Main Logo
আপডেট : ৯ জুলাই, ২০২৪ ২৩:২৯

এনবিআরের মতিউরের বান্ধবীরও অঢেল সম্পদ

নিজস্ব প্রতিবেদক
এনবিআরের মতিউরের বান্ধবীরও অঢেল সম্পদ

যেন রূপকথার গল্প। একটি সরকারি চাকরি পেয়ে তাকে ব্যবহার করে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন আরজিনা খাতুন। তিনি এনবিআরের কর্মকর্তা। রাজস্ব বোর্ডের মূসক মনিটরিং, পরিসংখ্যান ও সমন্বয়ের দ্বিতীয় সচিব। এর আগে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের উপ-কমিশনার ছিলেন। গণমাধ্যমে খবর আসছে সেই আরজিনা খাতুন ছাগলকাণ্ডে ফেঁসে যাওয়া এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রহমানের ঘনিষ্ট বান্ধবী। মতিউরের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে তিনি অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
আরজিনার বাবার বাড়ি রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলার তালুকপাড়া গ্রামে। তার বাবা আহমেদ আলীর সংসার আগে মাছ শিকার আর চাষাবাদ করেই চলত।

দ্বিতীয় সচিব হিসেবে আরজিনা খাতুন চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে থাকার সময় কোটি কোটি টাকা অবৈধভাবে আয় করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ টাকায় তিনি ঢাকা ও রাজবাড়ীতে করেছেন স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি।  
গত ১০ জুন আরজিনার দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদের খতিয়ান তুলে ধরে দুদকে অভিযোগ জমা দেন এক ব্যক্তি।

দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) করা অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, রাজধানীতে ফ্ল্যাট, গ্রামে আলিশান বাড়ি, পরিবারের সদস্যদের নামে-বেনামে জমি, বাসায় বিলাসবহুল ইন্টেরিয়র এবং দামি সব আসবাবপত্র করেছেন আরজিনা।

ছাগলকাণ্ডে ফেঁসে যাওয়া মতিউর রহমানের সঙ্গে সখ্য ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ফোনালাপ ফাঁস হয়েছে এরই মধ্যে।  

দুদকে দেওয়া অভিযোগে বলা হয়েছে, আমদানি পণ্য খালাসের নামে আরজিনা কিছু ব্যবসায়ী ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিতেন। অনেক সময় পণ্য খালাস না হলেও ফেরত দিতেন না ঘুষের টাকা। এভাবে দুর্নীতির টাকায় তিনি গড়েছেন কোটি কোটি টাকার সম্পদ। একই সঙ্গে স্বর্ণ চোরাকারবারিদের সঙ্গে যোগসাজশে হাতিয়েছেন প্রায় ছয় কোটি টাকার স্বর্ণ।  

দুদকের কাছে অভিযোগ জমা পড়েছে, মাত্র তিন বছরে ৫০০ ভরি স্বর্ণালঙ্কারের মালিক হয়েছেন আরজিনা।

সম্প্রতি দুর্নীতি, অনিয়মের নানা অভিযোগ মাথায় নিয়ে গা ঢাকা দিয়েছেন আলোচিত কর্মকর্তা মতিউর। তবে আরজিনার সঙ্গে তার একটি ফোনালাপ ফাঁস হয়েছে। সেই ফোনালাপ থেকেই ছাগলকাণ্ডের মতিউরের সঙ্গে আরজিনা খাতুনের সম্পর্কের অনেক অজানা তথ্য উঠে এসেছে।

দুদকে দেওয়া অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, অবৈধ টাকায় ৫০০ ভরি স্বর্ণ কিনেছেন আরজিনা খাতুন। তার বার্ষিক আয়কর নথিতে উল্লেখ করেছেন, বিয়ের সময় ১০০ ভরি স্বর্ণ উপহার পেয়েছেন। কিন্তু তার কাবিননামায় এ স্বর্ণের কথা উল্লেখ নেই।  

আরজিনা আগে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের উপকমিশনার ছিলেন। এক বছর আগে চট্টগ্রাম থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে বদলি করা হয় তাকে। চট্টগ্রামে থাকা অবস্থায় তার ঘুষের টাকা লেনদেনের বাহক ছিলেন তার বন্ধু আবু তাহের, গাড়িচালক শাহাজাহান আকতার ও অফিসের পিয়ন মো. ইলিয়াস।
 
অভিযোগে আরও বলা হয়, আরজিনা ১০০ ভরি স্বর্ণ কিনেছেন ঢাকার রয়েল মালাবার দোকান থেকে। বাকি স্বর্ণ কিনেছেন ঢাকার আপন জুয়েলার্স ও ডায়মন্ড ওয়াল্ড দোকান থেকে। বর্তমানে এসব স্বর্ণের দাম অন্তত ছয় কোটি টাকা। দেশের বেশ কয়েকটি ব্যাংকের লকার ও দোকানে স্বর্ণগুলো বন্ধক রেখেছেন তিনি।

