Main Logo
আপডেট : ৫ জানুয়ারী, ২০২৪ ১১:৫২

আজকের গল্প

নূপুর

হালিমা সুলতানা

নূপুর
শ্বশুর বাড়িতে আজকে আমার প্রথম দিন। কখনো ভাবিনি এভাবে হঠাৎ বিয়ে হয়ে যাবে। জীবনে বিয়ের আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম কিন্তু চল্লিশ বছর বয়সে এসে বিয়ে হবে সেটা কখনো ভাবিনি। আমার স্বামীর কোন ভাই নেই দুটো বোন আছে একজন আমার স্বামীর বড় একজন ছোট। শ্বশুর- শাশুড়ি মধ্য বয়স্ক।  আমার একমাত্র ননদ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। শ্বশুর ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার ছিলেন এখন অবসরপ্রাপ্ত। স্বামী একটা কলেজের রসায়নের প্রভাষক, বয়স বিয়াল্লিশ,দেখতেও বেশ সুদর্শন। সব মিলিয়ে আমার জন্য উপযুক্ত একটা পরিবার। বিয়ের ক্ষেত্রে সব সময় আমি অর্থের চেয়ে শিক্ষার গুরুত্ব দিয়ে এসেছি। বাবার বাড়িতে তো অর্থ বিত্ত ছাড়া অন্য কিছুই পাইনি জীবনে, সেজন্যই হয়তো শিক্ষার প্রতি বেশ আগ্রহ ছিল ছোট থেকেই। বিছানার মাঝে আমাকে বসিয়ে দিয়ে আমার ননদ চলে গেছে পাশের রুমে। আমি একা বসে আছি। 
হঠাৎ শাশুড়ি আমার জন্য কিছু খাবার নিয়ে এসে বললেন-মা খাবারটা খেয়ে নাও সারাদিনে অনুষ্ঠানের ঝামেলায় তোমার যে ঠিক মতো খাওয়া হয়নি তোমার মুখ দেখেই তা বুঝতে পারছি। শাশুড়ির কথায় খাবারের প্লেটের দিকে তাকিয়ে কিছুটা অবাক হয়েছি। আমার প্রিয় চিংড়ি মাছ আলু দিয়ে ভাজা সাথে চিংড়ি মাছের ভর্তা।  আশ্চর্য এই বিয়ে বাড়িতে আমার জন্য এগুলো কে রান্না করলো? মনে হয় শাশুড়ি করেছেন। কিন্তু উনি কিভাবে জানলেন যে এই খাবারগুলো আমি পছন্দ করি ? আচ্ছা আমাদের বাড়ির কারো কাছে শুনেননি তো আবার? হতেও পারে তা না হলে এতো গোসত পোলাও এর  ভিড়ে চিংড়ি মাছের ভর্তা ভাজি হওয়ার কথা নয়।
-কি হলো মা, খাচ্ছো না কেন?  মুখে তুলে দেবো আমি ? ও তুমি তো আবার কারো হাতের খাবার খেতে পারো না। চিন্তা করো না খেয়ে নাও,এগুলো আমি রান্না করেছি শুধুমাত্র তোমার জন্য। শাশুড়ির কথা শুনে কিছুটা লজ্জা পেলাম। আমি ছোট থেকেই মা ছাড়া অন্য কারো হাতের রান্না খেতে পারি না। শাশুড়ী তাড়া দিলেন-কি হলো মা? 
-না মা কিছু না।  খাবারের প্লেটটা হাতে নিয়ে যখনই মুখে অল্প দিতে যাবো তখনি আমার ননদ রুমে ঢুকে বলে- মা, মা দেখো গিয়ে তোমার ছেলের কাণ্ড,নার্সারির সব ফুলের গাছ মনে হয় নিয়ে এসেছে ভাবীর জন্য। ও ভাবী তোমার প্রিয় রজনীগন্ধার গাছ সবচেয়ে বেশি। আচ্ছা ভাবী পৃথিবীতে এতো কিছু থাকতে তুমি এই গাছের প্রেমে কেন পড়লে? 
ননদের কথা শুনে আমি কি বলবো বুঝতে পারছি না কারণ আমার বিয়েটা হয়েছে পারিবারিকভাবে কিন্তু শ্বশুর বাড়ি এসে সবার আচরণে মনে হচ্ছে আমি ওদের অনেক দিনের পরিচিত । অদ্ভুতভাবে এরা আমার সম্পর্কে এতো নিখুঁতভাবে সব কিছু জানে যেটা হয়তো আমার পরিবারের আপনজনেরাও জানে না।
-কি হলো ভাবী তুমি খাচ্ছো না কেন?  আর হ্যাঁ, তোমার রুমটা রজনীগন্ধা দিয়ে সাজাতে বলেছি দুলাভাইকে। 
চুপচাপ খেয়ে খাটের এক কোণে বসে আছি পাশের বাসার কয়েকজন মহিলা এসেছেন আমাকে দেখতে নতুন বউকে অবশ্য পাড়া পড়শি সবাই দেখতে আসে এটাই নিয়ম কিন্তু এদের 
কথাগুলো কেমন জানি। একজন মহিলা বললেন- শেষ পর্যন্ত শিকড় তাহলে যুদ্ধে জয়ী হলো। এতো বছর যুদ্ধ করে শেষে জয়ের মুখ দেখতে পেলো শিকড় ( শিকড় আমার স্বামীর নাম)। কিসের যুদ্ধ আর কিসের জয় ঠিক বুঝতে পারছি না। হয়তো আমাদের বয়স বেশি এতো দিন বিয়ে হয়নি সেজন্যই এগুলো বলছেন। বড় ননদ ছোটো একটা বাচ্চা নিয়ে এসে আমার কোলে দিয়ে বললেন-এই যে খুশির মা, তোমার খেলার সাথী আজ থেকে একে নিয়ে সারা বাসা মাতিয়ে রাখবে।  