আজকের গল্প
ক্ষণিকের জন্যে
তাছাদ্দুক হোসেন
ঘুমুতে পারছে না আলীম। বেদনায় বিমর্ষ, ব্যথায়
আচ্ছন্ন মন। বিছানায় গা এলিয়ে নানান এলোমেলো কথা ভাবছে সে। কিশোরবেলার সহপাঠী জীবন্নেছার কথা মনে পড়ে। ভীষণ ভালো লাগতো হালকা গড়নের শ্যামলা মায়াময় মুখের মেয়েটিকে, মনে মনে ভালোবাসতেও শুরু করেছিলো -জীবনও কি তাকে পছন্দ
করতো-ভালোও বাসতো বুঝি! জীবনের কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমের অতলে তলিয়ে যায় আলীম।
স্বপ্নের বাগানবাড়িতে হাঁটতে শুরু করে।
অফিসের গাড়িতে রাস্তায় বেরোয় আলীম আহমেদ। মন টিকছে না কাজে, টেবিলে একগাদা ফাইল। জমানো জরুরী কাজকে উপেক্ষা করে অশান্ত মনকে শান্ত করতেই এই বেরিয়ে পড়া। নিজেই ড্রাইভিং সীটে। ড্রাইভার রহমত আলী গাড়িতে বসেছিলো। আলীম আহমেদ ড্রাইভার রহমতকে ডেকে বলে-তুমি নয় আমি নিজেই স্টিয়ারিয়ে থাকবো আজ। তুমি বিশ্রামে থাকো। বলেই বেরিয়ে পড়ে আলীম আহমেদ। চালক রহমত আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে থাকে শুধু।
গাড়ি নিয়ে সারা শহর চষে বেড়ায় আলীম।
ক্লান্ত-অবসন্ন হয়ে আসে দেহ। রাস্তার পাশে প্রায় নিরিবিলি চায়ের দোকানের সামনে গাড়ি থামিয়ে
নেমে আসে আলীম আহমেদ। চাবির গোছা হাতে।
একটা হাতাছাড়া ভাঙা চেয়ারে বসে চায়ের ফরমায়েশ দিলে দুধচা চলে আসে। পাশের টেবিলে বসা স্থূলকায় রীতিমতো সুন্দরী মহিলার চেহারায় চোখ ঘুরে আসে। খচ্ করে উঠে মন। খুব চেনা মনে হলো। ভদ্রমহিলাও আলীমের দিকে দু একবার তাকিয়েছে। একটা সময়ে দুজনারই চোখ দুজনার চোখে আটকে যায়। দুজনকেই দুজনার খুব কাছের আপনজন মনে হলো। আলীমের চোখ নেমে এলো। লজ্জা পেলো বড়ো অপরিচিত কোন নারীকে এভাবে অনুমতিহীন দেখার জন্যে। মাটির দিকে তাকালো লজ্জায়, স্বভাববশত আঙুল ঘষলো মাটির বুকে। মনে তোলপাড় চলছে তার।
কী ভাবলেন ভদ্রমহিলা, ছি! এ কী হলো তার!
ভাবনায় ছেদ টানলেন ভদ্রমহিলা নিজেই-
যদি কিছু মনে না করেন...
আলীম চোখ তোলে। তাকায় প্রায় চেনা-অচেনা চোখের দিকে।
-বলুন প্রশ্নের জন্যে কান খাড়া হয়।
আলীম আহমেদের প্রায় খুঁটিনাটি সব জানতে চান ভদ্রমহিলা। আলীম ভাবনায় পড়ে। এতোকিছু জেনে ভদ্রমহিলার কী লাভ? গোয়েন্দা নয় তো! ভাঁজ পড়ে কপালে। আজকাল এই অস্থির সময়ে
কাউকে বিশ্বাস করে কিছু বলা মূর্খতা। খাতির জমিয়ে একটা ঘোট পাকিয়ে কিছু খসানোর মতলব হয়তো বা। এইরূপ কতো ঘটনাই তো অহরহ ঘটছে আজকাল। প্রশ্নের জবাব না পেয়ে
আবারো মধুর কণ্ঠ আলীমের কর্ণকুহরে মধু বর্ষণ
করে।
-কই, কিছু বললেন না যে।
ভদ্রতা রক্ষায় বলতেই হয় কিছু।
-আমার পরিচয়ে আপনার লাভ? ব্যবসার কথা ভাবছেন আমাকে নিয়ে।
তীর্যক জবাবেও পিছু পা নয় মহিলা। মুচকি হাসি ছড়ানো,অনুনয় জড়ানো কণ্ঠ এবার।
-লাভ তো আছেই। বলুন না প্লিজ। আপনাকে নিয়ে ব্যবসা পরে চিন্তা করা যাবে।
ভদ্রমহিলাকে পুলিশের লোক বলে মনে হলো আলীমের। না, উনার স্বামী আইনের লোক? নিজের পরিচয় দিতে নিরাপদ বোধ হলো না মোটেও।
-কই, কিছু ভাবছেন বুঝি?
