Main Logo
আপডেট : ৪ জানুয়ারী, ২০২৪ ১১:০১

আজকের গল্প

সন্দেহ বাতিক

তফিল উদ্দিন মণ্ডল

সন্দেহ বাতিক
আপনাদের নিশ্চয়ই শরৎচন্দ্রের'সতী'গল্পের কথা মনে আছে। সেই যে কন্যা স্বামীগৃহে যাওয়ার আগে কানে কানে মন্ত্র  শিখিয়ে দেয়া হয়েছিল-পুরুষ মানুষকে চোখে চোখে না রাখলেই গেলো। এই মন্ত্রগুণে বেচারা উকিল সাহেব দাম্পত্য জীবনে কেমন নাকানি চুবানি খেয়েছিলেন তা হয়ত আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
আমার ক্ষেত্রে ঘটনাটা তেমন নয়। মন্ত্র টন্ত্র শেখানোর কোন ব্যপার নেই। তারপরও যা ছিলো তার কাছে মন্ত্রগুণ সামান্যই। সারাজীবন আমি একটি চাঁদনামা মাদুলিতে ভরতি ছিলাম এবং মাদুলিটি আমার অতি পতিপরায়না স্ত্রী প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে জপমালার মত গলায় ঝুলিয়ে
রেখেছেন। 
পতির পৌরুষগুণে পত্নী উল্লসিত হন। তা হবারই কথা কিন্তু সমস্যাটা তখনই বাঁধে যখন সেই পৌরুষেয় গুণে অপরাপর স্ত্রীলোক মুগ্ধ হয়। মোদ্দা কথা পতির পৌরুষে মুগ্ধ হওয়ার অধিকার শুধু মাত্র স্বীয় পত্নীরই আছে বেগানা স্ত্রীলোকের নেই।
এই দৃঢ়তর অধিকার আপনার শ্যালিকার ক্ষেত্রেও।একই রকম।কেননা,স্ত্রী বর্তমানে
শ্যালিকাও বেগানা।
পরম সৃষ্টিকর্তার অপার করুণায় আমি যৌবনে সুদর্শন পুরুষ ছিলাম। বিধাতা আমাকে সৃষ্টি করার সময় বিস্মৃত হয়েছিলেন যে পুরুষের সৌন্দর্য এবং পৌরুষ বাস্তব জীবনে তার অশান্তিরও কারণ হতে পারে। বলছি একারণে যে, আমার স্ত্রীরত্নকে নিয়ে আমি যদি কখনও বাইরে বেড়াতে যেতাম তখন লক্ষ্য করতাম স্ত্রী রত্নটি চারপাশের বেগানাদের চোখের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। পাছে তাদের সুনয়নের দৃষ্টিবাণে তার পতিদেব বিদ্ধ হয়ে অকালে হাতছাড়া হয়ে যান। তার পতিদেব খাঁদে পড়ে পা ভাঙলেও বেগানা কাউকে সাহায্যে এগিয়ে আসতে দিতে নারাজ।
আমার শ্যালিকার তখন বিয়ের কথা হচ্ছিলো । আমার স্ত্রীর সামনেই আমি শ্যালিকাকে জিজ্ঞেস করলাম, তোর কেমন বর পছন্দ। শ্যালিকা চট জলদি বলে ফেলল- আপনার মত। এই সাদামাটা প্রশ্নোত্তরের মাঝে এত ঝড়ো হাওয়া লুকিয়ে ছিলো তা জানা থাকলে শ্যালিকা বানরের মতো বরকে পছন্দ করুক আমি তাতে কিচ্ছু বলতে যেতাম না।
    সন্ধ্যার পর স্ত্রীর মুখখানা থমথমে মেঘের মতো। আচার ব্যবহারে হাড়ি পাতিলের অনাবশ্যক ঝনঝনানি। বাক বচনে স্তব্ধতা।  অনুমান করতে পারছিলাম, ১৮০ মাইল বেগে ভয়াবহ রকমের ঝড় উঠতে যাচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে ভীত হন না এমন পুরুষ মানুষ বিধাতার রাজ্যে বিরল। পুরুষ মানুষকে ভীতি বিষয়টা উপলব্ধি করানোর জন্যই বোধকরি বিধাতা স্ত্রী নামক অত্যাবশ্যক পদার্থখানা সৃষ্টি করেছেন। আমি স্ত্রীর কথা বলছি নারীর কথা নয়। আমার এই সংক্ষিপ্ত জীবনে বুঝতে পেরেছি যে, সকল স্ত্রীই যদি নারী হতো তাহলে স্বর্গলোক পরিত্যক্ত সরকারি গুদামের মত খালি পড়ে থাকত।
