বিভ্রাট
তাছাদ্দুক হোসেন
চিঠিটা হাতে নিয়েই ভাবতে থাকে চন্দন। কার চিঠি,কোথা থেকে এসেছে,কি লেখা আছে ওতে এরূপ হাজারো প্রশ্ন মনে ঘুরপাক খায় চন্দনের। এ চিঠিই জীবনে প্রথম পাওয়া তার। আজকের দিনটি অন্যদিনের থেকে আলাদা হয়ে চন্দনের চোখে ধরা দেয়। চারদিকের প্রকৃতি
একেবারে নতুন তরতাজা মনে হচ্ছে তার কাছে। মনের ভিতর এক আনন্দবন্যা বয়ে যায় অস্বীকার করার উপায় নেই কোনো। আজকের এই চিহ্নটি চন্দনের কাছে ইতিহাস হয়েই থাকবে। দিনটিকে অমর করে রাখতে মনের ক্যানভাসে রংতুলির পরশ বুলায় সে।
দেখাই যাক্ কী লেখা আছে চিঠিতে। পত্রের কটি বাক্য পড়েই হতবাক ছন্দন।
সেই পুরনো মধুর শব্দ প্রিয়তম দিয়েই পত্রের শুরু। অল্পবয়সী তরুণী তন্বীর হাতের ছোঁয়ায় যে নীলখামের সাদা কাগজের পৃষ্ঠাটি ধন্য হয়েছে এটি বলাই বাহুল্য।
না, না,এ কেমন করে হয়?চন্দনের মনেই পড়ে না জীবনে এমন অন্তরঙ্গতা কারো সাথে কখনো ঘটেছে। একেবারে প্রিয়তম-আপন দয়িতের সম্বোধন!
ডাকপিয়ন হয়তো ঠিকানা ভুল করে ছন্দের ঠিকানায় চিঠিটা পৌঁছে দিয়ে গেছে! এতো বড়ো পৃথিবীতে কতো চন্দন ছড়িয়ে আছে!
পত্রের ঠিকানায় আবারো চোখ বুলায় ছন্দন। ঠিকানায় ভুল নেই কোনো এই চন্দনই এই চিঠির মালিক।
এলোমেলো ভাবনায় আচ্ছন্ন হয় চন্দন।
কাল পরীক্ষা। চিঠির ভাবনা ছেড়ে কিছুতেই পড়াতে মন বসাতে পারছে না সে। শুধু বইয়ের পৃষ্ঠায় অকারণ চোখ আটকে থাকছে।
সপ্তাহেও চিঠির রহস্য ভেদ করা সম্ভব হয়নি চন্দনের। ভালোবাসার কথাই ইনিয়েবিনিয়ে বলা হয়েছে লেখার প্রতিটি ছত্রে।
সন্ধ্যা পেরিয়েছে অনেক আগেই। পড়ার টেবিলে কঠিন অঙ্ক সমাধানে চন্দনের নিবিষ্ট মন। চিঠির ধাঁধার মতো অঙ্কও তাকে ঘোল খাওয়াচ্ছে। হঠাতই কাগজে কলমের খসখসানি থেমে যায়।
-কে আছেন? দরোজাটা একটু খুলুন।
চন্দন দরোজায় এগিয়ে দরোজার খিল খুলে দাঁড়ায়। চন্দন অবাক হয় অপরিচিত অল্পবয়স্ক একজন মেয়েকে দেখে।
-কাকে চান? চন্দনের প্রশ্ন।
-তোমাকে...
চন্দন ভ্যাবাচ্যাকা খায়। বিব্রত হয়। বলে কী এই মেয়ে! চন্দনকে কথা বলার সুযোগই দেয় না। মেয়েটি বলে
-চলো, ঘরে গিয়ে বসি। মেয়েটি চন্দনের গা ঘেঁষে ভিতরে ঢুকে আসে। চেয়ারে না বসে একেবারে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়।
দেখে মনে হয় অনেক দিনের পরিশ্রান্ত এক পথিক যেন মেয়েটি। চন্দন ভীষণভাবে অপ্রস্তুত!
-আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না আমি। কেনই বা একজন অপরিচিতের এই বাসায় বুঝতে পারছি না কিছু। চন্দন আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো। মেয়েটি তাকে থামিয়ে দেয়
-আমাকে চিনতে পারছো না তুমি? আকাশ থেকে পড়ে মেয়েটি। এমন ভাব যেন চন্দনের সাথে তার কতো যুগযুগান্তরের পরিচয়-কতো হৃদ্যতা!
আবার মেয়েটির কণ্ঠে অনুযোগ
-এই আমাকে চিনতে পারছো না! আমি কাঞ্চনা। কী ভুলো মন তোমার, কিছুই মনে রাখতে পারো না! তা না হলে এই আমাকেই প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিলে? ভুলে গেলে আমাকে?
বিস্ময় আর উত্তেজনায় চন্দন কাঁপে।
-আপনাকে আমি কোনোদি দেখিইনি,চিনি না আপনাকে আমি, অথচ আমাকে চিনার কথা বলছেন আপনি, কী করে হয় এটা? মেয়েটি একই কথারই পুনরাবৃত্তি করে।
-কেনো মিছে লুকোচ্ছো? একবার শুধু ভাবো, ভেবে বলো তো কী অপরাধ ছিলো আমার? আর...
-দেখুন ভুল করছেন আপনি, হয়তো ঠিকানা ভুলে এখানে এসে পড়েছেন!
-দুনিয়ার সকলের ভুল হতে পারে আমার নয়।
মেয়েটির দৃঢ় কণ্ঠ।
চন্দন ভাবে, মেয়েটির মাথা খারাপ নয় তো!