তুমি তো ছোটো বাচ্চা পছন্দ করো। বাচ্চাটা দেখে আনন্দে আমার চোখে পানি চলে আসছে। এতো বয়স হয়ে বিয়ের পর আমার জীবনে বুঝি সুখের জোয়ার আসতে শুরু করেছে। আসলেই আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন তা না হলে আমার মা এতোদিন আমার বিয়ের জন্য কতো কিছুই না করেছেন কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছিলো না। কতো তাবিজ কতো ঘটক কত কবিরাজ সব শেষে সবকিছুতেই মা মোটামুটি ব্যর্থ হয়েছেন। আমি বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। দাদু আদর করে আমার নাম রেখে ছিলেন খুশি কিন্তু যখন আমার বয়স বিশ বছর তখন থেকেই সবাই আমার বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলো। আমি অবশ্য তখন এগুলো নিয়ে চিন্তা করিনি কারণ তখন তো আমার জীবন সম্পর্কে খুব বেশি জ্ঞান ছিলো না। যখন আমার বয়স আটাশ পেরুলো সবাই হাজার চেষ্টা করেও আমার বিয়েটা দিতে পারেনি তখন বুঝতে পারলাম জীবন কি জিনিস। আমার আশেপাশের পরিবেশ ধীরে ধীরে পরিবর্তন হতে লাগলো এমন কি আমার বাবা মাও কেমন জানি হয়ে গেলেন। যেই আমি ছিলাম সবার চোখের মনি সেই আমিই সবার কাছে বিরক্তির কারণ হয়ে গেলাম। আমার বয়স যখন পঁয়ত্রিশ তখন আমি কয়েক বার আত্মহত্যা করতে চেষ্টা করেছি কিন্তু বরাবরই আমি ব্যর্থ হয়েছিলাম। সবাই বলতো এতো পড়াশোনা করে কি লাভ জীবনেতো একটা প্রেম করতে পারলি না। সত্যি তখন মনে হতো একটা প্রেম করলে হয়তো এতো কষ্টের মাঝে জীবন কাটতো না। জীবনে প্রেমের প্রস্তাব কম আসেনি কিন্তু আমার চিন্তাধারায় একটাই ছিলো আমি বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান আমার বিয়ে বাবা মা নিজে পছন্দ করে দিবেন আর আজ আল্লাহ আমার সেই ইচ্ছে পূর্ণ করেছেন। এমন সময় গিয়েছে বাবা আমাকে বলতো- খুশি তুই কাউকে নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে পারিস না? আজকাল কত ছেলেমেয়ে এগুলো করছে তুই তো করতে পারিস, নাকি?
-কাকে নিয়ে আমি পালিয়ে যাবো বাবা?  বাবার উত্তর - তুই তো দেখতে খারাপ না তাহলে যে কোনো একটা ছেলের সাথে পালিয়ে যা মা। 
বাবার কথাগুলো শুনে মনে হতো পৃথিবীতে আমিই একমাত্র ব্যক্তি যার না আছে বেঁচে থাকার অধিকার না আছে মরে যাওয়ার অধিকার।  নিঃশ্বাস আটকে আছে গলার এপার ওপারে। 
আমার বয়সী আমার সব মামাতো ফুফাতো বোনদের বিয়ে হয়ে গেছ । তাদের ছেলে-মেয়ে কলেজে পড়ছে আর আমার তখনো বিয়ে হয়নি। সবাই আমাকে নিয়ে খুবই চিন্তায় থাকতো। 
একেতো চেহারায় বয়সের ছাপ তার উপর গত প্রায় বিশ-বাইশ বছর ধরে ঘুমহীন রাত্রি সব মিলিয়ে প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। নামাজ পড়ে দোয়া করতাম আল্লাহ আমাকে এই ইহকালের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দাও। আমি হয়তো জীবনে অনেক বেশি পাপ করেছিলাম সে জন্য  আমার মতো বড় পাপীর দোয়া আল্লাহ এতো বছর কবুল করেননি। খাওয়া গোসল প্রায় ভুলতে বসেছিলাম।  মাকে বললাম - মা আমি শহরে গিয়ে একটা চাকরি করবো। মায়ের উত্তর-সাঁইত্রিশ বছর যখন ঘাড়ের উপর বসে বসে খাচ্ছিস তাহলে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত আমাদের ঘাড়ের উপর বসে বসে খেয়ে দিন কাটিয়ে দে।  নিজের জন্মধাত্রী মাও কেমন পরিবর্তন হয়ে গেছে। আচ্ছা এতে আমার কী দোষ? দিনে দিনে মানসিক আর শারীরিকভাবে ভেঙে পড়লাম কিন্তু সেগুলো প্রকাশ করার মতো আপনজন আমার ছিলো না। একদিন সবকিছুর মায়া ছেড়ে নিজের শরীরে নিজেই আগুন 
দিয়েছিলাম মা বাবার চোখের সামনে, বাবা আমার শরীরে আগুন দেখে হেসে বলেছিলেন-তুই এতো সহজে মরে গেলে আমার ঘাড়ের উপর বসে বসে খাবে কে?  জামার আগুন যখন পেট ছেড়ে উপরের দিকে আসতে লাগলো পাশের বাড়ির এক ভাবী দৌড়ে এসে আমাকে মাটির মাঝে ফেলে দিয়ে গড়িয়ে চিৎকার দিয়ে বলেছিলেন -ওরে পাগল আল্লাহর দেওয়া এতো সুন্দর শরীরটাকে কেন পুড়িয়ে দিলি?  