Main Logo
আপডেট : ৪ নভেম্বর, ২০২৪ ১১:০১

রিপন

তাছাদ্দুক হোসেন

রিপন
ছেলেটিকে আমার পড়ার ঘরের জানালার পাশে প্রতিদিন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। চোখে কোনো আবেদনের ছায়া নেই,মায়া দিয়ে শুধু ফ‍্যালফ‍্যালিয়ে আমার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। কিছু একটা বলতে চায় যেন। ছোট্ট বুক সাহসে কুলিয়ে উঠে না বলেই হয়তো বলতে চেয়েও আড়ষ্ট হয়ে আসে । মনের কথা বলতে যেয়ে বার বার ফিরে আসতে হয়। কিসের এক অব‍্যক্ত কান্না মনে গুমড়ে ওঠে।
চোখে পড়েও পড়েনি ছেলেটির দাঁড়িয়ে থাকা। সকালে বাগানে বেরোনোর সময় ফুলের একটি চারাগাছের শুকিয়ে যাওয়া চোখে পড়ে। মুহূর্তেই মনে পড়ে শান্ত অবুঝ মায়াময় মুখটি।
- এখানে দাঁড়িয়ে কী করছিস?
করুণ ডাগর চোখে তাকায় আমার দিকে। নিরুত্তর। ক্ষাণিক মায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে ভিতরে ডাকলাম ওকে। মাটির দিকে নত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটির মন ইতঃস্তত, বিক্ষিপ্ত। ঘরে ঢুকেই মেঝেতে ধপ্ করে বসে পড়ে।
-প্রতিদিন এখানে এসে কেন রে দাঁড়িয়ে থাকিস্ তুই? কী দেখিস?
এবার ছেলেটি মনে কোন দ্বিধা না রেখেই বলে ওঠে - শুনবেন, কেন আসি?
কৌতূহলী হয়ে উঠি।
-বলো শুনি।
-আমার নাম রিপন, মা, বাবা,ভাই-বোন নিয়ে আমাদের ছোট্ট সুখের সংসার। সুখেই কাটছিলো দিন। হঠাৎ একদিন...
চোখের সামনে ভেসে উঠে ফেলে আসা দিনের স্মৃতিকাতর দৃশ‍্য।
-তাহের সাহেব, শুনুন
পরিচিত কণ্ঠে পিছন ফিরে রৌশন সাহেবকে দেখতে পান তাহের আহমেদ। একই অফিসে কাজ করেন দুজনই। অফিসে তাহের আহমেদের রৌশন সাহেবের চেয়ে কিছুটা উঁচুপদে অবস্থান। দুয়ের মধ‍্যে একটি বিশেষ মিল আছে বলেই পাশাপাশি চলেন ওরা।
-ও রৌশন সাহেব...
নিচের পদে অবস্থানেও সাহেব বলতে ভুল হয় না।
-চলুন না আমার গরিবখানায়, যাচ্ছেন যাবেন বলে যাচ্ছেনই না। আজকে কিন্তু আপনাকে ছাড়ছি না।
সাথে নিয়ে যাবই আজ।
না করার উপান্তর না পেয়ে রৌশন খানের বাড়ির দিকে দুজনেই রওনা দেন।
সাদাসিদে মানুষ এই নিরহঙ্কার তাহের আহমেদ। নিয়মিত নামাজ আদায় করেন। কোনো ঝুটঝামেলায় নেই। কষ্মিনকালেও তাকে কেউ অপবাদে জড়াতে পারে নি। সাতপাঁচে থাকেন না বলে অফিসে সবাই তাকে সমীহের চোখে দেখে। কখনও উৎকোচে স্পর্শ পড়েনি তার ।  বিশ বছরের চাকুরি জীবনে সততাই তার একমাত্র অলঙ্কার।
অন‍্যান‍্য কতো জুনিয়ররা তরতর করে উঠে গেছে গাছের মগডালে। বাড়ি গাড়ি ব‍্যাংকব‍্যালেন্সে আখের ঘুছিয়ে নিয়েছে সবে। ব‍্যতিক্রমী তাহের আহমেদ এখনো টিনের দোচালা ঘরেই শান্তিতে বাস করছেন।এই দোচালা প্রাসাদে রূপ নিতে পারতো -প্রচুর সুযোগ হাতে কাড়ি কাড়ি টাকা নিয়ে এসে পাশে দাঁড়িয়েছে। মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন বারবার। নিছক কাগুজি নোটের কাছে নিজেকে বিকিয়ে সাময়িক সুখ কিনেননি তিনি।
অভাব অনটন লেগেই থাকে সংসারে। পরিবারের কাউকেই বাড়তি কোনো সুখ কিনে আনা তার পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠেনি। আয়ের মধ‍্যেই থাকতে হয়েছে-সাধ আহ্লাদ মিটাতে হয়েছে স্ত্রী-পুত্র সন্তানের। 
সমাজ যেখানে কলুষিত, মনকে সেখানে উন্নত তাজা সতেজ রাখতে যিনি যারপরনাই সচেষ্ট ; তার নাইবা থাকুক রাজসুখ, নাইবা যান তিনি পুষ্পসজ্জায় গড়াগড়ি কী আসলো গেলো তাতে?