-না, মানে ইয়ে...
খতমতো খেয়ে গড়গড় করে নামতা পড়ার মতো বলে যায়-
আমি আলীম আহমেদ, ঠিকানা ৩৪, কুর্মিটোলা ঢাকা,একটা প্রাইভেট ফার্মে জব করি, অবিবাহিত.
দেশের বাড়ি.. ময়মনসিংহ...
এ পর্যন্ত বলে দম নেয় আলীম। নেশায় পেয়ে বসেছে যেন তাকে। জ্বীনে পাওয়া রোগীর মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে স্থায়ী-বর্তমান নানা প্রসঙ্গ।
-আলীম!
যেন ভূত দেখায় চমকে উঠেন, আৎকে উঠেন।
চোখে-মুখে বিস্ময় আর আনন্দ একসাথে ঝরে পড়ে। আলীমের মুখে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকেন ভদ্রমহিলা। চোখে কী দেখছেন অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে। রীতিমতো ভড়কে যায় আলীম। চায়ে গলা ভিজিয়ে স্থির থাকতে চায় সে। ভদ্রমহিলা অস্থির হয়ে পড়েন। এক্ষুণি যেন একটা অঘটন ঘটে যেতে পারে এই আশঙ্কায় ঘামে নেয়ে উঠে আলীম।
-আপনি এমন করছেন কেন? কী হয়েছে আপনার?
হকচকিয়ে যায় সে। অজানা আশঙ্কা মনে বাসা বাঁধতে শুরু করে। যদি মূর্ছা যান, উপায় কী তবে? হাসপাতাল...নয়তো বাসা..। অবিবাহিতের ঘরে অচেনা-অবাঞ্চিতের আগমন অনেকেরই মনে সন্দেহের বীজ দানা বাঁধতে শুরু করবে। বাড়িওয়ালী দজ্জাল মহিলার মুখ মনে করে আৎকে উঠে আলীম। ইস্ কী মুশকিলেই না পড়া গেলো! কী কেলেংকারী ঘটতে যাচ্ছে আজ ভাবতেই গা শিউরে উঠছে বারবার।
ভদ্রমহিলা চেয়ার থেকে উঠলেন, ধীরে ধীরে এগোলেন আলীমের দিকে। মুখোমুখী দাঁড়ানো দুজন। বিস্ফোরণ ঘটলো বলে! পায়ের তলার মাটি সড়ে যাচ্ছে,চিৎকার করতো চাইলো আলীম.
না না, ফিরে যাও.ফিরিয়ে নাও ফিরিয়ে নাও আগুন ঝরানো শান্ত চোখের দৃষ্টি!
ততক্ষণে মহিলার মাংসল হাতের চাঁপাকলার আঙুল আলীমের হাতের উপর ঠাঁই নিয়েছে। রক্তে শিহরণ খেলে গেলো,পাপের শিহরণ। অপরিচিত বেগানা মহিলার হাতের স্পর্শে পাপ যেনো সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে। আশপাশের সমস্ত উৎসুক দর্শক সিনেমার স্যুটিংয়ে নিমগ্ন। শেষ দৃশ্যের অপেক্ষায় উৎসুক জনতা।
ঘৃণায় লজ্জায় নিজেকেই থুথু ছুড়তে ইচ্ছে করছে তার। গলা ফাটিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে হলো, কাঁদতে পারলো না,পায়ের তলার মাটি সড়ে গেলো না,ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেবার আগেই
-আলীম..আলীম...আমি জীবন্নেছা,তোমার হারিয়ে যাওয়া জীবন্নেছা..তোমার জীবন..
