Main Logo
আপডেট : ২৯ জুন, ২০২৪ ১০:১৮

অদ্ভুত

তফিল উদ্দিন মণ্ডল

অদ্ভুত
অদ্ভুত শব্দটার প্রকৃত অর্থ কী তা আমার আজও বোধগম্য নয়। বস্তুগত, তত্ত্বগত এবং বিমূর্ত ভাবনায় অদ্ভুতের প্রকৃতি আমি বহু তালাশ করেও কোন কুল কিনারা পাই নি। মাঝে মাঝে মনে মনে ভেবেছি কোন বিজ্ঞ লোককে জিজ্ঞেস করি কিন্তু শব্দটি সম্পর্কে মানুষের ধারণা এমন যে,এত সাধারণ শব্দের অর্থ না জানাটা মূর্খতা বলেই মানুষ বিবেচনা করে। তাই কাউকে জিজ্ঞেস করে নিজের পাগলামি প্রকাশ করার আর ইচ্ছে 
করেনি।
তবে শব্দার্থশাস্ত্র বলে যে,অর্থের কোন অর্থ নেই। কোন শব্দের অর্থ নির্ভর করে শব্দটি প্রয়োগের প্রসঙ্গের উপর অর্থাৎ প্রসঙ্গই ঠিক করে দেবে শব্দটির অর্থ কি।আমি শুক্রবারে মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে বের হয়েছি। বের হয়ে বড় রাস্তায় উঠে দেখি সকল মানুষ থানার দিকে ছুটছে। বাঙাল হুজুগে মেতে উঠবে না তা কি কখনো হয়? আমিও ঘটনার কিছু না জেনেই হুজুগের স্রোতো গা ভাসালাম। মূল রাস্তা থেকে থানার দিকে যে রাস্তাটি ঢুকেছে সে রাস্তার কাছাকাছি একটা চায়ের দোকানে দু'তিনজন প্রবীণ লোক চা পান করছেন। তাদের দেখে আমি হাঁটার গতি মন্থর করলাম। পাছে তারা ভাবেন, আমিও ফচকিয়া পোলাপানের মত হুজুগে দৌড়াচ্ছি।
আমি তাদের কাছে গিয়ে বসলাম। এক কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে বসেছি ঠিক তখনই একজন প্রবীণ বললেন,কী অদ্ভুত ঘটনা। এমন অদ্ভুত ঘটনা বাপের জনমে শুনিনি। চলেন,দেখে আসি ঘটনাটা কী। বলেই তারা উঠে থানার দিকে চলে গেলেন। আমার মনে তখন সেই অদ্ভুত শব্দটি তুলকালাম করতে লাগল। তড়িঘড়ি চা পান করে থানার দিকে রওনা হলাম।
থানার সামনে অনেক লোকের জটলা।দেখি একজন অল্প বয়সী পুরুষ। মাথাটি ঘটোৎকচের ন্যায় কেশশূন্য। মাথাটি লাল রঙে রাঙানো। সাথেই মধ্যবয়সী এক মহিলা। খোলা মাথা। মাথার চুলগুলো বিশ্রী রকমের কাটা। এক তরুণী তাকে থেকে থেকে কিল ঘুষি দিচ্ছে এবং অনবরত নিষ্ঠি বনের বৃষ্টি ঝরাচ্ছে। তার ক্রোধরঞ্জিত মুখ থেকে নিঃসৃত একটি বাক্যই শুধু আমি শুনতে পেরেছিলাম। তা হলঃ মাগী,তোর এতই যদি খায়েশ তো তার কাছে আমারে বিয়া দিয়েছিলি কেন? তুই হাঙ্গা করতিস।
এতক্ষণে আমি বুঝতে পারলাম,ওই রসিকা স্ত্রীলোক শ্বাশুড়ি, তার তাগড়া জামাতার হাত ধরে রাতের আঁধারে নিরুদ্দেশ যাত্রা করেছে। বেরসিক পুলিশের বাগড়ায় শেষ রক্ষা হয়নি। ধরা পড়া এখন বাদী-বিবাদী সবাই থানায় তামাশার পাত্রে পরিণত হয়েছে। আর মহিলার মেয়েটি ছিন্নশির টেংরা মাছের মত তড়পাচ্ছে।
উপস্থিত সকলেই কী অদ্ভুত কী অদ্ভুত  বলে বিস্ময় প্রকাশ করছে। আমি মনে মনে হিসাব কষছি এটা কোন ধরনের অদ্ভুত? বিমূর্ত না মূর্ত।
 আর এক ধরনের অদ্ভুতের কথা বলি।
