আপডেট : ১৯ নভেম্বর, ২০২৩ ০৯:৫২
আজকের গল্প
হারানো মানিক
তাছাদ্দুক হোসেন
গভীর রাত। বাইরে তুমুল বৈশাখী ঝড়। একটানা মুষলধারে বৃষ্টি। আকাশ ভেঙে বাদল ঝরছে। থামবার কোন লক্ষণই নেই। আলম চৌধুরী লেখার টেবিলে কলম হাতে লেখার খাতায় হিজিবিজি কাটে। লেখক চৌধুরীর বাজারে বেশ জনপ্রিয়তা।
ইতোমধ্যেই দুটো উপন্যাস বাজারে বেরিয়ে গেছে। বড়ো বড়ো লেখকের পাশাপাশি মোটামুটি
নামডাক আছে তার। কথাসাহিত্যের ফাঁকে মাঝেমধ্যে কবিতাও লিখেন, দৈনিক পত্রিকায় পাঠান, পত্রিকাওয়ালারা ছাপেনও। হাতে আসছে বাড়তি টাকা। বাড়তি আয় সংসারে যোগ হয় বলে
লেখা তাকে উৎসাহ দেয় বেশি বেশি করে লিখতে।
আলম চৌধুরী জানে পৃথিবীতে দারিদ্র্যকে পছন্দ করে না কেউ। অর্থহীন মানুষের যেমন দাম নেই:নামও নেই তেমনি। দাম এবং নাম দুটোই পাওয়ার জন্যে অর্থের পিছনে প্রাণান্ত ছুটছে আলম চৌধুরী।
জীবনের গল্প -গল্পের প্লট খুঁজছে লেখক। কাকে নিয়ে লেখা যায়-বৃষ্টিকে নিয়ে লিখবে....প্রকৃতির রূপ বদলের সাথে মানুষের রূপবদল কীভাবে ঘটে
এনিয়ে কী লেখা যায়? বৃষ্টি এলে মায়ের কথা মনে হয়। ব্যতিক্রম নয় আজও। মায়ের মায়াময় মুখটি মনে পড়ার সাথে সাথে বাবা, ভাই-বোনদের স্মৃতি
মনের মণিকোঠায় উঁকি মারে। শহরের নামকরা জাদরেল এডভোকেট আহমদ চৌধুরী। যেমন পসার তার-তেমনি ওকালতিতে কৃতিত্বের সাথে
অঢেল টাকার আমদানি। শুধু মানুষকে ভালোবেসে মানুষের মাঝেই তার অর্থের সিংহভাগ সাধারণ অসহায় মানুষদের পিছনেই বিলিয়ে দেন।
নিজের জন্যে-নিজের পরিবারের গুরুত্ব তার কাছে গৌণ ছিলো। এ গুণটি তিনি পেয়েছিলেন তার অর্ধশিক্ষিত সাক্ষর পিতার কাছ থেকে। নিজের সংসার ভেসে গেলো জলে- ভ্রুক্ষেপ নেই সেদিকে।
শুধুমাত্র নামী এডভোকেট আহমদ চৌধুরী তার মায়ের দিব্যি রাখতে গিয়ে মাথা গোঁজার এই চার কামরার হাফবিল্ডিং বাড়িটা সম্পন্ন করেছিলেন।
বাবাকে নিয়ে আলম চৌধুরীর নানান প্রশ্ন উঁকি দিয়েছিলো, এখনও দেয়- এতো টাকা কোথায় খরচ করতেন তিনি, কার-কাদের নিয়ে তার এই
আলো-আঁধারের খেলা ছিলো। বাবা গত হওয়ার আগে প্রায়ই কাছে ডেকে বলতেন -আলম, যতোদিন বাঁচবে একটা কথা মনে রেখো বাবা,মানুষকে কখনও কষ্ট দিও না,কুপথে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করোনা, না খেয়ে থাকলেও হাত পেতো না কারো কাছে,ন্যায়ের পথে, সত্যের পথে থেকো আজীবন।
বাবার এই সুপরামর্শগুলি, উপদেশগুলি অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে আলম চৌধুরী। যারপরনাই এই অভাব, স্বাচ্ছন্দ্যহীন এই জীবন, দারিদ্র্যের সাথে বসবাস।
মা-বোনকে খুব করে মনে পড়ছে। বড়ো আদরের ছোট বোন লাবনী চৌধুরী। পলি নামে চোখের মনিতে রেখে দিয়ছিলো সবাই। জীবনে ঘটে যাওয়া
না বলা এক কঠিন দুর্যোগে হারিয়ে গেলো বোন-বড়ো ভাই। কোথাও কি তারা আজও বেঁচে আছে?
