Main Logo
আপডেট : ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০৯:০০

আজকের গল্প

সেই লোকটি

আবু সাইদ কামাল

সেই লোকটি
আবু সাইদ কামাল

সুমন যখন উপাসনালয়ঘেঁষা রাস্তায় হেঁটে যায় তখন ধর্মীয় পোশাকধারী লোকটা সামনে পড়ে। এ লোকটিই উপাসনালয়ের পরিচালক বা পুরোহিত। উভয়েই উভয়ের দিকে তাকায়। কিন্তু কেউ কাউকে সালাম বা আদাব দেয় না। সাধারণত মানুষ তাকে আদাব দেয়। ধর্মীয় নেতা বলে সে আদাব নিতে অভ্যস্ত; দিতে নয়। সুমন তাকে আদাব দেয়নি অন্য কারণে। ষাটোর্ধ ধর্মগুরু রবির গায়ের পোশাক দেখে সাধারণ মানুষের ভক্তি থাকবেÑ এটাই স্বাভাবিক। সুমন জানে লোকটার এই ধর্মীয় লেবাসের ভিতরে একটা জানুয়ারের বসবাস। তার সম্পর্কে প্রথম ঘটনাটি জানতে পারে বন্ধু ডা: রেমনের কাছে।
থানা সদরের হাসপাতালে ডা: রেমন একের এক রোগী দেখে যাচ্ছে। সুমনও তখন জরুরি প্রয়োজনে তার চেম্বারে গিয়ে উপস্থিত। তাকে দেখে বলে, আরে সুমন ভাই! বসেন।
তার টেবিলের পাশে বসে আছে। ডা: রেমন রোগী দেখছে আর ফাঁকে ফাঁকে সুমনের সাথে কথা বলছে। চেম্বারের দরজা থেকে পিয়ন একজন করে রোগী ভিতরে ঢুকতে দিচ্ছে। সুমনের বসে থাকা অবস্থায় একজন মা তার মেয়েকে নিয়ে ঢুকে। বারো—তেরো বছরের মেয়েটি বিকশিত হচ্ছে। মা—মেয়ের মাঝে কিছুটা আভিজাত্যের ছাপ। মা পরিচয় দিয়ে বলে, আমি সরকার বাড়ি থেকে এসেছি। সাগর সরকার মেয়ের বাবা। আমি তার মা।
মেয়ের বাবাকে সুমন চিনে। বাবা পরিচিত বলে ডাক্তার ওদের বসতে বলে। সদ্য চালু হয়েছে থানা উন্নয়ন পদ্ধতি। সাগর সরকার বিগত সরকারের ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী সদস্য। থানা সদরেই ওদের বাড়ি। মেয়েটির কী সমস্যা জানতে চায় ডাক্তার। কিন্তু মেয়েটি আমতা আমতা করে। ডাক্তার বুঝলো, তার মা এবং সুমনের সামনে মেয়েটি মুখ খুলতে চায় না। তবে তার লক্ষণ দেখে ডাক্তারের গুরুতর কিছু সন্দেহ হয়। ডাক্তার তখন সুমনের সাথে কথা শেষ করে। সুমন বিষয়টা অঁাচ করে বিদায় নিয়ে চলে যায়। সাথে সাথে মেয়ের মাকেও ডাক্তার বাইরে পাঠায়। ঘর খালি হলে সমস্যা নির্ণয় করতে মেয়ের সাথে একান্তে কথা বলে। ডা: রেমন বলে, বলো মা তোমার কী সমস্যা?
মেয়েটি বলে, আমার বমি বমি লাগে। বমি হয়। মানে …মানে…
মেয়েটিকে ফের আমতা আমতা করলে রেমন বলে, ডাক্তারের কাছে কোনোকিছু লুকাতে নেই। আমি অনুমান করতে পারছি। এখন আমাকে বলো, তোমার এ অবস্থা কিভাবে হলো, কে এ জন্য দায়ী।
শেষে জড়তামুক্ত হয়ে মেয়েটি যা জানায়, তা শুনে তো ডাক্তার হতবাক। ধর্মশিক্ষার জন্য তার বাবা রামনাথপুর থানা সংলগ্ন উপাসনালয়ের ধর্মীয় নেতার উপর দায়িত্ব দেন। তিনি প্রতিদিন বিকালে আসেন। বাবা তো বাইরে বাইরে থাকেন। মা থাকেন গৃহস্থালি কাজে। ধর্মশিক্ষক একা পেয়ে একদিন সুযোগ বুঝে মেয়েটির মুখ চেপে ধরে তার ওপর ঝািঁপয়ে পড়ে। ধর্ষণ শেষে ধর্মের ছদ্মবেশধারী লম্পট রবি চলে যায়। লজ্জা অপমানে মেয়েটি একেবারে ভেঙে পড়ে। সন্ধ্যায় তার মন খারাপ দেখে মা বলে, কীরে চামেলি কী অইছে তর?
—কিছুই না।
—তাইলে মুখ ভার কইরা বইয়া রইছস কেরে?