হাত কেঁপে উঠলো, মনে আলোড়ন চললো,মুখে একফালি চাঁদের হাসি ছড়িয়ে পড়লো আলীমের।
জীবন্নেছার চোখের নিচে যেখানে দুফোঁটা কান্না জমে আছে আলীমের হাতের ভালোবাসার আঙুল তাকে স্পর্শ করে। হীরকের উজ্জ্বল জ্যোতি
আলীমের সারা চোখে-মুখে সারা অস্তিত্বে। সমস্ত ঘৃণা এক ফুৎকারে নিভে গিয়ে ভালোবাসার পারিজাত ফুটলো জীবনকে ঘিরে, জীবনের বাগানে। মিলনাত্মক দৃশ্যে দর্শক তৃপ্তি নিয়ে ফিরে গেলো যে যার সীমানায়।
-চলো একটু বেড়িয়ে আসি। অনেক কথা আছে তোমার সাথে-জীবন্নেছার প্রস্তাব।
-চলো জীবন। সম্মতি জানায় আলীম। পুরনো নামে জীবন বলে ডাকলো বলে জীবন্নেছা মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানায় আলীমের প্রতি।
সারা ঢাকা শহর চষে বেড়ালো দুজনায়।
শিশুপার্ক, সংসদভবন,টিএসসি, চিড়িয়াখানা, বোটানিকেল গার্ডেনে। মনের গোপন,ফেলে আসা
জীবন নানাপ্রসঙ্গ সারাদিন ঘোরে রাখে দুজনকে। একজন অবিবাহিত পুরুষের সারাদিন বিবাহিত নারীর সান্নিধ্যে কাটানো এক অভিজ্ঞতাই বটে। অন্তরঙ্গ পরিবেশে চায়নিজ রেস্তোরাঁয় আরো মনের কাছাকাছি এসে যায় দুজনা।
সময় গড়ায়, নদীর লক্ষ-কোটি টন জল সাগরে এসে নিজেকে সপে দেয়। ঘনিষ্ঠতা বাড়ে আলীম-জীবনের। মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে আলীম। আগের মতো অফিসে মন বসে না, চোখে শুধু জীবন যে কি না বন্ধু নিজাম মাওলার স্ত্রী। নিজাম এবং আলীম এক সাথেই পড়াশোনা শেষে ঢাকায় এসে চাকুরীতে ঢোকে। জীবন্নেছা নিজামের স্ত্রী জানা যায় বন্ধুর বাসায় বেড়াতে এসে।
-আরে আলীম, ভিতরে আয়। রাত আটটা। ড্রয়িং রোমের দামী সোফায় বসে আলীম বন্ধুকে বলে-
ভালোই তো আছিস পরিবার পরিজন নিয়ে।
-তা আছি জবাব দেয় নিজাম।
-ভাবি কোথায় ডাক্, বিয়ের সময়তো আর থাকা হলো না অফিসিয়াল ব্যস্ততায়।
-সবুর কর, ডাকছি। ভালোই লাগবে তোর। আর
কী ই বা বলবো তোকে অবিবাহিত পুরুষের কাছে সবই সুন্দর। তোর কাছেও তাই।
গোপন খোঁচাটি বুঝতে অসুবিধে হয় না আলীমের। আর সে তো জানে সে কেন বিয়ে করেনি আজও।
আজও কাকে আরাধনা করে সে।
নিজামের বউকে দেখে হতবাক হয়ে যায় আলীম। আরে এ কাকে দেখছে! এ যে তারই আরাধ্য নারী জীবন্নেছা।
-কি রে হা হয়ে গেলি যে! চিনিস না কি? আরে এ যে সে নয় পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী নারী যে কি না আমার স্ত্রী। অবশ্য বর্তমানে সৌন্দর্যে ভাটা পড়েছে, শরীরে নিতম্বে ভারী হয়েছে এই যা।
ঠাট্টা করতে পেরে যেমন মজা পেয়েছে নিজাম তেমনি আলীম মনে মনে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে।
জীবনও কম আশ্চর্য হয়নি এরা দুজনে বন্ধু-ঘনিষ্ঠ বন্ধু ভেবে।
জীবন-আলীম কিছুতেই বুঝতে দেয়নি তারা পূর্বপরিচিত-একান্ত আপন। টুকটাক কথা বিনিময়,রাতের ডিনার সেড়ে বাসায় ফিরে আলীম।
দশবছর সংসার করেও সংসার পূর্ণ হয়নি জীবন্নেছার। এ নিয়ে দুজনার মধ্যে দোষাদোষি লেগেই থাকে। অক্ষম বলে কখনও গালি হজম করতে হয় নিজামকে। বাঁজা বলে অপবাদ সইতে হয় জীবনকে। তবুও কেউ কাউকে ছেড়ে যাবার কথা চিন্তায়ও আনেনি তারা। আজ এ কি হলো জীবনের? বুকে হাহাকার কার লাগি, কিসের অপূর্ণতায় ভোগছে সে, জ্বলছে কোন আগুনে!
