Main Logo
আপডেট : ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪ ১০:০৪

আজকের গল্প

সময়ের দাবি

শিশির পাল

সময়ের দাবি
অবশেষে অপূর্ব কুসংস্কারের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে ভারতীকে আপনার করে নিল। এটাই ছিল সময়ের দাবি। 
গোঁড়া হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারের শিক্ষিত ছেলে অপূর্ব। নিয়ম নিষ্ঠা আর পূজা অর্চনার মধ্যেই থাকেন সারাক্ষণ। মা,দাদা-বৌদিকে নিয়েই তাঁদের সংসার। দাদার ব্যাংকের চাকুরী দিয়েই সংসার চলে। দাদা-বৌদির মধ্যে ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার নাই বললেই চলে। কিন্তু মায়ের মধ্যে ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কারের কোন ঘাটতি নাই। তার রান্না বান্না ও গৃহের অন্যান্য কাজকর্ম করার জন্য দুই জন নিয়ম নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ আছে। মা শুধু পূজা অর্চনা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। 
অপূর্ব একটু লাজুক ও ভীতু প্রকৃতির, বৌদিদের ঠাট্টা মসকারা পছন্দ করে না। এক কথায় অপূর্ব মা ছাড়া অন্য কোনো মেয়ে মানুষের সাথে তেমন একটা মেলামেশা করে না। ভীতু প্রকৃতির হলেও, সে সমাজ বিপ্লবের সাথে জড়িত। অপূর্বকে বিয়ে দেয়ার জন্য তার মা সম্ভ্রান্ত নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ পরিবারের রূপসী মেয়ে ঠিক করে রেখেছে।  মা অপূর্বকে একদিন কাছে ডেকে বলে, "আমি তোকে বিয়ে দেয়ার জন্য মেয়ে দেখে রেখেছি। তোর মত কি?" অপূর্ব লজ্জাবশত বললো, "দেখা যাবে ক্ষণ আগে একটা চাকরি-বাকরি পাই তো"। 
অপূর্ব ভালো মাইনের একটি চাকুরী পেয়েছে বেসরকারী কোম্পানিতে এবং পোস্টিং রাঙ্গামাটি। অপূর্বদের বাড়ি ময়মনসিংহ শহরে হওয়ায়, তার বেড়ে ওঠাও শহরে। সে যখন চাকরির বিষয় নিয়ে মার সঙ্গে আলোচনা করে, তখন তার মা সব কিছু শুনে বলে, " ওটা তো পাহাড়ি এলাকা, ওখানে বাঙালিদের বসবাস তেমন একটা নাই"। আরও বলে "নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান হয়ে ঐ ম্লেচ্ছ জায়গায় খ্রিষ্টানদের সাথে কিভাবে চাকরি করবি! যেখানে নিয়ম নিষ্ঠার কোন বালাই নাই, সেখানে তোর চাকরি করা হবে না"। মার এসব কথা শুনে অপূর্ব একটু দ্বিধা দ্বন্দ্বে পড়ে গেলো, কি করবে বুঝতে পারছে না। চাকরিটাও তার দরকার। অতঃপর সে তার দাদার সাথে চাকরির বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিবে বলে মনে মনে ঠিক করে।
ইতোমধ্যে অপূর্বর মা তার বড় ছেলে অমিতের  সাথে চাকরির বিষয় নিয়ে পরামর্শ করেছে। অপূর্বর দাদা অমিত মাকে বলেছে যে, "সে অবশ্যই চাকরিতে যোগদান করবে, এত ভালো মাইনের চাকরি না করার প্রশ্ন-ই আসে না। তাছাড়া নিয়ম-নিষ্ঠা ও কুসংস্কার নিয়ে পড়ে থাকলে তো আর পেট ভরবে না কাজকাম কিছু করতে হবে"। 
 
সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে এক নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ চাকর তেওয়ারিকে সঙ্গে নিয়ে অপূর্ব  রাঙ্গামাটিতে চলে যায়। যদিও পূর্বেই অফিস মারফত তার থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা সেখানে করা হয়েছিল। পূর্বনির্ধারিত কাঠের তেতালা বাড়ির দুতালায় তারা মাল-সামানা নিয়ে ওঠে গেলো । পাহাড়ি এলাকা বিধায় বাড়ি ঘর প্রায় সবই কাঠের নির্মিত, ইট পাথরের ছোঁয়া তেমন একটা লাগেনি। 
 
