুইকা রাত ৮ টা পর্যন্ত কাম করি। বিনিময়ে পাই মাস শেষে ১৫শ' থাইকা ২ হাজার টাকা। আর এরা কোনো পরিশ্রম ছাড়াই প্রত্যেক মাসে হাজার হাজার টেহা কামাই করতাছে। আমাগো যারা বড় অফিসার হেরা আমাগো দিয়া কম করাইয়া টাকা কামাই কইরা ওই টাকা এইসব মাইয়াগো পিছে খরচ করতাছে। এইটা কি একবার ভাইবা দেখছস। আরেকটা জিনিস ভাইবা দেখ, হেরাওতো রোজ রাইতেই মজা পাইতাছে। আর আমরা টাকার অভাবে রিক্সায় যাইতে না পাইরা হাইটা যাইতাছি। 
কথাগুলো কষ্ট দেয় নাহিদ আহমেদকে। অল্পশিক্ষিত গার্মেন্ট কর্মীর মনের কষ্টটা নিজের মতো করে বোঝার চেষ্টা করে।
নাহিদের মনে পড়ে সে যা করেছে তাওতো হাতাকাটা ওই দুই তরুণীর মতোই। দিবার সঙ্গে বিছানায় যাওয়ার আগে তাকে প্রতিবার কয়েক হাজার টাকা হোটেল ভাড়া গুনতে হয়। কিন্তু দিবাকে তো সে এক টাকা দিয়েও কিছু কিনে দেয়নি। সে তো তার বিবাহিত স্ত্রী। তার তো তাকে কিছু দেওয়া দরকার। কিন্তু কিছু দিতে গেলে যদি দিবা মাইন্ড করে। তাও নাহিদকে ভাবিয়ে তুলে। হাতাকাটা তরুণীদের সঙ্গে তো দিবাকে তুলনা করা যায় না। এতক্ষন গার্মেন্ট কর্মীদের কষ্টের কথা শুনে মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল নাহিদের। এবার তার হাসতে ইচ্ছে করলো। একাবারে অট্টহাসি। কিন্তু লোকজন কি ভাববে, সেটা ভেবে তা থেকে বিরত থাকে নাহিদ।

চলবে..

উপরে