জীবন্নেছার মাঝে পরিবর্তন লক্ষ করে নিজাম। আলীম এবং জীবনের মেলামেশায় সন্দেহের ছায়া দেখে আলীম। বাসায় ঘন ঘন আসা-যাওয়ায়, হাসি ঠাট্টায়, আলীমের বিদায় বেলায় জীবনের মুখে বিমর্ষ ভাব দেখে বুঝতে অসুবিধে হয় না নিজামের। তবে কী তার নিঃসন্তান স্ত্রী ভবিষ্যৎ স্বপ্নে বিভোর হয়ে সড়ে যাচ্ছে তার জীবন থেকে!
জীবন্নেছা-আলীমের সম্পর্ক গড়িয়েছিলো অনেক দূর। নিজামকে বিয়ে আর আলীমকে হারিয়ে ফেলার মাঝখানের দিনগুলো কাঁটার মতো বিঁধেছে প্রতিনিয়ত। যে আলীমের স্মৃতি তাকে তাড়িয়ে বেড়ায় সেই তাকেই একদিন ভুলে বসে জীবন্নেছা বেগম। জীবনের মানে আছে বলেই হারিয়ে যাওয়া-পালিয়ে যাওয়া পরাজিতের স্মৃতি নিয়ে পড়ে থাকা কেন? বাস্তববিশ্বাসী জীবন্নেছা
ভেঙে পড়ে নি। চিরসাথী হিসেবে বরণ করে নিয়েছে নিজামকে। কম কীসে নিজাম আলীমের চেয়ে। ঢাকা শহরে নিজামের নিজস্ব বাসায় বউ হয়ে আসে জীবন্নেছা বেগম। প্রতিক্ষেত্রে নিজামের সাথে আলীমের তুলনায় নিজামকেই এগিয়ে রাখে সে।
আজ এতো বছর পর ব্যবসায়িক মাপকাঠিতে হেরে যায় নিজাম। আলীম-জীবনকে নিয়ে এখন প্রায়ই স্বামী-স্ত্রীতে ঝগড়া লেগেই থাকে। প্রতিবেশীদের মুখরোচক গল্প হয়ে ওঠে তারা। জীবন-আলীম এতো কাছাকাছি এসে যায় যেখান থেকে সড়ে আসা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে দুজনার।ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মুখ দেখতে যাচ্ছে বাঁজা মেয়েমানুষ দশ বৎসর সংসার করা জীবন্নেছা বেগম। এখন তার চোখে সন্তানের স্বপ্ন!
নিজামের সংসারকে ভালোবাসাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তালাক নেয়া জীবন্নেছার আজ আলীমের সাথে বিয়ে। আলীমও জীবনকে একান্ত নিজের করে পাবে বলে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে।
আলীম আহমেদ ও জীবন্নেছা বেগম সুখী দম্পতি। জীবন ভাবতে চায় না মাঝের দশ বছরকে, কোনো এক নিজাম মাওলাকে যার সাথে স্বপ্নের সম্পর্কের দিনগুলি কাটিয়ে এসেছে।
প্রতিশোধের আগুনে জ্বলছে নিজাম। বিশ্বাসঘাতক বন্ধুর উপযুক্ত শাস্তি হওয়া চাই। মওকা খুঁজে। পেয়েও যায় উপযুক্ত সুযোগ ও পরিবেশ। গানের জলসা থেকে ফিরছে আলীম-জীবন স্কোটারে। নির্জন রাস্তা। মনে ছক এঁটে নেয়-প্রথমে বিশ্বাসঘাতিনী, লোভী নষ্টা জীবন্নেছা পর বন্ধু আলীম। রাস্তায় লোডসেডিং।
বাসার সামনে স্কোটার থেকে নামে তারা। অন্ধকারে জমদূতের মতো এসে দাঁড়ায় নিজাম।
-কে কে?কে এখানে?
