Main Logo
আপডেট : ২৫ নভেম্বর, ২০২৩ ০৯:৩৪

আজকের গল্প

আগুন , হিয়া

তাহমিনা রহমান

আগুন , হিয়া
তাহমিনা রহমান

অঝোর ধারায় বৃষ্টি...এর  কাব‍্যিক কনসেপ্ট বুঝার মতো তত্ত্বজ্ঞান শিউলির নেই । তবে তার মনোজগতের দাউদাউ আগুন নেভাতে এই মুহুর্তে বৃষ্টি ছাড়া আর যে কোন উপায় ছিলো না তা সে ভালোভাবেই বুঝতে পারছে । সে বুঝতে পারছে বৃষ্টির একটা অপার্থিব ক্ষমতা আছে । সে ভিজছে। বৃষ্টির ঢল তার শরীর বেয়ে নেমে যাচ্ছে পায়ের নিচে । তার হিয়ার মাঝে যে ক্ষোভ যে লেলিহান আগুনের হলকা সব‌ই যেন যাদুমন্ত্রের মতো শুষে নিচ্ছে বৃষ্টির তরল -আর্দ্র- আমেজ ।

আশপাশের অনেকেই হয়তো বিশেষ উৎসুক হয়ে দেখছে তাকে । দেখছে এজন্যই যে অমন অঝোর ধারায় কেন ভিজছে সে । আরো আরো পথচারীর মতো কেন পথের পাশে কোন বাড়ির বারান্দা বা সেডের নিচে না দাঁড়িয়ে আনমনে উপভোগ করছে প্রবল বর্ষণ । তার এই নিবিষ্ট পথচলায় অনেকের মনে হতে পারে শৈশবের বৃষ্টিস্নানের কথা মনে হতে পারে দাপাদাপি ডুবসাঁতারের কথা । আসলে ওসব কিছুইনা । সে হাঁটছে কারণ তাকে হাঁটতে হচ্ছে । তার এই হাঁটা আপাতত উদ্দেশ্যহীন হলেও অবধারিত। লোকালয় থেকে সে গুটিয়ে রাখতে চায় নিজেকে । তবে এই গুটিয়ে রাখাটা যে ক্ষণায়ু বৃষ্টি দ্বারা সম্ভব না তাও সে জানে । 
তার অস্থির হিয়ার ভেতর যে একটা প্রচ্ছন্ন প্রস্তুতি চলছে বৃষ্টিই যেন তার আপাত আশ্রয় ।

পলিথিনে মোড়ানো একটা ফুলছাপা রঙিন শাড়ি আর নগদ একহাজার টাকা সে বৃষ্টি থেকে বাঁচিয়ে রেখেছে । হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর কে কে যেন দয়া করেছে । পরনের শাড়িটাও কেউ একজন দান করেছে ।   বাড়ি থেকে কেউ তাকে নিতে আসেনি । আসবে না যে সে জানতোই । প্রথম প্রথম বাবা- মা আসতো পরে শোনা গেছে তারা ইউনুছের সাথে আপোস করেছে । বিনিময়ে কিছু টাকা পয়সাও পেয়েছে । শিউলির ভেতরের অভিমানটা উছলে ওঠে - কে জানে ইউনুছ হয়তো আলমকেও কিনে নিয়েছে ।
গরীবের ভালোবাসা কচুপাতার পানি । তবুও ওদের কাছেই ফিরতে হবে তাকে । ফিরে গিয়ে হয়তো ইউনুছের সাথে  নতজানু হয়ে ক্ষমা চাইতে হবে । নতজানু হয়ে আলমকে বলতে হবে... শিউলির ভাবনা হোঁচট খায় - না না আলমকে কিছুই বলতে হবে না । আলম‌ও হয়তো এতোদিনে কিছু একটা সুরাহা করে নিয়েছে নাহলেও অন্তত তার কথা শোনার মতো আলমের আগ্ৰহ বা সময় কোনটাই  হবে না । সে হয়তো পালিয়েই বেড়াবে তার কাছ থেকে ।