কাঠের বাড়ির তেতালায় বসবাসকারি একটি সাহেব খ্রিষ্টান পরিবারের কথা জানতে পেরে, নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ চাকর তেওয়ারির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার অবস্থা; এই বুঝি জাত গেলো। তেওয়ারি ছোট বাবুকে ডেকে বলে, "ছোট বাবু এখানে থাকা সম্ভব নয়, মাথার উপরে খ্রিষ্টানের বসবাস এটা মেনে নেয়া যায় না, আমাদের জাত যাবে যে।" ছোট বাবু অপূর্ব বলে, "কি বলছিস মাথার উপরে খ্রিষ্টান পরিবার!" তা হলে তো অন্য কিছু চিন্তা করতে হবে, আচ্ছা দেখা যাক কি করা যায়? 
মাথার উপরে কাঠের ফ্লোরে যখন হাঁটাচলা করে তখন ধুপধাপ শব্দ হয়। মনে হয় প্রায় সময়ই ইচ্ছা করে শব্দ করে, অযথা ঝামেলা করার জন্য। কারণ সাহেবরা তো বাঙালিদের পছন্দ করে না। এরকম শব্দে তেওয়ারি প্রায়ই তাদের উদ্দেশ্যে গালাগালি বকাঝকা করে। একদিন সন্ধ্যায় তেওয়ারি রান্নাবান্না করছে, এমন সময় উপর থেকে জল পড়ার শব্দ কানে এলো এবং দেখতে পেলো রান্নার উপরেও জল পড়ছে। পরে থাকার ঘরে গিয়ে দেখতে পায় পরিপাটি বিছানা ও আলনায় রাখা কাপড় চোপড় জল কাদায় ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে। এসব দেখে তেওয়ারির মাথায় খুন চেপে গেছে, কি করবে কিছু বুঝতে পারছে না। তেওয়ারি সাহেবদের উদ্দেশ্যে  যা ইচ্ছে তাই বলে গালিগালাজ করছে। বাহির থেকে তেওয়ারির আওয়াজ শুনে অপূর্ব বলছে, "কি হলো কার সঙ্গে রাগারাগি করছিস তোর মাথা খারাপ----- " কথাটা শেষ না হতেই অপূর্ব কাঠের সিড়ি বেয়ে ঘরে ঢুকেই বলে, "কি করে এমন হলো?" তেওয়ারি বলে, "ঐ শালা সাহেবের বাচ্চার কাজ। শালা মদ খেয়ে মাতাল হয়ে ফ্লোরে জল ঢেলে দিয়েছে।" এ-সবই সাহেবের মেয়ে ভারতী কাঠের পাটাতনের ফাঁকা দিয়ে অবলোকন করছে। 
 
