Main Logo
আপডেট : ২২ মার্চ, ২০২৪ ১১:১৩

বুড়ো চাচা আমি এবং সৃজন

শাহীন খান

বুড়ো চাচা আমি এবং সৃজন
বুড়োর পাশ দিয়ে যেতেই তিনি আমাদের ইনিয়ে- বিনিয়ে কেঁদে কেঁদে বললেন ," বাবারা আজ তিনডা দিন দইরা না খাইয়া আছি লড়তে চড়তে পারি না, যক্কায় বুগজি, গরে জুয়ান পোলা। বউ পোলাপান লইয়া সুহে শান্তিতে দিন কাডায়। ইলশা মাছ, ফজলি আম, দুদ পেত্তেক দিন খায়, মোর কপালে হেয়া তো দূরের কতা এ্যাক বোতল সিরাপও জোডে না। খিদার জ্বালায় পরানডা যায়!  কিছু খাইতে দেবা?  একথা বলেই জোরে জোরে কাশতে লাগলো এবং খুব কষ্টে শ্বাস নিতে লাগলো। তার এহেন অবস্থা দেখে আমাদের  চোখের কোণে পানি জমে গেলো। পকেট হাতড়িয়ে কিছু টাকা পেলাম, সেই টাকা দিয়ে একটি রুটির প্যাকেট কিনে বুড়োর হাতে দিলাম। বুড়ো কাঁপা কাঁপা হাতে প্যাকটটি নিয়ে তাড়াহুড়ো করে ছিঁড়তে চেষ্টা করলেন, কিন্তু পারলেন না। 
 
আমি বললাম- চাচা মিয়া, প্যাকেটি আমার কাছে দিন, প্যাকেটটি ছিঁড়ে রুটিটি বের করে দিই। বুড়ো আমাদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে প্যাকেটি হাতে তুলে দিয়ে বললেন, "তোমরা বড়ো বালো পোলা, তোমাদের আল্লাহ দনে মানে বরো হরুক। তা বাবারা কিচু খাইয়া রাকতে পারি না, বারে বারে বায়রায় যাই।"
-চাচা মিয়া আপনার এ অবস্থা কি আপনার ছেলে জানেন? 
-হ বাবা সব জানে। মোরে এই বাঙ্গা গরে রাইক্কা, খালের ওপারে টিনের গর উডাইয়া থাহে। মোর দিকে ফিইররাও চায় না। বুড়ো চাচার কথা শুনে ইচ্ছে হলো তার ঐ অপদার্থ অবাধ্য ছেলেটার কান ধরে টেনে এনে আচ্ছা করে ধোলাই দিয়ে বুড়োর পায়ের উপর ফেলে মাফ চেয়ে নিতে বলি। কিন্তু তা আর হলো না। 
 
সেদিন রাতেই বিশেষ কাজে আমাকে নলছিটির ঘাঁটাখালিতে যেতে হলো। যাওয়ার সময় সৃজনের হাতে একহাজার টাকার চারটি নোট গুঁজে দিয়ে বললাম-বুড়ো চাচাকে ডাক্তার দেখাস সেই সাথে কিছু খাবার কিনে দিস। কাজ শেষ করতে দু' চার দিন লেগে যেতে পারে। 
 
কাজ শেষ করে পাঁচ দিন পর বাড়ি এসে পুনরায় ঝক্কি - ঝামেলায় পড়তে হলো। তাই সৃজনের কোনো খোঁজ নিতে পারিনি। সৃজনও এর মধ্যে কোনো খোঁজ নিতে আসেনি। হঠাৎ বুড়ো চাচার কথা মনে পড়ায় মাকে সৃজনের কথা জিজ্ঞেস করতেই মা তড়িঘড়ি করে ঘরের ভেতর থেকে একটি খাম নিয়ে এসে হাতে তুলে দিয়ে বললেন "এই চিঠিটা সৃজন তোকে দিতে বলেছে, মনে ছিলো না, তাই দিতে পারিনি। ওর মন ভালো নেই, বানারীপাড়ায় গিয়েছে,  আসতে কদিন দেরি হবে।" একথা বলেই মা তার নিজের কাজে চলে গেলেন। আমি খামটি ছিঁড়তেই বেরিয়ে এলো সেই একহাজার টাকার নোট চারটি এবং এক টুকরো কাগজ। তাতে লেখা -
প্রিয় শাহীন, 
ভালোবাসা জানিস। তোর কথা মতো পরের দিন বেলা ন'টার দিকে বুড়ো চাচার জন্য ডাক্তার ও খাবার নিয়ে গিয়ে দেখি বুড়ো চাচা সেখানে নেই। আশেপাশের লোকজনকে জিজ্ঞেস করায় কেউ কেউ বললো, ঘরের ভেতর বোধহয় ঘুমিয়ে আছে, ভেতরে গিয়ে দেখতে পারেন। 
আমি আর ডাক্তার ঘরের ভেতর গিয়ে বুড়ো চাচাকে ঘুমানো অবস্থায় ঠিকই দেখতে পেলাম। ঘুম থেকে জাগানোর জন্য বারবার ডাকলাম কিন্তু সাড়া না পেয়ে শরীর ছুঁয়ে মৃদু ধাক্কা দিতেই সমস্ত শরীর নড়ে উঠলে ডাক্তার নাড়ি পরীক্ষা করে বললেন-চাচা মারা গেছেন। কী আর করি, হতাশ হয়ে সব্বাইকে ডাকলাম, তার ছেলে এসে মায়া কান্না কেঁদে লাশ নিয়ে গেলো। আমিও গেলাম। গিয়ে চাচার কবর খুঁড়েছি। আর মনে মনে তোকে স্মরণ করেছি। চাচাকে কবর দিয়ে এসে ভালো না লাগায় বানারীপাড়ায় চলে এলাম। তুই বাড়ি এলে আমার এখানে আসিস, কেমন!  ভালো থাকিস। 
ইতি, 
তোরই সৃজন।
 
সৃজনের চিঠি পড়ে মনের অজান্তে চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। তারপর গেলাম চাচার কবর জিয়ারত করতে। জিয়ারত শেষে সেই পথ দিয়ে বাড়ি আসতেই সেই ভাঙা ঘরখানা দৃষ্টিগোচর হলো। মনে পড়ে গেলো অবহেলিত বুড়ো চাচার কথা। চোখের কোণে পুনরায় অশ্রুগঙা প্রবাহিত হতে লাগলো। পকেটে তখনো নোট চারটি জমা ছিলো। 
 
 
 
 
উপরে