Main Logo
আপডেট : ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪ ১০:১৬

আজকের রম্য গল্প

হাফবিল্ডিং থেরাপি

তফিল উদ্দিন মণ্ডল

হাফবিল্ডিং থেরাপি
বহুদিন পর সেদিন বাঁশ কিনতে গিয়ে কেঁকড়া সালামের কথা মনে পড়লো। বলতে পারেন বাঁশের সাথে সালামের কি সম্পর্ক। অবশ্যই সম্পর্ক আছে। কিছু কিছু বাঁশ থাকে যেগুলোকে বামন বাঁশ বলা যায়। অঙ্কুরিত হওয়ার পর অন্য বাঁশগুলো স্বাভাবিক নিয়মে বাড়ে। আর দু একটার বৃদ্ধি স্বাভাবিক নিয়মে হয় না। সেগুলোর গাঁট হয় ঘন ঘন। তিন কি চার হাত পর্যন্ত লম্বা হয়ে আর বাড়ে না। গ্রামে গঞ্জে এসব বাঁশকে কেঁকড়া বাঁশ বলে।
 আমাদের সালামও তেমনি ছিলো। বয়সের তুলনায় সে বেড়েছিলো কম। তবু হয়তো তার নামের সাথে  কেঁকড়া বিশেষণটি যুক্ত হতো না কিন্তু একটি বিশেষ প্রেক্ষাপটে সেটা যুক্ত হওয়া ছাড়া আর বিকল্প ছিলো না।
গ্রামে দুজন সালাম ছিলো। তাই এই বামন সালামকে সহজে চেনার জন্য তাকে সবাই কেঁকড়া সালাম বলে ডাকতো। যদি কেউ তার সামনে কেঁকড়া সালাম করে ডাকতো তাহলে  ঝড়ের তাণ্ডব শুরু হয়ে যেতো। কেঁকড়া সালাম গায়ে গতরে আর কথার ছুরিতে তাকে ফালাফালা করে ফেলতো । অজস্র অনুচ্চার্য গালি গালাজের পর বলতো, এই শালার পো শালা,কেঁকড়া কেঁকড়া করস,কেঁকড়া কি তোর বাপ হয়?
কেঁকড়া সালাম খুবই সহজ সরল মানুষ। তাকে নিয়ে অনেকেই নির্মম মজা করতো। সে যখন ক্লাশ টেন এ পড়ে তখন সে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী প্রতিবেশী বিউটিকে  ভালবাসতো । এতই ভালবাসতো যে, যা কিছুই তার চোখে পড়তো সে বিস্ময়ের ভান করে বলতো, উহ্, বিউটিফুল। 
কেঁকড়া সালাম কেঁকড়া হলে কী হবে সে কিন্তু প্রেমের ক্ষেত্রে কেঁকড়া নয়। অত্যন্ত সিরিয়াস।
এই প্রেম তাকে কবি বানিয়ে ছাড়লো। সে বিউটিকে লক্ষ্য করে কবিতা রচনা করে। কবিদের মতো এই নব্য প্রেমিক কবিরও একটা বদ অভ্যেস আছে। তা হলো,কবিতা প্রসব করা মাত্র সেটা অপরকে শোনানো। কিন্তু তেমন বিশ্বস্ত বন্ধু তো চাই। কাকে শোনাবে সে কবিতা। অনেক ভেবে চিন্তে সে স্থির করলো তার রচিত কবিতা সাহাজুলকে শোনাবে। কেননা, সাহাজুল তার বাল্য বন্ধু এবং বিশ্বস্ত। এ পর্যন্ত সে যতো প্রেমপত্র বিউটিকে সাপ্লাই করেছে তার সবগুলোই সাহাজুল লিখে দিয়েছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো যে বুড়িকে সে আট আনা দশ আনা কররে পয়সা দিতো এবং বাজার থেকে কাল খয়ার, নুরানী জর্দা আর কিমাম কিনে দিতো সেই বুড়ি বেঈমানি করায় কোন পত্রই বিউটির হাতে পড়ে নি।