তর কি মরনের ভয় নেই মনে ? আর জেডাজি আপনিও কেমন বাবার চোখের সামনে নিজের মেয়ে শরীরে আগুন দিলো আর আপনি হাসছেন? ভাবীর কথায় বাবা ঘরে চলে গেলেন। মা মামাবাড়িতে ছিলেন। ভাবী মাকে খবর দিলেন সাথে সাথে। আমাদের বাড়ি থেকে মামার বাড়ি বিশ মিনিটের রাস্তা কিন্তু মা খবর পাওয়ার চার ঘণ্টা পরে সন্ধ্যাবেলা বাড়িতে এলো । এদিকে সারাটা দিন শরীর পোড়ার যন্ত্রণায় আমি ঝটপট করেছিলাম। সেদিন মনে হয়েছিলো আমি কোন মানুষ নয় একটা পাপের পাহাড় সে জন্য আল্লাহ আমাকে এভাবে জীবিত থাকতেই পোড়াছেন। একটা জামা ছিঁড়ে গেলে আর একটা জামা চাইলে মা বলতেন- তুই নতুন জামা গায়ে দিয়ে কোন্ নাগরকে দেখাবি তর কপালে তো একটা কানাও জুটে না। মায়ের কথায় আমি পাথর হয়ে যেতাম। আমাদেরতো টাকা পয়সায় কোনো অভাব নেই, এলাকায় দশটা ধনী পরিবারের মাঝে আমাদের একটা। তাহলে কেনো বাবা-মা আমার সাথে এমন আচরণ করেন?  তবে কি বিয়ে না হওয়াটা সম্পূর্ণ আমার দোষ? বাবা সবার বিষয়ে অনেক গুরুত্ব দিতেন কিন্তু নিজের মেয়ের বেলায় ঠিক উল্টো হয়ে গেলেন কেনো ?  মাঝে মাঝে মনে হতো আমি আমার মায়ের গর্ভের সন্তান নয় । একটা সময় মাও আমার থেকে বহু দূরে চলে গিয়েছিলেন। তখন আমি পুরোপুরি নিঃসঙ্গ একটা জীবনে সময়গুলো কাটিয়েছিলাম। আজ আল্লাহ আমাকে দু'হাত ভরে সবকিছু দিয়েছেন। সত্যি আল্লাহ তুমি মা-বাবার চেয়ে লক্ষ গুণে বেশি ভালোবাসো আমায় তা না হলে এমন একটা পরিবারে আমাকে বউ করে কেন পাঠাবে। আমার চোখের পানি দেখে বড় ননদ বললেন- কি গো খুশি, এমন খুশির দিনে তোমার চোখে পানি কেন? বড় ননদের কথা শুনে বাম হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে নিচের দিকে তাকিয়ে বললাম -কোথায় চোখে পানি? আমি তো এই বাচ্চাটাকে দেখে খুব খুশি হয়েছি আপু।
বড় ননদ বললেন - ঠিক আছে তাহলে আজ থেকে আমার এই ছোটো ছেলে তোমার সন্তান, তুমি এর মা। 
বাহ্! বিয়ে হতে না হতেই ছেলের মা হয়ে গেলাম! সত্যি আমার কপালে এতো সুখ ছিলো। 
সন্ধ্যাবেলায় আমাকে একটা আলাদা রুমে নিয়ে গিয়ে ছোটো ননদ বললো -ভাবী তুমি খাবার খেয়ে অল্প ঘুমিয়ে নাও ভাইয়া বাসায় ফিরতে কিছুটা রাত হবে। এতো সময় জেগে থাকলে তোমার শরীর খারাপ হবে তার চেয়ে অল্প খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো । সন্ধ্যাবেলায় খাওয়ার অভ্যাস আমার কখনোই ছিলো না কিন্তু আজকে খেতে হলো। নতুন বউ শ্বশুর বাড়িতে কি আর নিজের অভ্যাসগুলো সম্পর্কে বলা যাবে।  তার উপর এরা সবাই আমার প্রতি বেশ যত্নশীল। মনে হচ্ছে আমি সুখের সাগরে ভাসছি। রুমের লাইটটা নিভিয়ে দিয়ে ননদ বললো -ভাবী তুমি ঘুমিয়ে যাও কেউ তোমাকে বিরক্ত করবে না।
বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছি কিছুতেই ঘুম আসছে না। আসবেই বা কি করে গত অনেক বছর ধরেতো আমার রাতে ঘুমই হয় না। অনেকক্ষণ এপাশ-ওপাশ করার পর রুমের জানালাটা খোললাম।  রাস্তার আলোয় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে রাস্তাটা। এই রাস্তা দিয়েই আমার মামার বাড়িতে যেতে হয়। রাস্তাটা আমার পরিচিত হলেও আমার শ্বশুরের বাসাটা অপরিচিত। কী আশ্চর্য জীবনে কতবার এই রাস্তা দিয়ে আসা যাওয়া করেছি কিন্তু কখনো এই বাসাটা আমার নজরে আসেনি। রাতের রাস্তা দেখতে ভালোই লাগছে। যদিও শহরের রাস্তা তবুও এই রাস্তায় এতো যানবাহন চলাচল করে না। আচ্ছা শিকড় কোথায় গেলো? শ্বশুরবাড়িতে আজকে আমার প্রথম রাত্রি অথচ শিকড় এই সময় বাসার বাহিরে। অবশ্য এখন খুব বেশি রাত হয়নি মাত্র নয়টা বাজে। সেই যে সন্ধ্যাবেলায় ছোটো ননদ আমাকে এই রুমে ঘুমানোর জন্য রেখে গিয়েছিলো এরপর এই রুমে আর কেউ আসেনি,হয়তো আমার ঘুমের সমস্যা হবে ভেবে কেউ আসেনি।  আজকে সত্যি নিজের নামের স্বার্থকতা খুঁজে পেলাম। এভাবে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে আর ভালো লাগছে না এর চেয়ে বরং বিছানায় গিয়ে শুয়ে থাকি, যদিও ঘুম আসবে না তবুও এছাড়াতো এই মুহূর্তে আর কিছু করার নেই আমার। নিজের বাড়ি হলে ছাদে গিয়ে ফুলগাছগুলোর সাথে কথা বলতাম। আমার দুখের একমাত্র সঙ্গী ওরা। যখন অতিরিক্ত বিরক্ত লাগতো তখন সারারাত ছাদে কাটিয়ে দিতাম। এখানে তো সেই সুযোগ নেই।  আবার বিছানার এপাশ-ওপাশ করছি। রাত্রি যখন প্রায় এগারোটা বাজে ছোট ননদ রুমে এসে বললেন - ভাবী কি ঘুমিয়ে আছো ? 