আমি আমার ঘরের বারান্দায় বসে প্রতিদিন আরামসে হুঁকা টানি এবংপত্রিকা পাঠ করি। বারান্দার গ্রীলগুলো ঘন নেটে আবৃত। তাই আমি বারান্দা থেকে দুনিয়া দেখতে পারি কিন্তু আমাকে বাইরে থেকে কেউই দেখতে পায় না।
প্রতিদিনের মত সেদিনও ইজিচেয়ারে বসে হুঁকা টানছি। কী কারণে সেদিন পত্রিকা আসেনি। তাই নিবিষ্ট মনে হুঁকার নেশায় আপন মনে বুঁদ হয়ে আছি। হঠাৎ আমার কানে কারো আলাপের অস্পষ্ট কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছি। হুঁকার শব্দে তেমন ভাল শুনতে পাচ্ছিলাম না তাই হুঁকার নলটি রেখে খরগোশের মত কান খাড়া করে বসলাম।
একজন তরুণী আর একজন মধ্যবয়স অতিক্রান্ত পুরুষ বারান্দায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে নিম্নকণ্ঠে কথা বলছে। যদিও অন্যের কথোপকথন এমন লুকিয়ে শোনাটা অপরাধ  কিন্তু  কৌতূহলের কাছে অপরাধবোধ পাত্তাই পেল না। আমি তাদের কথাবার্তা সবই শোনলাম। তাদের কথোপকথন এখানে হুবহু উদ্ধৃত করতে আমার শরম লাগছে বিধায় আমি সার সংক্ষেপ তুলে ধরছি।
বয়স্ক ভদ্রলোক একজন কবি। পরিচয়ের কোন এক পর্যায়ে ওই কবির কবিতার বিষয়বস্তু থেকে ভাবের সমস্ত কিছু তিরোহিত হয়ে যায়। তখন কবির কবিতার বিষয়বস্তু হয় ওই মেয়েটি। প্রকৃতির সকল উপাদানের সাথে সুন্দরী, চটপটে বালিকা প্রেমিকার তুলনা করাই কবির কবিতার মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।এভাবে চলতে চলতে কবির কবিতার বিষয়বস্তু সেই তরুণী এবং কবি ভাবের সমুদ্র থেকে উঠে আসে। এবং দুজনে রাত বিরেতে গহীন অরণ্যে বাৎসায়নের হাত ধরে মদন দেবের অর্চনায় লিপ্ত হয়।
ঘটনা তখনও অদ্ভুত পর্যন্ত গড়ায় নি।
কিছুদিনের মধ্যেই কবি লক্ষ্য করে যে,তিনি একাই শুধু ওই তরুণীর রূপরসগন্ধস্পর্শমাধুর্য নিয়ে কবিতা লিখেন না আরও অনেক কবি কবিতা লিখে। এমন কি অকবিরাও তরুণীর সৌন্দর্য দানে ধন্য হয়।
 কবির মনে তখন প্রবল হিংসা জন্ম নেয়।যে পাত্র কেবলই তার অন্য কারো নয়,যার সুধামাধুর্য আকণ্ঠ পান করার একমাত্র অধিকার সেই পুস্পে বিচিত্র ভ্রমরের গুঞ্জন কবিকে অস্থির করে তুলে।
কবি আত্মসান্ত্বনা খুঁজতে তখন তার তরুণী কাব্যভক্তের সাথে মদনচর্চার সুখস্মৃতিগুলো কবিতায় বর্ণনা করেন। তার বন্ধু সুজনদের সাথে সেই সব গোপন কলা রসিয়ে রসিয়ে বর্ণনা করেন। আর তরুণী ভক্তের উদ্দেশ্যে সে এক পেয়ে সুখী নয় একজনে তৃপ্ত নয় এমন মন্তব্য করতে থাকেন। তাতে দুজনের ভাবমূর্তি সংকটের যে সংশয় দেখা দেয় সেটা নিরসনের জন্যেই তাদের আজকের এই সাক্ষাৎ।
 আমি তাদের এই ঘটনা শুনে অজান্তেই উচ্চারণ করলাম কী অদ্ভুত।
তাদের কথা শুনে ফেলেছি বুঝতে পেরে তারা সেখান থেকে দ্রুত সটকে পড়লো।
আমিও অদ্ভুত শব্দের প্রকৃত অর্থ অনুসন্ধানে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।
উপরে