—এমনি। ভাল্লাগতেছে না।
মান—সম্মানের ভয়ে কারও কাছে মুখ খুলেনি চামেলি। পরদিন আর পড়াতে যায়নি লোকটি। মেয়ের বাবার তাগিদে তৃতীয়দিন মেয়েটিকে পড়াতে আসে। কিন্তু চামেলি পড়তে যেতে চায় না। মায়ের ধমক খেয়ে মেজাজ দেখিয়ে শেষে পড়তে যায়। আতঙ্কগ্রস্ত ধর্মীয় শিক্ষক ভেতরে ভেতরে ভয়ে কাতর। চামেলির সামনে আসামীর মতো ধর্মশিক্ষক। পরিবারের সদস্যদের তুষ্ট করতে লোক দেখানো ধর্ম শিক্ষার আসরে বসে চামেলি। এক পর্যায়ে চামেলির হাত চেপে ধরে কাঁদ কাঁদস্বরে ধর্মশিক্ষক বলে, আমারে মাফ করে দাও! প্রবৃত্তির দাস হয়ে এমন একটা কাম করলাম! তুমি মাফ না করলে তো সৃষ্টিকর্তাও মাফ করবো না।
এর মাঝে হঠাৎ চামেলির বাবা রাজনৈতিক মামলায় জড়ায়। থানা থেকে ওয়ারেন্ট নিয়ে তাকে ধরতে যায়। ভাগ্যিস বাড়ি ছিল না। এ সমস্যায় থানা সংলগ্ন উপাশনালয়ের ধর্মগুরু ওসি সাহেবের সাথে দেখা করে জোরালে ভূমিকা নেয়। ফলে ঝামেলামুক্ত হয় সাগর সরকার। এ ঘটনায় সাগর সরকারের পরিবার ধর্মশিক্ষকের উপর বেশ কৃতজ্ঞ। আর সে সুযোগটাই আবার নেয় ধর্মবেশী লম্পট। সুযাগ বুঝে দ্বিতীয়বার চামেলিকে ধর্ষণ করে। এবারও মেয়েটি মুখ খুলে না। বরং তার বাবার উপকারের কথা বিবেচনা করে ধর্ষকের উপর ততটা ক্ষিপ্ত হয় না। তবে ক্রমে সে মানসিকভাবে ভেঙে পড়তে থাকে। ধর্মশিক্ষার সুযোগে এভাবে সাত—আটবার ধর্ষিত হবার পর চামেলি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। স্কুলের লেখাপড়াতেও অমনোযোগী হয়। মা—বাবার শত চাপেও ধর্মশিক্ষকের কাছে আর পড়তে যায় না। পাছে সত্য প্রকাশ হয় সে ভয়ে ভণ্ড ধর্মশিক্ষকও পড়াতে তেমন আগ্রহ দেখায় না।
মাস খানেকের মাঝে তার ঋতুশ্রাব বন্ধ হয়। তারপর থেকে চামেলির শারীরিক সমস্যা। বমি করে। খাবারে অনীহা। বাধ্য হয়ে মা তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। চামেলির কাছে এ পর্যন্ত শুনে ডাক্তার রেমনের অনুমান নিশ্চিত হয়। তখন মেয়ের মাকে ডাকে। মেয়ের পাশে বসে মা। ডাক্তার বলে, মেয়ের যে সমস্যা দেখতেছি তাতে মেয়েকে দায়ী করা যায় না। দায়ী মা—বাবা।
জবাবে মা বলে, বুঝতে পারলাম না।
—একজন লেবাসধারী লম্পটের কাছে মেয়েকে ধর্মশিক্ষা নিতে দিছেন। লোকটা লেবাসধারীর একটা জানুয়ার, বাঘের মুখে নিজের সন্তানকে তুলে দিয়ে খেঁাজ খবরও রাখেন নাই আপনারা। আর ঐ সুযোগে ভণ্ড ধর্মশিক্ষক জোর করে তার সর্বনাশ করেছে। আপনার মেয়েকে বেশ কয়েকদিন ধর্ষণ করার ফলে সে এখন অন্তঃসত্তা।
একথা শোনার সাথে সাথে যেনো আকাশ ভেঙে পড়ে মা’র মাথায়। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে নিঃশব্দে ডাক্তারের সামনে কান্না জুড়ে দেয়। তখন ডাক্তার বলে, এভাবে কাঁদলে তো আর সমস্যার সমাধান হবে না।
ডাক্তারের একথা শুনে দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য চামেলির মা হঠাৎ উঠে ডাক্তারের একটি হাত চেপে ধরে। বলে, আমারে বাঁচান স্যার!
—আপনি শান্ত হয়ে চেয়ারে বসেন। তারপর আমার কথাগুলো শোনেন। জেলা শহরে স্বনামধন্য গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা: এমকে দত্ত। তাকে আমি ফোন করে ঘটনাটা বলবো। তার কাছে গিয়ে আমার পরিচয় দেবেন। আশাকরি তাতেই সমস্যা মুক্ত হতে পারবেন।
—জি স্যার! তবে একটা অনুরোধ স্যার, বুঝতেই পারছেন আমাদের মান—সম্মানের ব্যাপার। বিষয়টা যাতে গোপন রাখা যায়, তেমনভাবেই ব্যবস্থাটা করে দেন। টাকা—পয়সার কোনো সমস্যা নাই। আগামীকালই তাইলে আমরা জেলা শহরে রওয়ানা হই!
—হ্যঁা, যান। তবে আমাকে সব বিষয়ে সময় সময় জানাবেন।
—আচ্ছা স্যার!
রাজ্যের দুশ্চিন্তায় বিধ্বস্ত হয়ে চামেলিকে নিয়ে বাড়ি ফিরে মা। পরদিন সকালে জেলা শহরে যায় ওরা। বিকেলে ডা: এমকে দত্তের কাছে যায়। ডা: রেমনের পরিচয় দিলে বেশ আন্তরিকভাবে চামেলিকে দেখে ডা: মোহন কুমার দত্ত। পরীক্ষা—নীরিক্ষার পর বলে আজ থেকে ঠিক দেড় মাস পর দেখা করবেন। গর্ভপাত করার জন্য একটা নির্দিষ্ট সময় অপেক্ষা করতে হয়।

দুই

নির্ধারিত সময় চামেলিকে নিয়ে আবার জেলা শহরে যায় তার মা। আগের বারের মতো উঠে তার মামাত ভাইয়ের বাসায়। তবে মা—মেয়ে ছাড়া ঘটনাটি আর কারোকে জানানো হয়নি। এমন কি মেয়ের বাবাও জানে না। চামেলির মা’র মামাতো ভাইয়ের বাসায় উঠলেও মেয়ের গাইনি সমস্যা বলে আসল ঘটনা চেপে রাখে। বাচ্চা একটা মেয়ের গর্ভে লেবাসধারী এক জানুয়ারের পাপের ফসল। চামেলির ভেতরে দুঃসহ মানসিক যন্ত্রণা। একেকবার মনে হয়, এই কলঙ্কিত জীবন নিয়ে বেঁচে থেকে লাভ কি? মাকেও তার কখনো চরম হতাশাপূর্ণ জীবনযন্ত্রণার কথা বলেছে। মা তখন সমর্পিত গলায় মেয়েকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, তর তো কোনো দোষ নাই। এই জন্য প্রথমত দায়ী আমি। ধর্মের শিক্ষক মানুষ বইলা বিশ্বাস করছিলাম জানুয়ারটারে। আর ঐ বিশ্বাসের ঘরে আগুন দিলো সে। ¯্রষ্টা নিশ্চয় এর বিচার করবো।
মেয়ের এমন মানসিক অবস্থা নিয়ে মা খুবই শঙ্কিত। ভাবে, কখনো যদি আবেগবশে আত্মঘাতী হয়ে কোনো দুর্ঘটনা করে বসে! তারপরও বেশ আত্মবিশ্বাস নিয়ে ভয়াবহ এ বিপদমুক্ত হওয়ার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যায় মা। সন্ধ্যায় মামাতো ভাই আকাশ চামেলির মাকে বিধ¦স্ত অবস্থায় দেখে বলে, কি গো জবা! তোমার স্বাস্থ্য এত ভাঙছে ক্যান?