আমি বললাম - না, ঘুম হয়নি।
ছোট ননদ বললো- তোমার ঘুমের ওষুধ বাসায় এসেছে। এখন তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আসোতো। সেই কখন থেকে সবাই তোমার জন্য অপেক্ষা করছে । ভাইয়া বললেন- খুশি ঘুমাচ্ছে? ওকে ঘুমাতে দেওয়া উচিত। ননদের কথা শুনে লজ্জায় আমার নাক মুখ লাল হয়ে গেছে। মাথা নিচু করে বিছানায় বসে আছি। 
-কি গো ভাবী, যাও না তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আসো,তোমাকে আবার সাজাতে হবে।  যাই হোক ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে দেখি বড় ননদ তার স্বামী, ছোট ননদ, পাশের বাসার কয়েকজন ভাবী আর শিকড়ের সব বন্ধুরা বসে আছে রুমে।
আমাকে দেখেই শিকড়ের বন্ধুরা বললেন - এই ভাবী আমাদের ট্যাক্স কোথায়? এতোদিন ধরে যে এতো কিছু করলাম আপনাদের জন্য এখন সেটার সুদে-আসলে হিসাব করে আমাদের দিতে হবে। 
কথাটা শুনে সাথে সাথে বড় ননদ বললেন - এই এখন খুশিকে সাজাবো ছেলেরা সবাই এই রুম থেকে বাহির হও। বড় ননদের কথার সাথে তাল মিলিয়ে ছোট ননদ আমাকে হাতটা ধরে বিছানায় বসিয়ে বললো - তাড়াতাড়ি এখানে বসো ভাবী, তোমাকে সাজিয়ে ভাইয়ার রুমে দিয়ে আমি ঘুমাতে যাবো। প্রায় বিশ মিনিট আমাকে সাজানোর পর শিকড়ের রুমে নিয়ে গেলো পাশের বাসার ভাবীরা। রুমটা দেখে আরও অবাক হলাম। পুরো রুম রজনীগন্ধা ফুলে সাজানো। এর চেয়ে বেশি অবাক হলাম বিছানার পাশের ছোট টেবিলের দিকে তাকিয়ে । টেবিলের উপর ছোট্ট একটা ছবির ফ্রেম আর ঐ ফ্রেমে আমার একটা ছবি বাঁধাই করা। এটা কিভাবে সম্ভব আমাদের বিয়েটা পুরোপুরি ঠিক হতে সময় লেগেছে পনেরো দিন। এতো অল্প সময়ে আমার ছবি বাঁধাই করে শিকড় তার নিজের বিছানার পাশে রেখেছে। আর আমিতো বিয়ের আলোচনার সময় আমার কোনো ছবি দেইনি শিকড়দের তাহলে আমার ছবি কোথায় পেলো? এমন নয়তো যে মা ওদের আমার ছবি দিয়েছেন? হতে পারে। আমাকে বিছানায় বসিয়ে সবাই চলে গেলেন। শিকড় আমার কাছে এসে বসে বললেন - খুশি,তোমার কি আমাদের বাসা এবং আমাদের পরিবারের লোকজন পছন্দ হয়েছে? 
আমি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললাম।  
শিকড় আবার বললেন-আচ্ছা খুশি,তুমি আজকে আমার কাছে কি উপহার চাইবে বলো। 
কি বলবো কিছুই মাথায় আসছে না। সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা মানুষ আমার স্বামী, তার কাছে কি চাইবো সেটাই বুঝতে পারছি না। 
-কি হলো খুশি কিছু বলছো না যে।
-আপনার যা পছন্দ আপনি সেটাই উপহার হিসেবে দিতে পারেন।
-তাই? পরে আবার বলবে না তো যে তোমার স্বামী তোমার বাসরঘরে এমন জিনিস উপহার দিলো যা তোমার পছন্দ নয়।
-না,না তা হবে কেন। আপনার যা পছন্দ তাই দিতে পারেন। আমার জন্য আমার স্বামীর পছন্দই সেরা।
-ঠিক আছে তাহলে একটু অপেক্ষা করো । এই বলে শিকড় একটা কাঠের আলমারি খোললো। আলমারি থেকে একটা ছোট্ট লোহার খাঁচা বাহির করে নিয়ে এসে আমার সামনে রাখলো। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি খাঁচাটার দিকে। অনেক পুরনো লোহার খাঁচা দেখেই বুঝা যাচ্ছে। খাঁচার লোহায় মরীচিকা ধরে আছে। ছোট্ট এই খাঁচাটার আবার একটা ছোট্ট দরজা আছে আর দরজায় লাগানো ছোট্ট একটা তালা। শিকড় আবার সেই আলমারির কাছে গিয়ে আলমারির ভিতর থেকে কি যেন একটা হাতে করে নিয়ে আসলো । আমার সামনে এসে হাতটা খুলে দিলো। কি আশ্চর্য এটা একটা ছোট্ট চাবি। মনে হচ্ছে ঐ লোহার ছোট্ট খাঁচার দরজার তালার চাবি এটা। শিকড় বললো- এই চাবিটা দিয়ে এখন এই খাঁচার দরজা খোলা হবে।  শিকড় মরীচিকা ধরা তালাটা অনেক কষ্টে খোললো । খোলার পর ওখান থেকে একটা নূপুর বাহির করলো। সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হচ্ছে ঐ একটা নূপুরের মাঝেও তালা লাগানো। আশ্চর্য নূপুরের মাঝেও তালা এটা কি জাদুর বাক্স নাকি?  