রাতের খাবারসহ কাপড় চোপড়, বিছানা পাতির এ অবস্থা দেখে অপূর্বর মন খুব খারাপ হয়ে গেছে এবং মনে মনে বেশ রাগও হয়েছে। এ-সব দেখে ভারতী একটি ঝুড়ি ভর্তি ফলমূল নিয়ে, তাদের দরজায় কড়া নাড়ছে আর বলছে, "দয়া করে দরজাটা খুলুন!" একথা শুনে তারা দুজনেই হতচকিত হয়ে দরজা খুলে দিলো । সঙ্গে সঙ্গে ঘরে না ঢুকে ভারতী ফলের ঝুড়িটি দরজার কাছে রেখে বলে উঠলো, "আপনারা আমাদের ক্ষমা করে দিন, বাবা মদ খেয়ে মাতাল অবস্থায় নেশার ঘোরে এসব করেছে"। পূর্বেই তাদের কথা-বার্তা আলাপ আলোচনার ভিত্তিতে ভারতী জানতে পেরেছিলো, এরা রক্ষণশীল গোড়া হিন্দু বাঙালী ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান। এদের মধ্যে জাত পাতের বাচবিচার অনেক বেশি। এরা অন্য জাতের রান্নাবান্না করা কোনো কিছু খান না। তাই ওদের জন্য ফলমূল নিয়ে এসেছে। ভারতীর আনা ফলমূল ও ভারতীকে দেখে চাকর তেওয়ারি তেলে বেগুনে জলে উঠলো এবং মনে মনে বললো, "জুতা মেরে গরু দান করা হচ্ছে, নির্লজ্জ বেহায়া কোথাকার"। তেওয়ারি চিৎকার করে আরও বললো, "আপনারা কি ভেবেছেন আমাদের? যান যান এগুলো নিয়ে যান, আপনাদের ছোঁয়া ধরা কোন কিছু আমরা খাব না"। এদিকে অপূর্ব ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে বলে উঠলো, " কি বলছিস তেওয়ারি ফলমূল ত নষ্ট হয় না, ফলমূল ধুয়ে নিয়ে ভক্ষণ করা যায়। শুধু রান্নাবান্না করা কোনো কিছু খাওয়া যায় না"। সে ভারতীকে উদ্দেশ্য করে আরো বললো, "আপনারা কোন ধরনের ভদ্রলোক হে যে, সন্ধ্যা হতে না হতেই ঘরে মদের আসর বসিয়েছেন"। ভারতী লজ্জাবনত হয়ে বললো, " তার জন্য তো আমি আপনাদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী, আমার বাবা একজন বদমেজাজী মানুষ"। 
 
পরদিন সকালে ভারতীর বাবা এসে অপূর্বকে না পেয়ে তেওয়ারিকে যা তা বলে শাসিয়ে যায়, "ফের যদি এরকম গালিগালাজ করিস তো তোদেরকে মেরে ফেলবো"। এসব শুনে সে ভয়ে জবুথবু হয়ে যায়, কোন টু শব্দটিও করার সাহস পায় নাই। ভারতীর বাবা একজন সুদর্শন সুঠাম দেহের অধিকারী। ভারতীর বাবা সাহেব খ্রিষ্টান আর মা সম্ভ্রান্ত বাঙালী  ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে ছিলেন। ভারতীর মা যখন নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা, তখন তার ঔরসজাত বাবা মারা যান। ভারতীর ঔরসজাত বাবা ছিলেন সম্ভ্রান্ত বাঙালী ব্রাহ্মণ পরিবারের ছেলে। ভারতীর মা অপরূপ সৌন্দর্যের অধিকারী। উল্লেখ্য তার ঔরসজাত বাবা ও খ্রিষ্টান বাবা একই অফিসের কর্মকর্তা ছিলেন। সেই সুবাদে খ্রিষ্টান সাহেবের সাথে ভারতীর মার পরিচয় ছিল। তার ঔরসজাত বাবা মারা যাওয়ায় মা গভীর শোকে সাগরে ভাসতে থাকে, কি করবে কিছু বুঝতে পারছে না। এমতাবস্থায় খ্রিষ্টান সাহেব ভারতীর মাকে কাছে টানার অভিপ্রায়ে বিয়ের প্রস্তাব করে। ততদিনে ভারতী এক বছর দুই মাসে পা রেখেছে। তার মা  ভবিষ্যৎ চিন্তা করে, সাহেবের প্রস্তাবে রাজি হয়ে মেয়েসহ খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করে, সাহেবকে বিয়ে করে নতুন সংসার শুরু করেন। 
 
অপূর্ব পরদিন সকালে অফিসে গিয়ে তারপর একা একাউন্টটেন্ট বিনয় বাবুর সাথে সব কিছু শেয়ার করলেন। বিনয় বাবুই অফিসিয়ালি সেই বাসা তার থাকার জন্য ঠিক করে রেখেছিল। বিনয় বাবু বলেন, "ঠিক আছে স্যার বিষয়টা আমি দেখবো"। বিনয় বাবুও একজন হিন্দু বাঙালী ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান। সে স্ত্রী পুত্র নিয়ে রাঙ্গামাটিতে তিন বছর ধরে নিজস্ব বাড়িতে অবস্থান করছে। 
 