বিষণ্ণ হয়ে আসে মন। এ যন্ত্রণা থেকে পরিত্রাণ, যন্ত্রণা থেকে উত্তরণ জীবনে হয়তো সম্ভব হবে না।
যে অতীত বুকে শেল বিঁধে গেছে তার আঘাত চিরকাল বয়ে বেড়াতে হবে আলম চৌধুরীকে।
বাইরে কড়া নাড়ার শব্দে ভাবনায় ছেদ পড়ে।
-ভিতরে কে আছেন,দরোজাটা একটু খুলুন, প্লিজ।
মেয়েলি কণ্ঠ। আলম চৌধুরী এই ঝড়ের রাতে কোনো অপরিচিত মেয়েমানুষকে ঘরে ঢুকিয়ে বিপদে পড়তে চান না। নিরুত্তর থাকেন তাই।
আবারো কড়া, এবার আরো জোরে। অগত্যা কাঁপা হাতে দরোজার সিটকিনি খুলে সড়ে দাঁড়ায় চৌধুরী।
-কে আপনি?কাকে চাই?
মেয়েটি ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে আছে। বৃষ্টিতে জামাকাপড় ভিজে একাকার।
-সব বলবো আপনাকে, আগে ঘরে ঢুকতে দিন প্লিজ।
দরোজার খিল লাগাতে গিয়ে চৌধুরী ভাবেন খারাপ মেয়েছেলে নয়তো, কেউ তাকে ফাঁসাতে চাইছে নাতো!
ঘরে এসে চেয়ার দেখিয়ে আলম চৌধুরী বলে- বসুন এখানটায়।
মেয়েটির চোখে-মুখে এখনও ভয়। ভয়ার্ত হরিণির মতো কাঁপছে।
-দরোজাটা বন্ধ করে দিন।
-কিছু মনে করবেন না। কে আপনি? আপনার জন্যে কী করতে পারি বলুন।
চৌধুরীর এই সম্মোহনীর জবাবে মেয়েটির মাথা চৌধুরীর পায়ে নুয়ে আসে।
-মাফ করবেন,আপনাকে খুব বিপদে ফেলে দিলাম এই অসময়ে।
-ঠিক আছে বসুন আপনি। ভিজে গেছেন একেবারে। টাওয়াল এনে দিচ্ছি শরীরটাকে মোছে নিন। তারপর চা খেতে খেতে আপনার কথা শুনবো।
চৌধুরীর কথায় বাঁধা দিতে যাচ্ছিলো মেয়েটি। তার আগেই ভিতর ঘরে চলে যায় চৌধুরী।
সাদিকের কথা মনে পড়ে। সাদিক খান, তার স্বামী
সুঠামদেহী পুরুষ, এমন দুর্যোগের রাতে কিছু না বুঝেই কিছু না শুনেই বাসা থেকে বের করে দিলো তাকে।
স্বামীর উপর বিতৃষ্ণায়, ঘৃণায় মনে ছি ছি ছাড়া আর কিছুই জন্ম নিচ্ছে না। কোনদিন এমনতো ছিলো না সাদিক। সাদিকের আজকের দুর্ব্যবহার তাকে বারবার চাবুক হানছে। অফিস থেকে ফিরে
তাকে দেখতে না পেয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকে সাদিক। ঘরে ঢুকেই জিজ্ঞেস করে-কখন এলে তুমি সাদিক?
রাগ-ক্ষোভের প্রকাশ ঘটে সাদিকের কণ্ঠে -
কখন এসেছি তা তোমার না শুনলেও চলবে, আমার তো আর ভুড়ি ভুড়ি টাকাওয়ালা বন্ধু-বান্ধবী নেই যে রোজ দেরী করে আমাকে বাসায় ফিরতে হবে, যাও সেই সব ধনী বড়লোক বয়ফ্রেন্ডদের কাছেই ফিরে যাও-আর কোনদিন এ বাসামুখো হবে না-এই মুহূর্তে আমার সামনে থেকে বিদেয় হও।
সাদিককে অনেক বুঝাতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় সে।
রাতিমতো ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তাকে বের করে দেয় সাদিক।
বাস্তবতায় ফিরে আসে ভদ্রমহিলা। বইয়ের রেকে চোখ যায়।প্রচুর দেশি-বিদেশী বই থরে থরে সাজানো বইয়ের রেকে। একটা পাণ্ডুলিপি টেনে পড়তে থাকে সে। ভদ্রমহিলা ভাবে লোকটি তাহলে লেখক!