চন্দন চিঠির প্রসঙ্গ টেনে আনে
-দেখুন আপনি আমায় একটি নতুন সমস্যায় জড়িয়ে ফেলছেন। আচ্ছা বলুন তো কদিন আগে একটি অচেনা মেয়ের চিঠি আমার নামে এসেছে সে আপনি নয় তো!
-না না এ কি বলছো তুমি?
মুখে তাচ্ছিল্যের ভাব এনে উচ্চারণ করে সে
-ও! নতুন ফুলের গন্ধ নিচ্ছো আজকাল, ভালোই ভ্রমর সেজেছো!
-এসব কী বলছেন? মুখে যা আসছে তাই বলে যাচ্ছেন। বললাম তো আমি চিনি না আপনাকে!
-কেন, রেল লাইনের কথা মনে পড়ে না?
চন্দনের চোখের সামনে রেললাইন উজ্জ্বল এক স্মৃতি নিয়ে হাজির হয়।
-হ্যাঁ হ্যাাঁ তীব্রবেগে ট্রেন আসছিলো...একটি মেয়ে দৌঁড়োচ্ছিলো ট্রেনের নীচে ঝাঁপ দিবে বলে।
-কেন বাঁচালেন আমাকে? কী ক্ষতি করেছিলাম আপনার?
-আত্মহত্যা মহাপাপ! আপনি কি তবে সে-ই! ওই দিনের পর আপনাকে তো আর কোনোদিনই দেখিনি আমি।আপনার বাসায় পৌঁছে দিয়ে ফিরে এসেছিলাম আমি। আর তো কোনোদিন দেখাই হয়নি আপনার সাথে।
-দেখা হয়নি? আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন মেয়েটির।
বলতে থাকে মেয়েটি
-মনে পড়ে না নদীর কূলে বসে
-কোন নদী? ছন্দের আগ্রহ
-কেন? গোধূলি বেলায় সূর্য ডুব ডুবু করছে, জয়নুল উদ্যানের পাশে ব্রহ্মপুত্রের কূলে বসে বলেছিলে আমায় দূরে কেন আর, এবার ধরা দাও।
কথা থামিয়ে মেয়েটি ছন্দনের দিকে হাত বাড়ায়, বলে
-আমি সবকিছু পিছনে ফেলে চলে এসেছি তোমার কাছে, তুলে নাও আমায়, জড়িয়ে নাও আমায় তোমার জীবনের সাথে।
ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে ছন্দনের।
-ঠিক করে বলুন তো কে আপনি? কী পরিচয় আপনার?
-আমাদের বাড়ি রতনপুর। তোমার গ্রামের বাড়ির লাগোয়া পাশের বাড়িই আমাদের।
-আমার গ্রামের বাড়িত করিমপুর! ছন্দনের জবাব।
কাঞ্চনা চন্দনের পাশে দাঁড়ায়। চন্দনের দুটো হাত আকড়ে ধরে বলে কাঞ্চনা
-লুকোচ্ছ কেন লক্ষীটি?
এবার মা কে উচ্চস্বরে ডাকে ছন্দন। মা ঘরে ঢুকেই কাঞ্চনাকে দেখে বিস্ময়ে বলে উঠেন
- এ কি মা, তুমি? কেমন আছো?
কাঞ্চনা গড় প্রণাম করে জবাব দেয়
-ভালো, আপনি ভালো তো?
-তোমার মা, বাবা কেমন আছেন?
- মা, বাবাতো স্বর্গে গেছেন।
-তোমার বাবা ভবেশ না? মা ভগবতী না?
তুমি অরুণা না?
মায়ের প্রশ্ন।
কাঞ্চনা জানায় ওরা তার বাবা-মা নয়। তার নাম কাঞ্চনা।
ছন্দন ভাবে মানুষের মতো একই অবয়বের মানুষ হতেই পারে। মা কাঞ্চনার মুখে অরুণার মুখ বসিয়ে কাঞ্চনা ভেবে নিয়েছে। ছন্দন কিছুই বুঝতে পারে না। সব ওলটপালট লাগে তার কাছে। ছন্দনের মা চায়ের কথা বলে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন।
কাঞ্চনার মুখাবয়বে অভিমান, আক্রোশ ঝরে পড়ে। দরোজার দিকে যেতে যেতে
বলতে থাকে
- না না কেউ আমাকে চেনে না,কেউ ভালো চোখে দেখে না আমায়,সবাই মুখ ফিরিয়ে নেয়, কেউ আমাকে বুঝতে চায় না। চলেই যাবো আমি।
ফিরে চলে কাঞ্চনা।
-শুনুন
চন্দন পিছন থেকে ডাকে।
কোনও শব্দই কাঞ্চনার কানে পৌঁছোয় না।
উদভ্রান্তের মতো শুধুই বলে চলে কাঞ্চনা
-আজ কেউ আমায় চেনে না, সবার কাছেই প্রয়োজন ফুরিয়েছে আমার। সবাই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে আজ। সবার কাছেই আজ আজ আমি অপরাচিতা-কলঙ্কিতা...
কাঁদতে কাঁদতে চলে যায় কাঞ্চনা। কাঞ্চনার কণ্ঠ মহাকাল ধারণ করে। মিলিয়ে যায় ইথারে ইথারে।
চন্দন এই মহূর্তে দুটি জটিল সমস্যা সমাধানে নিবিষ্ট হয়। কে এই কাঞ্চনা, আর সেই অপ্রত্যাশিত চিঠি! চিঠির উপর চোখ পড়ে ছন্দনের!