আজকের গল্প
ফেলে আসা আঙিনা
আলী হোসেন
১.
ধানক্ষেতের আইল ধরে হাঁটতে হাঁটতে মাঝে মাঝেই পড়ে যাচ্ছিলাম। ঠিক উপুর হয়ে বা চিৎ হয়ে নয়, পা ফসকে বাতর বা আইলের নিচে পড়ে যাওয়া। এটা বেশ লাগছিলো, সোনা রঙ ছড়ানো ধানগুলোকে ছুঁয়ে দিচ্ছিলাম। আমার হাতে খের বা নাড়া দিয়ে বানানো বেণী, এর মাথায় আগুন। বাজান বিড়ি ধরাবেন সেজন্যই এই আগুন নিয়ে সতর্ক চলা, যেনো নিভে না যায়।
তারপরও ঠিকমতো হাটঁতে পারছি না। এক হাতে বেণী অন্য হাতে ধানগাছে স্পর্শ বেশ কঠিন, তবুও তাই করছিলাম। বাজান আরও তিন ক্ষেত পরেই ধান কাটছেন। এখান থেকে দেখা যাচ্ছে। বাজান একা নয়, সাথে আছেন ফজলু কাকা, কাশেম ভাই, রহমান দাদু আর সুরভীর বাজান।
দূর থেকে ভেসে এলো কুউ.. উ.. উ.. ঝিক ঝিক শব্দ। গচিহাটা থেকে ট্রেন ছেড়েছে। আমি দ্রুত পা চালালাম। যেনো কাছে থেকেই ট্রেন দেখতে পারি। রেললাইনের দু' পাশেই ফসলের মাঠ। অজগরের মতো এঁকেবেকে আসছে ট্রেন। আহা কি যে সুন্দর দেখাচ্ছে।
ট্রেন যিনি চালাচ্ছেন, তিনি দেখতে কেমন? আমি ভাবতে থাকি।
আমি যদি ঐ ট্রেনের চালক হতে পারতাম। আচ্ছা, ট্রেন চালাতে কি আইএ বিএ পাশ দেওয়া লাগে? আমি জানি না। সুরভীর কাছে জানতে হবে। ও আমার মতোই বয়সী, কিন্তু অনেক বুদ্ধি। সে ঠিক বলতে পারবে।
এসব ভাবতে ভাবতে যখন বাজানের কাছে এলাম, তখন আমার ছায়া পায়ের নিচে।
কি রে গামছা আনছস না? বাজানের প্রশ্নে আমি কিছুটা অবাক হই। আমার মনে পড়ে গামছা আমি এনেছি, কিন্তু কোথায় পড়লো তা ভেবে পাই না।
আমি আবার বাড়ির পথে পা বাড়াই। সুরভী কিংবা ট্রেনের কথা আমার মনে থাকে না।
২.
বাড়ি ফেরার পথে রিপনের সাথে দেখা। হাতে গুলতি নিয়ে পঁচা পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে কি যেনো দেখছে। নামেই পঁচা পুকুর, কিন্তু এর জল স্বচ্ছ টলটলে। খুব বেশি মনোযোগ দিতে হয় না, সাধারণ চোখে দেখলেও জলের নিচে মাটি দেখা যায়। ওখানে চিংড়ি, পুঁটি, খোলসে, শামুক, ঝিনুক ও শ্যাওলা এসবও নজরে পড়ে।
মাঝে মাঝেই বড়শিতে কেঁচো বা বল্লার চাক ভেঙে নরম বল্লার একটি গেঁথে, অথবা মরা চিংড়ি, চেপা শুঁটকি, আটার কাই এসব দিয়েও এ পুকুরে অনেক মাছ শিকার করি। কই, শিং, মাগুর, শোল, টাকি বা লাডি মাছ, মাঝে মাঝে রুই, কাতলা এসবও ধরা পড়ে।
এরকম স্বচ্ছ জলের মাছ ভর্তি একটা পুকুরের নাম পঁচা পুকুর কেনো হলো, এ প্রশ্ন কখনই মনে আসেনি।
রিপনের কাছাকাছি হতেই ও হাতের আঙুল তার ঠোঁটে লাগিয়ে ইশারা দিলো, যেনো কোনও শব্দ না করি।
আমিও চুপ করে তার দেখানো জাম গাছের মগডালে তাকালাম, দেখি বেশ কয়েকটি ঘুঘু সেখানে বসে আছে। পঁচা পুকুরের তীরবর্তী জঙ্গলে অনেক উদ্ভিদ ও বৃক্ষ রয়েছে। যদিও সবকিছু ছাড়িয়ে বাঁশের সংখ্যাই বেশি। তাই আমরা এটাকে পুকুর পাড়ের বাঁশঝাড় বলেই ডাকি।
রিপন তার গুলতি বা গুলাই দিয়ে ঘুঘুর দল তাক করে যেই মারতে যাবে, তখনই মাথার উপর দিয়ে একটা হেলিকপ্টার উড়ে যাচ্ছে। পাখির নিশানা বাদ দিয়ে আমরা হেলিকপ্টার দেখার জন্য দৌড়ে একটু খোলা জায়গায় যাই।
বাজানের গামছা খুঁজে দেখা বা বাড়ি ফেরার জন্য তেমন তাগিদ অনুভব করি না। একসময় হেলিকপ্টার দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়। তখনও আমরা অবাক চোখে সাদা মেঘভর্তি আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি, যেনো এখনও আকাশযান দেখা যাচ্ছে।
আমাদের ছায়া তখন দীর্ঘ।