আজকের গল্প
রিগ্যান মার্কেট
মাহমুদ বাবু
কাপড়ের মূল্য অনেক বেশি থাকায় ছোটবেলায় আমরা দেখেছি, মানুষ কাপড়-চোপড় রিপু করে পরতো । আবার ছেঁড়া অংশের ওপর স্টিকার লাগিয়েও সারাই করতো ।
এইট কিংবা নাইনে পড়ি আমি, তখন দেশীয় টেক্সটাইলের যাত্রা শুরুর দিকে । মানহীন কাপড় তৈরি হতো এখানে । বাইরের যেসব জাপানী শার্টপিস, পেন্টপিস আসতো, সেগুলো জেলাশহরগুলোতে এভেইলেবল ছিলো না । দাম ছিলো অনেক চড়া । অর্থনৈতিক মন্দাও তখন দেশে ।
সম্ভবত আমি নাইনে পড়ি, প্রথমবার অন্য বন্ধুদের সাথে হাবীব মার্কেটে যাই । মার্কিন মুল্লুক থেকে সেকেন্ডহ্যাণ্ড বিশাল বিশাল সাইজের পেন্ট আসতো । ইউজ করা ওসব প্যান্ট কিছুটা রঙচটা থাকতো । সারি সারি দোকানে শহরের যুবকদের ভীড় লেগেই থাকতো । মার্কেটের শেষপ্রান্তে প্রসিদ্ধ দুটি টেইলার্স ছিলো_ একটার নাম_ বিএস টেইলার্স, আরেকটা_ এলিগ্যান্স টেইলার্স । সত্তর টাকায় পছন্দের প্যান্ট কিনে; বিএস, এলিগ্যান্সে নিয়ে গেলেই তৎক্ষণাৎ প্যান্টের সেলাই বরাবর খেচ্ খেচ্ করে কেটে ফেলতো টেইলার-মাস্টার । কিছুটা ফেড হয়ে যাওয়া কাপড় উল্টালেই দেখা যেতো, ভেতরের দিকটা চকচকে নতুন কাপড়ের মতো । উল্টো দিকটাকে ফ্রন্টে দিয়ে চমৎকার প্যান্ট বানিয়ে দিতেন ওনারা । সেলাই চার্জ ছিলো আশি টাকা । মোটমাট দেড়শ টাকায় দারুণ একটা স্মার্ট-প্যান্ট হয়ে যেতো ! ব্যাপারটা সম্ভব ছিলো_ বিশালাকৃতির প্যান্টে পর্যাপ্ত কাপড় থাকার কারণে । তখন থেকেই আমরা বুঝতে পেরেছি যে, আমেরিকান-ইউরোপীয়ানদের শারীরিক গঠন আমাদের চেয়ে বড়ো-সড়ো । ওইসব পুরনো প্যান্টের কাপড়ের গুণগত মান ছিলো তখনকার জাপানী নতুন কাপড়ের চেয়েও ভালো । বছরে দু'টো পুরনো প্যান্ট হাবীব মার্কেট থেকে কিনে, সারাই করে নিলেই তরুণ-যুবকদের চলে যেতো । প্যান্টগুলো উল্টালেই যে চকচকে নতুন হয়ে যেতো, ওটাই ছিলো মজার ব্যাপার । তখন বোঝার উপায়ই থাকতো না যে, কাপড়টা পুরনো । টেইলার্সগুলোর দক্ষতায় শহরের অধিকাংশ পোলাপান, এমনকি চাকুরিজীবীরাও এই প্যান্ট-উল্টানো কালচারে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন । বলতে গেলে আপামর পুরুষগণ_ নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, উচ্চ-মধ্যবিত্ত, এমনকি উচ্চবিত্তের টেডন-পোলাপানগুলাও খুঁজে খুঁজে দারুণসব প্যান্ট আবিষ্কার করে ফেলতো আশি-নব্বই দশকের সন্ধিক্ষণে । আমিও কয়েকটি প্যান্ট বানিয়েছিলাম, বিএস টেইলাস এর বাবুল ভাইয়ের কাছ থেকে । এখনও ওনাকে পথে-ঘাটে দেখি শুশ্রুমণ্ডিত প্রশান্ত মুখে পান চিবোতে । ধর্ম-কর্ম করেন । সামাজিকভাবে সচেতন এবং ভালো মানুষই মনে হয় তাঁকে । ওনাদের হাত ধরে আমাদের প্রজন্ম হাফপ্যান্ট থেকে ফুলপ্যান্টে উত্তীর্ণ হয়েছিলো । একপর্যায়ে পোলাপানে এই মার্কিন প্যান্ট মার্কেটের নামকরণ করেছিলো ডোনাল্ড রিগ্যানের নামানুসারে_ 'রিগ্যান মার্কেট' ।
তবে আমার প্রথম ফুলপ্যান্ট বানানো হয়েছিলো আরো বেশ আগে_ গাঙ্গিনারপাড়ের প্রসিদ্ধ 'স্টাইলো টেইলার্স' থেকে । খুব সুন্দর চেক কাপড়ের ওই প্যান্ট পরা ছবিও তোলা আছে । খুঁজলে এখনো ছবিটা পাওয়া যেতে পারে । তখনও আমাদের পরিবারের সামর্থে কমতি ঘটেনি । কিন্তু শৈশব পেরিয়ে তারুণ্যের রঙিন সময়টাতে আমরা ছন্দ হারিয়ে ফেলি । কথায় আছে_ 'দুর্যোগ নাকি একা আসে না, সাথে সাঙ্গ-পাঙ্গ নিয়ে আসে'। সিরিজ বোমা হামলার মতো, হেনো কোনো নেতিবাচকতা নেই, যা হামলে পড়েনি আমাদের নিরীহ-গোছের পরিবারটির ওপর । সেই স্মৃতিগুলো আমাকে অনেক কিছু দেয়, আবার অনেক কিছু কেড়েও নেয় ।
ওই সময়টাতে আমরা ব্যক্তিত্ব খর্ব হবার ভয়ে তটস্হ থাকতাম । সুপ্রতিষ্ঠিত স্বজনদের থেকে নিজেদেরকে যথাসম্ভব গুটিয়ে রাখতাম দুর্বিষহ পুরো একটা দশক ধরে ।