মুখের উপর আঁচলটা টেনে দিয়ে জড়োসড়ো শিউলি যখন বাসস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ায় বৃষ্টির ফোঁটা তখন হালকা হয়ে এসেছে । তবে আকাশ কালো । যে কোনো সময় আবার  ঝরা শুরু হতে পারে । লোকজনের আনাগোনাও কম । শিউলির ভেতরটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে দুরুদুরু করে । একা কোনোদিন এভাবে রাস্তাঘাটে বের হয়নি সে । অচেনা সবকিছু তার মনে কাঁপন ধরিয়েছে । কোথায় কিভাবে টিকিট কাটতে হবে কোন গাড়ি কোন দিকে যাবে কিছুই জানে না । অগত্যা একটা খালি টেম্পোতে উঠে বসে শিউলি ‌।

তিন চারজন রিকশাওয়ালা টাইপের লোক তাকে ঘিরে ধরে । চক্কর দেয় । চোখ টিপে বিশ্রী ইঙ্গিত করে । শিউলির মনটা দমে যায় । সে ঝট করে টেম্পো থেকে নেমে পড়ে । ছমাস আগের সেই দুর্ঘটনার কথা বিদ‍্যুতের মতো ঝিলিক দিয়ে ওঠে তার মনে । তার মনে হয় বাড়ি ফিরে আর কী হবে !  ওখানে তার কে আছে । আলম! যে তার রূপের পাগল ছিলো গত ছয় মাসে একদিনও  তাকে দেখতে  আসেনি । অথচ তার সামনেই আবার সে ভিক্ষুকের মতো গিয়ে দাঁড়াবে ! পলিথিনে মোড়ানো কাপড়ের পুটলিটা চেপে ধরে আবারও হাঁটতে শুরু করে শিউলি । বৃষ্টির ফোঁটা বাড়তে থাকে এর চেয়ে বেশি দুর্যোগ এখন তার মনের ভেতর ।

মেঘের আকাশে সন্ধ্যা কী রাত ঠাহর করা যায় না। রাস্তার পাশের নীল বাতিগুলো এক এক করে জ্বলে উঠে-সাথেসাথে  চারপাশের সবকিছু কেমন নীলচে হয়ে উঠে । শিউলী অবাক নয়নে চারপাশে তাকায় । মনটাও যেন ভয়শূন‍্য হয়ে যায় । ছোট বেলায় দাদীর কাছে শোনা সেই রূপকথার গল্পের কথা মনে পড়ে তার । সেই ডানাকাটা পরীর কথা , সাহসী রাজকুমার- রাজকন্যার কথা । দাদী বলতো সে নাকি রাজকণ‍্যার মতো সুন্দরী । দাদীর কথা শুনে শিউলির রাজকন্যা হতে ইচ্ছে করতো । 
খুব শীত লাগছে শিউলির । পরনের ভেজা শাড়িটা পাল্টাতে হবে তারপর - তারপর কী করবে ভেবে পায় না শিউলি ।

রাস্তার পাশে যাত্রীছাউনিতে গিয়ে আশ্রয় নেয় শিউলি। ছাউনির কোনার দিকটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। পরনের কাপড়গুলো দ্রুত খুলে ফেলে সে । গায়ে লেগে থাকা আঁটসাঁট ব্লাউজটাও একটানে খুলে ফেলে । পুটলি থেকে বের করে ফুলছাপা শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে নেয় । ভেজা শাড়িটা যাত্রীছাউনির সামনের খুঁটিগুলোতে ঝুলিয়ে দেয় । ভেতরে বেশ একটা ঘর ঘর ভাব আসে । আহা ঘর ! ঘর কী তার হবে কোনদিন ! 
 উষ্ণতা পেয়ে শরীরের লোমগুলো যেন সজাগ হয়ে ওঠে  শিউলির । ক্লান্তি ভর করে শরীরে । ঝিমিয়ে আসে চোখ দুটো ।  
পরী হয়ে আকাশে উড়ছে শিউলি । আলম তার পিছু পিছু উড়ছে কিন্তু কিছুতেই তাকে ধরতে পারছে না । কিন্তু একি ! ইউনুস কোথা থেকে উড়ে এসে আলমের ডানা দুটো কেটে দিলো আর অমনি ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেলো আলম ।