শিকড় নূপুরের মাঝ থেকে তালাটা বাম হাত দিয়ে টেনে ছাড়িয়ে নিলো। সাথে সাথে আমার শরীরে একটা কাঁপন শুরু হয়ে গেলো। মনে হচ্ছে শরীর থেকে কোনো হাজার কেজি ওজনের বস্তু সরে গেছে। মুহূর্তের মাঝে শরীরটা তুলোর মতো হালকা হয়ে গেছে। শিকড় আমার দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললো- কি গো সুন্দরী,এমন করে এখনি ঘেমে যাচ্ছো কেনো,এখনো তো আমি তোমার কাছেই যাইনি। শিকড়ের কথায় কি বলবো ভেবে পাচ্ছি না, তবে আমার খুব ঘুম ঘুম পাচ্ছে। কি অদ্ভুত কাণ্ড এতো বছর ঘুমানোর জন্য কতো চেষ্টা করেছি কিন্তু রাত্রিবেলা কখনো কয়েক মিনিটের বেশি ঘুমাতে পারিনি। আর আজ আমার জীবনের একটা বিশেষ রাত্রি আর আজকেই আমার দুচোখের পাতা ভারী হয়ে পৃথিবীর সব ঘুম এসে জড়ো হচ্ছে। কোনো রকমে চোখের পাতা খুলে শিকড়ের দিকে তাকিয়ে আছি। শিকড় খাঁচা থেকে বাহির করা নূপুরটা আমার বাম পায়ে নিজের হাতে পরিয়ে দিলো। এরপর কি হলো আমি বলতে পারবো না কারণ তখন সাথে সাথে আমি ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। যখন ঘুম ভাঙলো তখন দুপুর দুইটা বাজে। ঘুম থেকে জেগে তাকিয়ে দেখি রুমে কেউ নেই আমি একা বিছানায় শুয়ে আছি। শরীরের উপর একটা পাতলা কাঁথা দেওয়া, হয়তো রাতে শিকড় এটা আমার শরীরে দিয়েছিলো। রাতের কথা মনে হতে একটা ধাক্কা খেলাম। ছি!ছি!এটা আমি কি করলাম,বিয়ের প্রথম রাতেই এভাবে ঘুমিয়ে গেলাম অথচ গত বিশ-বাইশ বছর ধরে আমি রাতে ঘুমাতে পারিনি । শিকড় কি ভেবেছে আল্লাহ ভালো জানেন।বেচারার সকল স্বপ্নের মাঝে আমি এভাবে পানি ঢেলে দিলাম। তাছাড়া ঘুমটাও ভেঙেছে দুপুর 
দুইটায়। বাসার সবাই এখন কি না কি ভেবে বসে আছে আল্লাহ জানেন। এদের বাসার সবাই আমাকে কতো ভালোবাসে আর আমি কি না এরকম একটা কাজ করে বসলাম। ভয়ে ভয়ে বিছানা ছেড়ে পাশের রুমে গেলাম। গিয়ে দেখি সবাই ওখানে বসে আড্ডা দিচ্ছে।  আমাকে দেখেই বড় ননদের স্বামী বললেন - কি খুশি, রাতে ঘুম কেমন হলো ? তা খাওয়া দাওয়া কিছু লাগবে নাকি না খেয়েই বাবার বাড়ি চলে যাবে?
বড় ননদ তার স্বামী কে একটা ধমক দিয়ে বললেন -তুমি চুপ থাকো তো। খুশি,যাও তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে এসো। নিশ্চয়ই অনেক খিদে পেয়েছে? 
খিদের কথা শুনে মনে হলো পেটে একটা মুচড় দিয়েছে। গতকাল সন্ধ্যাবেলা অল্প খেয়েছিলাম এরপর আর কিছু খাওয়া হয়নি। ফ্রেশ হয়ে খেয়ে তৈরি হয়ে নিলাম বাবার বাড়ি যাওয়ার জন্য। আমি, শিকড়,বড় ননদের স্বামী আমরা তিনজন বাবার বাড়িতে আসলাম। বিকালের দিকে বড় ননদের স্বামী চলে গেলেন ঢাকা, উনার ছুটি আজকেই শেষ তাই অনেক বলার পরও তিনি থাকলেন না। শিকড় আমাদের বাজারে গিয়েছে মাছ কিনতে শ্বশুর বাড়ির জন্য। এই সুযোগে আমি আমার গয়নাগুলো গুছিয়ে রাখছি,হঠাৎ গতকাল রাতের কথা মনে হলো। শিকড় আমাকে নূপুর উপহার দিয়েছিলো । আমি তাড়াতাড়ি নিজের পায়ের দিকে তাকালাম একি আমার এক পায়ে নূপুর কেন?  ডান পায়ের নূপুর কোথায়?  তখনি মনে হলো শিকড় লোহার খাঁচা থেকে শুধু একটা নূপুর বাহির করেছিলো। আমি আমার বাম পায়ের নূপুরের দিকে বেশ ভালো করে তাকিয়ে দেখে বুঝতে পারলাম নূপুরটা আমার বেশ পরিচিত। সাথে সাথে আমি আমার গয়নার বাক্সটা খুললাম। একটা কাগজে মুড়ানো আমার নূপুরটা বাহির করলাম। যেটা আমি আজ থেকে প্রায় বাইশ-তেইশ বছর আগে গুছিয়ে রেখেছিলাম। এরপর আমি আর কখনো নূপুর পায়ে দেইনি এমন কি সাদা রঙের থ্রি পিসও পরিনি। কিন্তু শিকড়ের কাছে এই নূপুর কিভাবে এলো? তাহলে কি শিকড় সেই! অনেকগুলো প্রশ্ন মনের মাঝে ভিড় করছে এই মুহূর্তে। শিকড় যদি সেই হবে তবে নূপুরটা একটা কৌটায় বা বাক্সের মাঝে রাখতে পারতো,এভাবে তালা দিয়ে লোহার খাঁচায় কেন রাখলো,আর হঠাৎ করেই গতকাল রাতে এভাবে ঘুমিয়ে গেলাম কেন,ওদের বাসার সবার আচরণের মাঝে এতো পরিচিতি খুঁজে পাই কেন?  আমার মাথা কাজ করছে না,কোনো রকমে 
গয়নাগুলো গুছিয়ে দৌড়ে দাদীর কাছে গেলাম। দাদীকে গত দুই দিনের সব কথা খুলে বললাম। দাদী নূপুরের কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লেন। বাসর রাতে এমন বিচিত্র উপহার কেউ কাউকে কখনো দিয়েছেন বলে দাদী শুনেনি। তাছাড়া নূপুর থেকে তালা খোলার সাথে সাথে আমার শরীরের কাঁপন এবং ঘুমের বিষয়টা দাদী সাধারণভাবে নিলেন না। তিনি আমাকে বললেন-খুশি মাগরিবের নামাজের পরে তুই আমার সাথে আমাদের নতুন হুজুরের কাছে যাবি হুজুরের জ্বীন ছাত্র আছে।তিনি এই রহস্যের সমাধান দিতে পারবেন। দাদীর কথায় আমি মাথা নাড়িয়ে ওখান থেকে চলে আসি শিকড়ের ডাকে।