যাক, রাতে কেঁকড়া সালাম একটি কবিতা লিখেছে। এই কবিতা সম্পর্কে তার ধারণা এটাই তার শ্রেষ্ঠ রচনা। এমন একটি কালোত্তীর্ণ প্রেমের কবিতা বন্ধু সাহাজুলকে পড়ে শোনানোর জন্য সে ব্যকুল হয়ে উঠেছে।
স্কুল থেকে ফেরার পথে সাহাজুলকে সে কানে কানে বললো,দোস্ত, সরকার বাড়ির আমগাছ তলায় গিয়ে তুই বস আমার আসতে একটু দেরি হবে। বলেই সে,বাজারের দিকে চলে গেলো ।
সাহাজুল কথামতো আমগাছের নিচে বসলো।বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। কেঁকড়া সালাম পদ্মপাতায় মোড়ানো জিলিপি নিয়ে এসে সাহাজুলের সামনে মেলে ধরলো। বলল,জিলিপির দামটাও বেড়ে বারো আনা সের হয়েছে রে! নে,খা তাড়াতাড়ি। নারায়নের দোকানের জিলিপি।
সাহাজুল খেতে শুরু করলো। সে মনে মনে ভাবছে আজও বোধহয় প্রেমপত্র লিখে দিতে হবে। সে আপন মনে জিলিপি খেতে লাগলৌ। পরের উপর খেতে পারলে সাহাজুলের চাপা কখনও থামে না।গরুর জাবর কাটার মত সে চাপা নাড়তেই থাকে।
এবার কেঁকড়া সালাম বলে,শোন,আমি বিউটিকে নিয়ে একটা কবিতা লিখেছি।সাহাজুল বলল,তাই না কি? পড়ত শুনি। সাহাজুলের চালাকিটা হলো,কেঁকড়া সালাম কবিতা পড়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়ুক এই ফাঁকে সে জিলিপি গুলো খেয়ে শেষ করবে।
কেঁকড়া সালাম পকেট থেকে কাগজ বের করে পড়তে শুরু করে
বিউটি তুমি বিউটিফুল 
যেন তাজা গোলাপফুল 
সব সময় তোমায় দেখি
তাই আমি কবিতা লেখি।
গাল তোমার দুধের সর
বুকখানা কত ডাগর
কোন দিন তুমি আসবে কাছে
তোমার জন্য পরান নাচে।
সাহাজুল জিলিপি খাওয়ায় ব্যস্ত। কবিতার ঘূর্ণাক্ষরও তার কানে যায় নি। কিন্তু সে কেঁকড়া সালামের পিঠে হাত রেখে তার শার্টে হাত মুছতে মুছতে বলে, আহ! বেটা রবীন্দ্রনাথের ভাত মারবি তো দেখছি। এই কবিতার সামনে আমার চিঠি তো কিছুই না। এইটাই ঢেপার মাকে দিয়ে বিউটির কাছে পাঠিয়ে দে। প্রশংসায় কেঁকড়া কুঁকড়ে উঠলো । বলা বাহুল্য, সেদিন থেকে সাহাজুল প্রেম পত্র লেখা থেকে নিষ্কৃতি পেলো।
দীর্ঘদিন প্রেমপত্র লিখে,ঢেপার মায়ের পেছনে জর্দা কিমাম খরচ করেও যখন বিউটির দিক থেকে কোন সাড়া পেলয় না তখন কেঁকড়া সালাম অনেকটা হতাশ হয়ে পড়লো। কিন্তু আশা ছাড়ল না।
এরই মাঝে একরাতে বিউটি সুন্দরী কেঁকড়া সালামকে স্বপ্নে দেখা দিলো । সারারাত বিউটি তার সাথে ছিলো। কতো কথা,কতো গান,কতো কবিতা আর মনোভাবের যে ছড়াছড়ি হলো স্বপনে মজনু ও লায়লিকে নিয়ে এমন স্বপ্ন দেখেনি।
পরদিন বন্ধু সাহাজুলকে সে উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো,রাতে বিউটি এসেছিলো ।
সাহাজুল বললো,কোথায়,কিভাবে?