—আর কইয়েন না আকাশদা! সংসার সামলাইতে গিয়া এক্কেবারে নাজেহাল অবস্থা…।
—যতটুকু জানি, তোমাদের সংসারে তো এত ঝামেলা নাই।
—চামেলির বাবার উপর রাজনৈতিক মামলা। শান্তি নাই গো দাদা!
—ও আচ্ছা।
সত্যিই চামেলির এ ঘটনার পর থেকে বিগত দুই মাসের দুশ্চিন্তায় যেনো অনেকটা বুড়িয়ে গেছে জবা। পরদিন বিকাল চারটায় ডা: এমকে দত্তের চেম্বারে মেয়েকে নিয়ে যায়। গর্ভপাত করানোর জন্য একজন দক্ষ নার্স রয়েছে। ডা: এমকে দত্তের উপস্থিতিতে নার্স কাজ শুরু করে। কোনো রকম জটিলতা দেখা দিলে সেই মোতাবেক ডাক্তার ব্যবস্থা নিবেন, এ জন্যই পাশে আছেন। মা—ও সেখানে উপস্থিত। মেয়ের পাশে বসে আছে মা জবা।
নার্স ততক্ষণে বেশ মোটা একটা সিরিঞ্জ প্রস্তুত করে। সেটা চামেলির যৌনাঙ্গে যখন ঢুকায় তখন মেয়েটা যন্ত্রণায় মুখ বিকৃত করে দেয়। ছটফটায়মান মেয়ের কষ্ট দেখে মা জবার মনে হয় যে, মোটা এবং লম্বা কাঁচের দণ্ডটা বুঝি তার জরায়ুতেই ঢুকানো হয়েছে। অল্প সময়ের ব্যবধানে দক্ষ নার্স তরলাকারের ভ্রম্নণশিশু পিসকিরির মতো টেনে সিরিঞ্জে তুলে নিয়ে আসে। তাতে যন্ত্রণায় চামেলি অনেকটা কঁুকড়ে যায়। তবে অল্প সময়ের ব্যবধানে স্বাভাবিক হয় চামেলি। ডা: এমকে দত্ত ব্যবস্থাপত্র লিখে দিয়ে বলেন, ওষুধগুলো নিয়মিত সেবন করতে হবে।
ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে পাশের দোকান থেকে ওষুধ নিয়েই রিকাশায় চাপে মা—মেয়ে। অনেকটা নির্ভার বোধ করে মা। কিন্তু সে নির্ভার অবস্থাটা বেশিক্ষণ থাকেনি। খানিক পরই মেয়েটা পাগলামু শুরু করে। অন্তর্গত আত্মগ্লানিতে বেসামাল হয়ে রিকশা থেকে নেমে সে আত্মঘাতি হতে চায়। মা তাকে ঝাপটে ধরে রাখে। কেঁদে কেঁদে বলে, শান্ত হয় মা! তোর দুইটা পায়ে পড়ি, পাগলামি করিস না। এইটাকে জীবনের একটা দুর্ঘটনা মনে কর। রাস্তাঘাটে মানুষ কতো রকম দুর্ঘটনায় পড়ে না! তুই—ও এমন মনে কর। তরে ছাড়া কি আমি বাঁচমু! আমি বাঁইচ্যা থাকতে তোর কোনো অশান্তি অইতে দিমু না। মনে মনে জেদ ধইরা পড়ালেখা করবি। আমি তোর পিছনে আছি। যা যা লাগে, আমি সব দিবো।
চামেলিও মায়ের কষ্ট বোঝে। তার জন্যই মা পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছে। এসব ভেবে সে শান্ত হয়ে নীরব থাকে। তখন মা আবার মুখ খুলে বলে, সাবধান! মামার বাসায় গিয়ে একেবারে স্বাভাবিক আচরণ করবি। ওরা যেনো ভুলেও কিছু বুঝতে না পারে।
এভাবে বিপদমুক্ত হয়ে পরদিনই ওরা বাড়ি ফিরে যায়। ঘটনাটির মাস কয়েক পর বন্ধু সুমনের অফিসে আসে ডা: রেমন। তখন তার কাছ থেকে পুরো ঘটনাটি জানতে পারে সুমন।

তিন

এ ঘটনার বছর খানেক পর দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটে। ধর্মগুরু স্ত্রী তখন সন্তান সম্ভবা। আটমাস চলছে। পেট ঝুলে পড়েছে। সাংসারিক কাজ—কর্ম তেমন করতে পারে না। এ কারণে বড় একটি কাজের মেয়ে দরকার। বেশ খেঁাজাখুজির পর পাশের গ্রামের এক যুবতী মেয়েকে পাওয়া যায়। মেয়েটির বাবা নেই। বড় ভাই, একটি ছোটবোন এবং মা এই নিয়ে তাদের চার সদস্যের সংসার। বড় ভাই দিনমজুরের কাজ করে। ভাইয়ের উপার্জনে সংসার চলতে চায় না। অভাবের সংসারে মেয়েটিকে বাধ্য হয়ে কাজ করতে দেয়। যুবতী মেয়ে বলে সব জায়গায় তো দিতে পারে না। তার যৌন নিরাপত্তার বিষয়টি জড়িত। ধর্মীয় নেতার বাসা নিরাপদ ভেবে সমলার মা এবং বড়ভাই কাজে দিতে রাজি হয়। ধর্মগুরু সমাজের আদর্শ। তাদের ওপর তো নির্ভর করা যায়। বিশ্বাসের জন্য এরচে ভালো জায়গা