প্রচণ্ড একটা ঝাকুনি খেয়ে জেগে ওঠে শিউলি । যাত্রীছাউনির মেঝেতে গুটিশুটি হয়ে পড়ে আছে সে । স্বপ্নের ঘোর এখনো কাটেনি । চারপাশে আলমকে খুঁজছে সে । শুধু ঘুটঘুটে অন্ধকার । ওঠে দাঁড়িয়ে অন্ধকারেই হাতরিয়ে ছড়িয়ে দেয়া ভেজা শাড়ির উপর দিয়ে রাস্তার দিকে তাকায় শিউলি । লাইটপোস্ট থেকে মরা আলো ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে । নিরিবিলি রাস্তাটিও পড়ে আছে মরার মতো । কোথাও কেউ নেই শুধু লাইটপোস্টের আলোটা ঘিরে অস্থির হয়ে উড়ছে কিছু পোকা । শিউলির বূক চিরে বেরিয়ে আসে জমাট বাঁধা কষ্টমাখা একটা শ্বাস ‌। 

অন্ধকারে একটা ছায়ামূর্তি দেখে চমকে ওঠে শিউলি ‌। ওর কন্ঠস্বর কেঁপে ওঠে কে কে , কে --
পুরো অন্ধকারটাই যেন বলে ওঠে - আমি - 
শিউলি হাত বাড়ায় - আলম ! সত‍্যি তুমি এসেছো !
আলমের মুখটা দেখতে পায় না শিউলি কিন্তু তার কন্ঠ পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছে - হ‍্যঁ এসেছি । আমি তোর ওই বিকৃত মুখ দেখার আগেই তোকে শেষ করে দিতে এসেছি ।
আলমের কালো দুটি হাত ওঠে আসে , চেপে ধরে শিউলির কণ্ঠনালী , শিউলির অবশ দেহটা মেঝেতে পড়ে ছটফট করতে থাকে । 
তারপর আরও একটি কণ্ঠ বিকৃত হাসি । শিউলি বুঝতে পারছে - এ ইউসুফ । 
তারপর আরও একজন. আরও..আরও... 
শিউলি দেখতে পাচ্ছে সাদা-সাদাকালো থ‌ই থ‌ই পানি থেকে ওঠে আসছে কালো কালো জংলি মাছ , ডোরাকাটা অজগর । অজগরগুলো প্রচণ্ড  শক্তি দিয়ে পেঁচিয়ে ধরেছে তার শরীর । কিছুতেই নড়তে পারছে না সে। কালো মাছগুলো ওর হাতে পায়ে তীব্র কামড় বসিয়েছে। শিউলি বুঝতে পারে না এটা স্বপ্ন! দুঃস্বপ্ন! নাকি অন্তিম খেলা। শুধু আলমকে বলতে ইচ্ছে করছে - এইতো ভালো হলো । আমাদের ভালোবাসার কবর হলো ।

সহসা একটা তীব্র আলো শিউলির চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই অজগরগুলো ওদের দৃঢ় বাঁধন খুলে পালাতে থাকে। এক - দুই -তিন...
ওরা মানুষ তবে অজগর মানুষ ।
ছমাস আগে ইউনুছ এভাবেই পালিয়ে ছিলো ওর মুখের ওপর আগুনটা ছুড়ে দিয়ে।

উপরে