শ্যালিকা আমার মতো বর কামনা করে তাতে আমার দোষটা কোথায় বা শ্যালিকারই বা দোষ কোথায়। অথচ এই সরল বিষয়ের মধ্যেও সন্দেহ এসে উঁকি দিচ্ছে। স্ত্রী লোকের চোখের জানালায় সন্দেহের যাতায়ত অবারিত।
 বিবাহ সম্পর্কে আমার নিজস্ব একটা  ধারণা ছিলো। আর সে ধারণা সংস্কৃত কাব্য পাঠের প্রভাবেই হয়েছিলো। প্রমথ চৌধুরী ঠিকই বলেছিলেন, পৃথিবীর সকল সাহিত্য হচ্ছে জীবনের সমালোচনা আর সংস্কৃত সাহিত্য হচ্ছে যৌবনের সমালোচনা। জীবনে যৌবনকে প্রলম্বিত করার জন্য সংস্কৃত কাব্য তাই অল্প বয়স থেকেই রতিচর্চার পরামর্শ দেয়। সেই পরামর্শকে অমোঘ মনে করে আমি বালকত্ব ঘুচে যাবার আগেই বিবাহ কার্য সম্পন্ন করি।
সদ্যপ্রস্ফূটিত ফুলে মৌমাছি বসে যখন মধুর প্রাবল্যে হুশহারা হয়ে যায় বিবাহোত্তর কালে আমার অবস্থাও তেমনি হয়ে গেলো। ক্ষণিকের বিচ্ছেদও সহস্র বছর মনে হতো। একেবারে যেন ঘর হৈতে আঙিনা বাহির।
এমনই যখন হাল তখনই অনিচ্ছাকৃত প্রমাদটি ঘটে গেলো। আমার বন্ধু শহীদুল পত্রমিতালিতে আসক্ত ছিলো। সমস্যা হলো সে কিছুতেই প্রেমপত্র রচনা করতে পারতো না। ইচ্ছের পালে বাতাস যখন প্রবল তখন প্রেমের নদী খরতর। যে কোনো কিছুর বিনিময়ে তাকে প্রেমপত্র লিখতেই হবে। এটাই তার প্রতিজ্ঞা। 
শহীদুল কোনৌ এক ছুটির দিনে আমার রুমে এলো। রুমে সিনিয়র রুমমেটরা থাকায় সে তার মনের কথা বলতে পাচ্ছিল না। অনেকক্ষণ একথা সে কথা বলার পর আমাকে কানে কানে বললো- চল না একটু লালবাগ থেকে ঘুরে আসি। ঠিক তখনই সিনিয়র রুমমেট দুজন বাইরে চলে গেলো। এবার শহীদুল হাফ ছেড়ে বাঁচলো।
সে আমাকে বললো- দেখ, আমি তো চিঠি লিখতে পারি না। জীবনে বাবার কাছে টাকা চেয়ে চিঠি লেখা ছাড়া আর কোন রকম চিঠিপত্র লিখি নি। এখন আমার ইচ্ছে পত্রমিতালি করি। সাপ্তাহিক বিচিত্রা থেকে কয়েকটি মেয়ের  ঠিকানাও সংগ্রহ করে রেখেছি। এখন তুই যদি আমার হয়ে চিঠি লিখে দিস তাহলে আমার মনের সাধ পূরণ হয়। তোর ভাষা, হাতের লেখা সবই খুব সুন্দর। 
আমি শহীদুলের এমন অদ্ভুত শখ দেখে না হেসে পারলাম না। আমি বললাম, আমি রাজি তবে শর্ত আছে। 
- কী শর্ত?
-প্রতিদিন খাওয়াতে হবে এবং আমার যতো চিঠি সেগুলোর যতো ডাকটিকিট লাগবে সব তোকে দিতে হবে। শহীদুল হো হো করে হেসে বললো- এটা একটা কথা হলো ? আমি রাজি।
তখনও আমি জানতাম না কতবড় বিভ্রাটের বীজ আমি বপন করতে যাচ্ছি। 
কথামত আমি তার প্রেমপত্র লেখার মুন্সির দায়িত্ব নিয়মিত পালন করতে লাগলাম। 
আগেই বলেছি সংস্কৃত সাহিত্যের প্রভাবে যৌবনরস দীর্ঘ সময় ধরে উপভোগ করার জন্য ছাত্রাবস্থাতেই বিয়ের পাট চুকিয়ে ফেলি। তাই স্ত্রীকে পত্রলেখা আমার একরকম রুটিন ওয়ার্ক হয়ে গিয়েছিলো। 
ভুলবশত একদিন শহীদুলের জন্য লেখা প্রেমপত্র স্ত্রীর খামে পুরে ফেলি এবং যথারীতি ডাকবাক্সে ফেলে আসি। পরে যখন স্ত্রীর পত্রখানা টেবিলের উপর দেখতে পাই তখন আমার পিলে গড়বড় হয়ে যায় এমনকি ব্রহ্মতালু গরম হয়ে উঠে। এখন আর ব্রহ্মতালু গরম হলেই কী আর সান্নিপাত হলেই কী। একা একা বসে এখন কম্পজ্বরে ভুগতে শুরু করেছি।