তো সমাজে থাকার কথা না। কিন্তু এ ভণ্ড ধর্ম নেতা যে নারী লিপ্সু সে খবর তো রাখে না। তার নজর পড়ে মেয়েটির উপর। তাকে রাতে থাকতে দেয় রান্না ঘরে। স্ত্রী যখন নয়মাস তখন নড়াচড়া করতে পারে না। বিছানায় শুয়ে থাকে। মেয়েটা রাতে কী রান্না—বান্না করে খোঁজ নেওয়ার জন্য ধর্মীয় নেতা সেই ঘরে ঢুকে। লম্পট লোকেরা সাধারণত মেয়েদের প্রথমে প্রশংসা করে। পরে ফুসলিয়ে অপকর্মে লিপ্ত হয়। একান্তে কথা বলে যতটুকু বুঝতে পারে, সহজে তাকে পটানো কঠিন হবে। তখন ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিক। মতলব হাসিলের জন্য সমলাকে বলে, শেষ রাতের প্রার্থনার জন্য গরম পানির দরকার হবে। শেষ রাতে রান্নাঘরে একটু পানি গরম করে দিও। তুমি যদি না পারো, দরজা খুলে দিও। আমিই পানি গরম করে নিবো।
শেষরাতে দরজা টোকা দিলে সমলা উঠে পানি গরম করতে থাকে। স্ত্রী তখন ঘুমে। এ সুযোগে রান্নাঘরে ঢুকে। দরজা আটকিয়েই সমলার মুখ চেপে ধরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ভয় দেখিয়ে বলে, যদি ঝামেলা করস তাইলে চুরির মামলায় ঢুকায়া দিমু। পুলিশ আমার কথা বিশ্বাস করবো। কারণ, আমি থানা সংলগ্ন উপাসনালয়ের পরিচালক।
ধর্ষণ শেষে অসহায় সমলা মনিহারা সাপের মতো পাগলপ্রায়। ধল পহলের পরই ভণ্ড ধার্মিক উপাসনালয়ে ঢুকে। এ ফাঁকে সমলা মনে মনে স্থির করে এ বাসায় আর এক মুহূর্তও না। আলো ফোটা ভোরে সে রাস্তায় নামে। থানা সদর থেকে বাড়ি তো প্রায় এক কিলো দূরে। বেলা ওঠার আগেই সে বাড়ি পৌঁছে। এত সকালে তাকে দেখে মা তাজ্জব! কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই কান্নায় ভেঙে পড়ে সমলা। মা’র কাছে নিচুস্বরে কেঁদে কেঁদে সব খুলে বলে। তখনো বিছানা ছেড়ে উঠেনি বড় ভাই তুফান। বিছানায় থেকেই সব শুনে। মুহূর্তকাল দেরি না করে তার কাঠের গোলাকার রোলটা হাতে নিয়ে বের হয়। প্রথমে যায় মেম্বার কাকার বাড়ি। মেম্বারকে বিষয়টা জানিয়েই বলে, আইজ ঐ ভণ্ড ধর্মগুরুরে উচিত শিক্ষা না দিয়া ছাড়মু না। এতে আমার জেল—ফাঁস যাই হয়, হোক।
জবাবে মেম্বার বলে, তুফান পাগলামি করিস না।
ততক্ষণে তুফান বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। সকাল থেকেই ভণ্ড ধার্মিকের গতিবিধি লক্ষ করতে থাকে সে। উপাসনালয়ের কাছে আক্রমণ করলে পুলিশের কাছে ধরা পড়ার আশঙ্কা। তখন সকাল আটটা বাজে। মাছ—বাজারে ঢোকার আগেই রবির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তুফান। ‘শালা লুচ্ছা’ বলে চিৎকার করে ক্ষোভ ঝেড়ে ক্রমাগত পেটাতে থাকে। ধরাশায়ী হলে বাজারের মানুষের প্রতিরোধে ক্ষান্ত দিয়ে তুফান ফিরে আসে। বাজারের লোকেরা তাকে ধরাধরি করে রিকশায় তুলে হাসপাতালে নিয়ে যায়। হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক জানায়, তার একটি হাত ভেঙে গেছে।
উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে পাঠানো হয় জেলা হাসপাতালে। ক’দিন পর কাঁধে হাত ঝুলিয়ে ফিরে আসে ধর্মগুরু। থানা উপাসনালয়ের পরিচালক হলেও এ ব্যাপারে কোনো মামলা হয়নি। পুলিশ তার অপরাধ গুরুতর বলে জানতে পারে। তার ওপর এ ব্যাপারে ভিক্টিমও মামলা করতে আগ্রহী হয়নি। বরং সে ভিন্ন পথ ধরার প্রয়াস চালায়। তার ভাবমূর্তি পূণরুদ্ধারের জন্য থানার সব উপাসনালয়ে বার্তা পাঠিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করে। থানা সদরের উপাসনালয়ের একজন নেতাকে প্রহার করে অসম্মান করার বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলনই তার ইমেজ গড়ে তুলতে পারে বলে মনে করে। কিন্তু থানার অন্যসব উপাসনালয় থেকে যাচাই করে যখন প্রকৃত ঘটনা জানতে পারে, তখন কেউ আর তার কথায় আন্দোলনে নামেনি। বরং তার লাম্পট্যের বিষয়টি এলাকায় একটি মুখরোচক রটনা হয়ে দাঁড়ায়। এ সময়ে তার আর একটি অপকর্মের বিষয়ও ফাঁস হতে থাকে। ততদিনে সে ধর্মগুরু হিসাবে স্বধর্মের লোকদের দীক্ষাও দিতে থাকে। ধর্মগুরু হিসাবে মানুষের নানা অসুখের চিকিৎসার জন্য ঝাড়—ফুঁক দেয়। বিবাহিত যে সব মেয়ের সন্তান হয় না, তাদের চিকিৎসাও নাকি সে করে। এ চিকিৎসার জন্য সে অতি গোপনে জঘন্য পথ অবলম্বন করে। উপাসনালয় সংলগ্ন একটি কক্ষে অতিগোপনে নিঃসন্তান মেয়ের সাথে মেলামেশা করে। সাথে দেয় আরও কিছু তদবির। তাতে ওসব মেয়েদের পেটে নাকি সন্তান আসে। ভণ্ড এ ধর্মীয় নেতা সম্পর্কে এসব বিষয়ও কেউ কেউ বলাবলি শুরু করে তখন।
এ প্রসঙ্গে কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের কথা মনে পড়ে সুমনের। ভারতের তামিলনাড়–র নামাক্কাল জেলায় অসহিষ্ণু হিন্দুবাদীদের ধারাবাহিক আক্রমণ ও অপমানে নাকাল হয়েছেন তামিল লেখক পেরুমন মরগন। তার একটি উপন্যাসের বাংলা নাম দাঁড়ায় ‘অন্য অংশ নারী’। এ উপন্যাসে বর্ণিত একটি আখ্যানে জেলার অনগ্রসর একটি গোষ্ঠীর সমাজপতিদের ক্ষেপিয়ে তুলে।
লেখকের মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি অসহিষ্ণুতা প্রকাশ কিংবা গায়ের জোরে অপছন্দের মতকে ধাপামাচাপা দেওয়ার প্রয়াস চালায়। কিংবা লেখককে দমন করার জন্য স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা শাসকগোষ্টীর মাঝে যেমন দেখা যায়, তেমনি যুথবদ্ধ গোষ্ঠী সামাজিক স্তরে তাদের গুণ্ডামি অনুশীলন করে।
পেরুমন মরগানের উপন্যাসে কাউকে আঘাত করার উদ্দেশ্য ছিল না। তবে শিবের অর্ধনারীশ^র মূর্তির পূজা উপলক্ষে সন্তানহীন দম্পতির সন্তান লাভের অভিপ্রায় পূরণের জন্য অপরিচিত পুরুষের সাথে সম্মত যৌন সংসর্গের পুরোনো যে লোকাচার স্থানীয় ঐতিহ্যের অন্তভূর্ক্ত, তার প্রেক্ষিতে এক সন্তানহীনা নারীর দ্বিধাদ্বন্দ্ব—দোলাচলের চিত্রায়ন ছিল উপন্যাসে।
স্থানীয় সমাজপতিদের মনে হয়েছে, পেরুমন মরগান তার উপন্যাসে এ গোপন লোকাচারের কথা প্রকাশ করে অনগ্রসর জাতের সমাজকে অসম্মান করেছে। তাদের দাবী উপন্যাস থেকে বিতর্কিত অংশ বাদ দিতে হবে। এ গোলমালের সাথে স্থানীয় রাজনৈতিক সংগঠন জড়িত হয়।
শেষ পর্যন্ত আপত্তিকর অংশটি উপন্যাস থেকে বাদ দিতে হয়। শুধু তাই না, ভবিষ্যতে বিতর্কিত কিছু না লেখারও মুচলেকা দিতে হয়। গোলযোগকারীদের দাবীর প্রেক্ষিতে প্রশাসন লেখককে আপস করতে চাপ দেয়।
সেই অনগ্রসর সম্প্রদায় রাজনৈতিক সমর্থন নিয়ে সামাজিক মর্যাদার আন্দোলন গড়ে তুলে—তাদের জনগোষ্ঠীর আচরিত লোকাচারের বৈশিষ্ট্যগুলোকে অগোচরে রাখতে মরিয়া হয়ে উঠে। এ জাতগর্বী অসহিষ্ণুরাই জনসমাজে কেন্দ্রীয় শক্তির সমর্থন পায়।
সুমন ভাবে, এমন করেই ধর্মীয় আচারের নামে কিছু বকধার্মিক সমাজে অনাচার চালিয়ে যাচ্ছে। এ ধর্মগুরুও তাদেরই একজন।

চার

সেই প্রথম ঘটনা জানার পর থেকেই থানা সংলগ্ন উপাসনালয়ে আর সুমন প্রার্থনা করতে যায় না। ততদিনে অবশ্য থানা পরিষদের পাশে একটা উপসনালয় প্রতিষ্ঠা পায়। মার খেয়ে হাত ভাঙার পর থেকে ধর্মগুরু রবির বিষয়ে অফিস পাড়াতেও বেশ মুখ রোচক সমালোচনা হতে থাকে। একদিন অফিসের কর্মচারি সবুজ দুঃখ করে বলে, দেখুন এই ভণ্ড ধর্মগুরু একটা উপাসনালয়ের নেতা; তার মতো মানুষের কি কাজের মেয়েকে ধর্ষণ করা সাজে! তাইলে সমাজে মানুষ আর কাকে বিশ্বাস করবে? লোকটাকে তো আমি আগে থেকেই চিনি। আমাদের গ্রামের ধর্মশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষকের চাচাত ছোটভাই সে।