অভিযোগে আরও বলা হয়, ঢাকার মিরপুরে দুই কোটি টাকায় একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন আরজিনা খাতুন। কিন্তু কেনার চুক্তিনামায় উল্লেখ করেছেন এক কোটি ২১ লাখ টাকা। এছাড়া ফ্ল্যাট কেনার পর সেখানে ইন্টেরিয়র ডিজাইনের পেছনে খরচ করেছেন ২৭ লাখ টাকা, ফ্ল্যাটের ইলেকট্রনিক ও ফার্নিচারের পেছনে ব্যয় করেছেন ৩৫ লাখ টাকা। ফ্ল্যাট কেনার এক বছর পর তিনি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন।  

এছাড়া আরজিনার একটি প্রাইভেটকার থাকলেও ওই গাড়ি সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান ‘আনবি লজিস্টিক লিমিটেডে’র নামে রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছে। ওই সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ীও কাস্টমস কর্মকর্তার সঙ্গে দুর্নীতিতে জড়িত বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।

দুদকে দেওয়া অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, কাস্টমসে চাকরির আগে আরজিনা খাতুনের বাড়ি ছিল ২০ ফুটের একটি টিনের ঘর। সম্প্রতি তার গ্রামের বাড়িতে ৯০ লাখ টাকায় করেছেন বড় দোতলা বাড়ি। আসবাবপত্র ও ইলেকট্রনিক খাতে ব্যয় করা হয়েছে আরও অন্তত ৩৫ লাখ টাকা।  

অভিযোগে বলা হয়, আরজিনা খাতুন ও তার গ্রামের মো. আবু তাহের বাল্যবন্ধু। আবু তাহের ঢাকায় এয়ারপোর্টের কাছে কাওলা এলাকায় ব্যবসা করেন। আরজিনা চট্টগ্রাম কাস্টমসে থাকার সময় পিয়ন ইলিয়াস ও তার গাড়িচালক শাহজাহান আকতারকে দিয়ে টাকা পাঠাতেন দুটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। একটি নিরো এন্টারপ্রাইজ, অপরটি বেঙ্গল ট্রেডিংয়ের নামে।  

অভিযোগে আরও বলা হয়, আরজিনা তার বাবা আলী আহমেদের কাছে টাকা পাঠাতেন। তিনি তিন কোটি টাকায় আপন দুই ছোট ভাইয়ের নামে ৪০ বিঘা জমি কিনেছেন। বর্তমানে সেখান থেকে ৩০ বিঘা জমি বন্ধক রাখা হয়েছে।

এসব অভিযোগের বিষয়ে আরজিনার গ্রামের বাড়ি বালিয়াকান্দি উপজেলার নারুয়া ইউনিয়নের তালুকপাড়া গ্রামের বাড়িতে কাউকে পাওয়া যায়নি।  

তালুকপাড়া গ্রামের বেশ কয়েকজন বলেন, আহমেদ আলী একজন দিনমজুর। মাছ শিকার ও চাষাবাদ করে সংসার চালাতেন। দুই ছেলে ও এক মেয়ে তার। দুই ছেলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে চাকরি করেন। আর মেয়ে আরজিনা খাতুন অল্প দিনেই অনেক সম্পদ গড়ে তুলেছেন। নারুয়া বাজারে জমি কিনে ঘর তুলে ভাড়া দিয়েছেন। বালিয়াকান্দি ও রাজবাড়ী শহরেও বাড়ি করেছেন। মাঠে ১০-১২ পাখি (এক পাখি=২২ শতাংশ) জমি কিনেছেন। ব্যাংকে টাকা আছে কি না বলতে পারব না। তবে তিন ছেলেমেয়ে চাকরি করার পর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আর্থিক অবস্থা পাল্টে গেছে।

নারুয়া বাজারের ঘরের ভাড়াটিয়া ব্যবসায়ী আরজু বলেন, আরজিনার ভাই মতিন ও মেহের সেনাবাহিনীতে চাকরি করেন। জানা মতে, মতিন মিশন থেকে ফিরে বাজারের জমি কিনে টিনের ঘর বানিয়ে ভাড়া দিয়েছেন।  

এ বিষয়ে আরজিনা খাতুন সাংবাদিকদের বলেন, আমি দুদকের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তারা অনেক বিচক্ষণ। তারা সব কিছু খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। আমি যদি অন্যায় করে থাকি, তাহলে শাস্তি পাব। ডিভোর্সের পর আমার সাবেক স্বামী আবু হেনা মো. রউফউল আজম এসব মিথ্যা অভিযোগ দিচ্ছেন। আমি এখন চরম অশান্তির মধ্যে রয়েছি। তবে দুদক ডাকলে তার জবাব দেব।

দুদক অভিযোগের অনুলিপি আরজিনাকে দিয়েছে বলে জানা গেছে। তবে এখনও আরজিনাকে ডাকা হয়নি। অভিযোগটি এখনও নথিভুক্ত না হলেও দুদক কর্মকর্তারা খোঁজখবর নিচ্ছেন বলে জানা গেছে।

উপরে