-খুশি ও খুশি, দেখে যাও কতো বড়ো মাছ নিয়ে এসেছি বাজার থেকে। আমি শিকড়ের কাছে গিয়ে এই প্রথম শিকড়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করলাম এই কি সেই নাকি অন্য কেউ?  যদিও আমি ঐ ছেলের মুখের দিকে কখনো তাকিয়ে দেখিনি। আজ থেকে তেইশ বছর আগে তখন আমি ইন্টারমিডিয়েট প্রথম বর্ষের ছাত্রী। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে নতুন কলেজে ভর্তি হয়েছি।কলেজ থেকে মামাবাড়ি খুব কাছে তাই মা আমাকে মামাবাড়ি পাঠিয়ে দিলেন ক্লাস করার জন্য। পায়ে হেঁটে দশ-পনেরো মিনিটের রাস্তা মামা বাড়ি থেকে কলেজ। প্রতিদিন সকালে একা একাই কলেজে যেতাম।  রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় রাস্তার আশেপাশের কোনো কিছু কখনো আমার নজরে পড়তো না। প্রায় এক মাস যাওয়ার পর আমি বুঝতে পারলাম শহরে প্রবেশের মূল রাস্তার পাশে একটা মেকানিক্সের দোকান আছে আর ঐ দোকানে কয়েকটা ছেলে বসে প্রতিদিন আড্ডা দেয় আর আমাকে নিয়ে বাজে বাজে কথা বলে।যদিও এতোদিন এগুলো আমি খেয়াল করিনি কিন্তু আজকে একটা ছেলে এসে আমার রাস্তা আটকে ধরে। 
-কি গো সুন্দরী, এতো করে তোমার কথা বলি অথচ তুমি কখনো ফিরেও তাঁকাও না আমাদের দিকে। 
ছেলেটার কথা শুনে আমি তার পাশ কাটিয়ে কলেজে চলে গেলাম। এরপর থেকে আমি বুঝতে পারলাম ওরা প্রতিদিন আমাকে বিরক্ত করার জন্যই এই দোকানে এসে আড্ডা দেয়। আমি কখনো চোখ তুলে তাকিয়ে ওদের দেখিনি । কিন্তু দিনদিন অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছিলো তাই আমি আমার মামাতো ভাইকে বললাম-খায়ের শহরে প্রবেশের মুখে যে মেকানিক্সের দোকান আছে ওখানে কয়েকটা ছেলে বসে প্রতিদিন আড্ডা দেয় আর আমি কলেজে যাওয়ার সময় আমাকে উদ্দেশ্য করে বাজে বাজে কথা বলে। 
খায়ের বললো -খুশি আপু,তুমি চিন্তা করো না আমি এলাকার বড় ভাই কে এই সম্পর্কে বলবো।
যাই হোক এবার কিছুটা চিন্তা মুক্ত হলাম।পরের দিন যখন কলেজে গেলাম সেই আগের মতোই বিরক্ত করলো ওরা ।আমি মনে মনে বললাম বেটারা একটু অপেক্ষা কর তোদের ব্যবস্থা আমার মামাতো ভাই করবে আজকে। কিন্তু না,তা আর হলো না।এভাবেই ওরা বিরক্ত করতে লাগলো। এরপর আবার খায়েরকে এই বিষয়ে বললাম। খায়ের বললো - সরি আপু, আমি আসলে তোমার এই বিষয়টা ভুলেই গিয়েছিলাম।
খায়েরের কথা শুনে রাগারাগি করে আমি ওখান থেকে চলে এসে নিজের রুমে দরজা লাগিয়ে কান্না শুরু করলাম। মামা বললেন- কি হয়েছে, আমি বললাম- আমি বাড়িতে যাবো। ঐ দিনেই মামা আমাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। বেশ কয়েক দিন বাড়িতে থেকে আবার মামা বাড়িতে চলে গেলাম কারণ কলেজে তখন পুরোদমে ক্লাস হচ্ছিলো। পরের দিন যখন কলেজে যাচ্ছিলাম আমার শ্বশুর বাড়ির পাশের রাস্তাটা দিয়ে তখন হঠাৎ করে একটা ছেলে আমার পিছন থেকে বলে উঠলো- সাদা পরী সাদা জামা গায়ে দিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে সব ছেলেদের মন পাগল করে এখন আবার নূপুর পায়ে ঝুনঝুন শব্দ করে আমার মনে প্রেমের ঢেউ তুলে দৌড়ে যাচ্ছে। এমনি যদি যাবে তবে আমরা কিছু বললে এলাকার বড় ভাইদের কাছে কেনো বিচার দাও গো সাদা পরী?  ছেলেটার কথা শুনে আমি রীতিমতো দৌড়ে ঐ রাস্তাটা পার হওয়ার চেষ্টা করলাম কিন্তু বাঁধলো উল্টো বিপদ। আমার বাম পায়ের নূপুরটা কোন কিছুতে লেগে পা থেকে খুলে রাস্তায় পড়ে গেলো। এখন যদি আমি নূপুরটা রাস্তা থেকে তুলতে যাই তবে ছেলেটা আমাকে ধরে ফেলবে। সেজন্য নূপুর রেখেই দিলাম এক দৌড় কারণ ঐ রাস্তাটা তখন জনমানবশূন্য ছিলো।আমার দৌড় দেখে ছেলেটা পিছন থেকে চিৎকার দিয়ে বললো- এই যে সাদা পরী বিয়ে যদি করতেই হয় তবে আমি তোমাকেই বিয়ে করবো অন্য কাউকে না। আর এর জন্য আমাকে যা করতে হয় আমি তাই করবো।
সেদিন আর কলেজে যাইনি সরাসরি আমাদের বাড়িতে চলে এসেছিলাম। মা আমাকে দেখে 
বলেছিলেন- কিরে তুই তো গতকাল মামাবাড়িতে গেলি আজ আবার কেনো চলে এলি?  তখন মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে বলেছিলাম- মা,আমি আর মামাবাড়ি থেকে কলেজে যাবো না। আমাকে কলেজের হোস্টেলে পাঠিয়ে দাও। মা আমার কথায় কি ভেবেছিলেন জানি না কিন্তু এরপর আমি কলেজের হোস্টেলে থেকেই পড়াশোনা করি।
-কি খুশি মাছ পছন্দ হয়নি তোমার? 