এরপর তাকে নিয়ে যে ঘটনা বললো, তা শুনে তো সুমন অবাক। ধর্মগুরুর গ্রামের বাড়ি জেলাসদরের শহরতলীতে। প্রথম চাকুরির সন্ধানে তার বড় ভাইয়ের কর্মস্থলে আসে। দেশে প্রথম গণবিপ্লব শুরু হয়। পরে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণ করে সমাজতান্ত্রিক দল। কিন্তু কয়েক বছরের মাঝেই পরাজিত শক্তি দেশে আবার হঠাৎ রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ঘটায়। এ সময়েই দেশটির বিপ্লবীদের বিপক্ষের দালালেরা গর্ত থেকে আত্মপ্রকাশ করতে থাকে। এ ভণ্ড ধার্মিক ওদের কোনো সদস্য কিনা সে সম্পর্কে অবশ্য কেউ জানার চেষ্টা করে নাই। তার চাচাত বড় ভাই তখন অন্যের বাড়িতে লজিং থাকে। কাজেই ছোটভাইকে তো নিজের কাছে রাখতে পারে না। তাই পাড়ার অন্য এক কৃষকবাড়িতে ছোটভাইয়ের থাকার ব্যবস্থা করে। কৃষকবাড়ির খড়ের বৈঠক ঘরের দুটি অংশ। একটি অংশে থাকে ঐ বাড়ির দশম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত এক ছেলে। অন্য অংশে কামলাদের নিয়ে থাকে তার এক চাচাত ভাই। তার চাচাত ভাইটি ষণ্ডা প্রকৃতির। স্কুলে পাঠরত ছেলের সাথেই তাকে রাত যাপন করতে দেয়।
সামনে এসএসসি পরীক্ষার জন্য মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা শেষে ছেলেটা রাত দশটার দিকে ঘুমিয়ে যায়। তার ইচ্ছে শেষ রাতে আবার পড়তে বসবে। কিন্তু রাত একটার দিকে ছেলেটা টের পায় যে, তার পায়ুপথে পিচ্ছিল কোনো পদার্থ এবং একটি শক্ত দণ্ড উৎপাত করছে। অমনি তার ঘুম ভাঙে। পাশফেরা মাত্র লোকটা সতর্ক হয়ে ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকে। এ ঘটনায় ছেলেটার মাথায় রক্ত উঠে। ঝট করে ঘর থেকে বের হয়। বাড়ির ভিতর গিয়ে কোনো একটা অস্ত্র খেঁাজে। তার ইচ্ছে লোকটাকে তখনি খুন করে ফেলবে। সে উদ্দেশ্যে হাতের কাছে পায় একটি খুন্তি। এদিয়েই উপর্যোপরি আঘাত করে খুন করার ইচ্ছে তার। কিন্তু পরমুহূর্তেই বোধোদয় হয়। ভাবে, খুন করলে তো ফাঁসিতে ঝুলতে হবে, নয় তো যেতে হবে জেলে। তাই সে খুন করার পরিকল্পনা বাদ দিয়ে জুতাপেটা করার সংকল্প করে।
যেই চিন্তাÑ সেই কাজ। প্রচণ্ড ক্ষোভে সে ঘরে ঢুকে। অন্ধকারে লোকটার মুখ শণাক্ত করে। অতঃপর পায়ের চপ্পল সেন্ডেল দিয়ে কোনো কথা না বলে লোকটাকে চট চট শব্দে পেটাতে থাকে। হাতে যে ধাতব খুন্তি, তার শব্দ শুনে লোকটি। তাই প্রাণভয়ে লোকটি বিছানা থেকে উঠে ঘর থেকে বের হতে থাকে। ছেলেটা ততক্ষণ তাকে জুতাপেটা করতেই থাকে। ঘর থেকে বেরিয়ে লেবাসধারী লোকটি দৌড়ে পালিয়ে যায়। এরপর আর তাকে ঐ এলাকায় দেখা যায়নি। তখন দালালদের ঘুরে দাঁড়ানোর সময়। এ সময় সে এমন কোনো প্রভাবশালী কারো সুপারিশ নিয়ে আসে, যে কারণে থানা সদরের বড় উপাসনালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত হয়।
সবুজ সাহেবের কাছে এ তথ্য শুনে সুমনের মনে হলো, এ ভণ্ড ধার্মিক যে বলাৎকারের মতো জঘন্য অপকর্মে লিপ্ত হয়েছিল, তা তাৎক্ষণিক কোনো ব্যাপার নয়। নিশ্চয় এটি তার প্রেকটিসে ছিল। সুমন ভাবে, তাহলে এমন প্রশিক্ষণ কি তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছত্রাবাস নিয়েছিল?