এ মহাপ্রমাদের পর যখন শ্বশুরালয়ে গিয়েছি তখন কী অবস্থা হয়েছিলো তা অনুমানের ভার যারা পড়বেন তাদের উপরই ছেড়ে দিলাম। আমার কলমের সাধ্য নেই সে ঘোরতরকৃষ্ণ মেঘাচ্ছাদিত পরিস্থিতির কথা বর্ণনা করা। সে যাত্রায় বহুবাক্য ব্যয় করে বিশ্বাসটুকু হারানো ছাড়া মোটামুটি অক্ষতই পার পেয়েছিলাম।
সন্দেহ বাতিক তাদের মজ্জায় মজ্জায় প্রবাহিত। সে প্রবাহ কখন যে কোন ঘটনায় তীব্রতর হয় তা বলা মুশকিল। 
যেমন ভদ্রলোক সস্ত্রীক ট্রেনে যাচ্ছেন। ভদ্রলোক অতিমাত্রায় তাম্বুলগ্রাহী। যেতে যেতে সামনের সিটের মহিলা ভদ্রলোককে বললেন- আপনি তো দেখছি খুব পান খান। ভদ্রলোক বললে- হ্যা, বলতে পারেন পানাসক্ত মন পান চর্বনে আসক্ত।  মহিলা বললেন-না, আপনার পান খাওয়াটা একটু নবাবী ঘরানার। তা ছাড়া আপনি পান খেলে ঠোঁট দুটো লাল টকটকে হয়ে যায়। দেখতে খুবই সুন্দর লাগে।
ভদ্রলোক ভদ্রতাবশে বললেন-আপনি কি এক খিলি পান খাবেন? যদি খান আপনাকে এক খিলি পান দিয়ে আমি ধন্য হই। মহিলার জিহ্বাও এতক্ষণ লকলক করছিলো কিন্তু শরমে বলতে পাচ্ছিলেন না। ভদ্রলোকের প্রস্তাব পেয়ে মহিলা সহাস্যে বলে উঠলেন-আপনাকে ধন্য হওয়া থেকে আমি কী করে বঞ্চিত করতে পারি বলুন।
ঘটনা এইটুকুই। এত ছোট্ট ঘটনায় যে এত বেশি প্রতিক্রিয়া হতে পারে তা হয়তো ভদ্রলোকের ধারণায় ছিলো না। ভদ্রলোক তার স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে আৎকে উঠলেন। এক আকাশে আর কত কালো মেঘ জমে। তার চেয়েও পাঁচগুণ মেঘ ভদ্রলোক তার স্ত্রীর মুখে জমে উঠতে দেখলেন। নিজের সম্ভাব্য বদনসীব সাক্ষাৎ সামনে দেখতে পেলেন।
তার ধারণা সত্য। মহিলাটি তার গন্তব্যে নেমে যাবার পর ঘূর্ণিঝড় শুরু হয়ে গেলো । ভদ্রলোকের চরিত্র শুধু নয় তার চৌদ্দ গোষ্ঠীর চরিত্র নিয়ে টানা হ্যাচরা শুরু করলো। মহিলা কেন তাকে বললো- পান খেলে তার মুখ টকটকে লাল হয় আর কেনই বা অত সোহাগ করে পান বানিয়ে দিতে হলো ?মেয়ে লোক দেখলে বুঝি মাথা ঠিক থাকে না? চোখের দৃষ্টিটা এখন ঠিক করা উচিৎ। 
ভদ্রলোক আর কী করবেন। নীরবে সকল গঞ্জনা সহ্য করলেন। কেবল মনে মনে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করতে লাগলেন,হে খোদা পরপারে যদি বেহেশতে পাঠাও আমাকে একা পাঠিও। কারণ এই বাস্তব অভিজ্ঞতা ছাড়াও তার একটা গল্প মনে পড়ে গিয়েছিলো। 
এক লোক ঘরে স্ত্রীর যাতনা সহ্য করতে না পেরে গৃহত্যাগী হয়েছিলো। সারাদিন ঘুরতে ঘুরতে মনস্থির করলো যে রাতটা কোন এক হোটেলেই কাটিয়ে দেবে। ঘুরতে ঘুরতে এক হোটেলর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। হোটেলওয়ালা অত্যন্ত আদরের সাথে তাকে আসুন ভাই আসুন। আমাদের  হোটেলে একেবারে পারিবারিক আরামে থাকতে পারবেন। লোকটি চিৎকার করে বলতে লাগল- আরে বেটা, পারিবারিক আরাম থেকে নিস্তার পাবার জন্যে এলাম হোটেলে। এখানেও সেই পারিবারিক আরাম? যা শালা!  গাছতলাতেই শুয়ে থাকব তবু পারিবারিক আরামে নয়।
 
     
উপরে