শিকড়ের কথায় আমি ঝুড়িতে রাখা মাছের দিকে তাকিয়ে বললাম - বাহ্! মাছটা তো বেশ বড়।
শিকড় বললো- এই মাছের মাথাটা তুমি খাবে খুশি। তখন মাগরিবের আজান শুরু হয়। আমি নামাজ পড়তে চলে আসি। নামাজ শেষে দাদীর  সাথে নতুন হুজুরের কাছে গেলাম। হুজুর একজন তুলারাশি লোকের সাহায্যে একটা জ্বীনকে হাজির করলেন। দাদী হুজুরকে আগেই আমার সম্পর্কে সবকিছু বলে রেখেছেন। হুজুর জ্বীনকে সকল কিছু বললেন। জ্বীন শিকড়ের দেওয়া সেই নূপুরটা দেখতে চাইলেন। আমি বাম পা থেকে নূপুরটা খুলে হুজুরের কাছে দিলাম। হুজুরের হাতে নূপুরটা দেখে জ্বীন যা বললেন শুনে আমি আকাশ থেকে পড়লাম। গত তেইশ বছর আগে শিকড় আমার এই নূপুরটা দিয়ে কুফরি করে এবং আমার বিয়ে বন্ধ করে দেয়। এমন কি প্রতিমাসে আমার, বাবার, মায়ের পুরনো ব্যবহারের কাপড়ের টুকরো দিয়ে কুফরি করতো যাতে বাবা মার সাথে আমার দূরত্ব সৃষ্টি হয়। এমন কি আমার জন্য যতগুলো বিয়ের কথা হতো সবগুলো শিকড় আড়াল থেকে তার বন্ধুদের মাধ্যমে নষ্ট করতো আর সাথে তো কুফরি আছেই। আমি যখন রাস্তায় যাতায়াত করতাম দূর থেকে শিকড় বিভিন্ন লোকের মাধ্যমে আমার ছবি তুলে নিজের কাছে রাখতো। ছবিগুলোতে এমনভাবে কুফরি করা হতো যে আমার চেহারার লাবণ‍্য নষ্ট হয়ে যেতো। আর যতোদিন আমার বাম পায়ের নূপুরে তালা লাগানো থাকতো ততোদিন আমি রাতে ঘুমাতে পারতাম না। অনেক আগেই আমার পাগল হয়ে যাওয়ার কথা ছিলো কিন্তু নিয়মিত নামাজ রোজা রাখায় আমি পাগল হয়ে ঘরের বাহিরে যাইনি, তা না হলে শিকড় যতোদিন আমার ছবি তার বুকের মাঝে রেখে ঘুমিয়েছিলো ততোদিন আমি শিকড়ের বাসায় চলে যেতাম নিজের অজান্তেই। শুধুমাত্র ঠিক মতো নামাজ পড়া এবং রোজা রাখা তাছাড়া প্রতিদিন পবিত্র কুরআন মাজিদ পড়ার জন্য আমাকে কখনো ঘরের বাহিরে নিতে পারেনি কুফরি দিয়ে। আর এই সবকিছু শিকড় করেছে তিনটা কারণে 
এক - শিকড় আমাকে পছন্দ করে।  
দুই- আমার বাবা মায়ের সম্পত্তি যার একমাত্র ভবিষ্যৎ মালিক আমি।
তিন - শিকড়ের বাবা হওয়ার ক্ষমতা নেই। 
এগুলো শুনার পর আমি পাথর হয়ে গেলাম। একে একে শ্বশুর বাড়ির সকলের আচরণ এবং 
কথাগুলো আমার মনের মাঝে ভেসে উঠলো।এবার আমার কাছে সবকিছু পরিষ্কার হয়েছে।  কেনো শ্বশুর বাড়িতে আমার এতো আদর, কিভাবে সবাই আমার সম্পর্কে এতো কিছু জানে,আর কেনোইবা বাসররাতে শিকড় নূপুর থেকে তালা খোলার সাথে সাথে আমার শরীরের কাঁপন এসে শরীর হালকা হয়েছিলো আর 
কেনোইবা শিকড় আমার পায়ে নূপুর পরিয়ে দেওয়ার সাথে সাথে আমি ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। জীবনের এতোগুলো রঙিন দিন নষ্ট হয়েছে শুধুমাত্র শিকড়ের জন্য। এতোগুলো বছর আমি মৃত্যুর যন্ত্রণা ভোগ করেছি শুধুমাত্র শিকড়ের জন্য। কয়েকবার আত্মহত্যা করতে গিয়েছি সেটাও শিকড়ের জন্য। নিজের জন্মদাতা মা-বাবা পর হয়েছে শুধুমাত্র শিকড়ের জন্য। আমার ডান 
হাতটা আমার পেটের উপর রেখে একটা চিৎকার দিয়ে বললাম- দাদী গো আমার পেটের মাঝে আগুনে পোড়ার দাগটা কি কখনো মুছবে না?