জেলা শহরে সুমন বদলি হওয়ার পর ধর্মগুরু সম্পর্কে খেঁাজ নিতে গিয়ে অফিসের এক সহকর্মীর কাছে সব জানতে পারে। সহকর্মী রতন বলে, সে তো আমার কিছুটা আত্মীয়…। তবে তার সম্পর্কে এমন কিছু তথ্য আমি জানি, যা প্রকাশের মতো না। সুমন বলে, আমি তো তেমন কিছু বিষয়ই জানতে চাই। রতন জানায়Ñ
তাদের বাড়ির পাশেই তো ওদের বাড়ি। বাবার একমাত্র ছেলে রবি। এ জন্যই নাকি মা—বাবা মানত করেছিল, ছেলেটাকে ধর্মগুরুর শিক্ষায় শিক্ষিত করবে। সংসারে ওরা তিন ভাই—বোন। বোনেরা বড়। পরিবারের সবচে ছোট সদস্য বলে সবার আদরের ছিল। যখন থেকে হাঁটতে শিখেছে, তখন থেকেই দুষ্টুমিতে সেরা হয়ে উঠে। যা হাতের কাছে পেত, ধুপুস—ধাপুস আছড়ে বা ছুঁড়ে ফেলে ঘরের পরিবেশ অশান্ত করে তুলত। পরিবারের আদুরে সন্তান বলে এসব দুষ্টুমির জন্য কড়া শাসন হতো না। আর তাতে লাই পেয়ে বলতে গেলে মাথায় উঠেছিল। এভাবে দূরন্ত এক শিশু বনে চারপাশ চষে বেড়াত। পরিবারে মা—বাবা এবং বড় বোনদের আদর—স্নেহের ঐ স্বর্গের সুখ তার কপালে বেশিদিন টেকেনি। কারণ, মাত্র ছয় বছর বয়সেই তাকে ভর্তি করে দেওয়া হয় উপাসনালয় সংলগ্ন ধর্মশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। বাবা একটি অফিসের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারি। আবাসিক ঐ উপাসনালয়ে বাবা তাকে প্রতিদিন দেখে যেতো। কোনো কিছুর সমস্যা আছে কিনা খেঁাজ—খবর নিতো। উপাসনালয়ের ধর্মগুরুর সাথে কথা বলতো এবং ছেলেটিকে যেনো বিশেষভাবে দেখে—শুনে রাখে সে ব্যাপারে বলে আসতো। কিন্তু পরিবারের ছায়াহীন পরিবেশ ছেলেটার ভালো লাগতো না। মা—বোনদের স্নেহ—আদরের তৃষ্ণায় মন আকুল হয়ে যেত। রাতে ঘুমুতে যাবার সময় ফঁুপিয়ে ফঁুপিয়ে কান্নায় ভাসতো। আর তখনি ধর্মগুরুর কঠোর শাসনের স্বর শুনে ভয়ে চুপসে যেত।
সে মনে করতো ভিন্ন ভাষায় ধর্মবিষয়ে মুখস্ত করার মহান ব্রত পালনের যোগ্য সে নয়। তবু চাপে পড়ে ধর্মের বাণী একে একে মুখস্ত করতে হতো। অথচ কিছুই বুঝতো না সে। গুরু অর্থ বুঝাতো না। কেবল মুখস্ত করাতো। সহপাঠীদের সাথে সেও সমতালে মুখস্ত করতো। কিন্তু তার মন পড়ে থাকতো মা—বোনের কাছে। তাদে আদর—স্নেহ বঞ্চিত শিক্ষা জীবন কাছে নীরস মনে হতো। কখনো মন হয়ে যেতো পাগলপারা। আর তাই সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে একদিন সত্যি সত্যি পালানোর জন্য বের হয়। প্রথমে যায় নদীর পাড়ে। মনে মনে পরিকল্পনা করে, এ পথে বাবার কাছে ধরা পড়লে বলব, ভালো লাগছিল না। তাই বেড়াতে এসেছি।
ভাগ্যিস ধরা পড়েনি। ভালোয় ভালোয় সাহেব কোয়াটারের পথে পুলিশলাইন স্কুলের পাশ দিয়ে তাদের বাসায় পেঁৗছে। তাকে দেখেই মা অঁাৎকে উঠে বলে, কিরে রবি পালাইয়া আইছস নাকি?
জবাবে সে হঁ্যা সূচক মাথা দোলায়। তখন মা বলেন, তোর বাবা বাসায় আইসা দেখলে তোরে কি আস্ত রাখবো!
—আমি বাসায় থাকবো না।
—কই যাবি!
—ছবি কাকার বাসায়।
—বোকা ছেলে, তোরা বাবা কি সেখানে তোকে খুঁইজা পাইব না।
এভাবে সে বারকয়েক পালিয়ে চলে আসে। কিন্তু বারবারই বাবা বাসা থেকে তাকে আবার সেই ধর্মশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দিয়ে আসে। যেহেতু এখান থেকে মুক্তি যাওয়ার কোনো উপায় নেই, তাই সে সহপাঠীদের মতো মানিয়ে নিতে তৎপর হয়। ওদিকে ছেলেটার পালানো স্বভাব দেখে ধর্মগুরু তার দিকে বিশেষ নজর দেয়। তাকে শাসন যেমন করে, তেমন আদর করে এটা সেটা খেতে দেয়। এভাবে সে ধর্মশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খাপ খাইয়ে নেয়। কাটে ক’বছর। ধর্মশিক্ষায় সহপাঠীদের সাথে সেও সমানতালে এগোয়। ছেলেটা দেখতে বেশ নাদুস—নুদুস। তার প্রতি বিশেষ নজর পড়ে ধর্মগুরুর। এক পর্যায়ে ধর্মগুরু তাকে সবচে বেশি গুরুত্ব দিতে থাকে। তাকে বিশেষভাবে ধর্শশিক্ষার পাশাপাশি গুরুদীক্ষা দেওয়ার জন্য গভীর রাত পর্যন্ত নিজের কক্ষে রাখে।
রবিকে ধর্মগুরু বলে, গুরুই হলো শিষ্যের পরম আশ্রম, গুরু পরমধন। পিতা—মাতা জন্মের কারণে পরম শ্রদ্ধার পাত্র। তবে গুরু ধর্মের পথ প্রদর্শক বলে মা—বাবা অপেক্ষা অধিকতর মান্যের। গুরু ¯্রষ্টার সাথে ভক্তের সংযোগ ঘটিয়ে দেয়। দীক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে শিষ্যকে অন্ধকার থেকে আলোর পথ দেখায়। বলা যায়, শিষ্য যদি গাড়ি হয় গুরু তার ইঞ্জিন। তবে গুরুর বাসনা অনুযায়ী গুরু দক্ষিণা দিতে হয়। গুরুকে নানা রকম উপহার দিতে হয়। তবু গুরুঋণ কখনো শোধ করা যায় না।
এমন ভূমিকা টেনে ধর্মগুরু রবিকে বলে, এখানে পড়াশোনা করছো প্রায় চার বছর। ধর্মশিক্ষায় তোমার অবস্থান সহাপাঠীদের চে’ ভালো। আশা করি কৃতিত্বের সাথে তুমি তা অর্জন করবে। সাথে সাথে দিয়ে যাচ্ছি গুরুদীক্ষা। এরজন্য এখন তোমাকে গুরুদক্ষিণা দিতে হবে।
জবাবে রবি বলে, কী দক্ষিণা দিতে হবে গুরু।
—যা দিতে হবে, তা তোমার আছে।
—বুঝতে পারি নাই গুরু।
—কোনো অর্থ—কড়ি না। এজন্য তোমার কিছু কষ্ট বা ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। যা চাই, তা কারোকে বলা যাবে না। শুধু তুমি আর আমিই জানবো।
—জি গুরু। বলুন কেমন ত্যাগ!
