Main Logo
আপডেট : ২৮ ডিসেম্বর, ২০২৩ ১০:৩০

আজকের গল্প

পাপন

বহ্নি শিখা

পাপন

-মা, বাবু কোথায় গেছে?
-এই! চুপ। একদম চুপ। বাবুু বলবে না,বলবে লোকটা। লোকটা  কোথায় গেছে? এখন থেকে এভাবেই বলবে। ঠিক আছে?
-হুম। 
- হুম না। বল হ্যাঁ।
ভালো লাগেনি। মায়ের কথাগুলো। পঞ্চম শ্রেণীতে পড়া দশ বছরের ছেলে পাপনের। আস্তে করে সে বেরিয়ে গেলো রান্নাঘর থেকে।

মা একা একাই চিৎকার করে বাবাকে বকছে। জানোয়ার,বদমাইশ। খালি মিথ্যে কথা কয়। মিটিং না ছাই। সব লোক দেখানো। শয়তান কোথাকার।
কড়াই আর ছেনার (নাড়া কাঠি) শব্দে পাশের ফ্ল্যাটের কেউ উঁকি দিয়ে দেখে গেলো, রান্না করছে মিতা আর মনে মনে মুণ্ডু কষাচ্ছে সুতনুর। 
পাপনের বাবার। 

সূদুর ফরিদপুর থেকে ময়মনসিংহ বদলি হয়েছে সুতনু। চায়না কোকারিসের ম্যানেজারের চাকরি । সকাল দশটা থেকে রাত আটটা। সপ্তাহে একটা দিনই ছুটি। শুক্রবার। 
মিতা পাপনকে নিয়ে সারাদিন থাকে। তাই ওদের বেড়াতে নিয়ে যাবে বলেছিল। শুক্রবার বিকেলে।
ফরিদপুর একটা বে-সরকারি কলেজে পড়াতো মিতা। সুতনু অনেক টাকা বেতন পায়। মিতার চাকরি না করলেও চলে।
ছেলে পাপনের দেখভালের জন্য ছেড়ে দিতে হলো তার শিক্ষকতা। তা নিয়ে প্রায়ই ঝামেলা হয় দুজনের মধ্যে। পাপন ছোট হলেও বুঝে। কিছু বলে না-চুপ করে থাকে। মাঝে মাঝে কাঁদে। 

সেদিন একটু বেশি রকম বাড়াবাড়ি হয়ে গেলো। রাত নয়টা। রাতের খাওয়া হয়নি তখনও। 
কিছু আগে সুতনু এসেছে। স্নান সেরে এসে বিছানায় বিশ্রাম নিচ্ছে। পাশে বসে মিতা। মোবাইলের স্ক্রিন  উপর নীচ করছে।
 সুতনু চোখ বন্ধ রেখেই মিতাকে বলল
-কোম্পানি থেকে মিটিং ডেকেছে, সকাল আটটায় যেতে হবে। মিতা চিৎকার করে বলল
-মিথ্যে কথা। তোমার চালাকি আমি বুঝতে পারিনি ভেবেছো?
অনর্গল বকে যায়। যা ইচ্ছে তাই। কিছুতেই মিতা বিশ্বাস করতে চাইছে না সুতনুর কথা। সে ভাবছে সুতনু মিথ্যে বলছে। সে তার মা বাবার কাছে যাবে। 
সুতনু ভাবে যাওয়াটা খুবই প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সময় আর কাজের প্রয়োজনে কুলোচ্ছে না। হয়তো মা ভাবছে ভুলে গেছে সেতু। মা সেতু বলে ডাকে। কতদিন মা কে দেখা হয় না।
সুতনুর ইচ্ছে হয় না কোন কথা বলতে। মিতার অশ্রাব্য গালিগালাজ বেড়েই চলেছে। 
তার অবিশ্বাসগুলো দানা পাকিয়ে  মধ্যাকাশের গনগনে সূর্যের মতো প্রকট হয়ে উঠছে।
এরপর মুখ বন্ধ করে থাকতে পারেনি সুতনু।
কথা কাটাকাটির পর ধাক্কাধাক্কি। মিতা কপালে ব্যাথা পায় আলমারির কোনায় লেগে। 
সুতনুর সারা শরীরে অসম্ভব জ্বলুনি। নখের আচরে ছিড়ে গেছে কোনো কোনো জায়গায়। 

চিৎকার চেচামেচি কান্না এক ভয়ংকর অবস্থা। 
পাপন ভয় পায়। মা কে জড়িয়ে ধরে। সুতনু ব্যাগ গুছায়। একসেট শার্ট,প্যান্ট মিটিংয়ের কাগজপত্র। কিছু টাকা। 
হাজার টাকার হিসেব মিলছে না। দুটো বদ ছেলে আছে। কয়েকবার ধরা পড়েছে। অনেক দিনের পুরোনো। কিছু বলা যায় না। হাত থেকে টাকাগুলো পড়ে যায় সুতনুর। দ্রুত তুলে নেয়। পাশের রুমে যায়। ও জানে একবার রুম থেকে বেরুলে ভেতরে আসার পথ বন্ধ হয়ে যাবে। 
মিতা ফুঁসে চলেছে। ঢেলাঢেলি চলছে। ছেলেকেও বের করে দিল ঘর থেকে। বলল-যা বাপের কাছে যা। দুটোয় মর গে। বলে ভেতর থেকে লক লাগিয়ে দিল।

পাপন বারান্দায়। অন্ধকার। আকাশে অনেক তারা। ছ'তলা থেকে দেখা যায় অনেক দূর পর্যন্ত। অনেক উঁচু উঁচু বিল্ডিং,লাইট জ্বলছে। পাপন ভাবে ও-ই সব বাসায়ও কি ঝগড়া  হয়? ওখানেও কি আমার মতো কেউ আছে? কষ্ট পাচ্ছে ? টিচার আসবে একটু পরে। পড়তে ইচ্ছে করছে না। পাপনের চোখে জল আসে। 

সুতনু ফোনে কথা বলছে। পাপন শুনতে পায়
আজ আসবেন না।ম টিচার। ওর শরীরটা ভালো নেই।পায়ে পায়ে বাবার কাছে যায় পাপন। সুতনু ছেলেকে বুকে চেপে আদর করে। বলে-চল খেয়ে নিই। 

অনেকদিন পরে বাবার হাতের ডিমভাজি ভাত। 
ছেলেকে খাইয়ে নিজেও দু গ্রাস খেয়ে জল খায় সুতনু । মিতাকে হাজার ডাকলেও দরজা খুলবে না। খাবেও না। একযুগের অভিজ্ঞতা। এখন আর সাধাসাধি করার ইচ্ছে হয় না । 

নিজের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিয়ে যে মানুষ পাশের মানুষটির মন বুঝতে চায় না তাকে আর যাই হোক তোষামোদ করতে নেই।
পাপনকে ঘুমে রেখেই বেরিয়ে যাচ্ছে সুতনু। টেবিলে ঢেকে রেখে গেছে পাপনের প্রিয় ম্যাগি নুডলস। ঘুমন্ত ছেলেকে দেখে খুব মায়া হয়। 
রাতে ঘুমোনোর আগে বলছিল পাপন- বাবা,আমাকে কোনো হোস্টেলেই পাঠিয়ে দাও।

উপরে