একদিন সন্ধ্যায় অফিস শেষে অপূর্ব লঞ্চ টার্মিনাল এলাকায় হাঁটাহাঁটি করছে, এমন সময় দেখা পায় তার বাবার বন্ধু পুলিশ কর্মকর্তা সংকর রায়ের। তাকে দেখে অপূর্ব হতচকিত হয়ে যায় এবং বলে, "কাকাবাবু আপনি এখানে কতদিন এবং কেন?"। কাকাবাবু তাকে জড়িয়ে ধরে উত্তরে বললেন, ”আজ সাত দিন হলো এখানে এসেছি গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজে । তা তুমি এখানে কেন? কি কাজে এসেছ?" অপূর্ব জানায় " আমি কোম্পানির চাকরি নিয়ে বিগত তিন মাস যাবত এখানে আছি।"
কাকাবাবু জানতে চায় 
" তা তোমার মা এতদূরে আসতে দিলো তোমায় ! তোমার মা, দাদা-বৌদি কেমন আছে?" 
অপূর্ব জানায় "ভালো আছে কাকাবাবু।"
কাকাবাবু অপূর্বকে সাবধান করে দিতে ভুল করে না " এখানে কিন্তু কোনো রকম আন্দোলন টান্দোলনের সাথে জড়িও না। মন দিয়ে ভালো ভাবে শুধু চাকরি করবে। আমাদের কাছে খবর আছে স্বাধীকার আন্দোলনের এক বড়সড় নেতা হামিদ মজুমদার আজ এখানে আসছে, তার সংঘঠনের মিটিং করতে। তাকে ধরার জন্যই আজকে আমাদের এ আয়োজন।" 
ঘাটে লঞ্চ ভিড়লে ভিতর থেকে হামিদ মজুমদার দেখতে পায় পুলিশ বাহিনী সমস্ত টার্মিনাল ঘিরে রেখেছে। যদিও পূর্ব থেকেই সে ছদ্মবেশ নিয়ে আছে। একে একে সব যাত্রীর সাথে হামিদ মজুমদারও যখন টার্মিনালে নামেন, তখন 
সন্দেহ বশত পুলিশ তাকে তল্লাশি করে। যদিও পুলিশ তাকে চিনতে পারেনি। কৌতূহলবশত টার্মিনালে অবস্থানরত অপূর্ব এ সব কিছুই পর্যবেক্ষণ করছে। পরিশেষে পুলিশ কর্মকর্তা সংকর রায়ের সাথে কথা বলে অপূর্ব বাসায় চলে যায়। 
 
কয়েক দিন পর একাউন্টটেন্ট বিনয় বাবু, ভারতীদের পরিবারের সাথে দেখা করে এবং অপূর্বদের সাথে মিলেমিশে থাকার জন্য বুঝিয়ে বলে আসেন। তেওয়ারিকে রেখে অপূর্ব অফিসিয়াল কাজে বান্দরবান ও পার্বত্য চট্টগ্রামে যান। তার সেখানে দিন পনের থাকার পরিকল্পনা আছে। অপূর্ব চলে যাওয়ার দুই দিন পর তেওয়ারি ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়। অপূর্বদের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে, ভারতী একদিন তাদের দরজায় কড়া নাড়তে থাকে কিন্তু ভিতর থেকে কোনো সাড়া পায় না। বেড়ার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে তেওয়ারি অচেতন অবস্থায় মেঝেতে পড়ে আছে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ভারতী দরজায় ধাক্কা দেয় এবং সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে যায়। সে তাড়াতাড়ি তেওয়ারির কাছে গিয়ে মাথায় হাত দিয়ে দেখে প্রচণ্ড জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে কাছে বসে ভারতী তেওয়ারির কপালে জলপট্টি দেওয়া শুরু করে। সে যে একজন খ্রিস্টান পরিবারের সদস্য সেটা ভারতী নিজেই ভুলে গিয়েছিল মানবতার তাগিদে। কারণ তেওয়ারিরা তো গোড়া ব্রাহ্মণ পরিবারের, খ্রিস্টানের স্পর্শে যে তাদের জাত যাবে। 
 