এ কি করলো সাদিক খান? লাবনী ইয়াসমিন তার জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ। যাকে ছাড়া নিজেকে কল্পনাও করতে পারে না সাদিক, যে লাবনী তার জীবনের সমস্ত দুঃখ -কষ্ট ভুলিয়ে রেখেছে তাকেই আজ চরম অপমানে ঘর থেকে-বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে? না না, লাবনীকে তার ফিরিয়ে আনতেই হবে। রাগের মাথায়-সন্দেহে লাবনীর প্রতি অন্যায়ে অনুতপ্ত সাদিক।
ঝড়-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সাদিক শহরের আনাচকানাচ খুঁজে ফিরে লাবনীকে। অনেক কথাই মনে পড়ে সাদিকের। সাদিকের বুকে একান্তে নিবিড়ভাবে মাথা রেখে লাবনী বলেছিলো-
বলো সাদিক আমায় কোনদিন ভুল বুঝবে না তুমি। ভুল বুঝে কোনদিন তোমার জীবন থেকে সড়ে যেতে বলবে নাতো, বলো।
সাদিক লাবনীর ঘনকালো চুলে হাত বুলাতে বুলাতে, গালে উষ্ণ চুমোর রেখা এঁকে শুধু বলেছিলো-তুমি আমার জীবনের পুরোটা জুড়ে আছো-থাকবে। এমন অলুক্ষণে দিন যেন আমার জীবনে কক্ষনো না আসে।
এমন নিশ্চিন্ত আশ্বাসের পরও কোন অশুভ ভূতে তাকে পেলো যার জন্যে নিজেই আজকের দিনটির
জন্ম দিলো সে।
সাদিক আর ভাবতে পারছে না। উদ্ভ্রান্তের মতো পাগলের মতো লাবনীকে খুঁজতে থাকে সে।
-একটু দেরি হয়ে গেলো। কিছু মনে করবেন না।
নিজেকেই সব কাজ একা হাতে করতে হয়তো তাই। অবশ্য পুরুষ মানুষকে ঘরের কাজ মানায় না একদম। কেটলি থেকে কাপে চা ঢালতে ঢালতে বলে আলম চৌধুরী।
ভদ্রমহিলার সে দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। হাতের পাণ্ডুলিপিটি দেখিয়ে বলে-এই যে, এটি কার লেখা?
-কেন কী হয়েছে? আমার লেখা.
-আপনার কী আর লেখার বিষয় নেই
বলেই কান্নায় ভেঙে পড়ে মহিলা।
-আপনাকে আঘাত দেয়ার মতো কিছু লেখা আছে ওখানটায়?
-কেন আপনারা-লেখকরা প্রেমকেই শুধু উপজীব্য করেন আপনাদের লেখায়? প্রাণের চেয়ে যে ভালোবাসে-ভালোবাসা দেয় সেই যখন সন্দেহের কাঁটায় বিদ্ধ হয়ে প্রিয়জনকে আঘাত দেয়-নির্দয়-নিষ্ঠুর হয়-ভালোবাসাকে অপমান করে
তার বেলায়..
আরও কিছু বলতে গিয়ে থেমে যায় মহিলা।
আলম উৎকীর্ণ হয়ে শোনে। শান্তস্বরে বলে-
চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।
-আমাকে একটু একা ছেড়ে দিন প্লিজ। অনুনয় মহিলার কণ্ঠে।
মহিলা কে জানা অত্যন্ত জরুরী। আলম চৌধুরীর
সরাসরি প্রশ্ন-আপনি কে, কি পরিচয় আপনার, এতোরাতে কোত্থেকে আসছেন? দুর্যোগের রাতে বাইরে কেন আপনি? বলুন।
উদগ্রীব হয়ে প্রশ্নের উত্তর আশা করে আলম।
-আমি লাবনী ইয়াসমিন। লাবনী।
এতোক্ষণ মহিলার মুখে ভালো করে তাকায়ইনি আলম চৌধুরী। লাবনী নামটা শুনেই মন খচ্ করে ওঠে। এবার মহিলার মুখে তাকিয়ে কারো মুখের সাথে মিলাতে চেষ্টা করে আলম।
-আপনি এখানে কীভাবে?