দাদী আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন।
আমি দাদীকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম-কেঁদো না, আজকে আমার সকল কষ্টের পতন হবে, আমি সুখের রাজ্যে পা দেবো। বলেই ওখান থেকে হনহন করে আমাদের ঘরে চলে আসলাম। এসে দেখি শিকড় একা বসে টিভি দেখছে। আমি সরাসরি শিকড়ের ডান হাতটা ধরে টেনে আমার রুমের দিকে নিয়ে যাচ্ছি। শিকড় তখন বললো-কি হয়েছে খুশি, এভাবে আমাকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছো? আর এতো সময় কোথায় ছিলে তুমি? আমি তোমাকে মনে মনে সেই কখন থেকে খোঁজ করছি।
আমি বললাম - গতকাল রাতে আমাদের বাসর রাত ছিল কিন্তু সেটা হয়নি আমার ঘুমের জন্য তাই আমি ঠিক করেছি আজকে রাতে আমি ঘুমিয়ে যাওয়ার আগেই তোমার সাথে আমার বাসর হবে। শিকড় আমার কথায় কিছুটা লজ্জা পেয়ে বললো- সে না হয় হবে তা এতো তাড়া কিসের তোমার?  আমি কি হারিয়ে যাচ্ছি যে আমাকে খুঁজে পাবে না? 
আমি আমার রুমে ঢুকে সাথে সাথে দরজা লাগিয়ে দিয়ে বললাম-শিকড় একটা অদ্ভুত জিনিস দেখবে? বলেই আমার পেটের উপর থেকে শাড়িটা সরিয়ে দিলাম। শিকড় আমার পেটের দিকে তাকিয়ে বললো-খুশি তোমার পেটের উপর শাড়ি দাও এখনি। 
আমি বললাম-কেন আমার পেটটা দেখতে খুবই বাজে নাকি শিকড়?  
শিকড় তার দুচোখ নিজের দুই হাত দিয়ে ঢেকে বললো- প্লিজ খুশি, তুমি তোমার পেট ঢাকো। আমি বললাম-কেন ঢাকবো বলো? আমার পেটের মাঝে যে গর্তের সৃষ্টি হয়েছে সেটা কেনো হয়েছে তুমি জানো? জানো না? কিন্তু আজকে আবার সেই পুরনো গর্তে নতুন করে গর্ত হবে তবে সেটা আমার নয় তোমার পেটে। শিকড় বললো- তুমি এসব কি বলছো খুশি? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। 
-তোমার কিছু বুঝতে হবে না শিকড় তুমি শুধু দেখে যাও কি হয় এখন। বলেই আমি আমার রুমে রাখা কেরোসিন বোতলটা নিয়ে শিকড়ের শরীরের ঢেলে দেই।
-কি হচ্ছে এসব খুশি?  তুমি কি পাগল হয়ে গেছো খুশি?  
শিকড়কে আর কিছু বলতে না দিয়ে গ্যাসের ম্যাচটাতে আগুন জ্বালিয়ে শিকড়ের শরীরের ছুড়ে মারি। সাথে সাথে শিকড়ের সমস্ত শরীরে আগুন ধরে যায়। শিকড় চিৎকার দিয়ে বলছে-খুশি, আমাকে বাঁচাও খুশি,আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি খুশি। প্লিজ খুশি আমাকে বাঁচাও। কয়েক মিনিটের মাঝে শিকড়ের  চিৎকার শুনে বাবা, মা,দাদী,হুজুর, পাড়াপড়শি সবাই এসে আমার রুমের দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে আর বলছে - খুশি দরজা খোল খুশি, শিকড় যা করেছে তার শাস্তি আদালত দিবে, দেশে আইন আছে, আদালত আছে তারাই শিকড়ের কঠিন শাস্তি দেবে। আর আমি আর একটা কেরোসিনের বোতল খুলে শিকড়ের শরীরে ছিটিয়ে দিলাম। প্রায় দশ মিনিট পর শিকড় চিৎকার করতে করতে মারা গেলো। আমি তখন দরজা খুলে রুমের বাহিরে আসলাম। মা, বাবা,দাদী আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন -একি করলি খুশি, একি করলি?  এখন তোকে আমরা কিভাবে বাঁচাবো? এক ঘণ্টা পরে থানা থেকে পুলিশ আসলো। শিকড়ের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য পুলিশ হাসপাতালে নিয়ে গেলো। আমার দুই হাতে হাতকড়া বাঁধা। পুলিশ যখন আমাকে তাদের গাড়িতে তুলবে তখন আমি বললাম-আমাকে কয়েক মিনিট সময় দেবেন দারোগা সাহেব?  বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন-কিছু বলবি মা, খুশি? আমি বললাম-বাবা আমার আলমারিতে গয়নার বাক্সে কাগজে মুড়ানো আমার একটা নূপুর আছে ওটা নিয়ে আসবে বাবা? 
বাবা আমার কথা মতো আলমারি থেকে আমার নূপুরটা নিয়ে আসলেন। আমি আমার ডান পা-টা বাবার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম-বাবা মনে আছে আজ থেকে তেইশ বছর আগে আমি যখন কলেজে ভর্তির জন্য যাচ্ছিলাম তখন তুমি দুটো রূপার নূপুর এনে আমার পায়ে পরিয়ে দিয়ে বলেছিলে- আমার রাজকন্যা এখন থেকে যেদিকেই হেঁটে যাবে সেদিকেই নূপুরের ঝনকঝনক শব্দ হবে। বাবা তোমার রাজকন্যার যে দুটো পা ই খালি ছিলো গত তেইশটা বছর। বাবা ও বাবা দাও না তোমার রাজকন্যার দুটো পা আজকে নূপুর দিয়ে সাজিয়ে। আমার কথায় বাবা হাউমাউ করে কেঁদে কেঁদে আমার ডান পায়ে নিজের হাতে নূপুরটা পরিয়ে দিলেন। পুলিশ আমার হাতকড়া ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে আর আমার পায়ের নূপুর দুটো ঝনঝন শব্দ করে বেজে যাচ্ছে। আহ্! কি শান্তি এই নূপুরের শব্দে,আমার দীর্ঘ তেইশ বছরের কষ্টের সমাপ্তি হচ্ছে এই শব্দের ঝংকারে।
 
 
উপরে