তাহের আহমেদকে পারিবারিক দিনগুলোকে অনেক বাঁধা বিঘ্নের মধ‍্যে অতিক্রম করতে হচ্ছে। যে মানুষগুলোকে খারাপ কাজে সহায়তা করেননি তারাই বেশি করে বাঁকা চোখে দেখছে তাকে। এক অশুভ ছায়া তাড়া করছে প্রতিনিয়ত। আকাশের উজ্জ্বল চাঁদকে ঢাকবার জন‍্যে বৈশাখী কালো মেঘের আনাগোনা-কখন যেন চাঁদের আলো অন্ধকারে ঢেকে যায়! 
রৌশন খানের বাড়ির সামনে দাঁড়ায় রিক্সা। ভাড়া মিটিয়ে খান আহমেদ সাহেবকে নিয়ে ড্রইং রুমে ঢুকে। ড্রইং রুমের চাকচিক‍্যে তাহের আহমেদের চোখ ছানাবড়া। বিশ্বাস করতেই কষ্ট হচ্ছে এ রৌশন খানের বাড়ি। চোখ ধাঁধানো এ 
আভিজাত‍্যের পিছনে কোন ইতিহাস মিলাতে পারছেন না আহমেদ সাহেব।
এতো আপ‍্যায়ন আহমেদ সাহেবের কাঁটার মতো বিঁধছে। তার নিচের পদের একজন কর্মচারী এভাবে হয়তো তাকে অপদস্ত করার জন‍্যে আমন্ত্রণ জানিয়েছে তাকে -তাই মনে হচ্ছে তাহের আহমেদের।
রাতের খাবার না খাইয়ে ছাড়বেন না রৌশন খান। অগত‍্যা আহমেদ সাহেবকে থেকে যেতেই হলো। আকাশপাতাল ভাবতে ভাবতে একসময় নিদ্রাদেবীর কোলে আশ্রয় নেন আহমেদ সাহেব।
আয়নার সামনে রৌশন খান তার প্রতিবিম্বের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে-
-যা না এইতো সুযোগ প্রতিশোধের
-কিন্তু কেমন করে? এমন একজন সৎ মানুষকে হেনস্তা করা কী ঠিক হবে?
-তুই একটা বোকা,আহাম্মক।ভয় পাচ্ছিস কেন? ভুলে গেলি তোর অপমানের কথা! কাছে আয় কানে কানে বলে দিই কী করতে হবে?
রৌশন খানের চোখের সামনে ছায়াচিত্রের মতো ভেসে উঠে অতীত। একটি কথা আজকেও তাকে কুড়ে কুড়ে খায়- জর্জরিত করে- ছিঃ ছিঃ লজ্জা করে না আপনার এমন অধঃপাতে যেতে
-দেখুন স‍্যার, ছেলেমেয়েকে নিয়ে...
-সন্তানের দোহাই দিয়ে ছিঃ ছিঃ আপনি মানুষ না আর কিছু! ছিঃ! এর চেয়ে কুলি-মজুররাই...
অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে রৌশন খান। কুলি মজুর...তাহের,আজ তোমার নীতির সাথে আমার দুর্নীতির লড়াই। দেখি কে জিতে?
তাহের আহমেদ কখন যে রৌশন খানের দামী আরামদায়ক বিছানায় ঘুমিয়ে পড়েছেন টেরই পাননি। এক অশুভ স্বপ্নে ঘুম থেকে জেগে উঠেন তিনি। এক বিভৎস বিশালদেহী রাক্ষস  গিলে গিলে খাচ্ছে তাকে। শরীর থেকে রক্ত বেরুচ্ছে ফিনকি দিয়ে। রক্তে ভিজে সমস্ত গা জবুথবু। 
গভীর রাত। দরোজা খোলে বেরিয়ে পড়েন তাহের আহমেদ। বাড়ি ফিরতেই হবে তাকে। হাঁটার গতি দ্রুত হয়। অন্ধকার রাত। রাস্তায় মিউনিসিপলিটির বাতিগুলো
মৃদু আলো ছড়াচ্ছে। রৌশন খান এই সুযোগের অপেক্ষায় জেগেছিলো। চোর...চোর...চোর...বলতে বলতে ছুটে সে।
লোকের ভীড় বাড়ে। তাহের আহমেদকে ঘিরে দাঁড়ায় লোকজন।
-গয়নাগাটি, টাকাপয়সা নিয়ে পালাচ্ছিলো এই লোকটা। আহমেদ সাহেব রৌশন খানের মুখে তাকিয়ে তাজ্জব বনে যান। বলে কি? ডাহা মিথ‍্যে। যতই বুঝাতে যান তিনি এই কাজ করেননি ততই রৌশন খান জনতাকে বলেই চলে - ওকে তল্লাসি করুন আপনারা। আমি মিথ‍্যে নাকি সত‍্যি বলছি।
তালাস করে সত‍্যি সত‍্যি তাহের আহমেদের পকেটে টাকা, সোনাদানার হদীস মেলে । দীর্ঘজীবনে তিল তিল করে গড়ে তোলা অর্জিত সম্মান এক মুহূর্তে ধূলিসাৎ হয়ে যায় নীতির আদর্শে আপোষহীন তাহের আহমেদের ।
ঘটনাটি চাপা রইলো না। গোটা পরিবারে এর বিরূপ প্রভাব পড়ে। সংসারের শক্ত খুঁটি নড়বড়ে হয়। ভেঙে পড়তে থাকে 
মজবুত ভিত্তিগুলি । গোটা পরিবারটি একসময় তছনছ হয়ে যায়। আহমেদ সাহেবের স্ত্রী গাড়ি চাপা পড়েন। বড়ো ছেলে আত্মহত‍্যার পথ বেছে নেয়। শোকে মূহ‍্যমান তাহের আহমেদ একদিন অপবাদের বোঝা মাথায় নিয়ে পৃথিবীর মায়া কাটান।
রিপনের চোখ বেয়ে আষাঢ়ের ঢল নামছে। বাইরের বৃষ্টি আর রিপনের চোখের জল একাকার হয়ে বেদনার গান গাইছে যেন।
-আমি সবাইকে হারিয়ে ফেলেছি। রিপনের আর্দ্রকণ্ঠ।-তুমি কিভাবে এখানে এলে?
অপহরণকারীরা অপহরণ করে আমায়। ওদের আড্ডায় নিয়ে যায়। বুদ্ধি করে কৌশলে পালিয়ে আসি আমি।
-এখন থাকিস কোথায়?
রিপন কথা বলে না। এবার কৌতূহল প্রশমনে রিপনকে প্রশ্ন করি
-আমাকে কেন রোজ তাকিয়ে দেখিস তাতো বললে না।
রিপন আর নিজকে ধরে রাখতে পারে না। ছল ছল চোখে কান্নাভেজা গলায় বলে উঠে
-আপনি দেখতে ঠিক আমার ভাইয়ার মতো। ভাইয়াকে ভুলতে পারি না আমি। খুব ভালোবাসতাম ভাইয়াকে। 
আমার মনের বাঁধ এক মুহূর্তে ভেঙে খান খান। সস্নেহে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরলাম রিপনকে। 
 
 
উপরে