-আমি দাঁড়াও চুপ করে, টু শব্দটি করবে না, তাহলে একটিমাত্র বুলেট এফোঁড় ও ফোঁড় করে দিবে বুক।
জীবন্নেছা এই কণ্ঠের সাথে পরিচিত দশ বছর।
ভয়ে শিউরে ওঠে জীবন্নেছার অন্তরাত্মা। আজ কিসের শিকার সে। যে কি না জৈবিক -মানসিক শান্তি দিতে পারেনি কোনদিন তাকে ছড়ে আসা কি অন্যায় নাকি পাপ!
-কে তুমি? ভয়ার্ত কণ্ঠ আলীমের।
-আমি কে? প্রচণ্ড হাসিতে ফেটে পড়ে মুখোসধারী।
আমি কে? তোমার জীবনকেই জিজ্ঞেস করো না কেন?
লোকটির সামনাসামনি দাঁড়ায় জীবন্নেছা।
কে তুমি? কোথাও কখনও দেখেছি বলেতো মনে পড়ছে না। পথ ছেড়ে দাঁড়াও। যেতে দাও আমাদের।
-না চেনাই স্বাভাবিক, কিন্ত যেদিন তোমায় বউ করে লালবেনারসিতে,গা ভর্তি গহনায় মুড়িয়ে বউ ঘরে তুলেছিলাম, সেদিনতো তোমার মুখে আমাকে না চেনার প্রশ্ন ছিলো না। আমার বুকে যে তুমি দশ দশটি বছর মুখ লুকিয়েছো, আদর-ভালোবাসা দিয়েছো সেই তুমি আজ কী করে আমায় ছেড়ে যেতে পারলে? নিজামকে ভুলে গেলে এতো সহজে? আমিতো ভুলতে দেবো না তোমায়।
-নিজাম! কী চাও আমার কাছে?
-তোমাদের সুখের জীবন।
-বাঁচতে দাও আমাদের। কাতর মিনতি ঝরে পড়ে জীবন্নেছার কণ্ঠে। যেন কাঠগড়ায় দাঁড়ানো দুই আসামী বিচারকের কাছে করজোড়ে মুক্তির প্রার্থনা করছে।
-ক্ষমার কথা আসছে কেন? আমার ঘর ভাঙবার সময় একবারো কি ভেবেছো আমার কথা। আর এই বন্ধু, বন্ধুর এতোবড়ো উপকার করলো, পৃথিবীতে এর নজির পাওয়া দুষ্কর। এর শাস্তি আজ হোক। জগত-সংসার জানুক ভয়ঙ্কর পরিণতির কথা-আর ভয়ে শিউরে উঠুক সেইসব বিশ্বাস ভঙ্গকারী পাপিষ্টের মুখোসধারী দল।
এক নারীর জন্যে দুই বন্ধু-দুই প্রতিদ্বন্দ্বী। জীবনের মাথা বরাবর তাক করা পিস্তল। যে পিস্তল কি না সন্ত্রাসীর কাছ থেকে ভাড়ায় এনেছে নিজাম।
মুহূর্তে কিছু বলার আগেই ট্রিগারে চাপ পড়ে। গুলির শব্দে মূত্যুর ভয়ে প্রাণপনে দৌড়োতে থাকে
আলীম আহমেদ। সমস্ত নিস্তব্দ প্রকৃতিকে গগণবিদারী চিৎকারে সচকিত করে।
বাঁ-চা-ও...বাঁচতে চাই আমি বাঁচতে চাই...
-তোকে আর মরতে হবে না, হাত মুখে ধুয়ে অফিসে ছুট সকাল নয়টা বেজে গেছে।
মায়ের ডাকে চোখ খোলে তাকায়-জীবুন্নেছাকে খুঁজে। মায়ের সামনে মুখ লজ্জায় লাল হয়। বাইরে
জানালা দিয়ে শীতের মিষ্টি রোদ গায়ে এসে জড়াজড়ি করে। দূরে একটা মেয়েকে বেনী দুলিয়ে স্কুলে যেতে দেখে-দেখে মনে হয় ছিপছিপে গড়নের
শ্যামলা মুখের মেয়েটিই জীবন্নেছা।