—এ সাধনা গভীর রাতের। আমার কাছে অনেক রাত পর্যন্ত থাকতে হবে।
—আমি রাজি।
এভাবে শিক্ষার্থীর মগজ ধোলাই করে তার সাথে ধর্মশিক্ষার নামে ধীরে ধীরে গোপন একটি অভ্যাস গড়ে তুলে। তখন এক রাতে রবির বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ে। রবিকে আনতে তার মা রতনকে পাঠায় উপাসনালয়ে। তখন রাত এগারেটা। রতন ওদের হোস্টেলে গিয়ে জানতে পারে রবি গুরুর কক্ষে। রতনের মনে সন্দেহ দানা বাঁধে। ভাবে, এত রাতে গুরুগৃহে কী করে রবি?
কাছে গিয়ে দেখে বাইরে থেকে ঘরের দরজা বন্ধ। সে চুপি চুপি টিনের বেড়ার ফাঁকে ভিতরে গুরুর বিছানায় আলনার আড়ালে তাকিয়ে যা দেখে, তাতে সে স্তম্ভিত। তারপর ফের একটু দূরে সরে গিয়ে রতন ডেকে বলে, রবি! তর বাপের খুব অসুখ। তর মা অহনই আমার লগে যাইতে কইছে।
এ কথা শুনে তড়িঘড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে আসে রবি। বাড়ি যাওয়ার পথে রতন বলে, ঘরে গুরু তর লগে কী করতেছিল, সব আমি দেখছি। আমার লগে ঘটনা খুইলা ক। নাইলে আমি মাইনসের লাগে কইয়া দিুম। আর যদি কস, তাইলে আর কারও লগে কইতাম না।
রবি তখন কাউকে না বলার শর্তে রতনকে জানায়, এই গোপন কর্মটি ধর্মগুরু যেমন করে, তেমনি আবাসিক হোটেলের সিনিয়ররা জুনিয়রের সাথে করে থাকে বলেও রবি জানায়।
সহকর্মী রতনের কাছে শুনে সুমন মনে মনে বলে, এভাবেই তবে তাদের মাঝে এই অনাচারটি যুগ যুগ ধরে চলে আসছে।

পাঁচ

ক’দিন আগে রাজধানীর স্বল্পদূরের এক রিসোর্টে ভিন্ন সম্প্রদায়ের লেবাসধারী এক ধর্মীয় নেতাকে নারীসহ আটক করে সাধারণ মানুষ। এ নিয়ে দেশে বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। সে আবার ধর্মান্ধ একটি উগ্রবাদী সংগঠনের নেতা। শেষে পুলিশ তাকে আটক করে। ধর্মান্ধ সংগঠনটি ইতোমধ্যে ধর্মরক্ষার অজুহাতে দেশের নানাস্থানে ভয়াবহ নাশকতা চালায়। ওই ভণ্ড নেতাকে আটক করে রিমাণ্ডে দেওয়ার পর থেকে বেরিয়ে আসে তার নানা অপকর্মের খতিয়ান। বেশ কয়েকজন নারীর সাথে তার বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্ক এবং ধর্ম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিশু শিক্ষার্থীদের বলাৎকারের মতো নানা অপকর্মের কাহিনীও প্রকাশ হতে থাকে। আর এ ইস্যুকে কেন্দ্র করেই দেশের এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিশু বলাৎকারের মতো অনাচারের বিষয় ফাঁস হতে থাকে। ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠনে শিশু বলাৎকার মতো অনাচারের বিষয়ে বিষ্ফোরাক তথ্য ফাঁস করে ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষা লাভ করা এক যুবক।
থানা সংলগ্ন উপাসনালয়ের অধীনে ততদিনে গড়ে উঠেছে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সারাদেশেই যেখানে বাজার বা উপশহরে বড় বড় উপাসনালয় আছে, সেখানেই গড়ে উঠছে ওসব ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে শুধু পূণ্যের আশায় ছেলে—মেয়েদের এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ানো হচ্ছে। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পাশ দেওয়ার পর অতিস্বল্প সংখ্যক শিক্ষার্থী যারা উচ্চশিক্ষা নিতে পারছে, তাদের কথা আলাদা। কিন্তু বেশিরভাগ শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষা নিতে পারছে না। যে ভাষায় ওরা শিক্ষা নিচ্ছে তার অর্থ না জেনেই ওরা মন্ত্রের মতো বুলি শিখছে। কর্মমূখী কোনো শিক্ষা ওরা পাচ্ছে না। ফলে এরা সমাজের বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
সুমনের মনে প্রশ্ন, থানা সংলগ্ন উপাসনালয়ের ভণ্ড ধর্মগুরু কতৃর্ক পরিচালিত ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবস্থাও কি অনুরূপ! এখানেও নিশ্চয় ধর্মীয় আচার—অনুষ্ঠান হয়। শুদ্ধাচারী আচারের আলোয় আলোকিত দিকটার অপর পাশেই তো অনাচারের জমাট বাধা অন্ধকার। আর আন্ধকারের রহস্য তো আলো না জ্বালালে স্পষ্ট হয় না। আঁধারের রহস্যে আবৃত থাকে অনেক কিছু।
এ থানা সদর ছেড়ে সুমন বিশ বছর আগেই জেলা শহরে বদলি হয়েছিল। সেখানেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করে। জেলা শহর থেকে গ্রামের বাড়ির যাওয়ার পথে থানা সংলগ্ন উপাসনালয়ের পাশের রাস্তায় সেই লোকটিকে দেখে এমন কতো প্রশ্ন সুমনের মনে উঁকি দেয়। সেসবের উত্তর কি মিলে…

উপরে