আজকের গল্প
সীম গাছ
তাছাদ্দুক হোসেন
বসতঘরের লাগুয়া রান্নাঘরের খড়ের চালে খুব যত্নে সীম গাছ তুলেছে রহিমা বেগম। বাঁশের আগানী বেয়ে লকলকিয়ে উঠে গেছে সীমগাছটি।
হালকা বাতাসে সীমপাতাগুলো দোলে উঠলে রহিমার মনেও দোল লাগে। টানাটানির সংসার টেনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে রহিমা আর তার স্বামী তালেব মিয়া। কাঠা তিনেক ধানী জমিতে যে ধান ফলে তা দিয়ে চারজনের সংসার কোনো মতেই চলে না। শাকসব্জি বিক্রিতে যে টাকা আসে তাতে বৎসর কোনোমতে চলে যায়। এই শীতে সীমগাছটিকে পরম মমতায় সন্তানের যত্নে বড়ো করে তুলছে। গাছের গোড়ায় মাদা বেঁধে রোজ পানি ঢালে। ফুলে ভরে গেছে সমস্ত গাছটি। রহিমার চোখে হাসির ঝিলিক। ফুল থেকে প্রচুর সীম ধরবে এবার। নিজে আর কয়টা খাবে।বাজারে বিক্রি করে এবার অনেক টাকা ঘরে আসবে। সুখে স্বাচ্ছন্দে এবার অনটনের সংসার ভরে উঠবে। বড়ো ছেলে জয়নালের লুঙ্গি ছিঁড়ে গেছে, মেয়ে আছিয়ার জামা,নিজের জন্যে বাবুর হাটের তাঁতের শাড়ি, মাথার ফিতা, ছায়া,ব্লাউজ।
নারকেল তেলের কৌটো কিনতে হবে একটা। মাথার চুলে হাতের আঙুল পড়তেই বিয়ের আগের কথা মনে পড়ে যায় রহিমার। রুক্ষ খসখসে চুলের স্বাস্থ্য আবার ফিরে আসবে এই স্বপ্নে বিভোর হয় রহিমা। মুখের লাবণ্য ফিরে আসবে স্নো, পাউডারের ছোঁয়ায়। ভাবতেই কেমন রঙীন সংসারের পরিপাটি নিঁখুত এক ছবিতে আচ্ছন্ন হয় রহিমা বেগম। সীমগাছের নীচে দাঁড়িয়ে এমনি ভাবছে ত্রিশ পেরুনো রহিমা। গাছের গোড়ায় নজর পড়তেই দেখে মাটি শুকিয়ে গেছে। সাথে সাথে প্লাস্টিকের বদনায় পানি এনে গাছের গোড়ায় ঢালে। শান্তির নিঃশ্বাস পড়ে তার।
রাস্তার পাশেই বাড়ি রহিমার। লোকজনের কথা কানে আসে। সীম গাছের প্রশংসা শোনে। ভালোই লাগে রহিমার। বদনজর লাগতে পারে এই ভয়ে মাটির পাতিলে কালি লেপে বাঁশের আগায় টাঙিয়ে দেয় যেন কারো নজর না লাগে।
তালেব মিয়া এ সবের খবর রাখে না বললেই চলে। নিজের জমিতে কাজ করে। এর বাইরে দিনমজুরও খাটে অন্যের বাড়ি। বাড়ি ফিরে ক্লান্ত দেহে নাকে মুখে কয়টা গুঁজে তেল ছিটছিটে বালিশে মাথা রেখে কাঠের চৌকিতে শান্তির ঘুম ঘুমায়।
সারাদিন কাজ শেষে তালেব মিয়া রহিমাকে ডাকতে ডাকতে সেদিন ঘরে ফিরতেই রহিমা তার পাশে এসে দাঁড়ায়। রহিমা উৎসুক কানে স্বামীকে
জিজ্ঞেস করে-
আজগুয়া আডঅ গেছলাইন?
-হ, কেন কি তা অইছে?
তালেব মিয়ার পাল্টা প্রশ্ন।
-আডঅ সিমুইট উঠছে? কয় টেহা সের?
উত্তরের জন্যে কান খাড়া করে রহিমা।
-উঠছে। একশ টেহা সের।
রহিমার চোখ ঝলসে উঠে। আশ্চর্য হয়।
-একশ টেহা? তা অইলেত এইবার আমরা ম্যালা টেহার সিমুইট বেচতাম পারবাম।
গামছায় বাঁধা চালের পুটলিটা রহিমার দিকে বাড়িয়ে তালেব মিয়া বলে-চাউলগুলি নাও। ভাত রাইন্ধ্যা আনো হগলে মিইল্যা খাই।
যেন শুনতেই পায় না রহিমা।
-আপনে এক কাম করবাইন কালকে পরতম সিমুইট মজজিদের ইমাম সাইবেরে দিয়া আইবাইন। হের পরে বাজারে লইয়া যাইবাইন।
-এই জয়নালের মা কি কইলাম আমি হুন নাই?
সম্বিত ফিরে আসে রহিমার। রহিমা চালের পুটলি হাতে নিয়ে আনন্দের বন্যা বইয়ে রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে যায়।
রাত পোহাতেই রহিমার আহাজারিতে তালেব মিয়া, ছেলে মেয়ে বাড়ির অন্যান্য সদস্যরা এসে রহিমার কান্নার কারণ খুঁজায় তৎপর হয়। এতোদিনকার তিলতিল করে যত্নকরা সাধের সীমগাছটির গোড়া কার রাক্ষুসে গরু এসে এক নিমিশে উপড়িয়ে দিয়ে গেছে। রহিমার গগণবিদারি বিলাপে সকলের চোখ আর্দ্র হয়ে আসে।
-