তেওয়ারির জ্বর তো কোনো ভাবেই কমছে না, বরঞ্চ দিন দিন অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে! এদিকে ডাক্তারও কিছু করতে পারছে না। ভারতী একটু ভেবে নিয়ে সোজা অপূর্বর অফিসে গিয়ে ঠিকানা সংগ্রহ করে তেওয়ারির ঘটনা জানিয়ে তাকে জরুরি টেলিগ্রাম করে দেয়। টেলিগ্রাম পেয়ে অপূর্ব চলে এসে দেখতে পায়, ভারতী তেওয়ারির পাশে বসে; তার  সেবা করছে। এ দৃশ্য দেখে অপূর্বর মাথা খারাপ হয়ে যায় এবং মনে মনে ভাবে এই বুঝি জাত গেলো। যদিও এর কোনো বিকল্প ছিলো না। ভারতীর অপরিসীম সেবাযত্নের মাধ্যমে তেওয়ারি মাসখানেকের মধ্যে পুরাপুরি সুস্থ হয়ে উঠলো। ভারতীর মানবিকতা দেখে, অপূর্ব তার উপর ধীরে ধীরে দুর্বল হতে শুরু করে। কিন্তু ভারতীর কাছে লজ্জায় ভয়ে কোনো কিছু প্রকাশ করে না। তবে তাদের মেলামেশা চলতে থাকে। 
 
কিছু দিন পর ভারতীর পরিবার এ বাড়ি ছেড়ে দিয়ে অন্যত্র চলে যায়। এরপর থেকে ভারতীর সাথে অপূর্বর তেমন একটা দেখা সাক্ষাৎ হয় না। তেওয়ারি যদিও সুস্থ হয়ে উঠেছে কিন্তু শারীরিক দুর্বলতা এখনো কাটে নাই, মুখে খাওয়ার রুচি নাই। তাই সে বাড়ি যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে গেছে। একদিন রাতে তেওয়ারি অপূর্বকে বলছে "চল দাদাবাবু বাড়ি থেকে ঘুরে আসি, অনেক দিন তো হয়ে গেলো আর ভালো লাগছে না; তাছাড়া শুনলাম মা ঠাকরুনের শরীর টাও নাকি ভালো যাচ্ছে না!" সে আরও বললো "ভারতী দিদিমনিরা কোথায় থাকে তা কি তুমি জান! তাদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ হয়?মেয়েটা যে কি আদর যত্নই না করলো আমাকে! মেয়েটার জন্য মন পুড়ে!" প্রতি উত্তরে অপূর্ব বললো, "না ওদের সাথে অনেক দিন দেখা নাই, তবে শুনেছি লঞ্চ টার্মিনালের ঐদিকে কোথায় যেন থাকে?" 
 
মার অসুস্থতার খবরে অপূর্বর ভালো লাগছে না, মন চঞ্চল হয়ে উঠেছে; তাই সে এক সন্ধ্যায় একটু অন্যমনস্ক ভাবে লঞ্চ টার্মিনাল এলাকায় হাঁটাহাঁটি করছে। এমন সময় ভারতীর কথা মনে পড়ায়, অপূর্ব তার খোঁজ খবর করছে। খোঁজাখুঁজির এক পর্যায়ে অপূর্ব ভারতীকে পেয়ে গেলো এবং কুশল বিনিময়ের পর জিজ্ঞাসা করলো, "আপনি সেই যে বাসা ছেড়ে এলেন আর কোন খোঁজ খবর নেই, কোথায় আছেন? কি করছেন কিছুই তো জানিনা?ও হ্যা ভালো কথা শুনুন, তেওয়ারি তো সুস্থ হয়ে উঠেছে তবে মুখে খাওয়ার রুচি নাই। সব সময় আপনার কথা বলে, বলে,দিদিমণি যদি আমার সেবা যত্ম না করতো, তা হলে এ যাত্রায় আর বাঁচার কোন উপায় ছিলো না। আরো বলছিল, খ্রিস্টান ভেবে দিদিমণিকে কতই না অপমান করেছি। যাক সেসব কথা শুনুন মা'র শরীরটা নাকি খুব ভালো যাচ্ছে না"। ভারতী বলে, "অপূর্ব বাবু আমাকে কি কথা বলার সুযোগ দিবেন? না আপনি একাই বক্ বক্ করে যাবেন"। ভারতীর একথা শুনে অপূর্ব স্তম্ভিত ফিরে পেয়ে বলে, "ও তাই তো, আমি তো ভুলেই গেছি! হয়েছে কি অনেক দিন পর তো দেখা, তাই জমে থাকা সব কথা একেবারে উগলে দিচ্ছি"। ভারতী বলে, " মা'র কি হয়েছে? আপনাকে খুব উতলা মনে হচ্ছে"। অপূর্ব জানায়  "তেমন কিছু না বার্ধক্য জনিত আর আমার জন্য একটু টেনশন করে"। ভারতী বলে " আমি এখানে একটা সেচ্ছাসেবী সংঘঠনে যুক্ত আছি। আমরা খেটে খাওয়া মেহনতী মানুষের উন্নয়ন ও অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে কাজ করছি"। হাঁটতে হাঁটতে ভারতী অপূর্বকে বলে, "তা আপনি কি আমাদের সংঘঠনের ডেরায় যাবেন? আজ আমাদের সংঘঠনের মিটিং আছে, ঢাকা থেকে একজন বড় লিডার এসেছে।" অপূর্ব চলেন বলে, একসাথে হাঁটতে হাঁটতে কিছুক্ষণের মধ্যে সংগঠনের ডেরায় পৌঁছে যায় এবং দেখতে পায় সেখানে অবস্থান করছে মহিলা ও পুরুষ মিলে আট দশ জন লোক। ভারতী প্রথমেই তাদের লিডার হামিদ মজুমদারের সাথে অপূর্বর পরিচয় করিয়ে দেয়, তাদের একজন শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে। কারণ ভারতী জানতেন অপূর্ব একজন সমাজ বিপ্লবী। মিটিং শেষে রাত্রে বাসায় ফিরে অপূর্ব ভারতী সম্পর্কে সব কিছু তেওয়ারিকে জানালেন।
 