আরে স্বপ্নে এসেছিলো ।
সাহাজুল মনে মনে ভাবলো কেঁকড়ার পাগলামিটা পেকে উঠেছে।
সে রাতের পর থেকে কেঁকড়া সালাম বিউটিকে ঘন ঘন স্বপ্ন দেখে। প্রতিরাতে তো বটেই কোন কোন রাতে তিনবারও দেখা হয়। স্বপ্নে বিউটির সাথে কী কথা হয় তা সবিস্তারে বর্ণনা করে সাহাজুলের কাছে। 
একদিন সাহাজুল কেঁকড়া সালাম কে বলেই
ফেললো, কি রে,স্বপ্নে বিউটির সাথে কী শুধু আলাপ সালাপ ই করিস,?  না আরও কিছু হয়।
সাহাজুল প্রাণের বন্ধু হলেও এবার কেঁকড়া সালাম লজ্জায় চোখ ঢাকে। তারপর মৃদু হেসে বলে, ধ্যুর,সব কিছু কী আর বলা যায়? শরম করে না বুঝি?
 সাহাজুল বুঝতে পারে। কেনো যে কেঁকড়ার শরীর ধ্বসে যাচ্ছে, কেনো যে চোখ গর্তের মধ্যে ঢুকছে তা আর সাহাজুলের বোঝার বাকি রইলো না।
কয়দিন পর কেঁকড়া সালাম স্কুলে অনিয়মিত হয়ে পড়ে। একদিন যায় তো দুদিন যায় না। শরীরটাও শুকিয়ে গেছে। গাঁয়ের এফাজ কবিরাজের কাছ থেকে বলবর্ধক সালসার বোতল  কিনে খায়।শরীরে তবু আগের মতো আর বল পায় না।
একদিন সাহাজুল বললো, কি রে,তোর চামড়া তো হাড়ে ঠেকলো দেখছি। গালচাপা একেবারে সারিন্দার খোল হয়ে গেছে। ডাক্তার দেখা। দেরি না করে কালই কাসেম ডাক্তারের কাছে যাবি।
সাহাজুলের কথা মতো পরদিন সে হাড়গিলা বাজারে কাসেম ডাক্তারের কাছে যায়।
কাসেম ডাক্তার এলাকায় বিখ্যাত হোমিও চিকিৎসক। বিশেষ করে স্ত্রীরোগ সনাক্তকরণে তার জুড়ি মেলা ভার। শ্বেতপ্রদর,রক্তপ্রদর,অকালে হামিল গিরানোরোধ,বাধক ইত্যাদি কঠিন রোগ সে নিমেষেই নিরাময় করতে পারে। বাধকের কারণে মেয়েদের বন্ধ্যাত্ব হয় তাই মেয়েদের সে অগ্রিম চিকিৎসাও দিয়ে থাকে।
কাসেম ডাক্তারের বয়স হয়েছে। চোখের দৃষ্টিও ক্ষীণ হয়ে এসেছে। কানেও একটু কম শোনে। রোগী দেখে কথা খুব বেশি বলে না। তবে রোগীকে নেড়েচেড়ে দেখে।
কেঁকড়া সালামের চোখ দেখে সে আতকে উঠে। কি রে বেটা,তোর চোখ তো গবরাকানি পাখির চোখের মতো সাদা হয়ে গেছে। আর চেঙরা মানুষের চোখ এমন কলেরা রোগীর মতো গাতায় ঢুকছে কেন? বিয়ে করছস?
কেঁকড়া সালাম বলে, না।
শরীর কেমন লাগে?
খুবই দুর্বল। হাঁটতে হাঁইফাঁই করে।
ঘুম হয়?
গরুর মত সারারাতই ঘুমাই।
আজে বাজে স্বপ্ন দেখস?