মেয়েটি অকপটে নির্দ্বিধায় সবিস্তারে কোনো কিছু গোপন না করে সব কথা বলে যায়।
আলম চৌধুরী শুধুমাত্র শান্ত্বনা দিয়ে বলে-
সব ঠিক হয়ে যাবে একদিন। আপনার স্বামী তার ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হবে। আপনার কাছেই ফিরে আসবে সে।
অনেকটা হাল্কা লাগছে মনের সব কথা বলতে পেরে। চায়ে চুমুক দিতে দিতে এবার আলম চৌধুরীর ঘর-সংসারের খবর নিতে শুরু করলো লাবনী।
-শুনবেন আমার জীবন কাহিনী? শুনুন তবে-
দুই ভাই একবোনের সংসার। মা-বাবা গত হলেন। অকালে ঝরে গেলো বড়ো ভাইটিও। ট্রেনে করে মামাবাড়ি থেকে বাড়ি ফিরবার পথে ছোট বোনকে
হারিয়ে ফেলি। আজও খুঁজছি, আর ফিরে পাইনি। জানেন আপনার মতো আমার বোনটির নামও ছিলো লাবনী। লাবনী ভিতরে প্রচণ্ড ঝাকুনি খায়।
-তার কী কোনো ডাক নাম ছিলো?
হাঁ সূচক মাথা নেড়ে আলম চৌধুরী উচ্চারণ করে
-পলি।
এতোটুক বলতেই চৌধুরীর চোখে বিন্দু বিন্দু আষাঢ়ে মেঘ জমা হয়। এক্ষুণি যেন অঝর ধারায়
বৃষ্টি নামবে!
এক অভূতময় দৃশ্যের মঞ্চায়ন ঘটে এই মধ্যরাতে
ঝড়-দুর্যোগে। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে লাবনী আলম চৌধুরীর মুখে। আপনার প্রিয় হারিয়ে যাওয়া আপন জনকে যেন দেখছে লাবনী। বাকরুদ্ধ লাবনী। সৃষ্টির কী অপারলীলা, বিধাতার কী নিখুঁত খেল। তড়িতে আলমের বুকে মুখ লুকিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠে লাবনী
-ভাইয়া আমি তোমার হারিয়ে যাওয়া সেই ছোট্ট লাবনী। দুই ভাই-বোনের এই মিলন দৃশ্যের সাক্ষী হতে পেরে ঝঞ্চাবিক্ষুব্ধ এই রাত-এই প্রকৃতিও যেন
সার্থক আজ।
অনেকক্ষণ দুজনায় দুজনকে আকড়ে ধরে দুজনার মাঝে শান্তি খুঁজে।
-ভাইয়া আমি তোমার কাছেই থাকতে চাই, রাখবে আমায় তোমার কাছে? আর হারিয়ে যেতে দিও না আমায়।
-আমার কাছেই থাকবে বোন, তুই আমার কাছেই থাকবি।
দুজনার চোখেই কান্নার বন্যা। এ বন্যায় ভেসে যাচ্ছে আলম চৌধুরী ও পলি।
আজকের ভোর অন্যদিনের মতো নয়। এ ভোর দুর্যোগ পেরিয়ে আসা নতুন ভোর। সূর্যের আলো, পাখির কলকাকলি সব আজ আলম চৌধুরী ও লাবনী ইয়াসমিনের কাছে পুর্নজন্মের সোনালি আভা যেন। রোজকার অভ্যাস প্রাঃতভ্রমণ। আজকেও এই ভোরে ঘর থেকে বের হয় আলম
চৌধুরী। চাররাস্তার মোড়ে সাদিক আহমদের সাথে
দেখা হয় তার।
-আরে সাদিক এইদিকে? কেমন আছিস?
-ভালো,তুমি কেমন আছো? তুমি?
-অইতো কাছেই বাসা আমার। তা তোকে এতো উদভ্রান্ত লাগছে কেন? আলম প্রশ্ন করেই তাকায় সাদিকের দিকে।
কী বলবে সাদিক। কী জবাব দেয়া উচিত? না, বন্ধুর কাছে বলাই যায়।
-কাল রাতে তোমার ভাবী বাসা থেকে রাগ করে কোথায় যে চলে গেল, সারারাত খুঁজেও সন্ধান মিলেনি।
একটা অঙ্ক মিলাতে চেষ্টা করে আলম। হয়তো মিলতে পারে-হয়তো বা নয়।
-আমার বাসায় চল্, আজ আমার হাঁটাকে ইস্তফা।
এই বলে আলম সাদিকের হাত ধরে তার বাসায় নিয়ে আসে। আলম ভাবতে থাকে তার জন্যে হয়তো কোন চমক অপেক্ষা করছে। সাদিক ভিতরে ভিতরে পোড়ে দগ্ধ হচ্ছে। আলমের হাতে সাদিকের হাত। দরোজায় এসে কড়া নাড়ে আলম।
দরোজা খুলে দেয় লাবনী। সাদিক লাবনীকে,লাবনী সাদিককে দেখেই বাকরদ্ধ হয়ে পড়ে।