অপূর্ব চাকরির পাশাপাশি ভারতীদের সংঘঠনে মাঝে মাঝে সময় দেন। এভাবেই অপূর্ব ও ভারতী একে অপরের কাছাকাছি আসে । কিন্তু কেউ কারোর কাছে ভালোবাসার কথা প্রকাশ করে না। তবে সুখ দুঃখের কথা একে অপরের সাথে শেয়ার করে। বিশেষ  করে অপূর্ব তার মায়ের কথা ভারতীকে বলে। মা তার জন্য অনেক টেনশন করে, মা তার বিয়ে ঠিক করে রেখেছে এইসব। 
 
অপূর্ব মায়ের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে তেওয়ারিকে নিয়ে বাড়ি চলে যায়। ভারতীকে কিছু জানাতে পারে নাই। অপূর্বর কোন খোঁজ খবর না পেয়ে ভারতী তাদের বাসায় যায় এবং অপূর্বকে না পেয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। কি করবে কিছুই বোঝে উঠতে পারছে না? এমতাবস্থায় একাউন্টটেন্ট বিনয় বাবুর কথা মনে পড়ায় সোজা অপূর্বর অফিসে চলে যায় ভারতী। সে বিনয় বাবুর সাথে কথা বলে অপূর্বর মায়ের মৃত্যু সংবাদ সহ বিস্তারিত জানতে পারে । এদিকে তেওয়ারি ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে গেছে। 
 
অপূর্ব মায়ের মৃত্যুজনিত অনুষ্ঠানাদি সম্পাদন করে রাঙ্গামাটিতে ফিরে আসে। তেওয়ারি না আসায় রান্না বান্নাসহ গৃহের সমস্ত কাজ কর্ম অপূর্বকেই করতে হয়। ফিরে আসার খবর জানতে পেরে ভারতী তার সাথে দেখা করার জন্য চলে আসে। অপূর্বর এহেন পরিস্থিতি দেখে, ভারতী আবেগে আপ্লূত হয়ে কান্না জড়িত কন্ঠে বলে, "আমি কি আপনার কোনো কাজে আসতে পারি?" ভারতীর এ প্রস্তাবে অপূর্ব কি করবে বুঝতে পারছে না। ভালবাসা মানে না কোনো জাতফাত। তাই গোড়া ব্রাহ্মণ হয়েও অপূর্ব ভারতীকে তার নিঃসঙ্গ জীবনের সাথী করে নিতে হাত বাড়িয়ে দেয়।
 
 
 
উপরে