সলজ্জ বিষণ্ণতায় কেঁকড়া সালাম বলে জি দেখি।
মেয়ে মানুষ দেখস না পুরুষ মানুষ? 
মেয়ে মানুষ।
ডাক্তার গম্ভীর হয়ে বলে হুম্ বুঝছি।
ডাক্তার তাকে বলবর্ধক মাদর টিংচার দেয়। এক বোতল আলফা টনিক দেয় আর বলে,প্রতিদিন একটা করে হাফ বয়েল খাবে।
বাড়িতে এসে কেঁকড়া সালাম নিয়মমত ঔষধ সেবন করে। কিন্তু আরেকটা যে কী খেতে বলল,সেটা সে বুঝতে পারে নি।
সাহাজুলকে জিজ্ঞেস করলো, সাহাজুল, কাসেম ডাক্তার যে আমাকে হাফ বিল্ডিং খেতে বললো এখন হাফ বিল্ডিং কোথায় পাই বল তো।
সাহাজুল বুঝতে পেরেছে। সে মনে মনে হাসে।সরলের উপর সহজ দুষ্টামির লোভটা সে সামলাতে পারে না। তাই সে বলে, আরে, হাফ বিল্ডিংয়ের কি অভাব না কি? ইউনিয়ন পরিষদের ঘরটাই তো হাফবিল্ডিং।
কেঁকড়া সালাম বলে, আরে, অতবড় বিল্ডিং খাব কি করে?
ধ্যেৎ শালা। ছেনি আর কাগজ নিয়ে যাবি। বিল্ডিংয়ের দেয়াল থেকে ছেনি দিয়ে চেঁছে চেঁছে গুড়াগুলো নিয়ে আসবি। এনে ওগুলো ডাক্তারের ব্যবস্থামত দিনে একবার খাবি।
সেই থেকে কেঁকড়া সালামের হাফবিল্ডিং খাওয়া শুরু। নিয়মিতই সে হাফবিল্ডিং খায় কিন্তু শরীরে তো শক্তি পায় না। অবশ্য বিউটি ইদানিং স্বপ্নে আর ঘন ঘন দেখা করতে আসে না। ডাক্তারের কাছে আসে সালাম।
ডাক্তার বললো, কি রে,তোর কি অবস্থা? 
কেঁকড়া সালাম বলে, ডাক্তার সাব, শরীরে তো বল পাই না। আপনার কথামতো হাফবিল্ডিং খেতে খেতে বিল্ডিংই তো প্রায় শেষ করলাম তবু তো শরীরে জোর আসে না।
ডাক্তার তাজ্জব হয়ে প্রশ্ন করে, কী খাইছস?
হাফবিল্ডিং খাইছি।
সেটা আবার কি জিনিস? 
দালানের গুড়া?
আরে গাধা,আমি বলছি হাফবয়েল ডিম খেতে।হাফবয়েল মানে আধাসেদ্ধ। ওটা তোকে কে খেতে বলেছে?
আমার বন্ধু সাহাজুল।
ওরে কাল নিয়ে আসিস। এমন বিলেত ফেরত ডাক্তার যে এলাকায় আছে তা তো জানতামই না। ওর কাছে ডাক্তারিটা কিছু শিখতে হবে। শালার বেটা,হাফবিল্ডিং থেরাপি দেয়।
কেঁকড়া সালাম তার বোকামিটা এতক্ষণে বুঝতে পারে। এবার সে চলে যেতে উদ্যত হয়।
ডাক্তার তাকে বলে,আর এই যে বেটা,বিউটিফুল মেয়েদের স্বপনে একটু কম দেখ,গায়ে জোর পাবি।হাফবিল্ডিং আর খেতে হবে না।
পথে হাঁটতে হাঁটতে কেঁকড়া সালাম ভেবে কুল পায়না। সে মনে মনে বলে, বিউটির নামটা ডাক্তার জানল কী করে। সে যে বললো, বিউটিফুল। 
 
 
উপরে